অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬১।

0
467

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬১।

সকালের নাস্তা শেষ করে বসার ঘরে বসেছে সবাই। প্রিয়তা রান্নাঘরে, সবার জন্য চা বানাতে ব্যস্ত। মৌমি রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার চা বানানো দেখছে আর গল্প করছে।

হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এল প্রিয়তা। সবার হাতে হাতে চা দিল। নিজেও একটা কাপ নিয়ে বসল এক কোণে। চায়ের কাপে চুমুক বসালেন দিলরুবা বেগম। হেসে বলেন,

‘প্রিয়তা মা, চা’টা অসাধারণ হয়েছে।’

প্রশংসা শুনে প্রসন্ন হাসল প্রিয়তা। দিলরুবা বেগম এবার চোখের ইশারায় লুৎফা বেগমকে কাঙ্খিত কথাগুলো বলতে বললেন। লুৎফা বেগম ইতস্তত করছেন। মেয়ের কেমন প্রতিক্রিয়া হবে সেটাই ভাবছেন তিনি। অলিউল সাহেব তাঁর পাশেই বসা। তিনি উনুচ্চ সুরে তাঁকে বললেন,

‘তুমি বলা শুরু করো না, তারপর আমি বলছি।’

অলিউল সাহেব চোখের ইশারায় সম্মতি জানালেন। চায়ের কাপটা রাখলেন সামনের টেবিলে। হালকা করে গলা ঝেড়ে বললেন,

‘তোমাদের সাথে আমার খুব জরুরি একটা কথা বলার ছিল।’

সবাই পূর্ণ মনোযোগে তাকাল তাঁর দিকে। নীহাল জিজ্ঞেস করল,

‘কী কথা, বাবা?’

‘বলব এখনি।’

তিনি প্রিয়তাকে একবার দেখলেন আগে। প্রিয়তা প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। আর ভণিতা না রেখে তিনি বললেন,

‘আমি, তোমাদের মা আর দিলরুবা আপা মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমি জানি, আমাদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল নেই। কারণ, একজন মা বাবা কখনোই তাঁর সন্তানের খারাপ চান না। তাই আমরা আশা করছি, আমাদের সন্তানরাও আমাদের বুঝবে।’

সবাই অবাক হলো। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,

‘কী সিদ্ধান্ত, বাবা?’

অলিউল সাহেব লুৎফা বেগমের দিকে একবার তাকালেন। লুৎফা বেগম চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। অলিউল সাহেব এক পল বিরতি নিয়ে বললেন,

‘তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত।’

হকচকিয়ে উঠে প্রিয়তা। হতভম্ব তার মুখায়ব। অবিশ্বাস্য সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘আমার বিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

লুৎফা বেগম জবাব দিলেন। প্রিয়তা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘এই তো কেবল একটা ভুল থেকে বেরিয়ে এলাম, এরই মাঝে তোমারা আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত কী করে নিয়ে ফেললে? আমি এখন মানসিক ভাবে এসবের জন্য প্রস্তুত না, মা।’

‘প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাবে তুমি। আর আমরা তোমাকে যার তার হাতে তো তুলে দিচ্ছি না। আর আমাদের মনে হয়, তোমার একটা সুন্দর জীবনের জন্য এই বিয়েটা জরুরি।’

ফারজাদ চায়ের কাপটা রাখল আস্তে করে। অদ্ভুত ভাবে প্রিয়তার বিয়ের কথা শুনে তার খারাপ লাগছে। কেন খারাপ লাগছে সে জানে না। অথচ বক্ষঃস্তলে ঠিকই অনুভব করছে এক তীক্ষ্ণ ব্যথা। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠে। জবাব দিতে কষ্ট হচ্ছে ভারি। নীহাল বিস্মিত মা বাবার এই আচানক সিদ্ধান্তে। জিজ্ঞেস করল,

‘হঠাৎ তোমারা প্রিয়তার বিয়ের সিদ্ধান্ত কেন নিলে? আর কার সাথেই বা ওর বিয়ে দিতে চাইছো? আমাকেও তো কিছু বললে না।’

‘কারণ আমরা জানি, পাত্রের পরিচয় পেলে তুমি বিনা দ্বিধায় তোমার বোনকে তার হাতে তুলে দিতে রাজি হবে।’

মায়ের উত্তরে ভ্রু কুঁচকাল নীহাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কে সে?’

লুৎফা বেগম মুচকি হাসলেন। বললেন,

‘ফারজাদ।’

ফারজাদ প্রথমে নিজের নামটা ঠিক খেয়াল করল না। অন্যমনস্ক ছিল বোধ হয়। পরক্ষণেই কানে নিজের নামটা বাজতেই হতবাক হয় সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুৎফা বেগমের দিকে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

‘জি, আন্টি?’

লুৎফা বেগম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমরা আমাদের মেয়ের দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই, বাবা।’

ফারজাদ হতবাক, হতভম্ব। কথা খুইয়ে বসেছে যেন। সে দিলরুবা বেগমের দিকে চাইল। মায়ের এক বুক আশা যে তাঁর দু চোখে স্পষ্ট। সে পুনরায় কিছু বলার আগেই প্রিয়তা বলে উঠল,

‘মা, কী বলছো এসব? একটা মানুষ তোমার মেয়েকে এতটা সাহায্য করল, আর তোমারা তার সাহায্যের মূল্য এভাবে দিচ্ছ?’

দিলরুবা বেগম অস্থির সুরে বললেন,

‘কেন মা, এতে খারাপ কী? আমার ছেলেটাকে কি তোমার এতই অপছন্দ।’

প্রিয়তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘না না, আন্টি, তা না। কিন্তু এভাবে কী করে একটা বিয়ে হতে পারে, বলুন? আপনি, আপনারা সবাই তো সবকিছু জানেন, দেখেছেন সামনে থেকে। আর ফারজাদ (ফারজাদের দিকে চেয়ে), উনি তো পুরোটা ক্ষণ আমার পাশেই ছিলেন, নিজের সবটুকু দিয়ে আমায় সাহায্য করেছেন। এভাবে তো একটা সিদ্ধান্ত উনার উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’

ফারজাদের নির্বাক, নিষ্পলক চাহনি প্রিয়তার উপর। মেয়েটার অস্থিরতা যেন ফারজাদ টের পাচ্ছে। দিলরুবা বেগম বললেন,

‘কেউ কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে না। আর সবকিছু জানি বলেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি, মা। আমার মনে হয়, আমার ছেলের জন্য তুমিই যথেষ্ঠ।’

প্রিয়তা অসহায় চোখে তাকাল। মৌমি বলে উঠল,

‘প্লিজ প্রিয়তা আপু, রাজি হয়ে যাও না। আমার ভাইয়া খুব ভালো, তোমায় খুব ভালো রাখবেন।’

প্রিয়তা ফারজাদের দিকে চাইল। বলল,

‘ফারজাদ, আপনি কিছু বলছেন না কেন?’

ফারজাদ আর কী বলবে; সে তো নিজেই বুঝতে পারছে না তার মন কী চায়। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমাকে একটু সময় দিন।’

বলেই সেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে। প্রিয়তার খারাপ লাগল ভীষণ। মা বাবার সাথে রাগ দেখিয়ে বলল,

‘উনি হয়তো অপমান বোধ করছেন। এভাবে একটা মানুষকে ডেকে এনে কেন এত অস্বস্তিতে ফেললে তোমরা? পাকিস্তানে উনি আমাকে এতটা সাহায্য করলেন, আর আমার দেশে ডেকে এনে আমি উনাকে অপমান করেছি।’

প্রিয়তা নিজের রুমে চলে গেল। সবাই চেয়ে রইল কেবল। কারোর মুখে রা নেই কোনো। এমনটা হবে আশা করেনি হয়তো। মৌমি মন খারাপ করে বলল,

‘ভাইয়া কি রাজি হবেন না, আম্মি?’

দিলরুবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘কী জানি, তোমার ভাই’ই জানে।’

‘তুমি গিয়ে একটু বোঝাও না।’

‘আমার কথা কি কোনো সময় শুনেছে ও? এবার যদি ও রাজি না হয়, আমি আর জীবনেও ওর বিয়ের কথা মুখে আনব না।’

লুৎফা বেগম দিলরুবা বেগমের কাঁধে হাত রাখলেন। আশ্বস্ত করে বললেন,

‘চিন্তা করিস না। নিশ্চয় ভালো কিছু হবে।’

‘প্রিয়তাও তো মানতে চায়ছে না।’

‘আন্টি, আমি বোঝাব ওকে। ফারজাদের সাথে আমার বোন ভালো থাকবে। আর ভাই হিসেবে বোনকে ভালো রাখার জন্য আমি সবটুকু করতে পারব।’

নীহালের সম্মতি পেয়ে তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও কমল। মৌমি ধীর গলায় নীহালকে বলল,

‘চলুন আমরা একটা মিশনে নামি, ভাইয়া আর প্রিয়তা আপুর বিয়ের মিশনে। আপনি প্রিয়তা আপুকে রাজি করাবেন আর আমি ভাইয়াকে।’

নীহাল ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আপনার মাথায় সবসময় এমন আজগুবি চিন্তা ঘুরে, না?’

‘আজগুবি চিন্তা কোথায়? সুন্দর একটা বুদ্ধি দিয়েছি। আমরা দুজন একসাথে মিলে কাজ করলে কাজটা সহজ হবে, বুঝেন না কেন?’

নীহাল দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আপনার যা খুশি করুন। আমি আপাতত আমার বোনের কাছে যাই।’

সে উঠে প্রিয়তার রুমের দিকে গেল। মৌমিও উঠে দাঁড়াল। বলল,

‘আম্মি, আমিও ভাইয়ার রুমে যাই। চিন্তা করো না, আমিও ভাইয়াকে বুঝিয়ে রাজি করাব।’

দিলরুবা বেগম মাথা চাপড়ে বললেন,

‘তুই বকা খাবি রে, মেয়ে।’

নাক মুখ কুঁচকে মৌমি বলল,

‘ভালো কাজের আগে ভয় দেখাবে না তো। কিচ্ছু হবে না, আমি যাচ্ছি।’

‘যা, পরে বকা খেয়ে এসে আমার কানের সামনে প্যাচপ্যাচ করে কাঁদবি না একদম।’

_________

‘প্রিয়, আসব?’

ভাইয়ের গলা পেয়ে ওড়নায় মুখ মুছল প্রিয়তা। বলল,

‘এসো ভাইয়া।’

নীহাল ভেতরে এল। প্রিয়তার পাশে বসল বিছানায়। হাত রাখল তার মাথার উপর। বলল,

‘কষ্ট পাচ্ছিস?’

প্রিয়তার চোখ জলে টইটুম্বুর। নীহাল বলল,

‘ফারজাদকে তোর পছন্দ না?’

‘ভাইয়া, উনাকে অপছন্দের প্রশ্ন’ই আসে না। কিন্তু সত্যি হলো যে, উনার মতো একজন মানুষ আমার মতো মেয়ে ডিজার্ভ করে না কখনোই। উনি নিশ্চয় এখন ভীষণ রেগে আছেন, মনে মনে আমাদের অনেক নিচু মনের মানুষ ভাবছেন। এভাবে উনাকে অপমান করাটা ঠিক হয়নি, ভাইয়া।’

নীহাল অবাক হয়ে বলল,

‘এসব তুই কী বলছিস, প্রিয়? ফারজাদ তোকে ডিজার্ভ করে না মানে? তোর মতো মেয়ে হয় না-কি? নিজেকে তুই এতটা ছোট করছিস কেন?’

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘এত ভুল করার পরেও নিজেকে কী করে সম্মান করব, ভাইয়া? নিজের প্রতি আমার নিজেরই এখন রাগ হয়। আমার মতো ঘর পালানো মেয়ে আর যায় হোক ফারজাদের মতো চমৎকার পুরুষের জন্য না।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here