অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬০।

0
60

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬০।

নীরবতার এক বিস্তর প্রহর কাটিয়ে লুৎফা বেগম বললেন,

‘কিন্তু প্রিয়তা কি মেনে নিবে বিয়েটা? ও কি এত তাড়াতাড়ি নিজের অতীত ভুলতে পারবে?’

অলিউল সাহেবেরও সেই চিন্তা। তিনিও বললেন,

‘আমারও তো সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আপা। আমার মেয়েটা নিঃসন্দেহে আপনাদের কাছে ভালো থাকবে, কিন্তু সে কি আদৌ নিজের এই ভালোটা চাইবে?’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘ছেলে মেয়ে কি আর নিজেদের ভালো বোঝে, ভাইজান? এই যে আমার ছেলেটা, আমার খারাপ সময়ের সঙ্গী, নিজের মায়ের এত এত দুঃখ কষ্ট দেখে ছেলেটা আমার বিয়ের প্রতি বিমুখ হয়ে বসে আছে। তার এই সম্পর্কটার উপর থেকে সব বিশ্বাস’ই উঠে গিয়েছে। কোনোভাবেই ওকে আমি বিয়েতে রাজি করাতে পারছি না। কিন্তু, প্রিয়তার সাথে পরিচয় হবার পর মনে হলো ও আমার ছেলের এই ভুল ধারণাটা ভাঙাতে পারবে, দূর করতে পারবে বিয়ে নিয়ে তার সমস্ত ভয়। আমার বিশ্বাস আপনারা একটু বুঝিয়ে বললেই প্রিয়তা রাজি হবে, ভাইজান। আর ফারজাদকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।’

লুৎফা বেগম আর অলিউল সাহেব একে অন্যকে একবার দেখলেন। প্রস্তাবটা নিত্যান্ত’ই চমৎকার। এমন ছেলে আর এমন পরিবার আজকাল হয় না-কি। কিন্তু এখন যত দুশ্চিন্তা কেবল প্রিয়তাকে নিয়ে। লুৎফা বেগম বললেন,

‘প্রিয়তা রাজি থাকলে আমরা চোখ বন্ধ করে তোর হাতে আমাদের মেয়েকে তুলে দিব। কিন্তু প্রিয়তাকে আমরা কোনোপ্রকার জোর করতে পারব না।’

‘না না, জোর করতে হবে না। তুই ওকে বুঝিয়ে বলবি। আর আমরা সবাই আছি তো ওকে বোঝানোর জন্য।’

দিলরুবা বেগমের প্রত্যুত্তরে প্রসন্ন হাসলেন লুৎফা বেগম। এক পল সময় নিয়ে বললেন,

‘তবে আমারও একটা আবদার রাখতে হবে।’

খানিকটা অবাক হলেন লুৎফা বেগম। জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোর কী আবদার?’

প্রিয়তার কথা শুনে নীহাল আর মৌমির ব্যাপারে আরো আগেই অলিউল সাহেবের সাথে কথা বলে রেখেছিলেন লুৎফা বেগম। তাই এখন কোনোপ্রকার ভণিতা না করেই বললেন,

‘আমার মেয়েকে আমি তোকে দিয়ে দিব, তার বিনিময়ে তোর মেয়েকেও আমায় দিয়ে দিতে হবে।’

দিলরুবা বেগমের চোয়াল ঝুলল। অবিশ্বাস্য চোখে তিনি চেয়ে আছেন। লুৎফা বেগম হাসলেন। বললেন,

‘মুখ বন্ধ কর, মশা ঢুকবে তো।’

দিলরুবা বেগম হতভম্ব সুরে বললেন,

‘কী বলছিস তুই?’

‘ছোট বেলার স্বপ্ন পূরণ করছি, আমাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। আমাদের ছেলের বিয়ের জন্যও আমরা পাত্রী দেখছি। চোখের সামনে এত দারুণ পাত্রী থাকতে আর খুঁজে কী করব? কী, মেয়ে দিবি না?’

দিলরুবা বেগম চোখ বোজে নিশ্বাস ছাড়লেন। কলেজে থাকতে দুই বান্ধবী প্ল্যান করেছিলেন, বিয়ের পর একজনের সাথে অন্যজনের ছেলে/মেয়ের বিয়ে দিবেন। এই স্বপ্ন যে কখনো সত্যি হবে সেটা হয়তো দুজনের কেউই তখন ক্ষুনাক্ষরে ভাবেনি। লুৎফা বেগম অধৈর্য গলায় বললেন,

‘কিরে রুবা, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’

দিলরুবা বেগম জোরে নিশ্বাস ছেড়ে ধাতস্ত করলেন নিজেকে। এত খুশি তার সইবে তো? তিনি বললেন,

‘মৌমি রাজি থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

একসঙ্গে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলেন লুৎফা বেগম এবং অলিউল সাহেব। লুৎফা বেগম উদ্দীপ্ত সুরে বললেন,

‘তবে আর দেরি কেন, ছেলেমেয়েদের এখন’ই ডাকা হোক।’

‘এখনই বলবি? কাল সকালে বললে ভালো হয় না?’

‘আচ্ছা, তোর কথাতেই হবে সব। কাল সকালেই বলব।’

দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,

‘ঠিক আছে।’

‘এখন তবে শুয়ে পড়। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছিস, বিশ্রামের প্রয়োজন।’

দিলরুবা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘আমার রুমটা একটু দেখিয়ে দে।’

‘তুই আমার সাথে আমার রুমে শুবি।’

অবাক হয়ে দিলরুবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘তাহলে ভাইজান শুবেন কোথায়?’

‘নীহালের রুমে। মৌমি থাকবে প্রিয়তার সাথে আর ফারজাদ থাকবে গেস্ট রুমে।’

‘না না, কী বলিস। ভাইজানকে রুম ছাড়তে হবে না। ফারজাদকে বরং নীহালের সাথে দিয়ে দে। আর আমি আর মৌমি তখন অন্যরুমে থাকতে পারব।’

লুৎফা বেগম নাক মুখ কুঁচকে অভিমানের সুরে বললেন,

‘ওহ, বান্ধবীর সাথে থাকার ইচ্ছে মরে গিয়েছে তোর? আমি আরো কত আগ্রহ নিয়ে বসে আছি, কতদিন পর আমরা একসাথে থাকব দুজন।’

‘কিন্তু, ভাইজানের কষ্ট হয়ে যাবে তো।’

অলিউল সাহেব হেসে জবাব দিলেন,

‘আহা শ্যালিকা, নো টেনশন, আপনার জন্য আমি এইটুকু কষ্ট করতেই পারি।’

অলিউল সাহেবের কথা শুনে হেসে ফেললেন দুই বান্ধবী। লুৎফা বেগম বললেন,

‘ছেলের সাথে থাকতে আবার কষ্ট কীসের? কথা কম বলে চুপচাপ আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড় তো।’

লুৎফা বেগমের সামনে দিলরুবা বেগম আর জোর খাটাতে পারলেন না। বাধ্য হয়েই বান্ধবীর সাথে বান্ধবীর রুমে গেলেন।

.

দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করলেন অলিউল সাহেব। বললেন,

‘গল্প শেষ হয়েছে তোমাদের?’

প্রিয়তা বলল,

‘জি বাবা, শেষ। আমরা এখন রুমে চলে যাব, তুমি এসে শুয়ে পড়ো।’

ফারজাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আংকেল এই রুমে থাকবেন?’

‘জি, মা আর আন্টি একসাথে থাকবেন। মৌমি আমার সাথে, আর আপনি গেস্ট রুমে।’

প্রিয়তা জবাবের পর পরই নীহাল বলল,

‘প্রিয়তা তুই ফারজাদকে উনার রুমটা দেখিয়ে দে। আমি বরং বাবার শোয়ার জন্য বিছানাটা করে দেই।’

‘আচ্ছা। আপনি আসুন আমার সাথে।’

ফারজাদ আর মৌমিকে নিয়ে নীহালের রুম থেকে বেরিয়ে এল প্রিয়তা। প্রিয়তার রুমটা নীহালের রুমের অপর পাশেই। তাই সে মৌমির দিকে চেয়ে বলল,

‘তুমি এই রুমে থাকবে মৌমি। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

মৌমি মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

গেস্ট রুমটা একবারেই ফ্ল্যাটের শেষ মাথায় করিডোরের ডানদিকে। প্রিয়তা দরজা খুলে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। ভেতরে প্রবেশ করল ফারজাদ। আশেপাশে চোখ বুলাল কিঞ্চিৎ। প্রিয়তা বলল,

‘চেষ্টা করেছি আপনার পছন্দমতো সবকিছু করার। আশা করছি কমতি থাকলেও মানিয়ে নিতে পারবেন।’

ফারজাদ মৃদু হেসে বলল,

‘ধন্যবাদ। এইটুকু আমার জন্য অনেক।’

‘ঐটা ওয়াশরুম। আর সামনে পর্দা দেওয়া দরজাটা বারান্দা। এখানে পানির জগ রেখে দিয়েছি। টেবিলের ড্রয়ারে ঔষধের বক্স আছে। আর রাতে কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ছোট্ট একটা মিসড কল দিবেন তাহলেই হবে। কোনোপ্রকার অস্বস্তিতে পড়তে হবে না, সমস্যা হলে অবশ্যই জানাবেন।’

প্রিয়তার এত এত ব্যস্ততা দেখে হাসল ফারজাদ। বলল,

‘এত ব্যস্ত হবেন না, প্রিয়তা। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।’

প্রিয়তার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘তাও, একটুও অসুবিধা বোধ করলে ভাইয়াকে বা আমাকে ডাকবেন।’

ফারজাদ মাথা কাত করে বলল,

‘অবশ্যই ডাকব। এবার আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’

‘আচ্ছা, শুভ রাত্রি।’

‘শুভ রাত্রি।’

বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। ফারজাদ দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বিছানায় বসে। ছোট খাটো পরিপাটি গোছানো একটা রুম। বেশ যত্নে রাখা প্রতিটা জিনিস। দেখেই ঠাহর করা যাচ্ছে, প্রিয়তা বড্ড যত্ন নিয়ে সময় খুইয়ে রুমটা গুছিয়েছে তার জন্য। প্রিয়তার ব্যস্ত, উদগ্রীব মুখখানা স্মরণে আসতেই আরো একবার হাসল ফারজাদ। উঠে দাঁড়াল ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য। তখন মনে পড়ল, ব্যাগটা তার বসার ঘরেই রাখা। সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে নিয়েও থমকে দাঁড়াল। প্রিয়তা এক শক্ত ব্রেক কষল তার চলমান পায়ে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খাচ্ছিল যে। ফারজাদের আচমকা আগমনে বেশ ভয় পেয়ে যায়। ঢোক গিলে বলে,

‘আপনার ব্যাগটা দিয়ে যেতে এসেছিলাম।’

ফারজাদ খেয়াল করে বলে,

‘আমি এক্ষুনি গিয়ে আনতাম, আপনার কষ্ট করার কী দরকার ছিল।’

সে এগিয়ে প্রিয়তার হাত থেকে ব্যাগটা টেনে ভেতরে আনল। বলল,

‘অনেক কষ্ট করেছেন। এবার আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আর আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না, আমার একদম কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আচ্ছা। শুয়ে পড়ুন তবে। আল্লাহ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

দরজাটা আটকে ওয়াশরুমে চলে গেল ফারজাদ।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here