হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব১১

0
118

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১১

পেছন ফিরে আলভি ভাইয়াকে দেখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক বাবা এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম তবে! আমি আগেই বুঝেছিলাম এমন ঘর কাঁপানো হাসি আমার ভাই ছাড়া কেউ দিতেই পারেনা। আর ঐ গোমড়ামুখো কুমড়ো পটাসটার পক্ষে তো মোটেও সম্ভব নয়।

আলভি ভাইয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসল। অধরের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল

-‘ সারাবছর তো বইয়ের ধারে কাছেও নেওয়া যায়না তোকে। আর এখন তো পড়াশোনার ঝামেলা নেই তো কি এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছিস এখন?

আমি ডায়রিটা বন্ধ করে, আলভি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সত্য গোপনে রেখে তাই মিথ্যে বানিয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম

-‘ একটা নতুন ডায়রি কিনেছিলাম, সেটাই উল্টে পাল্টে দেখছি আরকি।

আলভি ভাইয়া এবার কিছুটা ঠাট্টার ছলে বলল

-‘ ওহ তাই তো বলি, যে মানুষ সারাবছর পড়ার ধারে কাছেও যায়না। সে কিনা এই অবসরে পড়বে, এটা তো একটা ভৌতিক ব্যাপার!

আলভি ভাইয়ার কথায় আমি চটে গেলাম। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম

-‘ কি বললি ভাইয়া?

-‘ ক্ষেপিস না বইন। মজা করছিলাম। একটু আধটু কি মশকরাও করতে পারব না তোর সাথে?

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম

-‘ তাই বলে তুই আমাকে এভাবে অপমান্স করবি ভাইয়া? দিস ইজ নট ফেয়ার কিন্তু!

আলভি ভাইয়া আলতো হেসে বলল

-‘ তুই আমার বোন তুই আমার মতোই হবি। তোর অত বেশি পড়াশোনার কোনো দরকার নেই, বুঝলি। যারা বেশি বেশি পড়ে তারা হয় বেশিদিন বাঁচেনা নয়তো পাগল টাগল হয়ে পাগলাগারদে আশ্রয় নিতে হয়। যেমন আমাদের সবার প্রিয় আদ্রিশ ব্রো।

শেষোক্ত কথাটা বলে আলভি ভাইয়া হো হো করে হেসে ওঠে। আমিও তাল মিলিয়ে হেসে ফেললাম। একমাত্র আমার ভাই-ই পারে আদ্রিশ ভাইয়াকে সেই লেভেলের রোস্ট করতে তবে সামনাসামনি এমন ভন ধরবে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা! আলভির ভাইয়ার হাসির তোড় এতোটাই তীব্র ছিল যে মনে হলো আমাদের বাড়ি সুদ্ধ কেমন কেঁপে উঠল যেন।
আমি হাত দিয়ে কান চেপে তাই বললাম

-‘ ভাইয়া আস্তে হাস, হয়তো এই বাড়ি ভেঙে পড়বে নয়তো আমি চির বধির হয়ে যাব।

আলভি ভাইয়া হাসি থামিয়ে সরু চোখে তাকায়। থমথমে গলায় বলল

-‘ সবাই আমার হাসির প্রশংসা করে আর তুই আমার বোন হয়েও এমনভাবে বলতে পারলি?

আমি সূক্ষ্ম হেসে বললাম

-‘ মশকরা করছিলাম ভাইয়া। কি যেন বলছিলি?

আলভি ভাইয়া এবার হতাশ কন্ঠে বলল

-‘ জানিশ মেহু, আদ্রিশ ভাই যে কি পাগলের মতো করে পড়ত। বাপ রে বাপ! মানুষ ওতো পড়ে কেমনে? আমাদের বংশে ঐ এক পিসই একটা চিজ!

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম

-‘ উনি তো একটা বদ্ধ উন্মাদ! কখন কি বলে আর কখন কি করে তা বোঝা ভার! কে বলবে উনি আমার শান্তশিষ্ট ভালো মামনিটার একমাত্র বেয়াড়া কুমড়ো পটাসমার্কা স্পেশাল চাইল্ড!

আলভি ভাইয়া আমার কথা শুনে আবারও হো হো করে হেসে ওঠে। আমি বুঝিনা এই বান্দা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, এতে এতো হে হে করার মতো কি আছে আশ্চর্য! আমার সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্রুপ করে সে বলল

-‘ বেচারাকে শেষমেশ স্পেশাল চাইল্ড বানায় দিলি। ভাগ্য ভালো যে আমরা কেউ-ই ভাইয়ের মতো ওমন পাগল হইনি রে। এখন তো তোকে নিয়ে ভয় হচ্ছে, তুইও না আবার আদ্রিশ ভাইয়ের মতো পাগল টাগল হয়ে যাস।

আমি ভ্রু কুটি করে বললাম

-‘ আশ্চর্য আমি কেন পাগল হতে যাব?

-‘ কারণ তোরা দুজনই সাইন্সের স্টুডেন্ট। আর আমি তো কমার্সের স্টুডেন্ট, এইজন্য আমার সাথে খুব একটা পেরে উঠতে পারেনি। তোর এসএসসির আগে যেমনে ধরে বেঁধে তোকে পড়তে বসাতো, জাস্ট চিন্তা কর ইন্টারে কি করবে ভাই? একবার কি হয়েছিল জানিস, আদ্রিশ ভাইয়ের এমন পাগলের মতো পড়া দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই আপনি কি পৃথিবীতে নতুন? আর কেউ তো এমনে পড়ে না।’ তখন সে আমায় উত্তরে ‘ছাগল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো আলভি ভাইয়ার। আমি হাসি চেপে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে ফেললাম। আলভি ভাইয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-‘ তোর ভাইকে ছাগল বলেছে বলে কোথায় তুই প্রটেস্ট করবি তা না তুই দাঁত কেলিয়ে হাসছিস?

আমি চুপ হয়ে গেলাম তবুও আমার হাসি পাচ্ছে ভীষণ। আলভি ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল

-‘ আদ্রিশ ভাই সবচেয়ে বেশি পাগল হয়ে গিয়েছিল কবে জানিস?

আমার না সূচক মাথা নাড়ালাম। আলভি ভাইয়া তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল

-‘ ভাই যেবার মেডিক্যাল অ্যাডমিশন দিবে, সেবার যে কি পাগলের মতো পড়ত। খাইতে গেলেও পড়ত, ওয়াশরুমে গেলেও পড়ত এমনকি ঘুমানোর মধ্যেও বিড়বিড় করে পড়ত। আর আমারে খালি বলত, ‘আলু এই এমসিকিউগুলা ধর তো আমারে।’ সে কি একটা অবস্থা, বাড়িতে একেবারে হুরুস্থল পড়ে গিয়েছিল। মানে চিন্তা কর, একটা মানুষ এমনে কেমনে পড়তে পারে? মেন্টাল না হইলে তো জীবনেও সম্ভব না।

আমি বিদ্রুপের সহিত বললাম

-‘ তুই জানিস না ভাইয়া, ডাক্তাররা এমনই পাগলই হয়! ব্যাটা নির্ঘাত কোনো পাগলের ডাক্তার। লজ্জায় হয়তো বলতে পারেনি আমাদের। ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছি উনার তো আবার লজ্জা বলতে কিছুই নেই।

আলভি ভাইয়া এবার স্বাভাবিক গলায় বলল

-‘ তবে পাগল হলেও মেধাবী ছিল নয়তো কেউ এমনি এমনি সাইত্রিশ তম হয়না ডিএমসির মতো একটা জায়গায়!

আমি মাথা নাড়ালাম। যতো নিন্দাই করিনা কেন নিঃসন্দেহে সে একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। এমনকি সে আমার পড়াশোনা নিয়েও যথেষ্ট পজেসিভ। তার এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে। পড়াশোনার ব্যাপারে সে সর্বদা আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা মানুষ আসলে সবদিক দিয়ে খারাপ হয়না, কিছু ভালো গুণও থাকে তার মাঝে।

আদ্রিশ ভাইয়া সম্মন্ধে তীব্র সমালোচনার পর আমিই নিজ থেকে বললাম

-‘ থাক বাদ দে তো, শুধু শুধু পাগলের প্রলাপ বকে কি লাভ?

-‘ হ্যাঁ তাই তো। থাক বাদ দেই।

প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাই আমি বললাম

-‘ রিশতা আর অরনী ঠিকভাবে পৌঁছেছে ওদের দাদু বাড়িতে?

-‘ হ্যাঁ আদ্রিশ ভাই গিয়েছে ওদের ড্রপ করতে। তোকেও তো কত করে যেতে বললাম কিন্তু তুই তো গেলি না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিকটা আলসে ভঙ্গিতে বললাম

-‘ ওতো দূরের পথে আমার যেতে মন চায়না ভাইয়া।

-‘ কোথাও না গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবি তাহলে?ঘরে থেকে থেকে তো ফার্মের মুরগি হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। সন্ধ্যায় বের হব আমরা। আমাদের সাথেই তুই যাবি ব্যাস এটাই আমার শেষ কথা।

কথাবার্তার পাঠ এখানেই মুলতুবি করে আলভি ভাইয়া উঠে চলে যায় তার ঘরে। আমি আবারও ডায়রিটা সামনে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম, নাহ কিছু নেই। একইরকম দেখতে একদম নতুন ডায়রি। ব্যাটা কত বড় শেয়ানা, ডায়রিটাই পাল্টে ফেলেছে। পরক্ষণেই কিছু একটা নজরে পড়তেই মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আমার। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।

আমার প্রিয় মেহরুন রঙের একটা সফট কটনের থ্রিপিস পরে মাথায় বেশ খানিকটা ওড়নাটা টেনে নিলাম। আয়নায় নিজেকে একবার পরোখ করে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। মা, মামনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আলভি ভাইয়ার সাথে চলে এলাম। গাড়ির কাছে আসতেই দেখা হলো এক রমনীর সাথে। প্রথম দেখাতেই তাকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধে হয়না, ইনি সেই আয়ুশী ভাবি। আলভি ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে আয়ুশীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল

-‘ মেহু, ও হচ্ছে আয়ুশী, আমার বেস্টফ্রেন্ড। আর আয়ুশী ও হচ্ছে আমার বোন।

আমি তো আয়ুশীকে আগে থেকেই চিনি। সত্যিটা বলে দিলেই তো পারত, এতে এতো ভণিতার কি দরকার ছিল!

আমার মনের কথাটা কেড়ে নিয়ে গাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে আদ্রিশ ভাইয়া অধরের কোণে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে ঠাট্টার ছলে বলল

-‘ ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ কিন্তু তুই। প্রথমে ক্লাসমেট থেকে জাস্টফ্রেন্ড, তারপর জাস্টফ্রেন্ড থেকে বেস্টফ্রেন্ড, এরপর তো ডিরেক্ট গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললি। এখন শুধু বউ বানানোটাই বাকি।

আচমকা আমার সামনে আদ্রিশ ভাইয়া হতে এমন বাক্যচয়ন শুনতে হবে তা হয়তো কল্পনা করেনি আলভি ভাইয়া বা আয়ুশীর কেউই। আয়ুশী লজ্জা পেল ভীষন। আলভি ভাইয়াও গলা কাখারি দিতে আদ্রিশ ভাইয়ার পাশের সিটটাতে বসে পড়ল। আমি আর আয়ুশী গিয়ে পেছনের সিটে বসে পড়লাম। কোথাও ঘুরতে গেলে আমার সাথে প্রত্যেকবার অরনী বা রিশতা থাকে কিন্তু এবার নেই বলে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। তবে আয়ুশী ভাবি অন্যরকম মানুষ। একই ইয়ারে পড়ার সুবাধে মেয়েটা আলভি ভাইয়ার বয়সীই হবে। তবে আয়ুশী ভাবি বেশ কথারু এবং চটপটে স্বভাবের। আমিও কিছুটা খুব মিশুক প্রকৃতির। ঘন্টা দুয়েকের এই পরিচয়ে আমাদের বন্ধুত্ব মনে হচ্ছে যেন কতকালের!

গাড়ি এসে থামল ব্রিজের কাছে এসে। আমরা সবাই নেমে পড়লাম চট করে। দুপুরের ভ্যাপসা গরম ভাবটা মিলিয়েছে কিছুটা। প্রান্তর ছুঁয়ে এখন ধেয়ে আসছে মাতাল করা হাওয়া। আকাশে আজ পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। চারপাশে কেমন ঝলমল করছে রঙ বেরঙের আলোয়। আমার কাছে ভালোই লেগেছে পরিবেশটা।
আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী ভাবি নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি হলাম না ওদের মাঝে।

চোখ বুঁজে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলাম, ভেতরটা যেন শীতল হয়ে এলো। দূর অন্তরীক্ষের পানে চোখ রেখে প্রকৃতি বিলাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আদ্রিশ তার প্রেয়সীর পানে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল পলকহীনভাবে। ইশ শত অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখাটা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে তো তার জন্য। তার ধারণা, “এটুকু বয়সে প্রেম জিনিসটা একেবারেই বেমানান, এসব কারণে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। আগে পড়াশোনা তারপর সব। অন্ততপক্ষে মেয়েদের পড়াশোনা করে নিজের পায়ে আগে দাঁড়ানো উচিত। পিচ্চি এই মেয়েটার ভালোর জন্যই তো এমন করে অথচ সে কত অবুঝ!” এজন্য কতটা দূরে সরে থাকতে হচ্ছে তাকে। কথাটা ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

#চলবে~

সবাই ফলো দিয়ে রাখুন যাতে পর্ব মিস না হয়।

পেইজঃ Bindas Life

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here