অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫৩।

0
445

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৩।

দীর্ঘ প্রায় পঞ্চান্ন দিন পর পুনরায় আজ আবার দেশের মাটিতে পা রাখল প্রিয়তা। সময়টা অন্য সবার নিকট অতি ক্ষুদ্র ঠেকলেও তার কাছে এক আকাশ সমপরিমাণ ব্যবধান। এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়েই জোরে শ্বাস টানল সে। এই তো নিজের দেশের ঘ্রাণ পাচ্ছে। চারদিকে চোখ বুলাল। যেদিন দেশ ছেড়ে ছিল সেদিনের কথা মনে পড়ছে খুব। সেদিন ঠিক এইখানটাতে দাঁড়িয়েই বারবার পেছন ফিরে চাইছিল সে। দেখছিল, তার নিজের দেশের মানুষগুলোর ব্যস্ত পদাচরণ। ভেবেছিল, এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ফের দেশে ফিরবে। হ্যাঁ, ভালোবাসা পেয়েছে ঠিকই, তবে মাধ্যমটা ভিন্ন। প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেসব কথা আর ভাববে না। যদিও মস্তিষ্ক হলো বেহায়া এক জিনিস, যেটা ভাবতে বারণ করা হবে সে সেটাই ভাববে বেশি।

নীহাল ডেকে বলল,

‘গাড়িতে উঠ, প্রিয়।’

নীহাল গাড়ি ঠিক করেছে। প্রিয়তা গাড়িতে বসল গিয়ে।
গাড়ি চলছে। প্রিয়তা জানলা দিয়ে দেখছে নিজের পরিচিত শহরটাকে। নীহাল বলল,

‘আন্টি বা ফারজাদকে একটা কল দিয়ে আমাদের পৌঁছানোর খবরটা দেওয়া উচিত।’

প্রিয়তা বলল,

‘হ্যাঁ, জানিয়ে দাও।’

নীহাল ফারজাদকে কল দিয়ে জানাল। কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজ বাড়িতে পৌঁছে গেল তারা। প্রিয়তার বুক ধুক ধুক করছে। সে নীহালের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ভাইয়া, মা বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন তো?’

‘অবশ্যই করবেন। আর আমি আছি না, চিন্তা করিস না।’

ভাইয়ের আশ্বাস পেয়ে অনেকটা মনে শান্তি পেল প্রিয়তা। গাড়ি থামতেই নেমে দাঁড়াল তারা। নীহাল ভাঁড়া মিটিয়ে দিয়ে ব্যাগপত্র গাড়ি থেকে নামাল সব। ভেতরে যাওয়ার জন্য গেইট খুলতেই দারোয়ান হেসে বললেন,

‘গ্রামের বাড়ি থেকে আইসা পড়ছেন, আপা? কতদিন পর দেখলাম আপনারে। আপনি ভালো আছেন তো?’

প্রিয়তা ভাইয়ের দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার দারোয়ানের দিকে চেয়ে হেসে জবাব দিল,

‘জি চাচা, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’

‘জি, আল্লাহ রাখছে ভালো।’

‘আচ্ছা, আমরা ভেতরে যাই তবে।’

‘জি জি, যান।’

ভেতরে প্রবেশ করল নীহাল আর প্রিয়তা। নীহাল কলিং বেল বাজাল। দুই মিনিটের মাথায় দরজা খুলে দিল প্রিয়তার বাবা অলিউল জামান। এতগুলো দিন পর বাবার মুখটা দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। অলিউল জামান মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। নীহাল প্রসন্ন হেসে ব্যাগ সব নিয়ে ভেতরে এল। প্রিয়তা কেঁদেই চলছে। অন্তঃস্থলের গভীর জখম যেন চোখ দিয়ে বয়ে যেতে চাইছে আজ। অলিউল সাহেব মেয়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আর কেঁদো না, মা। অনেক কেঁদেছ, অনেক কষ্ট পেয়েছ, আর না।’

প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল। বাবার পাযুগল জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, বাবা। আমি যে খুব অন্যায় করে ফেলেছি।’

অলিউল সাহেব মেয়েকে ধরে দাঁড় করালেন। বললেন,

‘ক্ষমা করে দিয়েছি। সন্তান হাজার ভুল করলেও মা বাবা কখনো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না, এই ক্ষমতা মা বাবার নেই। যা হয়েছে সব ভুলে যাও। নতুন ভাবে শুরু করো সবকিছু, আমরা তোমার পাশে আছি।’

প্রিয়তা জড়িয়ে ধরল বাবাকে। এমন একটা পরিবারের সাথে এত বড়ো অন্যায় সে কী করে করতে পারল। সে কান্না থামিয়ে তাকাল আশেপাশে। দেখল, মা নেই। বলল,

‘মা আমার উপর এখনো রেগে আছেন, তাই না?’

অলিউল সাহেব মৃদু হেসে বললেন,

‘তোমার মায়ের তো বরাবরই অভিমান একটু বেশি। এখনো অভিমান করে নিজের রুমেই বসে আছেন। যাও গিয়ে অভিমান ভাঙাও।’

প্রিয়তা চোখ মুখ মুছে মায়ের রুমের দিকে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, মা বিছানার এক কোণে বসে আছে চুপচাপ। চোখ ছলছল করে উঠল তার। নিজের করা ভুলের অনল এখন তাকে দগ্ধ করছে বড্ড। সে ক্ষীণ সুরে ডাকল,

‘মা।’

সাড়া পেল না কোনো। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল তাই। পেছন থেকে আরো একবার ডেকে বলল,

‘মা, আমি এসেছি। আমার সাথে কথা বলবে না?’

রাশভারী গলার স্বর ভেসে এল জবাবে,

‘কেন এলি?’

প্রিয়তা নিজেকে আর সংযত করতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করে দাও না, মা।’

‘করব না ক্ষমা।’

চোখ তুলে মায়ের দিকে চাইল প্রিয়তা। দেখল, মায়ের চোখ মুখও লাল হয়ে আছে খুব। কেঁদেছেন তা আর বোঝার বাকি নেই। প্রিয়তা মায়ের গলা জড়িয়ে গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল,

‘ক্ষমা করতে না পারলে শাস্তি দাও, তাও আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখো না প্লিজ।’

‘এটাই তোর শাস্তি, আমি তোর সাথে কোনোপ্রকার কথা বলব না।’

প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে উঠে। বলে,

‘এভাবে বলো না, প্লিজ। আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’

‘আমার কষ্ট হয়নি? আমাদের কষ্ট হয়নি? আমার কষ্ট যখন তুই বুঝিসনি এখন আমি কেন তোর কষ্ট বুঝব? ছাড় আমাকে।’

প্রিয়তা তার হাতের বাঁধর আরো শক্ত করে বলল,

‘ছাড়ব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্ষমা করছ ততক্ষণ পর্যন্ত এভাবেই থাকব।’

প্রিয়তার মা লুৎফা বেগম নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। না, এত সহজে তিনি গলবেন না। মেয়েটা তাঁকে বড্ড বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। মা’কে তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় দেখে প্রিয়তার কান্না আরো বাড়ল। বলল,

‘মা, দাও না ক্ষমা করে।’

তিনি জবাব দিলেন না কোনো। প্রিয়তা না পেরে মায়ের পা ধরে বসল। খানিকটা হকচকিয়ে লুৎফা বেগম মা সরিয়ে আনতে চাইলেও প্রিয়তা ছাড়াল না। কেঁদে কেঁদে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করে দাও না, মা। আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে।’

ফোঁপাচ্ছে প্রিয়তা। দরজার সামনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা আর ভাই। বোনের কান্না নীহাল সহ্য করতে না পেরে বলল,

‘মা, প্রিয়কে ক্ষমা করে দাও না, মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে তো।’

লুৎফা বেগম এবার রাগ দেখিয়ে বললেন,

‘ওহ, এখন বোনের কষ্টটা খুব চোখে লাগছে? মা যে এতদিন দুঃখে কষ্টে জীবিত লা শ হয়ে পড়েছিলাম, সেটা চোখে পড়েনি?’

নীহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে আসে। প্রিয়তাকে তুলে বসায়। সে নিজে বসে হাঁটু ভাঁজ করে। নরম গলায় বলে,

‘মা, আমি মানছি প্রিয়তা ভুল করেছে, আর অবশ্যই ভুলটা বিশাল। এটা করা তার মোটেও উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, এই ভুলের শাস্তি এই দুইটা মাস ও কম পায়নি। ওর উপর দিয়ে ঠিক কী কী গিয়েছে সেটা তুমি জানো না, মা। এতকিছুর পরেও তোমার মেয়েকে যে আজ আবার ফিরে পেয়েছ, সেটাই কি অনেক নয়, মা? মেয়ের ভালোবাসার চেয়ে কি তোমার কাছে তোমার জেদ বড়ো হয়ে গেল? একটু কি ক্ষমা করা যায় না, মেয়েটা তো তোমারই।’

লুৎফা বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। যথাসম্ভব কান্না আটকানোর চেষ্টা বোধ হয়। তিনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,

‘ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গিয়েছে এখন। তারা এখন মা বাবার চেয়েও বেশি বোঝে। আবার আসে বড়ো বড়ো কথা বলে মাকে বোঝাতেও। মা যেন অবুঝ, কিছু বোঝে না। শোনো, মায়েরা সব বোঝে। আর একটা সন্তানের কিঞ্চিৎ কষ্টেও রূহ কেঁপে উঠে তাঁদের। তাই মায়ের ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। আর তোমার বোন, বিরাট অন্যায় করেছে। আমি হাই প্রেশারের রোগী, জানটা আমার কোনোরকমে আটকে আছে। কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি? অবশ্য মায়ের কষ্ট বোঝে ক’জন ছেলেমেয়ে?’

তিনি আঁচলে নাক মুছলেন। প্রিয়তা জড়িয়ে ধরল ফের।নীহাল এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাঁটুতে মাথা রাখল। প্রিয়তা ভেজা সুরে বলল,

‘তোমার ভালোবাসায় কেউ প্রশ্ন তুলছে না, মা। মায়ের ভালোবাসার কাছে সবকিছু ফিকে পড়ে যায়। তোমাকে, বাবাকে আর ভাইকে ছাড়া পাকিস্তানে থেকে বুঝেছিলাম, তোমাদের ছাড়া আমি ঠিক কতটা অসহায়। তবে ভাগ্যের গুণে সেখানেও এক মা পেয়েছিলাম আমি। তিনিও বুঝিয়েছেন, মায়ের ভালোবাসা কতটা গভীর হয়। আমার ভুল হয়েছে, মা। আর কখনো তোমাকে একটুও কষ্ট দিব না। একদম তোমার লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকব। এখন দুধ দিলেই এক টানে খেয়ে নিব সবটা। সবজি রাঁধলে আর মুখ কালো করে রাখব না। প্রতিদিন সকালে উঠে তোমার সাথে হাঁটতে বের হব। বিশ্বাস করো, আর একটুও বিরক্ত করব না তোমায়। দাও না ক্ষমা করে।’

নীহালও বলল,

‘হ্যাঁ মা, ক্ষমা করে দাও না।’

মায়ের মন, মোমের মতো গলে যেতে সময় নেয়না এক মুহুর্তও। ছেলে মেয়ের এত এত অনুরোধে লুৎফা বেগমও বাধ্য হলেন নিজের রুক্ষ, শক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। তিনি প্রিয়তার দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বললেন,

‘আর যদি কোনোদিন আমার কোনো কথার অমান্য হয়েছিস তো আর কখনো তোকে ক্ষমা করব না।’

‘না না, আর জীবনেও তোমার কথার বিপরীতে আমি যাব না, প্রমিজ।’

‘মনে থাকে যেন।’

‘আচ্ছা, মনে থাকবে। এখন বলো, ক্ষমা করে দিয়েছ।’

তিনি রাশভারী গলায় নাক ফুলিয়ে বললেন,

‘হুঁ।’

‘এভাবে না, সুন্দর করে বলো না।’

লুৎফা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘আর ঢং না করে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও, আমি খাবার দিচ্ছি।’

প্রিয়তা মা’কে জড়িয়ে ধরল। গালে চুমু খেয়ে বলল,

‘আই লাভ ইউ, মা।’

তিনি জবাবে বললেন,

‘আই হেইট ইউ।’

প্রিয়তা হাসল। বলল,

‘ইয়েস, আই নো।’

চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here