#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৬
সন্ধ্যে নাগাদ আমরা রিসোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার মন ভীষণ খারাপ। নেত্র হতে গরিয়ে শুষ্ক কপোল বেয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণারা টপটপ করে ঝরে পড়ছে। আমার এই মন খারাপের কারণে হয়তো আজ আকাশটাও কেমন গুরুগম্ভীর হয়ে ছেয়ে আছে! আকাশের বুকে মেঘেরা পুঞ্জীভূত হয়ে খানিক সময় পরপর গর্জন করছে। আমার ভেতরে থাকা চাপা আর্তনাদগুলো হয়তো মেঘের গর্জনরূপে বাইরে বেরিয়ে আসছে! মাঝেমধ্যে বিজলি চমকাচ্ছে। শুরু হয় এলোপাতাড়ি বাতাস সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বারিধারা বইতে আরম্ভ করে!
আমি ধীর পায়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করে বেলকনির পথে পা বাড়ালাম। মন খারাপ থাকলে আমি আমার এই ছোট্ট বেলকনিতে চলে আসি। বেলকনিতে আসা মাত্রই নজর পড়ল গোলাপ গাছটার দিকে। একটা কলি ফুটে, এখন প্রায় ঝরে পড়ার মতো অবস্থা। ইশ গোলাপটার মতো যদি আমিও ঝরে যেতাম! পাশে থাকা আরেকটা তাজা গোলাপ নজরে আসতেই মলিন হাসলাম। এই গোলাপটা আমার মনকুটিরে বসবাসরত মানবটার জন্য বরাদ্দ ছিল কিন্তু আফসোস আমি তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসলেও সে আমায় ভালোবাসল না! আচ্ছা সে ঐ নারীর মাঝে কি এমন দেখল যা আমার মাঝে নেই? এর উত্তর জানা নেই আমার।
গোলাপ গাছটা থেকে সরে এসে বেলকনির মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের পানে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।সুরহীন বেসুরে গলায় গাইলাম
-‘ “|দৃষ্টির পানে আকাশে চেয়ে
তোমাকে আমি খুঁজবো না
আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে
ভালোবাসি, তা বলবো না
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু ভালোবাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু কাছে ডাকবে না?
আগেও তো ভালোবাসতে তুমি
আগেও তো কাছে ডাকতে তুমি
তবে আজ কেন দূরত্বটা সবচেয়ে কাছের?
ভালোবেসে কি ভুল করেছি আমি?|”
নেত্র হতে দূর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ঝরে পড়ল। ভেতরটা হাহাকার করছে আমার। আদ্রিশ ভাইয়া এমনটা আমার সাথে না করলেও পারত। আমার অনুভূতিগুলো নিয়ে কেন এমন ছিনিমিনি খেলল সে?
-‘ মেহু…
ধরা গলায় কোনো পুরুষালী কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে ঠেকতেই আমি চকিত তাকালাম সেদিক পানে। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে। বুকের মাঝে দুহাত গুঁজে বেলকনির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমি কিছু বলার পূর্বেই সে আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আমার থেকে কয়েক হাত দূরে বসে পড়লো।
তারপর শান্ত কণ্ঠে আমায় জিজ্ঞেস করল
-‘ সারাক্ষণ আকাশের পানে চেয়ে কি এতো দেখিস মেহু? কি আছে এই আকাশের মাঝে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না, চুপচাপ সেখানে ঠায় বসে রইলাম।
এবার সে আমার দিকে ফিরে চাইলো। ভ্রু উঁচিয়ে বলল
-‘ মুখে কুলুপ এঁটেছিস? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোকে।
আমি এবার শীতল কন্ঠে বললাম
-‘ কেন এসেছেন এখানে? আমি তো আপনাকে বিরক্ত করিনি তবে?
আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে অবিশ্বাস্য চাহনিতে চাইলো যেন এ মুহুর্তে এমন কিছু বলে ফেলেছি যা আমার বলা একেবারেই সাঁজে না! সে বেশ খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-‘ এই মেহু, কি হয়ছে তোর, সত্যি করে বল তো? তুই আবার আমায় ‘আপনি’ করে ডাকতে শুরু করলি কবে থেকে?
সে এবার কিছুটা থেমে আবারও বলল
-‘ আমি খেয়াল করেছি আয়ুশীকে দেখার পর তুই যেন কেমন বিহেভ করছিস। শোন আয়ুশী মেয়েটা কিন্তু বেশ ভালো। তবে তুই তো প্রথম দেখাতেই দেখছি ভাবির প্রতি জেলাস ফিল করা শুরু করে দিয়েছিস। এরপর আবার ননদ ভাবি মিলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে না ফেলিস।
শেষোক্ত কথাটা আদ্রিশ বেশ বিদ্রুপের সহিত বলল।
তার মুখ থেকে ‘আয়ুশী’ নামটা শুনে আমার বুকে গিয়ে একদম বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধে। মর্মবিদ্ধ হরিনীর ন্যায় চেয়ে রইলাম তার দিকে। মনে মনে আওড়ালাম, ‘মেয়েটার নাম তবে আয়ুশী।’
আদ্রিশ ভাইয়া এবার অধরের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল
-‘ কি রে তোর ভাবিকে সত্যিই পছন্দ হয়নি মেহু?
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম। আদ্রিশ ভাইয়ার বুকে গিয়ে একেবারে হামলে পড়লাম। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় আদ্রিশ। সে নড়াচড়া করতেও যেন ভুলতে বসেছে এ মুহুর্তে! সে কখনো ভাবেনি মেহরুন হঠাৎ এমন করে বসবে। নিজেকেই তো সামলানো এখন বড় দায় হয়ে পড়েছে, মেহরুনকে কিভাবে সামলাবে তবে!
আদ্রিশ দ্রুত ছাড়িয়ে নেয় নিজের থেকে মেহরুনকে। ছিটকে দূরে সরে বসে সে। অন্যদিক ফিরে ঘনঘন শ্বাস টেনে নেয়। একটুর জন্য তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মেহরুনের হঠাৎ এমন আক্রমণাত্মক স্পর্শে তার সমস্ত শরীর শিরশির করছে যেন! শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেছে মেহরুনের কোমল স্পর্শে! মেয়েটা কেন এতো অবুঝ! ইচ্ছায় মেহরুন থেকে দূরে দূরে থাকতে চায় আদ্রিশ!
আমি এবার ধরা গলায় বললাম
-‘ তুমি এমনটা কিভাবে করতে পারলে আদ্রিশ ভাইয়া? আমি তো তোমাকে আমার নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম তাহলে?
আদ্রিশ ভাইয়া স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি যে হুট করে এমন কথা বলে বসব তা হয়তো তিনি ভাবেননি কখনো। কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর সে আড়ষ্ট কন্ঠে আওড়াল
-‘ তুই এখন যথেষ্ট বড় হয়েছিস মেহু। এমন হুট করে বড় ভাইদের ধারে কাছেও ঘেষবিনা। এসব পাগলামি ছেড়ে, মন দিয়ে পড়াশোনা কর।
আমি তার আরেকটু কাছে গিয়ে কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বললাম
-‘ বেশ করেছি, আমি আরও কাছে আসবো তোমার। কি করবে করো?
আদ্রিশ ভাইয়া কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ চেচিয়ে বলল
-‘ থাপড়ে তোর গাল একদম লাল করে ফেলবো মেহু। তুই কি আদৌও কিছু বুঝিস না নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করিস? এখন থেকে আমার কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকবি। আমার ধারে কাছেও ঘেষবিনা। অভদ্র মেয়ে, বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরতে তোর লজ্জা করেনা?
লাজ লজ্জা ভুলে আমি নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলাম
-‘ না একটুও করেনা। আমি আমার শাশুড়ির ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছি তাতে তোমার কি?
আদ্রিশ তব্দা খেয়ে যায়। দুদিনের পিচ্চি মেয়েটা বলে কি এসব? যেখানে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়ার কথা সেখানে কাটকাট গলায় জবাব দিচ্ছে। কিছুটা ভেবে আদ্রিশ বাঁকা হাসে। মাথার মধ্যে তারও দুষ্ট বুদ্ধি কিলবিল করছে যে।
কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে চলে যেতে নিলেই আমি করুণ কন্ঠে বলে উঠলাম
-‘ আমার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখো – আমার এই ডাগর চক্ষুদ্বয়, ঘন ভ্রুযুগল, বটবৃক্ষের ন্যায় ঘন কালো নেত্রপল্লব, সরু নাক, শুভ্র গায়ের রং, আর ঘন লম্বা এলোকেশী চুল কোমড় ছাপিয়েছে। একটা নারীর সৌন্দর্যে এছাড়া আর কি চাই! যা দরকার তা সবই আমার মাঝে বিদ্যমান! আমি তো কম সুন্দরী নই, তাহলে আদ্রিশ ভাইয়া কেন ভালোবাসলে না আমায়? আচ্ছা তুমিই বলো কি নেই আমার মাঝে যা তুমি ঐ মেয়েটার মাঝে দেখলে?
আমার কথায় আদ্রিশ ভাইয়া থমকে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল
-‘ কোন মেয়েটা?
আমি কাটকাট গলায় জবাব দিলাম
-‘ কোন মেয়েটা তুমি সত্যিই বুঝতে পারছো না আদ্রিশ ভাইয়া?
আদ্রিশ ভাইয়া ‘না’ সূচক মাথা নাড়ায়। তার এহেন কর্মকান্ডে আমার মেজাজ তরতর করে বেড়েই চলেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে থমথমে গলায় বললাম
-‘ আমি আয়ুশীর কথা বলছি।
আদ্রিশ ভাইয়া বিষ্ময় নিয়ে বলল
-‘ তোর কি মাথায় ব্যামো হয়েছে নাকি শরীর খারাপ? নিশ্চয়ই ফুচকা খেয়ে তোর মাথা আউলায় গেছে। বারবার করে বলেছিলাম ওতো ফুচকা একসাথে খাস না। আমার কোনো কথাই তো তোর কান অবধি পৌঁছায় না। বলি, কথা বলার সময় কি কান খুলে জামার হাতার মধ্যে গুঁজে রাখিস? মর্কট কোথাকার।
আমি এবার ভীষণ রেগে গেলাম। বাজখাঁই গলায় বললাম
-‘ দশ প্লেট ফুচকা আমি একা খাইনি। তোমাদেরও ভাগ দিয়েছিলাম ওখান থেকে। আমায় দেখলে কি তোমার রাক্ষসী মনে হয় যে দশ প্লেট ফুচকা আমি একাই সাবরে দিবো।
আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে।
আমি এবার চোখমুখ শক্ত করে বললাম
-‘ আমি যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও। একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবেনা।
আদ্রিশ ভাইয়া ইনোসেন্ট ফেস করে বলল
-‘ জো হুকুম ম্যাডাম।
-‘ আয়ুশী নামের মেয়েটার সাথে তোমার কতদিনের সম্পর্ক?
আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া এবার চিৎকার করে বলে উঠল
-‘ আস্তাগফিরুল্লাহ, পরের বউয়ের সাথে আমার কতদিনের সম্পর্ক মানে? এসব কি নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথাবার্তা বলছিস মেহু? তোর মাথায় সত্যিই ব্যামো হয়েছে।
আমি ভ্রু কুটি করে বললাম
-‘ পরের বউ মানে? নিজের বউকে কেন পরের বউ বলে চালাচ্ছো?
-‘ তুই থাম। উজবুক কোথাকার। শেষমেশ আয়ুশীরে আমার বউ বানায় দিলি? ছিহ্! আয়ুশী তোর ভাবি আমার ভাবি সবার ভাবি লাগে। মানে ও তোর আপন মায়ের পেটের ভাই আলভির দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র গার্লফ্রেন্ড। তোর ভবিষ্যত ভাবি!
আমি হা করে চেয়ে রইলাম আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে। ছিহ! এতোক্ষণ কতোকিছু ভেবে ফেলেছিলাম এই মানুষটাকে নিয়ে। আমি আসলেই একটা উজবুক। না বুঝে শুধু শুধু ভুলভাল ভেবে কান্নাকাটি করছিলাম। আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। যাক আমার আদ্রিশ ভাইয়ার উপর অন্য রমনীর কুনজর পড়েনি তবে। মনে মনে ভেবে স্বস্তি পেলাম বেশ।
আমাকে অবাকের চরম পর্যায়ে ফেলে দিয়ে আদ্রিশ ভাইয়া বলে উঠল
-‘ শোন একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, আমি রিশতা আর অরনীকে যেমন বোনের নজরে দেখি, তোরেও ঠিক তেমন বোনের নজরেই দেখি। তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলবি। একদম আমার আশেপাশে ঘেষার চেষ্টা করবিনা বলে দিলাম।
কথাটা আমার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়ে সে গটগট পদধ্বনির আওয়াজ তুলে প্রস্থান করে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। সবেমাত্র মনে একটু আশার প্রদীপ জ্বলেছিল আর তার মাঝে এক বালতি সমবেদনাস্বরূপ জল ঢেলে দিয়ে চলে গেল আদ্রিশ ভাইয়া। এনাকে নিয়ে আমি সত্যিই হতাশ!
#চলবে~
গল্পটা এত্তো সুন্দর হচ্ছে যে আপনারা আবেগে আপ্লুত হয়ে রেসপন্স করতেই ভুলে যাচ্ছেন। কি দারুন না ব্যাপারটা!🧛♀️
সবাই রেসপন্স করবেন সবাই ফলো দিয়ে রাখুন যাতে পর্ব মিস না হয় ধন্যবাদ সবাইকে ❤️
পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করুন।।