#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব -৩১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
চেরি ফুল দেখতে ভীষণ সুন্দর। জাপানি মেয়েদের সৌন্দর্যের রহস্য লুকিয়ে এই বিশেষ ফুলেই। বহু প্রাচীন কাল থেকেই রূপচর্চায় জাপানে ব্যবহার করা হয় চেরিফুল। জাপানিদের কাছে চেরি ব্লসম একটি ক্ষণস্থায়ী এবং আভিজাত্যের প্রতীক। জাপানিরা সীমিত ফুলের সময়কালে চেরি ব্লসম গাছকে উদযাপন করতে এবং লালন করতে ভালোবাসে এবং অনেক লোক হানামি নামে পরিচিত ‘ফুল দেখার’ পার্টি আয়োজন করে । সে দেশে চেরি ফুল সাকুরা নামে পরিচিত। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত জাপানে ফোটে এই চেরি ফুল। সবচেয়ে বেশি ফোটে মার্চ-এপ্রিলে। যে কারণে সেখানে বসন্তের দূত বলা হয় চেরি ফুলকে।
জাপানি শব্দ হানামির অর্থ—সবাই মিলে চেরি ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা। প্রতি বসন্তে স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীরা জাপানজুড়ে উদ্যানগুলোতে চেরি ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। জাপানিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন চেরি ব্লসম মৌসুমের আগমনের জন্য। লাখ লাখ পর্যটক এই সময়ে জাপান ভ্রমণে বের হন। আবহাওয়ার কারণে সব শহরে একই সময়ে ফুল ফোটে না। হরেক কিসিমের রঙের হলেও হাল্কা গোলাপি, প্রায় সাদা চেরি ফুলটিই সব চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। জাপানি সাহিত্য ও শিল্পে ‘বসন্তের দূত’ হিসেবে বিখ্যাত এই ফুল।
সুইজারল্যান্ডে এপ্রিল মাস। চেরি ফুল ফুটে গেছে ইতিমধ্যে। সুইজারল্যান্ডে খুব কম সংখ্যক চেরি ব্লসম রয়েছে। চেরি ফুল বা চেরি ব্লসমের সাথে আমরা প্রায় সবাই কমবেশি পরিচিত। গোলাপি বা সাদা রঙের অপূর্ব সুন্দর এই ফুল পছন্দ করেনা এরকম মানুষ বিরল। চেরি ব্লসমকে জাপানের জাতীয় ফুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপে, 19 শতকের শেষ থেকে 20 শতকের গোড়ার দিকে, কলিংউড ইনগ্রাম, একজন ইংরেজ, জাপানি চেরি ফুল সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করেছিলেন এবং বিভিন্ন শোভাময় জাত তৈরি করেছিলেন এবং চেরি ব্লসম দেখার সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।
এখন চেরি ব্লসম এর সময়। রুদ্র যে বিল্ডিং এ থাকে সেই সেই বাড়ির চারিদিক চেরি গাছে পরিপূর্ণ। পুরো রাস্তা জুড়ে রয়েছে পাতাবিহীন চেরি গাছ। তটিনীর এই জিনিসটা খুব অবাক লাগে আবার ভালোও লাগে, পুরো গাছে একটা পাতাও নেই ! শুধু ফুল আর ফুল। গোলাপি, সাদা ফুলে ফুলে প্রকৃতি যেন নিজের রুপ লাবন্যের জলসা সাজিয়েছে।
তটিনী মুগ্ধ চোখে চেরি ফুল দেখছে। হাত দিয়ে ছুয়ে দিলেই যেনো মূর্ছা যাবে এই ফুল। তার ফুল কুড়াতে ইচ্ছে করছে। রুদ্র তটিণী-র কিছু ছবি তুলে নিলো। তটিনী ছবি পেয়ে মহাখুশি। রুপান্তরকে এবার জ্বালিয়ে শেষ করা যাবে এটা দেখিয়ে।
তারপর দুজন লেক দেখতে গেলো। খুব আশ্চর্যজনক সুন্দর একটি লেক। তটিনী ও রুদ্র নৌকাতে চড়ে লেকে চারিদিকে ঘুরতে লাগলো। হঠাৎ নৌকা দুলে শব্দে উঠলো। নৌকায় বৃদ্ধ দম্পতি একজন আরেকজনের হাত ধরে আছে শক্ত করে। দুজনেই লাইফ জ্যাকেট পরা , তারা বোটে উঠতে ভয় পাচ্ছে সম্ভবত। নৌকার চালক খুব যত্ন করে তাদের নিয়ে বসালেন। বৃদ্ধ দম্পতির চোখে অপার আনন্দের ছোঁয়া।
মনে হচ্ছিল কোনরকম ঝড়ঝাপটা ছাড়া খুব আনন্দে কেটেছে তাদের পুরোটা জীবন। এই বৃদ্ধ বয়সেও দুজনের মধ্যে কি মিল, কি প্রেমময় সম্পর্ক ! একজন আরেকজনের হাতও ছাড়ছে না।
শীতকালের ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে লাগছে। লেকের চারিদিকেও রয়েছে চেরি ফুল। চেরি ফুলের সৌন্দর্য পানিতে আরো সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। তটিনীর চোখে এক অন্যরকম আনন্দ ঝিলমিল করছে। রুদ্র মৃদু হেসে তার দিকে তাকালো।
তটিনী নিজের অজান্তেই কেমন শান্তি বোধ করছে। পানিতে নিজের হাত ডুবিয়ে দিলো সে, ঠান্ডায় যেন হাত জমে যাচ্ছে তার পরেও বের করতে ইচ্ছা করছে না! রুদ্র পানিতে নিজের হাত ডুবিয়ে তটিণী-র হাত মুঠো করে ধরলো। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। তটিণী খেয়াল করে দেখলো সেই বৃদ্ধ দম্পতি ও সেম কাজটাই করছেন। জীবনে আসলে সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না। একটা ভালোবাসার মানুষই পারে জীবনের সব দুঃখ এক নিমিষেই উধাও করে দিতে। পৃথিবীতে এমন অহরহ মানুষ রয়েছে যাদের ছোটবেলা থেকে বড়বেলা কাটে কষ্টে। কিন্তু একটা সময় পর যখন তাদের প্রিয় মানুষ হয় তখন তারা সব দুঃখ ভুলে যায়। প্রিয় মানুষ পেয়ে তারা এতো খুশি হয় যে আগের পাওয়া সব দুঃখ সেই সুখের কাছে খুব কম মনে হয়। হাজার হাজার দুঃখ যন্ত্রণা নিরাময়ের খুবই সহজ একটি মাধ্যম হলো প্রিয় মানুষ! লক্ষ কোটি কারণের একটাই সমাধান! সুন্দর না?’
রুদ্র ও তটিণী-র লেক ঘুরাঘুরি শেষ হলো। তারা বৃদ্ধ দম্পতির সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। বৃদ্ধ দম্পতি তাদের মাথায় হাত ভুলিয়ে তাদের প্রভুর নাম নিয়ে দোয়া করে দিলেন। রুদ্র ও তটিনী বিনা দ্বিধায় তা গ্রহণ করলো। বৃদ্ধ নিজের বাড়ির ঠিকানা দিলেন। রুদ্র ও তটিনী তার বাড়িতে গেলে তিনি অত্যন্ত খুশি হবেন। রুদ্র কথা দিলো না, তবে কখনো সেদিকে যাওয়া হলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
তারা বিদায় নিলো। রুদ্র ও তটিনী হাতর হাত রেখে ঘুরলো শহরের প্রতিটি কোণা। সুইজারল্যান্ডের মধুচন্দ্রিমাটার স্থায়িত্ব ছিল সাতদিন। তটিণী সাতদিন পর যখন এয়ারপোর্টের পৌছালো। রুদ্রের সে কি পাগলামি। তটিনী তো একপায়ে থেকে যেতে রাজি। কিন্তু রুদ্র নিজেকে সামলে নিলো। তটিনীর পড়াশোনা রয়েছে। বেঁচে থাকলে আবারও মধুচন্দ্রিমা হবে না-হয়। বুকে পাথর বেঁধে তটিনীকে বিদায় দিলে সে। তটিনী চোখের জল মুছতে মুছতে বিমানে চেপে বসলো। আর কবে দেখা হবে? আর কবে একসাথে তুষারপাত দেখবে তারা? আর কবে চেরি ব্লসমের সুভাসে মাতোয়ারা হতে পারবে সে? আর ওই বৃদ্ধ দম্পতি? তাদের বাড়িতে কি যাওয়া হবে তার কখনো? উত্তর মেলে না। তবে ভেতর থেকে কেউ বলে রুদ্র যতোদিন আছে ততোদিন তোমার কোনো চিন্তা নেই তটিনী। চাপ নিও না রুদ্র সব পারে। রুদ্র তার তটিণী-র জন্য সব করবে।
তটিনী চোখের জল মুছে হাসলো। ঠিকই তো রুদ্র যখন বলেছে আবারও হবে তারমানে তাদের আবারও এই সুইজারল্যান্ডের মাটিতে পা রাখা হতে পারে। রুদ্র নিশ্চয়ই এমনি এমনি আশ্বাস দেয়নি। বিমান ত্যাগ করে আকাশে উড়ে গেলো। এয়ারপোর্টের বাহিরে দাঁড়ানো তটিণী-র শুভ্র মানবটি চোখের কোণের জল মুছে নিলো খুব গোপনে।
সে ক্লান্ত পথিকের মতো সুইজারল্যান্ডের সন্ধ্যায় ঘেরা পথে হাঁটতে শুরু করলো। সে জানেনা আজ তার গন্তব্য কি। শুধু জানে তাকে হাটতে হবে। একা হেঁটে আবারও অভ্যস্ত হতে হবে। সাথে দিতে হবে মনের বাড়াবাড়ি রকমের ইচ্ছেদের জলাঞ্জলি। এই যে তার মন বাড়াবাড়ি রকম ইচ্ছে পোষণ করছে। তার মন বলছে তটিনী বিমানে উঠেনি। কিন্তু সে জানে তটিনী বিমানে উঠেছে। মন বলছে তটিনী এখনি হয়তো দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। বলবে, ‘আপনাকে ছাড়া থাকতে পারি না, যাবো না কোথাও। যদি যেতে হয় আপনার সাথেই যাবো।’
হ্যাঁ তটিনী এটা বলেছে রুদ্রকে। কিন্তু বিমানে উঠার আগে। কিন্তু রুদ্র মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তটিনীকে থামিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে আমাদের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের ভালোর জন্য অনেক কিছু করতে হয়। এটাতেই তাদের ভালো হবে। সেজন্য সে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তটিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে পথিক নিজ মনে শুধালো,
‘তুমি আজ চলে গেছো বলে মধুচন্দ্রিমার চন্দ্র থমকে গেছে। তুমি চলে গেছো বলে নিস্তব্ধ ফ্লাটটি আজ একা পড়ে আছে। তুমি চলে গেছো বলে তোমার আমার বেডরুমটি আজ দুটি মানুষের আলিঙ্গনের অভাবে ভুগছে। অবশেষে তুমি চলে গেছো বলে চেরি ব্লসমের গাছ থেকে কমেনি আর একটিও ফুল। কেউ তাকে আবদার করে বলেনি ‘তোমার গাছ থেকে একটি ফুল নেই?’ এক ক্লান্ত পথিকের বুক পুড়ছে, সে থমকে গেছে তোমাতে। তোমাকে নিয়ে সাজানো দুনিয়াতে। তোমার আমার আবার দেখা হোক। সুইজারল্যান্ডের মাটিতে আবারও আমাদের মধুচন্দ্রিমা হোক। প্রিয় ঐশি!
(চলবে)