#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৯
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
তারপরেই কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতায় সময় ফুরোলো। চুপিসারে। বন্ধ চোখে। তাকিয়ে থাকা তাদের পক্ষে কভু সম্ভব নয়।
অন্ধকার ধীরে ধীরে তার ঝাঁপি নামিয়ে দিতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলকে সাক্ষী রেখে দুজনেই চোখ মেলে একটুখানি হাসলো। একজনের চোখে খানিকটা জল ছিল অপরজনের চোখে সেই জল দেখার মুগ্ধতা।
ব্যস!
তারপর ফোন বেজে উঠলো। অভিক রিসিভ করে দেখলো আর কেউ না। সাজিয়া বেগম ফোন করেছেন। সে সুজানাকে ফোনের স্ক্রীন দেখালো। সুজানা গাল মুছলো দ্রুত। বলল,
আম্মা? আপনাকে কেন ফোন করেছে? জানতে পেরেছে আমি এখানে এসেছি?
উফফ!
অভিকের এমন শব্দে সুজানা থেমে গেল। অভিক বলল
এটা করিমের ফোন সুজানা। অভিক ফারদিনের নয়।
সুজানা ভাবতে সময় নিল। তারপর মৃদু হেসে উঠলো। অভিকও হাসলো। বলল
কি চালাক করিমুল্লাহ সাহেবের মেয়ে!
সুজানা এবারও হাসলো।
অভিক ফোনটা কেটে নিজ থেকে করলো। লাউড করে সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালামের জবাব দিয়ে বলল
ভালো আছ বাবা?
জ্বি। আপনার শরীর ভালো আছে? মন ভালো আছে?
সাজিয়া বেগম হেসে বললেন
হ্যা হ্যা সব ভালো। সকাল থেকে ফোন দেব দেব করে দেয়া হয়ে উঠেনি। মনেও পড়েনি। এখন মনে পড়লো তাই দিলাম। বলছিলাম যে কাল আমাদের এদিকে এসো না।
অভিক বলল,
আমি?
হ্যা তুমিই তো। সাথে নিখিলদেরও নিয়ে এসো।
সুজানা মুখ চেপে ধরে হাসলো। অভিক বলল
হ্যা যাব না কেন? একেবারে বড় সাইজের ইলিশ মাছ নিয়ে যাব।
আমি কি বলেছি ইলিশ মাছ নিয়ে আসতে হবে? তোমার রুইমাছ তো এখনো খাওয়া হয়নি।
সেটা বড় কথা নয়। ইলিশ মাছ নিয়ে যাব সেটা বড় কথা।
সাজিয়া বেগম হেসে ফেললেন আওয়াজ করে। বললেন
আচ্ছা! তাহলে কাঁটা বেছে ভাতটাও খেয়ে যেও।
সেটা না খেয়ে ফিরছি না।
তাহলে তো ভালোই। বলো কবে আসবে?
অভিক সুজানার দিকে তাকালো। সুজানাও সরু চোখে উৎসুক হয়ে তাকালো। অভিক হেসে বলল
আসব। কিন্তু কবে সেটা বলব না।
এমা এটা কোনো কথা হলো? আচ্ছা যাইহোক এসো কিন্তু।
আচ্ছা।
সালাম বিনিময় শেষে ফোনটা কেটে গেল।
ফোনটা রেখে পকেটে রেখে অভিক হাসলো সুজানার সাথে।
সুজানা হেসে মাথা নামিয়ে শাড়ি, চুড়ি প্যাকেট করতে করতে বলল
একটা কথা বলব?
অভিক তার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,
একশটা বলুন।
এগুলো আমি অন্যদিন নিয়ে যাই?
আজ নয় কেন?
আম্মাকে কি বলব?
বলবেন করিম দিয়েছে।
করিম আমাকে এসব কেন দেবে?
সেটা আবারও বুঝাতে হবে? এই ছোট্ট চিরকুটের পেছনে অনেকগুলো রাত জাগা ছিল সুজানা।
সুজানা প্যাকেটটা বুকে জড়িয়ে বলল
মজা করেছি। আমি নিয়ে যাব। এগুলো আমার।
অভিক দিঘীর জল থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে মুখ ফেরালো। সুজানা তাকে তাকাতে দেখে মাথা নামিয়ে নিল। অভিক বলল
পড়লেই তবে পুরোপুরি আপনার। আর যে পড়বে সে আমার।
রাঙা অনুভূতিরা লজ্জা দিয়ে রাঙিয়ে দিল সুজানাকে। সে আর তাকাতে পারলো না।
অভিক তাকে অমন দেখে হাসলো নিঃশব্দে।
তারপর আর কথা হলো না তাদের।
বুকের সাথে শাড়ি চুড়ি জড়িয়ে দাঁড়ালো সুজানা। চুপচাপ হেঁটে দু’জনেই পার হলো সেগুন বাগিচা।
একজনের চোখেমুখে নিদারুণ লজ্জা, এরপর কি হবে তা নিয়ে ভয়, নানান আকাশ পাতাল ভাবনা। অন্যজন এই পাশাপাশি হাঁটার ব্যাপারটা অনুভবে ব্যস্ত।
যতদূর গেল ততদূর তারা অনুভব করলো এই পথচলায় তারা দুজন দুজনের পাশাপাশি কাছাকাছি থাকলেই ভালো থাকবে। পথের ধুলো, আর ঝড়াপাতাদেরও তাতে আনন্দ। তারা উড়ে যাবে, আর মড়মড় শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করবে আজকের মতো।
_________________
অভিক বাড়ি ফিরেই দেখলো বসার ঘরে আড্ডা বসেছে। মাগরিবের নামাজ কালাম পড়ে সবাই চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। অনেকগুলো গল্প তাদের জমা পড়ে আছে।
অভিককে দেখে আড্ডায় ভাটা পড়লো বৈকি তবে কিয়ৎক্ষণ পর বাচ্চাদের হৈচৈ বেড়ে গেল। অভিক দুজনের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে আদর করলো তাদের। জিনিয়া ভাইয়ের বাচ্চা ভিকিকে কোলে করে নিয়ে এসে বলল
আরেহ তোমার কথাই হচ্ছিল এখানে। ফোন বন্ধ করে রেখেছ কেন? সবাই চিন্তা করছে। মামি আজ তোমাকে পেয়েছে।
অভিক ভিকিকে কোলে তুলে নিল। বলল
সে কথা পরে। বাবু হিসু করে দেবে না তো।
সবাই তার কথা শুনে হেসে উঠলো। আনিকা বলল
অনা আবিদ তো হিসু করে দেয়ার জন্য তোকে পাইনি। ভিকি তো পেয়েছে। ভিকি সোনা একটু হিসু করে দাও তো চাচ্চুকে।
অভিক হাসলো। বলল
ভয় পাচ্ছি না। হুম।
সালমা বেগম এসে বললেন
অভি এসেছিস? হ্যা রে একটু ঘুম দিচ্ছিলাম। তুই সেই সুযোগে না বলে বেরিয়ে যাবি?
আনিকা বলল
পেয়েছে তোকে। ছোটমা তোর উপর ভীষণ ক্ষেপেছে।
অভিক নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে বলল
মা আমি এখনো বাচ্চা আছি?
তাই বলে ফোনটাও অফ রাখবি?
ফুপু জেসমিন বেগম বললেন
বলে যেতে হয় অভি। তারউপর ফোন বন্ধ। এমনটা কেউ করে?
সরি ফুপী।
আর সরিইইই মাআআআ। ফোন অফ করাটা জরুরি ছিল। ওই সময় কোনো ঝামেলা এলাউ না।
সালমা বেগম রান্নাঘরে পা বাড়িয়ে বললেন
তুই আমার সাথে কথা বলতে আসবি না অভি। আহনাফকে বললাম সেও বলল ছোটমা অভির ফোন এখনো বন্ধ। সিজানকে বললাম সেও একই কথা বললো। নাহিদকে বললাম সেও একই কথা।
অভিক বাবুকে আদর করে আনিকার কোলে দিয়ে মায়ের পেছন পেছন ছুটলো। বলল
মা মা ফোন বন্ধ থাকলে সবাই তো এরকমই বলবে। শোনো না তোমার জন্য গুড নিউজ আছে।
তোর গুড নিউজ তোর বাপকে শোনা।
না তোমাকে শুনতে হবে।
সবাই তাদের মা ছেলের কান্ড দেখে হাসলো।
অভিক মায়ের পেছন পেছন ছুটলো। রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বলল
মা উঠবস করব?
কর।
অভিক উঠবস না করেই গুনতে লাগলো।
এক, দুই, তিন, চার….
সালমা বেগম ফিরে তাকাতেই অভিক সোজা হয়ে গেল। উনি ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন
কোথায় গিয়েছিলি? খুব বড় হয়ে গিয়েছিস তুই? আমি জিজ্ঞেসও করতে পারব না? আমাকে বলে যেখানে ইচ্ছে যা।
অভিক অসহায় গলায় বলল
লাইসেন্স আনতে গিয়েছিলাম মা।
সালমা বেগম কফির জন্য দুধটা চুলায় বসাতে বসাতে হঠাৎ থেমে গেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে চোখ বড় বড় তাকালেন।
অভিক মাথা দুলিয়ে বলল,
হুমম।
সালমা বেগম কি জিজ্ঞেস করবেন ভেবে পেলেন না। অভিক বলল
আর পেয়েও গিয়েছি।
সালমা বেগম সামনে ফিরে নিঃশব্দে হেসে নিলেন ছেলের আড়ালে। বললেন
আমি ওর মাকে এখন বলতে পারি?
কি বলবে?
বলব আমার রান্নাঘরে একটা বাসন অবহেলিত পড়ে থাকে। বিশেষ আয়োজন ছাড়া খাবার টেবিলের একটা চেয়ারও।
চলবে,
রিচেক করা হয়নি পাঠক