#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬২।
পুরো দিনটা কাটল সকলের থমথমে এক ভাবমূর্তিতে। প্রিয়তা কারোর সাথে কথা বলল না ঠিক মতো। নীহাল যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, প্রিয়তাকে বোঝানোর। প্রিয়তা কতটুকু বুঝেছে কে জানে। ঐদিকে মৌমিও ইনিয়ে বিনিয়ে প্রিয়তার একগাদা সুনাম করেছে ভাইয়ের কাছে। উদ্দেশ্য, যে করেই হোক ভাইয়ের মনে প্রিয়তার প্রতি ভালো লাগা তৈরি করতেই হবে।
দুপুরের খাবারের টেবিল নীরব। টুকটাক প্লেট, চামচের শব্দ ছাড়া আর তেমন কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মৌমি অনেকক্ষণ চুপ থেকে এবার যেন পারছে না আর। মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,
‘আমরা কি বিকেলে কোথাও বের হব না?’
অস্বস্তিতে বুঁদ হয়ে থাকা প্রিয়তা তার দিকে তাকাল। বলল,
‘নীহাল ভাই তোমাদের নিয়ে বের হবেন।’
‘কেন, তুমি যাবে না?’
‘না।’
‘উঁহু, উনার সাথে আমি জীবনেও যাব না। তোমার যেতে হবে।’
‘ভাইয়া একা যাচ্ছে না তো, দিলরুবা আন্টি আর ফা.. তোমার ভাইয়াও সাথে থাকবেন।’
মৌমি তাও নাক কুঁচকাল। বলল,
‘তারপরও তুমি না গেলে আমি যাব না।’
প্রিয়তা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। ফারজাদের সামনে থাকতে যে তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে, সেটা সে কী করে এই মেয়েকে বোঝাবে। মৌমি নাছরবান্দা, তাকে না নিয়ে যে যাবে না সেটা সে ভালো করেই অবগত। উপায়ান্তর না পেয়ে বলল,
‘আচ্ছা, যাব। খেয়ে নাও এবার।’
মৌমি খুশি মনে বাকি খাবারে মনোযোগ দিল।
________
দুপুরের শেষ ক্ষণ। সূর্যের তেজ ম্রিয়মান। তৈরি হচ্ছে প্রিয়তা আর মৌমি। দিলরুবা বেগম যাবেন না জানিয়েছেন। প্রিয়তার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মৌমির জন্য রাজি হতে হলো তাকে। বের হলো চারজন। প্রিয়তা, মৌমি, ফারজাদ আর নীহাল। উবার ডেকে তাতেই উঠে বসল বসাই। নীহাল সামনের সিটে। মৌমি চট করে বায়না ধরল,
‘আমি জানলার পাশে বসব।’
প্রিয়তাকে জানলার পাশের সিট ছেড়ে বসতে হলো মাঝে। আর তার পাশের সিটেই বসল ফারজাদ। ফারজাদ বসতেই আঁইঢাঁই শুরু হলো প্রিয়তার। বড্ড ইতস্তত বোধ করছে সে। ফারজাদকে শান্ত দেখালেও প্রিয়তা তার ভেতরকার অস্বস্তিটাও ঠিকই টের পাচ্ছে। ফারজাদের সাথে এত কাছাকাছি বসাটা মোটেও তার সমীচীন মনে হচ্ছে না। মনের মাঝে এমনিতেই এক বিরাট বিরোধ চলছে, এরই মাঝে ফারজাদের কাছাকাছি থাকাটা মোটেও ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না। প্রিয়তা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। আড়চোখে একবার দেখার চেষ্টা করল ফারজাদকে। ফারজাদের দৃষ্টি বাইরের জগতে। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা, আর উঁচু উঁচু সব বিল্ডিং দেখাতে সে ব্যস্ত। তার মনের অবস্থা বাইরে থেকে ঠাহর করা মুশকিল বেশ। সকাল থেকেই একেবারে চুপচাপ। মনে মনে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা একমাত্র সে’ই জানে। প্রিয়তা মাথা ঘামাল না এত। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অতি সন্তর্পনে। মুখে না বললেও সে জানে, ফারজাদ কখনোই রাজি হবে না, আর সেও তাই চায়।
গন্তব্যে পৌঁছে একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই নীহাল ভাড়াটা দিল। ফারজাদ দিতে দিচ্ছিল না তাকে। প্রিয়তা আর মৌমি রমনা গেইটের সামনে। মৌমি কৌতুহল নিয়ে এদিক ওদিক লাগছে। চারদিক অতি নতুন লাগছে তার। কী সুন্দর, কী চমৎকার পরিবেশ। কত কত মানুষ। প্রিয়তা বলল,
‘এটা হলো রমনা পার্ক। ঢাকার মধ্যে অন্যতম পরিচিত একটি স্থান। এখানে প্রতি বছর আমাদের পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। বৈশাখে আসলে দেখতে পারতে, কী চমৎকার ভাবে সেজে উঠে এই প্রাঙ্গণ।’
‘বৈশাখ’টা কী, আপু?’
‘এটা হলো বাংলা মাসের প্রথম দিন, মানে বাংলা নববর্ষ। ইংরেজি বছরের শেষে যেমন হ্যাপি নিউ ইয়ার পালন করা হয়, তেমনি এখানে বাংলা বছরের শেষেও নববর্ষ পালন করা হয়।’
‘ওহহ আচ্ছা, এবার বুঝেছি।’
নীহাল আর ফারজাদ এল তাদের সম্মুখে। নীহাল বলল,
‘ভেতরে চল।’
প্রিয়তা আর মৌমি ধীর পায়ে হাঁটছে। আর নীহাল, ফারজাদ তাদের পেছনেই। মৌমি এদিক ওদিক দেখছে, আর বিভিন্ন প্রশ্ন করছে প্রিয়তাকে। প্রিয়তা তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সুন্দর ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে মাঠের কাছে এসে থামল তারা। মৌমি বলল,
‘এখন একটু বসি।’
‘হ্যাঁ, চলো।’
প্রিয়তা আর মৌমি বসল একটা সিটে। ফারজাদ ব্রিজের কাছটাতে গিয়ে দাঁড়াল। প্রিয়তা সেদিকে তাকাল। নীহাল তাদের সামনেই। প্রিয়তা কী ভেবে যেন উঠে দাঁড়াল আবার। বলল,
‘ভাইয়া, তুমি এখানে বসো। আমি একটু ফারজাদের সাথে কথা বলে আসি।’
মৌমি আর নীহাল দুজনেই আতঙ্কে তাকাল। নীহাল বলল,
‘অযথা কোনো কথা বলে ব্যাপারটা আরো জটিল করিস না, প্রিয়।’
‘না, আমি জটিল করব। বরং জটিলতা ভাঙাব।’
প্রিয়তা এগিয়ে গেল ফারজাদের দিকে। নীহাল মৌমির পাশে বসল। মৌমি দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটতে কাটতে বলল,
‘আপনার কী মনে হয়, প্রিয়তা আপু ভাইয়াকে কী কথা বলবে?’
নীহাল বিরক্তের সুরে বলল,
‘সেটা আমি কী করে বলব?’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক; আপনি কী করে বলবেন আর। তারচেয়ে বরং বসে বসে দোয়া করেন, এখন এই দোয়াটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু কাজে দিবে না।’
এই বলে সে নিজেই মোনাজাত ধরে বসল। চোখের পল্লব বোজে দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে কী কী যেন বলছে সব। নীহাল চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। তার এসব পাগলামী দেখে হাসল সে। তারপর সামনেই চেয়ে দেখল এক ছোট্ট মেয়ে বেলি ফুলের মালা বিক্রি করছে। সে তখন খেয়াল করে মৌমির হাত জোড়া খালি। এই বেলি ফুলের মালাটা নিত্যান্ত’ই চমৎকার দেখাবে তার এই হাতে। সে ঐ মেয়েটাকে ডাকল। একটা বেলি ফুলের মালা কিনে নিল। মোনাজাতে তোলা হাত যুগলের মধ্যে একটা হাত ধরে নিল খপ করে। মৌমি চমকে চোখ মেলল সঙ্গে সঙ্গেই। চোখ খুলে এমন কিছু একটা দেখবে সেটা সে কখনোই আশা করেনি। নীহাল বেশ যত্ন করে মালাটা তার হাতে পরিয়ে দেয়। নিজের হাতে হাতটা রেখে বলে,
‘সুন্দর লাগছে।’
মৌমি বাকরুদ্ধ। নীহালের এহেন ব্যবহারে নিশ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে বসেছে সে।
________
‘জায়গাটা ভালো লেগেছে?’
প্রিয়তার উপস্থিতি ফারজাদ টের পায়নি। আচমকা প্রশ্নে খানিক অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘জি, সুন্দর।’
প্রিয়তা ঘুরে দাঁড়াল। আশেপাশে এখন অনেক মানুষ। বিকেলের সময়, সবাই’ই তাদের মতো ঘুরতে বেরিয়েছে হয়তো। প্রিয়তা এক পল সময় নিয়ে বলল,
‘আমি দুঃখিত। মা বাবার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।’
ফারজাদ তাকাল তার দিকে। বলল,
‘ক্ষমা যাওয়ার কারণ?’
‘এমন অনাকাঙ্খিত এক মুহুর্ত তৈরি করার জন্য।’
ফারজাদ সামনের দিকে ফিরল ফের। মানুষগুলো সব ছবি তুলাতে ব্যস্ত। সে খানিকটা সময় বিরতি নিয়ে বলল,
‘আমি আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ কাটিয়েছি ভীষণ দুঃখে। প্রতিরাতে আমার আর্তনাদে কেঁপেছিল আমার ঘরের প্রতিটা দেয়াল। ছোট থেকেই অনেক কিছু দেখে, শিখে বড়ো হয়েছি। আর এই অনেক অনেক দেখা, শোনা আর শেখা একটা প্রগাঢ় চিন্তা, ভয় আর আতঙ্ক তৈরি করেছে আমার মনে। মায়ের এত এত কষ্ট বিয়ের প্রতি আমার এক আলাদা বিদ্বেষ তৈরি করেছিল। তারপর এত বছর পর আবার আপনার এই কাহিনী। আমি অবাক হই ভাবলে, ভালোবাসা মানুষকে কতটা অন্ধ বানিয়ে দেয়। অথচ মজার ব্যাপার দেখুন, এতকিছুর পরেও আমি আমার মনকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারলাম না। চলে গেল সে অন্যের দখলে। যেটা আমি কখনোই চাইনি সেটাই হলো।’
প্রিয়তা নিষ্পলক চেয়ে শুনল সব। ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো?’
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️