#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(১১)
_______________________________
(৪৪)
পার হয়ে গেলো সপ্তাহখানেক। প্রভা সারাদিন বাসায় একা থাকে। আরমান সকালে অফিসে যায় রাতে ফিরে আসে। প্রথম দিনের ন্যায় দুপুরে লাঞ্চ পাঠিয়ে দেয়। মারইয়াম ইউজিউয়েল অনেক বকাবকি করলেন ছেলেকে। সেইসবে পাত্তা দেয়নি আরমান। এরপরের সপ্তাহে আরমানকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ওর বন্ধুরা এলো কলোরাডো। ওদের কাছে বাসার চাবি থাকায় খুব সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারলো। তাছাড়া প্রতি সপ্তাহেই ওরা এখানে আসে। ছোটখাটো একটা পার্টি করে ফেলে। বাসার ব্যাকইয়ার্ডের প্রাঙ্গণে পার্টির ব্যবস্থা করলো ওরা সাতজনে। সেখানে আগুন জ্বালিয়ে বারবিকিউ করা হচ্ছে সাথে আরো অনেক কিছু। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় টুকটাক নানান আয়োজন সেরে ফেললো ওরা। অফিস থেকে বাংলোয় ফিরে ওদের দেখতেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলো আরমান। হাসিমুখে এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনিময় করলো সবার সাথে। আচমকা নিকুয়াল এগিয়ে এসে বলল,”আমরা এলাম প্রায় ঘন্টা পাঁচেক হলো। অথচ তোমার ওয়াইফ কামরা থেকে একটুও বেরুলো না। জিজ্ঞেস ও করলো না আমরা কেমন আছি ইত্যাদি। তোমার ওয়াইফ এমন কেন?ভেরী আনস্মার্ট! কোনো ম্যানার্স নেই।”
চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো আরমানের। আচমকা নিকুয়ালের গলা চেপে ধরে বলল,”যদি তোমার রক্ত হালাল হতো তাহলে তরবারী দিয়ে তোমার মাথা কে’টে ফেলতাম আমি।”
এমন কথা শুনতেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সবাই। আরমান রেগে গেলো কেনো বোধগম্য হলো না কারোরই। অ্যারোন বলল,”ওতো মজা করে বলেছে আরমান। এতো এগ্রেসিভ হওয়ার কি আছে? তুমি কি সত্যিই পাগল হয়েছো?”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো আরমান।
“বউ মজা করার জিনিস?”
“সেটা কখন বললাম?”
“পরপুরুষের মধ্যে আমার স্ত্রী এসে কি করবে? আর তিনি কামরায় কি করছেন তা ওর জানতে হবে কেন? স্মার্ট না আনস্মার্ট সেটা ওর জানা কি বেশি জরুরী?”
এমিল বলল,”ও বুঝতে পারেনি তুমি এতোটা হাইপার হয়ে যাবে। জানলে বলতো না। শান্ত হও।”
সবার থেকে নিকুয়াল একটু অন্যরকম। খুবই চটপটে। তাই মজা করেই বলেছে। সামান্য একটা কথার জন্য আরমান রেগে যাবে বুঝতে পারেনি। সমস্যা সমাধানের জন্য নিকুয়াল বলল,”দোস্ত স্যরি! বুঝতে পারিনি তুমি এতোটা হাইপার হয়ে যাবে। তবে আমরা তোমাকে জাস্ট পরীক্ষা করছিলাম তুমি তোমার স্ত্রীকে কতোটা ভালোবাসো। এর বেশি কিছু না।”
কামরার ভেতর থেকে সব শুনলো প্রভা। অলিভার বলল,”ঈদার্নিং কথায় কথায় তুমি রেগে যাচ্ছো! ব্যপারটা কি বলো তো?”
ম্যাথিউ বলল,”বিয়ে হয়েছে অনেকদিন হলো। বাসর হয়নি বোধহয়।”
ইভান বলল,”বউ বাসর করতে দেয়নি হয়তো।”
ফের রক্তিম চোখে তাকালো আরমান। সবগুলো ছিলো বিধর্মী। এখন নামের মুসলমান হয়েছে! এমিল বলল,”বাসরটা আজই সেরে ফেলার বন্দোবস্ত করো অ্যারোন।”
“তাই-ই করতে হবে দেখছি। বন্ধু তো আমার কথায় কথায় রেগে আগুন!”
আরমান চলে যেতে নেয়। অ্যারোন বলল,”এক পাও এগুবে না। সোজা হয়ে এখানে বসে থাকো।”
“ফ্রেশ হবো।”
অলিভার বলল,”একসাথে হয়ে নিও। এখন তুমি বাসায় যেতে পারবে না।”
নীরবে হার মানলো আরমান। ততক্ষণে অ্যারোন,এমিল,ইভান,অলিভার ফোন করে ওদের ওয়াইফ এবং ফিয়ন্সেকে নিয়ে এলো। মহিলারা সবাই পার্টিতে যোগ দিলেও প্রভা কামরায় ছিলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই বাসায় ফিরলো। বাসায় প্রবেশ করতেই আরমান চমকে উঠলো। তার হারামী বন্ধুগুলো দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছে। কতক্ষণে সম্পূর্ণ বাসা তাজা ফুল দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে। বন্ধুদের দিকে তাকাতেই মুচকি হাসলো। পিঠ চাপড়ে অ্যারোন বলল,”যাও বন্ধু গুড নাইট।”
ওরা যার যার কামরায় ফিরে গেলো।
(৪৫)
নিজের কামরায় প্রবেশ করতেই বিস্মিত হলো আরমান। তার কামরা অজস্র ফ্রেশ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সাজানো হয়েছে বেডের উপর বাসরঘর ও। সেখানে প্রভা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আরমান এগিয়ে গেলো। লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে থাকা প্রভাকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারছিলো না। বেডের সামনে গিয়ে প্রভার ঘোমটা তুললো। খুব সুন্দর করে বউ সাজিয়েছে প্রভাকে। নিশ্চয়ই এটা ওদের বউ এবং ফিয়ন্সেদের কাজ। আরমান তাকিয়ে রইলো। চিবুক তুলতেই সবুজাভ মণিতে দৃষ্টি রাখলো প্রভা। মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো প্রভা। আরমানের মনে হলো প্রভা একটু বেশিই সুন্দর! ঠিক যেন পূর্ণিমার চাঁদ। আরমানের চোখ ঝলসে গেলো। হঠাৎ ভাবলো বিয়ে হয়েছে তাদের অনেকদিন হয়েছে,অথচ বাসর হয়নি। প্রভাকে স্ত্রীর অধিকার দেওয়া হয়নি। যেটা ঠিক হচ্ছে না। অন্যায় হচ্ছে প্রভার সাথে। আজ যেহেতু সুযোগ এসেছে তাহলে সে প্রভাকে তার স্ত্রীর অধিকার দিতে প্রস্তুত। প্রভার পাশে বসলো। হাতের উপর হাত রেখে বলল,”আ’ম সো স্যরি!”
মাথা তুলে তাকালো প্রভা। আরমান ফের বলল,স্যরি এগেইন।”
মিনমিন করে বলল,”কেনো?”
“আপনার সাথে খুব বাজে বিহেভিয়ার করে ফেলেছি তারজন্য।”
লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,”আসলেই ঐদিন আপনাকে বাজে অবস্থায় দেখে আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিলাম। বিষয়টি আমি মানতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিলো! কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালেবাসি!”
ভালোবাসি কথাটা শুনতেই একরাশ হীম শীতল শিহরণ বয়ে গেলো প্রভার শিরদাঁড়া বেয়ে।
“আজ যদি একটা অন্যায় আবদার করি আপনি রাখবেন?”
মাথা নাড়ালো প্রভা।
“আপনাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
মাথা নেড়ে না জানালো প্রভা।
“বেশ তাহলে আরেকটা অন্যায় আবদার করি?”
“করুন।”
“আমি আপনার স্বামী তা কি মানেন?”
“হুম।”
“ধরুন আমি খুব খারাপ! আমি খুব বাজে! রাগী! বদমেজাজী ইত্যাদি। সব জেনেও আপনি আমাকে ভালোবাসতে পারবেন? আমার সংসার করতে পারবেন কিংবা আমার হাতে হাত রেখে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন?”
“পারবো।”
“ইনশাআল্লাহ বলুন।”
“ইনশাআল্লাহ।
গলা কাঁপলো প্রভার।
“আমার সব জেনেশুনে আপনি পারবেন আমার সাথে বাকিটা জীবন পার করতে?”
“পারবো।”
“আমি যেমনটা চাই আপনিও ঠিক তেমনভাবে চলতে পারবেন?”
“চেষ্টা করবো।”
“আমি যা পছন্দ করি না তা কখনো করবেন না বলুন।”
“করবো না।”
“কথা দিন আমাকে।”
আরমান হাত বাড়ালো। প্রভা হাতের উপর হাত রেখে বলল,”কথা দিলাম।”
“আজ কিন্তু আমি আপনাকে জোর করছি না,ডিভোর্সের ভয় দেখাচ্ছি না। শুধু আবদার করেছি,আমি যেমনভাবে আপনাকে দেখতে চাই আপনি ঠিক তেমনভাবে চলবেন আমার সাথে বাকি জীবনটা পাড়ি দিবেন। তবে বিশ্বাস রাখুন আমি শরীয়ত বিরোধী কোন আবদার করবো না। আপনার কষ্ট হয়ে যাবে এমন কোন কাজ করবো না।”
বলেই একটা শ্বাস ফেললো।
“আরেকটা আবদার করি?”
“করুন।”
“জীবনে যত যাইহোক আমার থেকে কিছু লুকাবেন না সেটা যাইহোক! আমি মানিয়ে নিবো। কখনো মিথ্যা বলতে পারবেন না। কোনো কথা লুকাতে পারবেন না বলুন।”
“আচ্ছা।”
“একজন নারীর সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে আপন মানুষটা হচ্ছে তার স্বামী। তেমনি একজন পুরুষের বেলায়ও। এমন কোনো কাজ করবো না যাতে আপনি কষ্ট পান। আজ থেকে আমি খুব ভালো স্বামী হওয়ার চেষ্টা করবো। তেমনি আপনিও একজন ভালো স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করবেন। আমি কষ্ট পাবো এমন কোনো কাজ করবেন না মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
“জীবনে যতো যাইহোক,বিপদ-আপদ বালা-মুসিবত যাই আসুক আগে আমার সাথে শেয়ার করবেন। আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। কখনো কারো কান কথা ধরবেন না। কেউ চাইবে না আমরা ভালো থাকি। আমাদের আশেপাশে অনেক মুখোশধারী আছে তারা আমাদের সংসারে ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করবে আপনি সবসময় সংযত থাকবেন। ভালো এবং আদর্শ স্ত্রীর মতো থাকবেন। তবেই আমার ভালোবাসা পাবেন। আর যদি এর অন্যথা করেন,একবার দু’বার তিনবার পর্যন্ত আপনাকে ক্ষমা করবো। চতুর্থ বার আপনাকে আমি ক্ষমা করবো না। এর শাস্তি কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। মনে থাকবে সব?”
“থাকবে।”
“তাহলে শপথ করে আমার অনুরূপ বলুন,”হে মন! তুমি তওবা করো,কেননা মরণ তো অতীব নিকটে আর খেয়াল-খুশির বাধ্য হবো না আমি। কেননা খেয়াল-খুশি তো সব-সময়ই ফিতনা সৃষ্টিকারী!”
প্রভাও আরমানের মতো করে বলে শপথ করলো। আরমান সন্তুষ্ট হয়ে বলল,”চলুন ফ্রেশ হবেন। দাম্পত্য জীবন শুরু করার পূর্বে নফল নামাজ আদায় করবেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তবেই তো আমাদের সংসারে সুখ দান করবেন আল্লাহ।”
মাথা নাড়ালো প্রভা। আবারও বলে উঠলো,”নেককার স্ত্রী ছাড়া কোনো পুরুষ যেমন সুখী হতে পারে না তেমনি নেককার স্বামী ছাড়াও কোনো মেয়ে সুখী হতে পারে না। একটি সুখী পরিবারের জন্য উভয়কেই দ্বীনদার হওয়ার প্রয়োজন। আর একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী আল্লাহর দেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। আমাদের নবী রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন,“সাফল্যের জন্য দ্বীনদার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করো।”(বুখারীঃ হা/৫০৯০)
অতএব আজ থেকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন। কারণ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মানুষগুলোর উপর আল্লাহর রহমত থাকে। আর আপনি ও একজন দ্বীনদার স্ত্রীতে রূপান্তরিত হবেন। বুঝতে পেরেছেন?”
মাথা নাড়ালো প্রভা। ফের বলল,”আর শুনুন,রবের নিষিদ্ধ কাজগুলোর প্রতি আমাদের এক আকাশ পরিমাণ ঘৃণা জন্মাক। রব অসন্তুষ্ট হোক আজ থেকে এমন কোনো কাজ আমরা করবো না ঠিক আছে?”
আবারো মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো প্রভা।
“আর শুনুন,“পরিপূর্ণ মানসিক শান্তি একমাত্র আল্লাহর দিকেই রয়েছে।”(সুরা রদঃ আয়াত: ২৮)
ফের মাথা নাড়ালো প্রভা। আরমান একটি লাল শাড়ি বের করে প্রভার হাতে দিয়ে বলল,”পুরুষের বেলায় সাদা আর নারীর বেলায় লাল টুকটুকে রঙটা আমি খুব পছন্দ করি। শাড়িটা আপনার জন্য কিনেছিলাম। এটা পড়ুন।”
কোনমতে শাড়িটা পড়ে প্রভা ফ্রেশ হলো। আরমান শাওয়ার নিলো। অতঃপর দু’জনে নফল নামাজ আদায় করে মোনাজাত ধরে সর্বশেষে বলল,
وَمِنْهُمْ مَّنْ يَّقُوْلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِى الْاٰ خِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَا بَ النَّا رِ.
“হে মনের পরিবর্তনকারী! আমাদের মনকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা করুন। মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের এক রাখুন এবং যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাতে আবার একসাথে করবেন। হে আল্লাহ কবুল করুন আমাদেরকে। আমিন।”
মোনাজাত শেষে জায়নামাজের উপর বসা অবস্থায় প্রভার কপালে চুমু খেয়ে উরুর উপর বসালো।
“জানেন,মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে,জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন আল্লাহভীরু বিশ্বস্ত পুরুষের স্ত্রী হওয়া! তদ্রূপ ছেলেদের ক্ষেত্রেও নেককার,চক্ষু শীতলকারী,আল্লাহভীরু স্ত্রী পাওয়াটা সফলতা। আমি কোনো দ্বীনি পরিবার পাইনি। কিন্তু আপনার থেকেই দ্বীনি পরিবারের জন্ম হবে ইনশাআল্লাহ!”
বলেই পকেট থেকে একটি রিং বের করে বলল,”আজকের রাতের গিফট!”
ভীষণ খুশি হলো প্রভা। একটা চেইন পরিয়ে দিলো। একজোড়া রূপা এবং ডায়মন্ডের নুপুর পড়িয়ে দিয়ে বলল,”খুব যত্ন নিয়ে আপনার জন্য গড়িয়েছিলাম। কিন্তু দেওয়া হয়নি এইদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম বলে।”
ফের ভীষণ খুশি হলো প্রভা। প্রভাকে নিয়ে আরমান উঠে দাঁড়ালো। জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে প্রভাকে পাঁজাকোলে তুলে বেডের উপর বসালো। আলমারি খুলে একটি বক্স বের করে আনলো। বক্সটি প্রভার হাতে দিয়ে বলল,”খুলে দেখুন।”
বক্সটি খুলতেই বেরিয়ে এলো পাঁচটি তাসবীহ্! অবাক হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল,”ওয়াও! কি সুন্দর!”
মৃদু হাসলো আরমান।
“এগুলো আপনার জন্য।”
একটি একটি করে তাসবীহ্ হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো প্রভা। অরিজিনাল মুক্তোর দানা দিয়ে তৈরী এই তাসবীহ্গুলো। পাঁচটি তাসবীহ্-ই মুক্তো,ডায়মন্ড,মহামূল্যবান পাথর এবং সোনা দিয়ে কারুকার্যময়ী করে গড়ানো হয়েছে। প্রভা ভীষণ খুশি হলো।
“এখন থেকে প্রতিদিন নামাজ আদায় করে তাসবীহ্ গুলো পড়বেন।”
মাথা নাড়ালো প্রভা।
“আচ্ছা এতো সুন্দর আর এতো দামী তাসবীহ্ গিফট দেওয়ার মানে কী?”
“কারণ আপনি যাতে তাসবীহ্গুলো দেখার লোভে নামাজ পড়েন এবং তাসবীহ্ পাঠ করেন।”
ভীষণ অবাক হলো প্রভা। অতঃপর লাইট অফ করে দু’জনে শুয়ে পড়লো।
(৪৬)
কিছুক্ষণ পর প্রভাকে বুকে টেনে আনতেই আচমকা কেঁদে উঠলো। আরমান ঘাবড়ে গেলো। লাইট অন করে বলল,”এনিথিং রং?”
“আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”
এমন একটা মুহূর্তে এই কথাটি আশা করেনি আরমান। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,”হঠাৎ এই কথা কেনো?”
“আমার সাথে তো আপনার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। তাহলে বিয়ে করলেন কেন?”
“বিয়ে করতে হলে প্রেমের সম্পর্ক থাকতে হয়?”
“নয়তো বিয়ে করলেন কেন?”
“বিয়ের বয়স হয়েছে তাই করেছি।”
“আপনি তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতেন।”
“তা পারতাম। মেয়ের অভাব নেই।”
“তাহলে আমাকে করলেন কেন? আমি তো আপনার মতো এতো সুন্দর না! আমার তো কিছুই নেই।”
তপ্তশ্বাস ফেললো আরমান।
“কে বললো?”
“বলার কী আছে যা সত্য তা। আমার রূপ-গুণ,টাকা-পয়সা,ক্ষমতা,ধন-দৌলত,ঐশ্বর্য কিছুই নেই। তাও কেন বিয়ে করলেন?”
“আপনাকে ভালো লেগেছিলো।”
“মিথ্যা কথা।”
আরমান বিরক্ত হলো। এমন একটা রোমান্টিক সময়ে কি শুরু করলো মেয়েটা? মাথামোটা গাধী! লাইট অফ করে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। অসহ্য লাগছে সব। তা দেখে প্রভা বলল,”জানতাম আপনার মোহ কাজ করেছিলো ভালোবাসা নয়।”
“ঘুমান।”
প্যাঁচ প্যাঁচ করে অনেকক্ষণ কাঁদলো প্রভা। ধৈর্য্যহারা হলো আরমান। লাইট অন করে উঠে বসলো আবারও। হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্রভাকে তুলে বসালো।
“কি সমস্যা বলুন? ঘুমাতে দিচ্ছেন না ঘুমাচ্ছেনও না ব্যপার কি?”
কিছু বলতে পারলো না প্রভা। আরমান তাকিয়ে রইলো। চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে এইটুকুনি সময়ের মধ্যে। কি মেয়ে এটা? ভীষণ কাঁদতে পারে! মায়া লাগলো। বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলল,”কাঁদছেন কেন?”
“আপনি অনেক সুন্দর!”
“তো কি হয়েছে?”
“আমি আপনার মতো সুন্দর না। তাই আপনি সবসময়ই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এই যে আজও নিলেন।”
“এটা আপনার ভুল ভাবনা।”
“মোটেও না। তাই তো আপনি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে বলেছেন কারণ সে সুন্দরী!”
“তার থেকেও আপনি আরো সুন্দরী!”
“মিথ্যে কথা।”
“আপনি যদি সুন্দর না হতেন তাহলে আপনাকে বিয়ে করতাম না। আর শুনুন,মানুষকে মানুষ অসুন্দর বানায় সৃষ্টিকর্তা নয়।”
“তারমানে আপনিও সুন্দরের পূজারী?”
“হ্যাঁ। যেমনটা আপনিও। আর সুন্দর তো পায়ের তলাও। সুন্দর দিয়ে কি হবে?”
“এইরকম সবাই বলে।”
“সবাই বললেও আপনি আমার চোখে দেখা আমার মায়ের পরে দ্বিতীয় সুন্দরী নারী।”
অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো প্রভা। এটা নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেনি। চিবুক তুলে বলল,”আপনি খুব সুন্দর! ভালোবেসে আপনাকে শুধু একটা নামেই বার-বার ডাকতে ইচ্ছে করে।”
কৌতুহলী হলো প্রভা।
“কি সেটা?”
“বেলাডোনা।”
“এটা কেমন নাম?”
“সুন্দরী নারীকে বেলাডোনা বলে ইতালিয়ান ভাষায়। আজ থেকে আপনি আমার বেলাডোনা। আমার সুন্দরী নারী! আমার সুন্দর বউ!”
মোমের মতো গলে গেলো প্রভা।
“চলুন ঘুমাই।”
বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো প্রভাকে। আদুরে চুমু খেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে নেশালো গলায় বলল,”আমার সুন্দরী বউ! আমার সুন্দরী নারী! আমার বেলাডোনা।”
শ্বাস আঁটকে এলো প্রভার। একসময় স্পর্শ গুলো গাঢ় হতে লাগলো। সায় দিলো প্রভাও। ঘনিষ্ঠ হলো দু’জনে। অতঃপর পূর্ণতা পেলো দু’জন কপোত-কপোতীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষা!
(৪৭)
আরমান-প্রভা টোনাটুনির সংসার পেতেছে কলোরাডোর গহীন অরণ্যে গড়ে তোলা বাংলোতে। দু’জনেই খুব সুখে আছে। আরমান একজন ভালো স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছে। আগের থেকে রাগ,জিদ,ক্রোধ সব কমিয়ে ফেলেছে। প্রভাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই দু’জনের মধ্যে। মারইয়াম ইউজিওয়েল এবং আয়েশা মির্জা ভীষণ খুশি হলেন। দূরে থাকলেও ছেলেমেয়েরা ভালো আছে এরবেশি আর কি চাই! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,বাইরের খাবার খেতে পারে না আরমান। তবুও এই কয়েকদিন বাইরে খেয়ে আরমান অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মারইয়াম ইউজিওয়েল শেপ এবং হ্যাল্পিংহ্যান্ড পাঠিয়েছেন ছেলের জন্য। বিনাবাক্য ব্যয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে আরমান। সে চায় না তাদের দু’জনের মধ্যে বাড়তি কেউ থাকুক। প্রভাকে নিয়ে বন-অরণ্যে,পাহাড়,সমুদ্রের কাছাকাছি একা থাকতে চায়। ছেলের প্রতি রাগ হলেও মারইয়াম ইউজিওয়েল চুপ রইলেন। কিছু বললেই তো ছেলে রেগে উঠবে তাই নীরবে হজম করছেন সব।
(৪৮)
সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আরমান রেডি হয়ে প্রভাকে বলল,”সাবধানে থাকবেন। আমি একটু শপিং করতে যাচ্ছি। কিছু কেনাকাটা করে ফিরে আসবো দ্রুত।”
সাথে সাথেই বায়না ধরে প্রভা বলে উঠলো,”বাসায় থেকে আমি বোরিংফিল করছি। আমাকেও আপনার সাথে নিয়ে যান না প্লিজ।”
আরমান ভাবলো আসলেই ঠিক। প্রভা সারাদিন বাসায় থাকে। একটু রিফ্রেশ হওয়ার দরকার।
“ঠিক আছে রেডি হয়ে নিন।”
ভীষণ খুশি হলো প্রভা। শপিং করতে করতে রাত হয়ে গেলো। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে আরমান-প্রভা দু’জনে কিচেনে ঢুকলো। এরপূর্বে আরমান কখনো রান্না করেনি। তবুও সাহস করে ঢুকলো। ইউটিউব দেখে রান্না করতে লাগলো। প্রভা নিজেও রান্না পারে না। আরমান কখনো রান্না করতে বলেনি। প্রভাকে কিচেনে ঢুকতে দেয় না। তবে আজ দু’জনে মিলে ঢুকে রান্নার করার চেষ্টা করছে। যা পেরেছে রান্না করেছে। রান্না সেরে দু’জনে গোসল সেরে নামাজ আদায় করে খাবার খেয়ে নিলো। খাওয়া-দাওয়ার পর প্রভা প্লেট বাটি ধুতে নিলো কিচেনে। তা দেখে আরমান আহ্লাদ দেখিয়ে বলল,”আপনার এতো কষ্ট করতে হবে না বেলাডোনা। এদিকে দিন আমি ধুয়ে দিচ্ছি। মাত্র দু-তিনটে প্লেট বাটিই তো এ আর এমন কি! আপনি বরং রেস্ট করুন। আজ অনেক কাজ করেছেন।”
বলেই প্রভার হাত থেকে প্লেট-বাটি নিয়ে নিজেই ঘষে-মেজে ধুতে লাগলো। প্রভা তাকিয়ে রইলো। অতিরিক্ত দরদ দেখানোর কারণে প্রভার মেজাজ খারাপ হলো। পুরুষ মানুষ থাকবে পুরুষের মতো। কি রান্না করতে আসে,কি প্লেট-বাটি ধুতে আসে। কি কথায় কথায় রাগ-জিদ দেখায়। দাঁড়া আজ জন্মের প্লেট-বাটি ধোঁয়াবে। সুযোগ পেয়ে প্রভাও কিচেনের ময়লা হাঁড়ি-পাতিল যা ছিলো সবগুলো বের করে আরমানের সামনে রাখলো। তা দেখতেই আরমানের চক্ষু চড়কগাছ! বউয়ের উপকার করতে গিয়ে ফেঁসে গেলো বেচারা! শুকনো ঢোক গিলে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে আরমান ধুতে লাগলো সব। ফ্রিজ থেকে একটা শসা আর একটা গাজর বের করে প্রভা কিচেন-কেবিনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে কামড় দিয়ে খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে আরমানের হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়া দেখতে লাগলো আর মনে মনে বলল,”কথায় কথায় আমার সাথে রাগ দেখানোর প্রতিশোধ এটা মিঃ রাগী সাহেব। এতোদিন আমাকে অনেক রাগ দেখিয়েছেন যে এটা সেটার প্রতিশোধ।”
বলেই দাঁত-মুখ পিষে শসা চিবুতে লাগলো। তা দেখে আরমানও দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,”আমার হাতে হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়ানো তাই না মাথামোটা গাধী বউ! সব প্রতিশোধ কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নিবো নয়তো আমিও মির্জা আরমান শাহরিয়ার চৌধুরী নয়!”
হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়া শেষে দু’জনে কামরায় ফিরে গেলো। ভালো করে হ্যান্ডওয়াশ করে ল্যাপটপে কিছুক্ষণ কাজ করলো আরমান। কাজ শেষে শুয়ে পড়তেই দু-চোখ বুজতেই প্রভাও আরমানের পাশে শুয়ে পড়লো। আচমকা প্রভাকে কাছে টেনে আনলো। মৃদু চিৎকার করে উঠে প্রভা বলল,”কি করছেন?”
বাঁকা হাসলো আরমান। প্রভার গলায় মুখ ডুবাতেই কেঁপে উঠলো।
“আরেহ! ছাড়ুন। ঘুমাবো।”
কিছু বললো না আরমান। প্রভার কানে মুখ রেখে বলল,”পানিশমেন্ট।”
“মানে?”
“আজ সারারাত পানিশমেন্ট পাবেন। সকালে উঠে শাওয়ার নিবেন।”
কথা বলতে ভুলে গেলো প্রভা। আরমান আর অপেক্ষা করলো না। নিজের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিলো প্রভাকে।
_____________
চলবে।