#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৭
বেলকনির রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এখন সময়টা পড়ন্ত বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার ঠিক আগ মুহুর্ত। অস্তায়মান সূর্যের রক্তিম আলোকছটা মেলায়নি এখনো। দৃশ্যটা মনোমুগ্ধকর! তবে আমার কাছে নয়। একরাশ অবহেলা, অভিমান আর মেহনত আমার মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে প্রতিনিয়ত।
আমার আসলেই গতকাল উচিত হয়নি আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে ওমন আচরণ করা। মনের কোণে যার অবাঁধ বিচরণ তার পাশে অন্য একটা মেয়েকে দেখলে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত তা আমার জানা নেই। এসব দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি তাই রাগের বশবতী হয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত অভিমানেরা অভিযোগে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে অনুধাবন হতেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। কাল সারারাত আমার আর ঘুম হয়নি। আমার একটা বাজে অভ্যেস আছে – আমি আবেগ জিনিসটাকে একদমই নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। আর কোনো কারণে আমার মেজাজ বিগড়ে গেলে আমি কি বলি বা কি করি তা আমি নিজেও জানিনা। পরে বোধগম্য হতেই আফসোস ছাড়া আর উপায় থাকেনা।
আজকে না আমি আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে পড়েছি। আর না সে আমার সামনে এসেছে। আদ্রিশ ভাইয়া ঠিকই বলে আমি শুধু গায়ে পায়েই বড় হয়েছি আমার বুদ্ধি জ্ঞান এখনো হয়নি। কথাটা ভেবে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তার ভাষ্যমতে, “আমি নাকি আবেগে গা ভাসাচ্ছি। আদ্রিশ ভাইয়া আমার জীবনে নিছক স্বপ্নমাত্র।” যাকে ধরা ছোঁয়া যায়না শুধু কল্পনায় অনুভব করা যায়। সে কি সত্যিই আমার অনুভূতির অন্তরালেই পড়ে রইবে চিরকাল? আকাশের পানে চেয়ে বিষাদমাখা কন্ঠে আওড়ালাম,
-‘ “তারে আমার ছুয়ে দেখার সাধ্য নেই
তবুও কেন এতো অনুভবে রয়
তারে আমি বাস্তবে খুঁজি
সে কেন কল্পনায় রয়”
মামনির ডাকে আমার ভাবনার সুঁতো ছিড়ল। বেলকনি হতে ধীর পায়ে আমার ঘরে চলে এলাম। মামনি হাস্যজ্বল মুখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। হাতে তাঁর তেলের বাটি। বুঝলাম তিনি আমার মাথায় তেল দেওয়ার জন্যে এসেছেন।
মামনি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। আমার দু’গালে হাত রেখে চিন্তিত সুরে বললেন
-‘ তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন মেহু? তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ মা?
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন
-‘ দুপুরে খাবার টেবিলে আমাদের সাথে একসাথে বসে খেলি না। কত করে ডাকলাম তাও তো এলি না।
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা এসে হাজির হলেন আমার কক্ষে। মামনির কথা শুনে মা আক্ষেপ করে বলে উঠলেন
-‘ আর বলো না ভাবি। খাবে না মোটে, জোর করে খাওয়ানোতে একটু খেলো যা। এবয়সে এতো জেদ মেয়েটার! একে নিয়ে সত্যিই আর পারিনা বাপু।
মায়ের দিকে ফিরে তাকালেন মামনি। আলতো হেসে বললেন
-‘ থাক মেয়েটাকে আর বকো না। এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কি বকা যায়?
-‘ ওকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়েছো তোমরা। হয়েছে তো একটা লক্ষ্মী ছাড়া বাঁদর! নইলে এই বয়সী মেয়েরা কোথায় ঘরের কাজ করবে তা না সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ানো আর বাঁদরামি করা, এর স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। কিছু বললেই ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে বুক ভাসাবে। বলি ভেতরে একটু ভারদার আন। বড় তো হয়েছিস যথেষ্ট, আর কতোকাল বাচ্চা থাকবি?
আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে একবার মায়ের দিকে চাইলাম। মা এমন কেন? এমনিতেই আমার মন খারাপ। তার উপর আবার এসব বলে আমার মনটাকে আরও খারাপ বানিয়ে দিচ্ছেন। মামনি হয়তো বুঝলেন আমার ব্যাপারটা। তাই তিনি শান্ত স্বরে বললেন
-‘ বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে আচরণিক পরিবর্তনও ঘটে। এই সময়টাতে ছেলেমেয়েরা বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এটা বয়সে এটা স্বাভাবিক বিষয়। আর তাছাড়া আমাদের মেহু তো এখনও ছোট, বড় হলে দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে। কি তাই না মেহু?
আমি ঠোঁট চেপে হেসে মাথা নাড়ালাম। মা-ও আর কিছু বললেন না। তার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সারাক্ষণ মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় থাকেন তিনি। যখন বাড়িতে একটা মেয়ের অভাবে সবাই প্রায় কাতর, ঠিক তখন কোনো এক ভোরে তার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিল এক ছোট্ট কন্যাশিশু। নাম রাখা হয়েছিল মেহরুন ইবনাত খান। সেই ছোট্ট মেহরুন আজ কত বড় হয়েছে! কিন্তু তার মাঝে থাকা দূরন্তপণা আর বাচ্চামো স্বভাবটা আর গেল না। কবে তার মেয়েটার একটু ভারবুদ্ধি হবে? এতো সহজ সরল আর আবেগপ্রবণ হলে তো চলবেনা! তিনি বয়সের ভারে কাঁবু না হলেও মেয়ের চিন্তার ভারে ঠিকই কাঁবু হয়ে পড়ছেন। এসব ভেবে বুকে ফুরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
মামনি আমার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললেন
-‘ এবার বল কি হয়েছে তোর মা? মন খারাপ করে ঘরে বসেছিলি কেন?
অনেকের চাচিরা নাকি খারাপ হয়! কিন্তু আমার মামনির মাঝে এমন কোনো লক্ষণের লেশমাত্র পাইনি আমি। তাঁর মাঝে শাশ্বত মায়ের রূপ ফুটে ওঠে! আমি কিছু বললাম না, মামনিকে জড়িয়ে ধরলাম। মন আমার ভীষণ খারাপ, এখন ভেতরে ভেতরে কেমন অপরাধবোধ কাজ করছে আমার। গতকাল আদ্রিশ ভাইয়াকে রাগের মাথায় বেহায়ার মতো যা বলেছি তা সারাজীবন আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে মারবে! ছোট বয়সে সত্যিই আমি এমন অবহেলা, মান অভিমানের বোঝা বইতে পারছিনা। আমি চাইলেও আমার আবেগকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা। যে মানুষটাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে নিজের ভেবেছি তার এমন অবজ্ঞা সত্যিই মেনে নেওয়া বড় কঠিন।
মামনি আমার চিবুক উঁচু করে ধরলেন। আমার চোখে পানি লক্ষ্য করে তিনি বললেন
-‘ বোকা মেয়ে হঠাৎ কাঁদছিস যে?
আমি হালকা হেসে বললাম
-‘ কই কাঁদছি, তুমি থাকতে কি কাঁদতে পারি আমি?
মামনি এবার হেসে আমার মাথায় তেল দিতে বসলেন। আমার চুলের ভাঁজে তেল দিতে গিয়ে আফসোসের সুরে বললেন
-‘ ইশ কতো সুন্দর চুল, তেল না দিয়ে দিয়ে কি করেছিস তুই? আমি যা হোক ধরে বেঁধে চুলে তেল দিয়ে দেই বলে চুলগুলো এখনো টিকে আছে। নইলে সবকটা ঝরে যেত!
মামনির কথায় আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে মা থমথমে গলায় বলে উঠলেন
-‘ আমি জানিনা তুই মন খারাপ করে কেন ঘরের মধ্যে বসেছিলি? তবে একটা কথা বলি, এতো আবেগি হয়ে যাসনা। আবেগ জিনিসটা বড্ড খারাপ। নিজের আবেগকে যদি নিয়ন্রণ করতে না পারিস তবে সবাই তোর আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। দূর্বল ভেবে তোকে হেয় করবে। তুই এখন আর বাচ্চা না, যথেষ্ট বড় হয়েছিস। নিজের মাঝে পরিবর্তন আন। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ কর।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা ভুল কিছু বলেননি। সত্যিই আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। আমার নিজেকে শুধরে নেওয়া উচিত!
মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে মামনিও বললেন
-‘ আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাস না মেহু। এই বয়সটা খুব খারাপ। কিছু লুকাতে গিয়ে বড় অঘটন বাঁধিয়ে ফেলিস না কখনো।
আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। মানুষগুলো আমার খেয়াল রাখে ভীষণ। আমায় নিয়ে কতটা ভাবে তারা। সত্যিই আমি ভাগ্যবতী তাদের মতো এমন আপনজন পেয়ে। তবে মায়ের পর মামনিই যেন একটু বেশি খেয়াল রাখেন আমার। অরনী আর রিশতার জন্যও মামনি তেমনটা করেননা যতোটা আমার জন্যে করেন।
তিনি এবার আমার চুলে বেঁণী করতে করতে বলতে লাগলেন
-‘ জানিস মেহু, ছোট থেকেই তোর প্রতি আমার ভীষণ মায়া। আমার কোনো মেয়ে নেই। একটাই মাত্র ছেলে। মেয়ে হয়নি বলে কতো আফসোস করেছি। যখন তুই ছোট বউয়ের কোল আলো করে এলি তখন থেকেই তোকে নিয়ে আমার স্বপ্ন! তোকে আমি নিজের মেয়ের মতো দেখি তখন থেকে। আমার ছেলেটারও কোনো ভাইবোন নেই বলে ও একটু কেমন একরোখা হয়েছে, তাই ওর ব্যবহারে কোনো কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ করে দিস মা। ছেলেটা আমার বড্ড ভালো মানুষ। ও তোকে ভালোবাসে ভীষণ। ওকে কখনো কষ্ট দিস না মা।
শেষোক্ত কথাটা শুনে আমি চমকে তাকালাম মামনির দিকে। মামনি আমার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললেন
-‘ ওমন করে তাকাচ্ছিস যে। শোন, আমার ছেলের জন্য আমি বাইরের কোনো মেয়ে আনবো না, বুঝলি? ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে৷ আমার ছেলের বউ করে আমার কাছে রেখে দিবো তোকে সারাজীবন।
মামনির কথা শুনে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। পরে বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ফেলল আমায়। মা কিছু বললেন না তবে মুচকি হাসলেন এসব দেখে আমি লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম। ইশশ এখন আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। লজ্জায় আর থাকতে না পেরে বেলকনিতে ছুটে চলে এলাম। পেছন থেকে শুনতে পেলাম মা আর মামনির অমায়িক হাসির ঝংকার!
হঠাৎ কাঁধে কারো শীতল স্পর্শে চমকে তাকালাম সেদিক পানে। অরনীকে দেখে স্বস্তি পেলাম। তবে সে আমায় অবাক করে দিয়ে বলল, “আদ্রিশ ভাইয়া নাকি আমায় ডাকছে।”
#চলবে~
আমার শরীরটা খুব বেশি ভালো নেই। তাই কি থেকে কি লিখেছি জানিনা। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং~