হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম #Nusrat_Jahan_Bristy #পর্ব_২৭

0
91

#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_২৭

গাড়ি এসে থামে থানার সামনে। থানায় লোকবল অনেকটাই বেশি। দেখে মনে হচ্ছে যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে তারা আর তাদের দৃষ্টিও গাড়ির দিকে। রিহান গাড়ি থেকে নামতে নিলে জাহিন বাঁধা দিয়ে বলে, “তুই গাড়িতে থাক।”

“কিন্তু ভাইয়া।”

জাহিন রাগ দেখিয়ে বলে, “যেটা বলছি চুপচাপ সেটা কর বেশি কথা না বলে। আর হ্যাঁ যাই হয়ে যাক না কেন গাড়ি থেকে বের হবি না।”

রিহান মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। জাহিন পকেট থেকে মাক্স বের করে মুখে পড়ে নিয়ে খাঁড়া চুলগুলা এলোমেলো করে দিয়ে কপালে এনে ফেলে নিজ হাতে। জাহিন চায় না এই মুহূর্তে এখানে একটা গন্ডগোল হোক আগে নুহাশকে থানা থেকে বের করতে হবে তারপরেটা পরে দেখা যাবে। জাহিন গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হতে নিবে তখনই জাহিন কিছু একটা ভেবে বলে।

“সিট চেঞ্জ কর?”

রিহান হতবাক হয়ে বলে, “মানে।”

“আমি চাই না কেউ বুঝতে পারুক তুই কিংবা কেউ আমার সাথে এখানে এসেছে।”

“আচ্ছা।”

জাহিন ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে বা হাত দিয়ে কপাল চুলকাতে চুলকাতে থানার ভেতরে ঢুকে। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে জাহিনের পানে তাকিয়ে রইল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। জাহিন থানার ভেতরে ঢুকার সাথে সাথে এক লোক নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে বলে।

“ভাই চলে এসেছে ওই শেখ জাহিন।”

ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে পুরুষালী এক কন্ঠস্বর ভেসে আসে, “ঠিক আছে তাহলে আর এরপরে কি কি করতে হবে সেটা তো খুব ভালো করেই জানিস।”

“জি ভাই।”

বলেই ফোন কেটে দেয়। থানার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাঁচটা অল্প একটু নামিয়ে যবুকটি থানার দিকে স্থির‌ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রহস্যময় হেসে বলে।

“জননেতা জাহিন দেখি এবার তুমি কি করো? জানি তুমি নুহাশের জামিন ঠিক করিয়ে নিবে কারণ তোমার বন্ধু যে উকিল। কিন্তু মানহানি যা হওয়ার তা তো হবেই এর থেকে তুমি কি করে বাঁচবে?”

________

জাহিন থানার ভেতেরে ঢুকে মুখের মাক্সটা খুলে হাঁটতে হাঁটতে চুলগুলা ব্যাক ব্রাশ করে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সোজা শারাফের কেবিনে ঢুকে উৎকণ্ঠা গলায় বলে।

“নুহাশ কোথায়?”

শারাফ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকিয়ে রেখেছিল। জাহিনের কন্ঠস্বর শুনে চোখ খুলে জাহিনকে দেখে বলে, “ভাই তুমি এসেছো।”

“হুম নুহাশ কোথায়?”

শারাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “জিজ্ঞাসাবাদ রুমে রেখেছি ওকে।”

“নিয়ে চল আমাকে।”

শারাফ জাহিনকে নিয়ে চলল নুহাশের কাছে। দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই নজর পড়ে ঘরের এক কোণে নুহাশ হাঁটুমুড়ে বসে রয়েছে, দু হাত আড়াআড়ি করে হাঁটু ধরে রেখে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে হাঁটুর উপরে। দরজা খুলার শব্দ শুনে নুহাশ মুখ তুলে সামনের দিকে তাকাল কিন্তু ঠাঁই বসে রইল। জাহিন দ্রুত পায়ে নুহাশের কাছে এসে হাটু ভেঙ্গে বসে চাপা গলায় বলল।

“কি হয়েছিল রাস্তায়?”

নুহাশ নির্বাক। জাহিন পুনরায় প্রশ্ন করল নুহাশকে কিন্তু কোনো উত্তর দিল না নুহাশ, শুধু এক নজরে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে যেন নুহাশ একটা ট্রমার ভেতরে চলে গেছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল নুহাশ টু শব্দটাও করল না। নুহাশের ভাব দেখে জাহিনের রাগ উঠল মন চাইছে নুহাশের বা গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিতে। জাহিন হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অনামিকা আঙ্গুল দ্বারা বা চোখের ভ্রুটা চুলকিয়ে রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এভাবে ভেঙ্গে পড়ার কি মানে আছে সেটাই বুঝত পারছে না জাহিন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শারাফ বলে উঠল।

“ভাই আমি বলছি।”

জাহিন শাসানোর স্বরে বলল, “তুই কেন? ও কি বোবা যে তোকে বলতে হবে? ওকেই সবটা বলতে হবে।”

জাহিন নুহাশের জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে নুহাশের দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে ঠান্ডায় গলায় বলল, “যা যা হয়েছে সবটা বল বেশি দেরি করলে আমার হাতে কিন্তু তুই চড় খাবি নুহাশ।”

জাহিনের গলার স্বর ঠান্ডা হলেও সেই‌ স্বরে রয়েছে রাগের আভাস। নুহাশ জাহিনের চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত গলায় বলে, “বিশ্বাস করো ভাই আমি এমনটা করি নি।”

“জানি আমি তুই কিছু করিস নি। কিন্তু আমাকে না বললে বুঝবো কি করে কি হয়েছিল সেই সময়?”

“বলব কিন্তু তার আগে একটু পানি খেতে হবে।”

শারাফ নুহাশের কথাটা শোনার সাথে একজন কনস্টেবলকে পানি আনতে বলল। নুহাশ সবটা খুলে বলল জাহিনকে। জাহিন স্তব্দ হয়ে বসে রইল। সবাই যেন তাদের পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে। শারাফ বলল।

“ভাই কি করবে এখন?”

“গাড়িটা কোথায়?”

“থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।”

“আগামীকাল মেয়েটাকে থানায় আসতে বলবি। ওই মেয়ের পেট থেকে কি করে সত্যি কথা বের করতে হবে সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।”

“কি করবে তুমি?”

“সেটা আগামীকালকেই দেখতে পাবি।”

_______

অয়ন্তিকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখে জোহরা বেগম চিন্তিত হয়ে বলেন, “কি হয়েছে জারার?”

“দরজা খুলল না মা। তবে বলেছে ওর নাকি কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাই একটু একা থাকতে চায়।”

“বুঝলাম না মেয়েটার হঠাৎ হলো কি?”

রেকেয়া বানু আহাজারি করে বলতে শুরু করলেন, “আমার সংসারটাতে কালো ছায়া পড়েছে তাই একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে। এই কালো ছায়াটা হল এই মেয়েটি।”

অয়ন্তিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হল। অয়ন্তি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অয়ন্তি কথাগুলা গায়ে মাখলো না মেখে লাভ কি যার যেটা বলার সে তো সেটা বলবেই। এর মাঝে রুনা আক্তার বলেন, “মা কি বলছেন আপনি এসব? অয়ন্তির মতো একটা নরম ভদ্র মেয়েকে আপনি এভাবে বলতে পারেন না। ওর মতো মেয়ে হয় না।”

রেকেয়া বানু দ্বিগুন রেগে গিয়ে বললেন, “এই সব ভদ্র সদ্র মেয়েগুলাই এক একটা মিচকা শয়তান হয়। এই মেয়ের জন্যই আমার এক নাতি ঘর ছাড়া হয়েছে। না জানি আমার নাতি তিনটা কি অবস্থায় আছে। আমি আমার এক মানিককে পাঁচ বছর আগে হারিয়েছি আর কোনো‌ মানিককে হারাতে চাই না আমি বোঝতে পেরেছো তোমরা।”

রুনা আক্তারের বুকটা ধ্বক করে উঠে শাশুড়ির শেষ কথাটা শুনে। সন্তানকে হারিয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিন্তু সেই ক্ষত এখনও শুকায় নি। প্রতি দিন রাত হলে যখন ঘুমাতে যায় আর মস্তিষ্ক যখন স্থির হয়ে চোখ লেগে আসে তখনই মনে হয় দূর থেকে সেই চির চেনা একটা কন্ঠ ভেসে আসে‌ কানে “মা মা গো ওরা আমাকে বাঁচতে দিল না মা। ওরা আমাকে মে*রে ফেলল মা। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন মা। আমি শত চেষ্টা করেও দম ধরে রাখতে পারে নি মা। তুমি আমাকে ছোট বেলার মতো কোলে তুলে নাও মা তাহলে আমি হয়তো আবারো প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারব মা। মা কই তুমি মা আমাকে টেনে তুলে নাও তোমার কোলে মা?”

এর মাঝে শেখ রেজাউল সাহেব রাগ মেশানো গলায় বলল, “উফফ তোমার চুপ করো সবাই আল্লাহ আল্লাহ করো যেন ছেলে দুটো সুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।”

জোহরা বেগম আস্তে করে বলেন, “ছেলে দুটো নয় ছেলে তিনটা।”

রেকেয়া বানু ভ্রু কুঁচকে বলেন, “ছেলে তিনটা মানে?”

“রিহান ফিরে এসেছে।”

রেকেয়া বানু খুশি হয়ে বললেন, “রিহান দাদু ভাই ফিরে এসেছে কিন্তু সে কোথায়?”

“জাহিনের সাথে থানায় গেছে।”

“যাক বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে এবার শুধু নুহাশকে নিয়ে ফিরলেই হল।”

রিহান ফেরাতে বাড়ির সবাই খুশি হলেও কেন জানি অয়ন্তির মনে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। যে লোকটার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলো তার বড় ভাইয়ের সাথে সেই লোকটার সামনে কি করে যাবে সে? কি করে রিহান নামক লোকটাকে সে ফেইস করবে? আর রিহানেই বা কি করে তাকে ফেইস করবে?

______

রাত দশটা বেজে গেছে কিন্তু নেহাল এখনও জামিনের কাগজ নিয়ে থানায় আসে নি। জাহিনের দলের সকলে এসেছে। সকলে নুহাশকে সান্ত্বনা দিচ্ছে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে। থানার সামনে হঠাৎ করেই যেন লোকবল আরো বেড়ে গেছে সাথে প্রেসের লোকজনও কোথা থেকে যেন উদায় হল। জাহিন নেহালকে ষষ্ঠবারের জন্য ফোন করতে নিলে নেহাল হন্তদন্ত হয়ে থানার ভেতরে আসে। জাহিন নেহালকে দেখার সাথে সাথে নেহালের কাছে গিয়ে বলে।

“সব ঠিকঠাক মতো হয়েছে?”

“হুম তোর ফোনটা পাওয়ার পর যেন একটু তাড়াতাড়িই‌ জামিনের কাগজ মঞ্জুর করেছে কোর্ট থেকে।”

“কাগজটা দে দেখি।”

জামিন পেয়ে গেছে নুহাশ কিন্তু এই কেসটা নির্বাচনের আগে যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করতে হবে আর সকলের সামনে প্রমাণ করতে হবে নুহাশের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। থানার কার্যক্রম শেষ করে জাহিন নুহাশকে গম্ভীর গলায় বলে।

“এবার বাড়ি চল।”

এর মাঝে রাসেল বলে, “ভাই বাইরে তো অনেক প্রেসের লোক আছে কি করে যাবেন?”

জাহিন আকস্মিক চোখ মুখ লাল করে হিংস্র গলায় বলে, “পায়ে হেঁটে যাব আর প্রেসের লোকজন আছে তো তাতে আমার কি হয়েছে? ওদের ভয়ে কি আমি এখানে লুকিয়ে বসে থাকব। ওদের কাজেই হচ্ছেই একটা নিউজকে ঘুরিয়ে পেঁছিয়ে লেখা। ওরা যা পারে তাই লিখে ব্রেকিং নিউজ করে দিক তাতে আমার বা*ল ছেঁড়া যাবে।”

সবাই হতবাক হয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। ঠান্ডা মেজাজের জাহিনকে এভাবে রেগে যেতে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে ওরা তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে জাহিনের মুখে এমন গা’লি শুনে। তাদের ভাই কি বিয়ে করে চেঞ্জ হয়ে গেল নাকি। জাহিন সবাইকে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে।

“আমাকে যদি তোদের দেখা হয়ে থাকে তাহলে সর আমার সামনে থেকে।”

শারাফ বলে উঠে, “ভাই চিন্তা করো না আমার ফোর্স দিয়ে ওদের আটকে রাখব।”

জাহিন থানা বের হতে নিবে তখনই হাঁটা থামিয়ে নেহালকে উদ্দেশ্য করে বলে, “নেহাল তুই ভেতরে থাক এই‌ ঝামেলা শেষ হলে তারপর থানা থেকে বের হবি তার আগে নয়।‌ আমি চাই‌ না তোর কোনো ক্ষতি হোক।”

নেহাল মাথা নাড়িয়ে বন্ধুর কথায় সায় দিল। এখন না বের হওয়াটাই উত্তম তার জন্য।

________

জাহিন থানা থেকে বের হল পেছন পেছন নুহাশ আর অন্যরাও বের হয়েছে। থানা থেকে বের হতে দেরি হল কিন্তু প্রেসের লোকজনদের হামলে পড়তে দেরি হল না। লোকবল এতটাই বেশি যে পুলিশের লোকেরা হিমশিম খাচ্ছে আটকে রাখতে তাদের। প্রেসের লোকজন অনেক প্রশ্নই করল দূর থেকে জাহিনকে, কিন্তু একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিল না জাহিন। অন্য দিকে জনগণরা হিংস্র হয়ে বাজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে কারো পোষা কু’কু’র তারা আর তারা তাদের মালিকের বলা কথাগুলা জাস্ট এখানে এসে আওড়াচ্ছে। এর মাঝে আকস্মিক এক পাথর ছুড়া হলো সেটা এসে পড়েছে জাহিনের ঠিক পায়ের নিচে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আক্রমণের সংকেত দিচ্ছে তাদেরকে। জাহিন এক বার পায়ের কাছে থাকা পাথরটা দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে নুহাশ বলে চিৎকার করে নুহাশকে নিজের জায়গা থেকে সরিয়ে দেয় কিন্তু ছুড়া পাথরটা গিয়ে পড়ে জাহিনের ঠিক বা গালের হারের অংশটাতে। জাহিন চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁতে চেপে যন্ত্রণাটা সহ্য করে নিল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল লাল রক্তের ধারা। নুহাশ আতকে উঠে বলে।

“ভাই তুমি ঠিক আছো?”

জাহিন হাত দিয়ে ক্ষত স্থানটা চেপে ধরে বলে, “আমি ঠিক আছি তোরা সবাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ।”

সবাই গাড়িতে উঠে বসলে জাহিন গাড়িতে না উঠে বসে একজনকে দেখে থমকে যায়। লোকটা তাকে হাতের ইশারা বোঝায় “ইউ‌ আর ফিনিশ।” জাহিন লোকটার দিকে তেড়ে যেতে চাইলে শারাফ বাঁধা দিয়ে বলে।

“ভাই গাড়িতে উঠো তুমি। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে একটা দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে।”

জাহিনকে জোর করে শারাফ গাড়িতে বসিয়ে দেয়।

________

রাত এগারোটার সময় জাহিন, রিহান আর নুহাশ শেখ বাড়িতে এসে পৌঁছায়। আজমল শেখ আর আযহার শেখ কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। জাহিন সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আজমল শেখ ছেলের সামনে এসে সজোরে বা গালে চড় বসিয়ে দেন। এভাবে চড় মারাতে‌ জাহিনের ক্ষত স্থানটা যেন আরো‌ তাজা হয়ে উঠল। জাহিন চোখ বন্ধ করে বাবার চড়টা হজম করে নিল। আকস্মিক জাহিনের গালে এভাবে চড় মারাতে বাড়ির সকলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জোহরা বেগম আতকে উঠে বলেন।

“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে এত বড় ছেলের গায়ে হাত তুলছো।”

আজমল শেখ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “তুমি চুপ‌ করো জোহরা আজকে ওর সাথে আমার একটা বুঝাপড়া আছে। ও পেয়েছেটা কি? রাজনীতি করে ও কি বুঝাতে চাইছে আমাদের হুম? রাজনীতি করলে জীবনে কোনো রকম এচিভমেন্ট পাওয়া যায় না যা পাওয়া যায় সবটাই ধ্বংস। পাঁচ বছর আগের জীবনে ফিরে যাও জাহিন ভেবে দেখো পাঁচ বছর আগে এই রাজনীতি আমাদের কাছ থেকে কি কেঁড়ে নিয়েছিল।”

জাহিন শান্ত গলায় বলে, “আপনি মেইন কথায় আসেন বাবা এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে।”

“তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও এটাই আমার কথা।”

“সরি বাবা রাজনীতি ছাড়তে পারব না। কাউকে না ছাড়ার কথা দিয়ে রেখেছি আমি তাই আপনার কথাটা মানতে পারব না আমি।”

আজমল শেখ উচ্চ বাক্যে বলেন, “জাহিন বাবার মুখে মুখে তর্ক করা শিখে গেছো দেখা যায়।”

“আপনি জানেন বাবা আমি তর্ক করতে পছন্দ করি না কিন্তু কিছু জায়গাতে তর্ক করতে হয়।”

“হয় তুমি রাজনীতি ছাড়বে নয় তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।”

জোহরা বেগম আবেগী গলায় বলে উঠেন, “কি বলছো‌ কি তুমি এসব ছেলেটাকে?”

“যা বলছি ঠিকই বলছি ও এই বাড়ি থেকে চলে যাক।”

আযহার শেখ ভাইকে বোঝার স্বরে বলেন, “ভাই আপনি একটু শান্ত হোন এভাবে হাইপার….।”

ছোট ভাইকে আর কিছু বলতে না দিয়েই আজমল শেখ বলে তেঁতে উঠে বলে, “তুই চুপ কর তুই হচ্ছিস মেইন কালপ্রিট তুই যদি এই রাজনীতিতে না জড়াতি তাহলে এমন কিছুই হতো না, না এই বাড়ির বড় ছেলেকে হারাতে তো না আজকের এই ঘটনাটা ঘটতো।”

আযহার শেখ পিছু হেঁটে যান। ভাই তার আজ ভীষণ ক্ষেপে গেছে।

জাহিন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, “ঠিক আছে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব তাতে যদি আপনি খুশি হোন তো তাই হবে।”

জোহরা বেগম ছেলের কাছে এসে ছেলের হাত ধরে দূরে নিয়ে গিয়ে রেগে বলেন, “কি বলছিস কি তুই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি মানে?”

জাহিন কোনো কথা বলল না। জোহরা বেগম স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, “আর তুমি কি বলছো এসব ভেবে বলছো তো?”

“হ্যাঁ আমি ভেবেই বলছি। ওর ভালোর জন্য বলছি ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বলছি। ও আর এখন নয় ওর জীবনের সাথে একটা ফুলের মতো মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে আর আমি চাই না মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাক ওর এই রাজনীতির জন্য।”

জাহিন বাবার কথাটা শুনে ড্রয়িং রুমের চারপাশটায় নজর বুলায়। কিন্তু অয়ন্তির কোনো অস্তিত্ব নেই, কোথায় আছে মেয়েটা? ও কি জানে না জাহিন যে বাড়িতে এসেছে?

আজমল শেখ পুনরায় নরম স্বরে বললেন, “ও নিজের চোখে দেখেছে এই রাজনীতি কি করে একটা জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে? কিন্তু তারপরও ওর কোনো শিক্ষা হয় নি। আজ যে নুহাশ জেলে গিয়েছিল সেটাও এই রাজনীতির কারণেই গিয়েছে।”

“আচ্ছা তুমি চুপ করো যা হওয়ার হয়ে গেছে জাহিন তো সবটা সামলে নিয়েছে।”

“কি সামলে নিয়েছে ও। নুহাশের শুধু জামিন হয়েছে জোহরা কেস এখনও শেষ হয় নি।”

“আচ্ছা আচ্ছা চুপ করো এখন বাবা মা ঘুমিয়েছেন একটু আগে ঔষধ খেয়ে। ওনারা উঠে গেলে স্বাস্থ্যের খারাপ হবে ওনাদের। তুমি রুমে চলো আমার সাথে।”

আজমল শেখ আর কিছু না বলে রুমে চলে যায়। জোহরা বেগম নুহাশ, রিহান আর নুহাশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তিন জন তিন জনের ঘরে যাও আর গিয়ে ফ্রেশ হও। রাতের খাবারটা রুমেই পাঠিয়ে দিবো তোমাদের।”

রিহান দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে চলে যায়। রিহান এতক্ষণ আড়ালে ছিল বাবা যদি একবার তাকে দেখে নিত তাহলে খবর আছে। কিন্তু সকাল বেলা যদি দেখে তখন তো এখনের খবরটা পরে পড়বে। নুহাশের দুচোখ খুজে বেড়াচ্ছে জারাকে কিন্তু জারা নেই? মেয়েটা তার এই বিষয়ে জানার পর থেকে কি ভাবছে তার সম্পর্কে? হয়ত তাকে খুব খারাপ ভাবচ্ছে তবে এক দিকে থেকে ভালোই হয়েছে এতে যদি জারা নুহাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাতে দুজনের জন্যই সুখকর। নুহাশ ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে দিকে চলে যায় তবে যাওয়ার আগে জারার রুমে দিকে এক পল তাকায়। জোহরা বেগম ছেলের ক্ষত স্থানটায় আস্তে করে ছুঁয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলেন।

“ইস কতটা কেটে গেছে।”

জাহিন মায়ের হাতটা ধরে বলে, “মা আমি ঠিক আছি এতটা পেনিক হওয়ার মতো কিছু হয় নি।”

“বাবার কথায় কিছু মনে করিস না বাবা। বাবা রেগে কথাগুলা‌ বলে ফেলেছে মন থেকে বলে নি।”

“হুমম জানি।”

“যা ঘরে যা।”

জাহিন ছয় কদম পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই থমকে যায়। কিছু একটা মনে করে কিচেনের দরজার দিকে তাকাতেই কেউ একজন দ্রুত সরে যায় তবে শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ দেখা যায়। জাহিন বুঝতে পারল এটা তার লাজুক বধূ ছাড়া কেউ নয় কিন্তু মেয়েটা এভাবে লুকোচুরি খেলছে কেন? সামনে পসছে না কেন তার? জাহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। জাহিন চলে যেতেই অয়ন্তি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে। অয়ন্তিকে দেখার সাথে সাথে জোহরা বেগম বলেন।

“অয়ন্তি মা ঘরে যাও। ঘরে গিয়ে জাহিনের ক্ষত স্থানটা পরিস্কার করে দাও।”

“আচ্ছা।”

________

জাহিন ঘরে ঢুকে জ্যাকেটটা গা থেকে খুলে বিছানায় রেখে এলোমেলো পায়ে হেঁটে সোজা গিয়ে বসে পড়ে সোফায়। মাথাটা সোফায় হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। কিয়ৎক্ষণ সময় যেতেই জাহিন কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ মেলে তাকাল। চোখের সামনে ভেসে উঠল অয়ন্তির‌ শুকনো মুখটা তার থেকে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। জাহিন পুনরায় চোখ বন্ধ করে আস্তে করে বলে।

“কিছু বলবেন?”

“আসলে মা বলেছে আপনার ক্ষতটা পরিস্কার করে দিতে।”

জাহিন চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল, “শুধু মা বলেছে বলে ক্ষত স্থানটা পরিস্কার করতে এসেছেন।”

অয়ন্তি জাহিনের কথায় নিরুত্তর রইল। শুধু মা বলেছে বলে যে সে এটা করতে এসেছে এমনটা নয় স্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও এটা সে করত। জাহিন অয়ন্তির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ মেলে অয়ন্তিকে আগের স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে।

“কি হল দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি পরিস্কার করে দিবেন ক্ষতটা।”

অয়ন্তি জাহিনের কথা শুনে আলমারি থেকে ফাস্ট এউড বক্সটা এনে জাহিনের কাছে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বেজাল বাঁধলো অয়ন্তি কোথায় বসে জাহিনের চিকিৎসা করবে। জাহিন তো সিঙ্গেল সোফায় বসেছে আর সিঙ্গেল সোফায় তো আরেক জন বসতে পারবে না। জাহিন অয়ন্তি ভাবনা বুঝতে পেরে সেন্টার টেবিলটা টেনে একটু কাছে এনে বলে।

“এখানে বসুন।”

অয়ন্তি অবাক চোখে জাহিনের দিকে তাকাল। এই লোক দেখা যায় অন্তর্যামী তার ভাবনা বুঝে ফেলল। জাহিন পুনরায় বলল, “কি হলো বসুন।”

অয়ন্তি জাহিনের মুখোমুখি হয়ে বসল। জাহিনের দু পায়ের মাঝখানে অয়ন্তির ছোট্ট পা দুটো রাখা। জাহিন এক দৃষ্টিতে অয়ন্তির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার চোখে মুখে কেমন যেন একটা অদ্ভুত মায়া আছে যে মায়ায় সে বার বার আটকে যায় আর একটা না একটা উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে। অয়ন্তি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে তুলা বের করছে। জাহিন তা দেখে ঢোক গিলে সাথে সাথে নজর সরিয়ে নেয়। এই দিকে অয়ন্তি তুলা বের করে তুলাতে স্যাভলন লাগিয়ে একটু ঝুকে জাহিনের ক্ষত স্থানে চেপে ধরল। জাহিন জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আহ করে উঠে। অয়ন্তি জাহিনের আর্তনাত শুনে দিশেহারা হয়ে সাথে সাথে তুলাটা সরিয়ে নিয়ে জাহিনের বা গালে হাত রেখে কিছু এগিয়ে এসে ক্ষত স্থানে ফু দিতে শুরু করল। অয়ন্তি ফু দিতে ব্যস্ত আর জাহিন তার বউকে দেখতে ব্যস্ত। অয়ন্তির চোখে মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে সেটাই তাকে নিয়ে। জাহিন মুচকি হাসল। অয়ন্তি যখন বুঝতে পারল সে জাহিনের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে সাথে সাথে অয়ন্তি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।

“পরের কাজটা আপনি করে নিয়েন।”

অয়ন্তি উঠে চলে যেতে নিলে জাহিন জলদি অয়ন্তির হাতের কব্জি চেপে ধরে বলে, “শুরুটা যখন আপনি করেছেন শেষটাও আপনি করেন। আর বউ থাকতে আমি কেন এত পরিশ্রম করব?”

ইস আবারো সেই বউ ডাক। এভাবে কেন বউ বলে ডাকে লোকটা তাকে? তার বুঝি কিছু হয় না।‌ অয়ন্তির ভাবনার মাঝেই জাহিন তার কব্জি ধরে টান মারে কিন্তু অয়ন্তি নিজের টাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে পড়ে জাহিনের বক্ষস্থলে। অয়ন্তি ভয়ে দু হাত দিয়ে খামচে ধরে জাহিনের দু কাঁধ। এভাবে টান মারাতে অয়ন্তির খোপা করে রাখা চুল গুলা খুলে গিয়ে সমস্ত চুল গিয়ে পড়ে জাহিনের মুখে। জাহিন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। আচ্ছা মেয়েদের চুলের ঘ্রাণ এমন মাতাল করা হয় কেন? এটা চুলের নিজস্ব ঘ্রাণ নাকি শ্যাম্পুের ঘ্রাণ কোনটা? জাহিনের ভাবনার মাঝে অয়ন্তি জাহিনের দিকে পিটপিট চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলে আনমনে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। জাহিনও আলতো হাতে অয়ন্তির চুল গুলা কানে গুজে দিয়ে মোহনীয় গলায় বলে।

“এভাবে আমার সামনে কখন আর ঠোঁট কামড়ে ধরবেন না অয়ন্তি। তখন হয়তো আবারো আমি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে দিবো যেটা আমি এই মুহূর্তে করতে চাইছি না।”

কথাটা বলেই অয়ন্তিকে সেন্টার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে নিজের ব্যবহৃত কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে‌ যায়।‌ অয়ন্তি তব্দা হয়ে বসে রইল। জাহিন কি করার কথা বলে গেল তাকে? কিয়ৎক্ষণ সময় যেতেই জাহিনের বলা কথাটার মর্ম বুঝতে পেরে অয়ন্তির গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here