#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(১২)
_______________________________
(৪৯)
সপ্তাহ দুয়েক পরের কথা। লাঞ্চ সেরে মনোযোগ দিয়ে অফিসে কাজ করছে আরমান। আচমকা লিয়ানা এসে জড়িয়ে ধরলো। যার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। রুদ্রমূর্তি হয়ে লিয়ানাকে সরিয়ে কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় মে’রে বলল,”ইউ সোয়াইন! হাউ ডেয়ার ইউ?”
থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত রেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো লিয়ানা। চেঁচিয়ে উঠে বলল,”আমাকে না জানিয়ে তুমি বিয়ে করলে কেন?”
“তোমাকে এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে?”
“একশবার দিবে।”
“কি বললে?”
“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আরমানের কেবিনে লিয়ানাকে ঢুকতে দেখে দ্রুত রিয়াদ এলো। আরমানকে রুদ্রমূর্তির বেশে দেখতেই অবগত হলো আজ লিয়ানার কপালে চরম দুঃখ আছে। খুব আফসোস হলো লিয়ানার জন্য।
“আমার কেবিনে ওকে ঢুকার পারমিশন কে দিয়েছে রিয়াদ?”
অস্থির হয়ে উঠলো রিয়াদ।
“নিষেধ করেছি স্যার। শোনেনি।”
“শোনেনি তাই না?”
ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো রিয়াদ। তার স্যারকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
“হ্যান্ডগ্লাভস দাও।”
চেঁচিয়ে উঠলো আরমান। দ্রুত হ্যান্ডগ্লাভসগুলো দিতেই হাতে পরে নিলো। আচমকা লিয়ানার গলা চেপে ধরে বলল,”হাউ ডেয়ার ইউ? আমার পারমিশন ব্যতীত আমার কেবিনে ঢুকে,আবার আমাকে জড়িয়ে ধরিস! ষ্টুপিড লেডি।”
এবার শক্ত করে লিয়ানার গলা চেপে ধরে উপরে তুলে একটা আঁছাড় মা’র’লো। ব্যথা পেতেই লিয়ানা গুঙিয়ে উঠলো। পরপর আরো তিন-চারটা আঁছাড় মা’র’তেই কোমড় প্রায় ভেঙ্গে আধমরা হয়ে গেলো লিয়ানা। কোমড় ধরে ব্যথায় আর্তনাদ করতো লাগলো সমানে। দয়া-মায়া হলো না আরমানের। বলা নেই কওয়া নেই! হুট করে কোথ থেকে একটা বেগানা নারী এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো! কি সাহস!
“একে নিয়ে যাও চোখের সামনে থেকে। আজকের পর থেকে এই মেয়েটাকে যেনো আমি আর চোখের সামনে দ্বিতীয়বার না দেখি। তাহলে কিন্তু সেদিনই হবে এই মেয়ের শেষদিন।”
বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। দু’জন গার্ড এসে লিয়ানাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো। রিয়াদ অনেকবার নিষেধ করেছিলো,কিন্তু মেয়েটা শুনেনি। মেয়েটাও যা ইচ্ছে তাই। ঠিকিই করেছে তার স্যার। এতো ছ্যাঁছড়া কেন মেয়েটা! এর কিছুক্ষণ পরেই জরুরী একটা কল আসতেই রিয়াদকে নিয়ে একটি ফাইভ স্টার হোটেলে বিজনেস ডিল করতে চলে গেলো আরমান। সেখানে ব্যবসায়িক লেনদেন সংক্রান্ত কিছু জটিলতা দেখা দেয় ক্লায়েন্টের সাথে। যার ফলে খুব সাংঘাতিকভাবে মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে আরমানের।
(৫০)
রাত প্রায় সোয়া এগারোটা ঘড়ির কাটায়। অন্যদিন রাত সাত-আটটার মধ্যে বাসায় ফিরলেও আজ এখনও বাসায় ফিরেনি আরমান। টেনশন করতে লাগলো প্রভা। আরমান তাকে ফোন কিনে দেয়নি। আগের ফোনটা কোথায় কে জানে! বাসায় যে ল্যান্ডফোন আছে সেটার সংযোগ ও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আরমান। প্রভার শ্বাস আঁটকে এলো। এতোরাত হলেও মানুষটা এলো না। পায়চারী করতে লাগলো কামরাময়। বিশাল বড় একটা বাসা,তার খুব ভয় লাগে একা থাকতে। মনে হচ্ছে ভূত আসছে! যদিও ভূত বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। তবুও প্রভা ভূতে ভীষণ ভয় পায়। বেশকিছুক্ষণ পর আরমান আর রিয়াদ এলো। রিয়াদ ওর কামরায় চলে গেলো। আরমান নিজের কামরায় গেলো। পেছন পেছন প্রভাও এলো। স্যুটটা খুলে গলার টাই খুলতে নিতেই প্রভা বলল,”আজ এতো দেরী হলো যে?”
“কাজ ছিলো।”
“সারাদিন আপনার কাজ থাকে তাই না?”
আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো প্রভা। নিজেকে ধাতস্থ করলো আরমান। তার মাথাটা গরম হয়ে আছে। তবে সে চায় না প্রভার সাথে খারাপ কিছু হয়ে যাক।
“একটা ফোন ও এনে দিচ্ছেন না। বাসার ফোনের সংযোগ ও বিচ্ছিন্ন। পেয়েছেনটা কি আপনি?”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,”খাবার নিয়ে এসেছি। ডিনার রেডি করুন। আমি ক্ষুধার্ত।”
আচমকা প্রভার চোখ পড়লো আরমানের শার্টের বুকের দিকটায়। সেখানে লাল হয়ে আছে। প্রভা এগিয়ে গেলো। শার্ট খুলতেই হাতে নিলো। আরমান ওয়াশরুমে চলে যেতেই সেদিকে একবার তাকিয়ে দাগটার উপর আঙ্গুল রাখলো। বুঝতে পারলো এটা লিপস্টিকের দাগ। কারণ চিকন চিকন দুটো ঠোঁটের দাগ স্পষ্ট! প্রভার শ্বাস আঁটকে এলো। চোখ পড়লো বোতামের মধ্যেও বেশ কয়েকটা সোনালী চুল আঁটকে রয়েছে। প্রভার মাথা ঘুরে উঠলো। সকালে তার সামনেই এই শার্ট পরেছে মানুষটা। তখন খুব পরিষ্কার ছিলো। কোনো দাগ ছিলো না। আর আরমান খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। জামাকাপড় পরিধান করার বেলায় খুব সচেতন। যে জামা একবার পরে সেটা দ্বিতীয় বার পরে না। তাহলে এই দাগ কোথা থেকে এলো? নাকের কাছে নিতেই মেয়েলি স্মেইল পেলো। ফুঁপিয়ে উঠলো প্রভা। মানুষটা পরকীয়া করছে তাকে রেখে! আর তার কোনো রিলেশন না থাকার পরেও মানুষটা তাকে অনেক শাস্তি দিয়েছে। যারজন্য সে সু’ই’সা’ই’ড পর্যন্ত করতে নিয়েছিলো। তখন ম’রে গেলে আজ এমনদিন দেখতে হতো না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লো প্রভা। সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো শ্বাস আঁটকে। ততক্ষণে গোসল সেরে অযু করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরুলো আরমান। শার্ট হাতে নিয়ে প্রভাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু না বলে সোজা নামাজ আদায় করতে চলে গেলো। ঘড়িতে দেখলো রাত সাড়ে এগারোটা। এশার নামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেছে আরো পাঁচ মিনিট পূর্বে। দ্রুত নামায কাযা করতে চলে গেলো। নামাজ শেষ করে প্রভাকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,”এখনো দাঁড়িয়ে রইলেন যে? শরীর ঠিক আছে।”
নীরব রইলো প্রভা। কিভাবে পারে একটা মানুষ এতো অভিনয় করতে? নামাজ-কালাম,হাদীস-কোরআন সবই পড়ে। সেই মানুষটা আবার বউ থাকতে পরকীয়া করে! বাইরে থেকে ফিরে আজ আবার গোসলও করলো। দুঃখে কষ্টে প্রভার ম’রে যেতে ইচ্ছে করলো। খুব খুব ঘৃণা জন্মালো মানুষটার প্রতি। কিসের অভাব দিয়েছিলো সে মানুষটাকে। যখনি,যেইসময় তাকে কাছে ডেকেছে শতকিছুর পরেও সে সায় দিয়েছে। নিষেধ করেনি কখনো। তাহলে কিসের জন্য মানুষটা পরকীয়ায় জড়িয়ে গেলো?সে সুন্দর নয় বলে কি! প্রভার কপালে হাত রাখলো আরমান। সব স্বাভাবিক। প্রভার চোখে পানি দেখে বলল,”এনিথিং রং?”
“কিছু হয়নি।”
“ডিনার করবেন আসুন।”
“আপনি করুন।”
শক্ত চোখে তাকালো আরমান। প্রভা কিছু বলতে পারলো না। আরমানের পিছু পিছু গেলো। আরমান ডিনার রেডি করে খেতে বসলো। সে খেলেও প্রভা খেতে পারলো না। এমন একটা ঘটনা জানার পর সে কিভাবে স্বাভাবিক থাকবে? আরমানের ভেজা চুলের দিকে চোখ পড়তেই বুক ফেটে কান্না এলো। প্রভার সাথে কোনো কথা না বলে আরমান কামরায় চলে গেলো। প্রচণ্ড টায়ার্ড থাকায় শুয়ে পড়লো। তার শরীরটা নেতিয়ে আসছে কেমন। শরীরটাও গরম গরম! জ্বর আসবে কি! রাতে গোসল করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। সেও বা কি করতো! একটা বেগানা নারী তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো আষ্টেপৃষ্ঠে। তপ্তশ্বাস ফেলে দু-চোখ বুজে রইলো। বেডের এক কোণে বসে রইলো প্রভা। আচমকা ফোনের নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। মোবাইলের দিকে তাকাতেই স্ক্রিনের উপর দেখলো,”হাই সুইটহার্ট!”
আরেকটা ম্যাসেজ আসতেই কৌতুহলী হয়ে ফোনের উপর টাচ করতে নিতেই ফোন অফ করে আরমান বলল,”নেক্সট টাইম পারমিশন ব্যতীত আমার ফোন ধরবেন না। আই ডোন্ট লাইক দিস।”
পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইলো প্রভা। কিভাবে পারলো মানুষটা তাকে এমন কথা বলতে? আর ওই খারাপ মেয়েটা কে? মানুষটাকে এতো রাতে ম্যাসেজ দিলো কেন? আর্সেল নয় তো? আজ রাতে লেট করে বাসায় ফেরার কারণ কি তবে এই মেয়েটা? আচ্ছা মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললো না তো! সন্দিহান হলো প্রভা।
“বসে রইলেন কেন? ঘুমান। সকালবেলা উঠে নামাজ কালাম পড়বেন। আপনাকে নামাজ আদায় করতে দেখি না।”
শক্ত গলায় বললো। এখনও নিশ্চল পাথুরে মূর্তির মতো বসে রইলো প্রভা।
“সব জায়গায় ফাইজলামি পছন্দ করি না। বউ বউয়ের মতো থাকার চেষ্টা করবেন। এর বেশি কিছু না।”
অভিমানে,দুঃখে,কষ্টে প্রভার চোখে জল এসে ভর করলো। টুপটুপ করে অজস্র জল গড়াতে লাগলো গাল বেয়ে।
“কথা কানে যায় না?”
ধমকে উঠলো আরমান। ফুলতে লাগলো প্রভা। অন্ধকারে আধো-আলোয় দেখলো প্রভা কাঁদছে। মায়া হলো হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে আনলো। বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে পিঠে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,”রাগের সময় কথা বলার ধরণটা বদলে যায় ঠিক,তবে আপনার প্রতি ভালোবাসাটা নয়। কাঁদছেন কেন? কিছু হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
কিছু বলতে পারলো না প্রভা। তবে কান্নায় ভেঙে পড়লো। গালে,ঘাড়ে,গলায় চুমু খেয়ে গভীরভাবে প্রভাকে কাছে টানলো। একসময় ঘনিষ্ঠ হলো দু’জনে। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ রেসপন্স করলো না প্রভা। নিথর একটা মানুষের মতো পড়ে রইলো। সবটাই বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে প্রভার থেকে সরে পড়লো আরমান।
(৫১)
অসুস্থ হয়ে পড়েছে আরমান। অফিসে যায়নি আজ। সকাল সকাল গোসল সেরে নামাজ আদায় করে বাসায় বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো। জ্বর বাড়তেই ল্যাপটপ অফ করে বেডের উপর আধশোয়া হয়ে বসলো। প্রভা একটু আগে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে সবে কামরায় এলো। হঠাৎ ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। চমকালো প্রভা। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ভেজা চুল মুছতে মুছতে আঁড়চোখে আরমানকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ খুব মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে কিছু টাইপ করছে আরমান। ব্যপারটা লক্ষ্য করতেই সন্দিহান হলো প্রভা। নিশ্চয়ই কালরাতের ওই মেয়েটার সাথে চ্যাটিং করছে! কালরাতেও ম্যাসেজ দিয়েছিলো মেয়েটা। এখন সে দেখবে কিভাবে তারা একে-অপরকে কি ম্যাসেজ দিচ্ছে! টেনশনে অস্থির হয়ে উঠলো। তার সামনে তার স্বামীকে ওই মেয়েটা কেঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে! চুমু খাচ্ছে! আরো কত কি করছে! অথচ স্ত্রী হয়ে সে কিছুই করতে পারছে না! খুব কান্না পাচ্ছে প্রভার। দু-চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো। কিভাবে ম্যাসেজগুলো দেখবে ভেবে পাচ্ছে না। পরে যদি ডিলেট করে দেয় তাহলে সে দেখবে কিভাবে? বুদ্ধি করে কফি বানিয়ে আনলো। আরমানের হাতে কফি তুলে দিতেই প্রভার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। এই ফাস্ট নিজ থেকে কফি বানিয়ে আনলো প্রভা। আরমান যতটুকু জানে প্রভা চা-কফি বানাতে পারে না। তবুও এক চুমুক দিতেই মুখ বেঁকে গেলো। কিছু বললো না। কফি হাতে নির্বিকার হয়ে ফোনে টাইপিং করতে লাগলো। উশখুশ করে আঁড়চোখে বার-বার দেখার চেষ্টা করছিলো প্রভা। কিন্তু দেখতে পারছে না কিছুই। ব্যপারটা বুঝতে পারলো আরমান। যেই মেয়ে এখনও অব্ধি একটা গ্লাস মাজতে পারে না সেই মেয়ের হঠাৎ কফি বানিয়ে আনার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো। মোবাইলটা প্রভার হাতে দিয়ে বলল,”এতো কষ্ট করছেন কেন? আমি বরং বলি আপনি টাইপ করুন। ততক্ষণে আমি কফিটা শেষ করি কেমন!”
ফোন হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রভা। আরমান তাকে এতো সহজেই ফোন দিবে ভাবতে পারেনি। আচমকা ম্যাসেজের নোটিফিকেশন আবারও বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ-ম্যাসেজ করছে আরমানের বন্ধুরা।
(৫২)
তখন প্রায় সন্ধ্যাবেলা। হঠাৎ বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। প্রভা ডোর খুলতেই ভেতরে প্রবেশ করলেন আয়েশা মির্জা এবং মারইয়াম ইউজিওয়েল। ছেলের অসুস্থতার কথা শুনতেই কলোরাডো চলে আসলেন শ্বাশুড়ি মাকে নিয়ে। বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ছেলেটা। ছেলের সাথে খোশগল্প করলেন বেশকিছুক্ষণ। প্রভার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন ওনারা দু’জন। বিয়ে হয়েছে প্রায় মাস তিন-চারেক হবে। অথচ প্রভা এখনও রান্না-বান্না,সংসারের কাজকর্ম কিছুই পারে না। দু’জন মানুষ থাকে তারা অথচ প্রভা এক মগ কফিও নাকি বানাতে পারে না। আয়েশা মির্জার নাক-কান কাটা গেলো বউয়ের সামনে। একটা মেয়ে এতোটা আনাড়ি হয় কিভাবে তা ওনার জানা নেই। আরমান কিচেনে যেতেই রাগ প্রকাশ করে প্রভাকে বললেন,”শশীপ্রভা তুমি চা-কফি কিংবা রান্না-বান্না করতে জানো না?”
নির্লিপ্তে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো প্রভা। বিয়ের আগে তার মা কখনো তাকে কিচেনে ঢুকতে দেয়নি কিংবা বাসার কোনো কাজ করতে দেয়নি। একটামাত্র মেয়ে তো তাই সবার ভীষণ আদরের ছিলো। মারইয়াম ইউজিওয়েল বললেন,”কেমন মেয়ে তুমি বুঝি না! এতোদিন আমি জানতাম বাঙালি মেয়েরা খুব সাংসারিক। বিয়ের পর কোমড়ে শাড়ির আঁচল বেঁধে স্বামী-সংসারকে আগলে ধরে শক্ত হাতে। কিন্তু তুমি এমন কেন?কেমন যেনো অদ্ভুত! স্বামী-সংসারের প্রতি মন নেই। দায়িত্বহীন উদাসীন।”
কিছু বলতে পারলো না প্রভা।
“মাত্র দু’জন মানুষ তোমরা। আমার ছেলে আর তুমি। বাড়তি কেউই নেই। রিয়াদ তো বাইরে বাইরে খায়। তোমাদের বাসায় থাকলেও ঝামেলা নেই তার। ছেলেটা বড্ড বুঝদার।”
তপ্তশ্বাস ফেললেন। ফের বলতে লাগলেন,”আমাদের খেদমত করা লাগবে না তোমার। সেই আশাও করি না আমি। আমাদের জন্য যথেষ্ট সার্ভেন্ট রাখা আছে। অন্তত আমার ছেলেটার টুকটাক খেদমত তো করতে পারতে! তোমাদের কষ্ট হবে বলে,বাসার কাজ এবং রান্না-বান্নার জন্য শেপ সহ বেশকয়েক জন সার্ভেন্ট পাঠিয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার স্বামী পাকনামি করে পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের। তুমি তো ওকে বুঝিয়ে সার্ভেন্টেদের রাখতে পারতে।”
কি বলবে প্রভা? মানুষটা তো তাকে কিচেনে যেতে নিষেধ করে। নিজেই রান্না করে তার জন্য। আর মানুষটার মুখের উপর সে কথা বলতে পারে না। কথা বললেই তো ধমক মা’রে। রাগ,তেজ সব দেখায়।
“ওতো নিষেধ করবেই কারণ তুমি যেই আনাড়ি মেয়ে। আর ও কি সারাক্ষণ বাসায় থাকে নাকি?তোমার তো সব শিখে নেওয়া উচিত। তোমার স্বামী,তোমার সংসার,সব তোমার। তোমার ভাগ্য কতো ভালো যে আমার ছেলে তোমাকে রান্না করে খাওয়ায়। সেবাযত্ন করে। ভালোবাসে। ইভেন তোমার জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট হতে ভাতও রান্না করে। যেই ছেলে আমার জীবনে ভাত কি জিনিস চিনতো না,আর এখন তোমার জন্য ভাতও রান্না করে।”
মিথ্যে বলেনি অবশ্য! আরমান তার জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট হতে রাইস-কুকারে ভাতও রান্না করে। সে-তো পিজ্জা,বার্গার,চিকেন কিংবা ফ্রাইড রাইস এইসব খেয়ে থাকতে পারে না আরমানের মতো। প্রতিদিন এইসব খেতে ভালো লাগে না ওর। এছাড়াও বাঙালিরা যতোই এইসব খাবার খাক না কেনো তাদের ভাতের একটা খিদা থেকেই যায়। আয়েশা মির্জা হতাশ শ্বাস ফেললেন। বড়মুখ করে প্রভাকে বিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু স্বামী,সংসার নিয়ে প্রভা বড্ড উদাসীন,দায়িত্বহীন। একটা গ্লাসও নাকি মাজতে পারে না। এটাও শুনলেন যে প্রভা নিজের শাড়ি-কাপড়ও পর্যন্ত নাকি ধুতে পারে না। সকালের বাসি কাপড় থেকে শুরু করে পিরিয়ডের কাপড়গুলোও পর্যন্ত সব আরমানই ধুয়ে দেয়। এটা কেমন মেয়ে? বাসায় যে সার্ভেন্টটা এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে যায় তার থেকে সব জানতে পারলেন ওনারা দু’জন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন।
“ধর্ম-কর্মেও তো মন নেই তোমার। তখুনি ছেলেটাকে নিষেধ করেছি বাংলাদেশী বিয়ে করো না। তুমি যেই দেশী সেইরকম মেয়েকেই বিয়ে করো। শুনলো না কথা। দাদীমার কথায় ছেলে আমার নাচতে নাচতে বিয়ে করতে গেছে। এখন বিয়ের পর থেকে একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে।”
তপ্তশ্বাস ফেললেন মারইয়াম ইউজিওয়েল।
“তোমাকে চাকরানী করে নয় বরং রাজরানী করে বিয়ে করে এনেছে আমার ছেলে। তোমার কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। অন্তত আমার ছেলেটাকে দেখেশুনে রাখতে পারতে। ও পুরুষ মানুষ। তোমার স্বামী। তোমার জান্নাতের সঙ্গী। এছাড়াও এই পুরুষ মানুষটার মাধ্যমেই আল্লাহ তোমার রিজিকের ব্যবস্থা করেন। মানুষটার একটু যত্ন নিতে। কেনো এতো কষ্ট দাও? হয়তো সে মুখ ফুটে বলে না তোমার তো বুঝে নেওয়া উচিত। ও পুরুষ মানুষ। কয়দিকে সামলাবে? অফিসের কাজ সেরে বাসায় ফিরে তোমার জন্য আবার রান্না ও করে। সবই জানতে পারলাম। এমনটা আশা করিনি তোমার থেকে। তোমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ চালিয়ে আবার রান্নাও করে। সেই পিকচার সোস্যাল মিডিয়াতেও আবার গুঞ্জন তোলে। আর তুমি কি এমন মহৎ কাজ করো যে একজন স্বামীর খেদমত করতে পারো না?তোমাদের বাঙালি ভাষায়,“যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।” পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। চেষ্টা করার মতো একটা মন এবং সুস্থ মানসিকতা থাকতে হয়। একজন সুন্দরী নারীর থেকে একজন যত্নশীল নারী বেশি সুন্দর হয়! যার দুনিয়াতে সবকিছুই আছে কিন্তু হেদায়েত নেই, তার কিছুই নেই।”
তপ্তশ্বাস ফেললেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে আরমান মা এবং দাদীমার জন্য কিছু ফ্রুটস এবং কফি বানিয়ে আনলো। ওনারা দু’জন প্রভার দিকে তপ্তচোখে তাকালেন। টুকটাক এইসব তো প্রভার করা উচিত কিংবা করতে পারতো। বাঙালি হোক আর যাইহোক এইসব কি শিখিয়ে দিতে হয় নাকি? মানুষের একটা কমনসেন্স বলেও কিছু থাকে। ছেলে তার বউকে কিছু করতে না দিয়ে নিজেই করছে। কত সৌভাগ্য মেয়েটার! আরমান মায়ের পাশে বসলো। কফি তুলে দিয়ে বলল,”এতো কষ্ট করে আসার কি প্রয়োজন ছিলো আম্মিজান?”
“বিয়ে করে তুমি তো পর হয়ে গেছো। যেনো তোমার বউকে আমি জ্বালিয়ে মা’র’ছি! খেতে দিচ্ছি না! পরতে দিচ্ছি না! শুধু কষ্টই দিচ্ছি!”
“এইসব কেমন কথা আম্মিজান?”
“এখুনি তুমি মহলে ফিরছো।”
“এখানে আমার খুব ভালো লাগে আর আমরা খুব ভালো আছি,সুখে আছি আম্মিজান।”
“তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই।”
মৌন রইলো আরমান। প্রভাকে নিয়ে কয়েকটা দিন এখানে একা থাকতে চায়। তাকে ছাড়া যে তার মাও ভালো নেই সেটা তার চেয়ে আর ভালো কে জানে?
“তোমার যখুনি মন চাইবে বউকে নিয়ে এখানে এসে থাকবে। তারজন্য নিষেধ করেছি?”
“তা বলিনি।”
“তাহলে অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে আছো কেনো?এখুনি মহলে ফিরছো দ্যাট’স ফাইনাল।”
“আম্মিজান!”
“কোনো কথা নয়। তোমার এইসব টলারেট করতে পারছি না। আমার কতোবড় সাম্রাজ্য! আর তুমি বন-বাদাড়ে,বন-জঙ্গলে এসে বাস করছো!”
রিয়াদ এবং নিজের বডিগার্ডকে ডেকে আরমানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লাগেজে গুছিয়ে গাড়িতে তুলতে বললো। হার মানলো মায়ের কাছে আরমান।
(৫৩)
প্রিন্সেস মারইয়াম টাওয়ারে পৌঁছাতেই বেশ রাত হয়ে গেলো। যার যার কামরায় ফিরে গেলো সবাই। ডিনার শেষে সবাই শুয়ে পড়লো। অসুস্থ থাকা বিধায় আরমান ও ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম এলো না শুধু প্রভার। সারারাত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের জল বিসর্জ্জন দিলো। তাকিয়ে রইলো অদূরে ম’রা গাছের ডালপালাগুলোর দিকে। সারারাত বরফ ঝরলো! ম’রা গাছের ডালগুলো ধীরেধীরে ভরে গেলো বরফের শিউলি ফুলে ফুলে। তুষারপাতের রাতটা খুব সাদা হয় বলে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো প্রভার। তবে এটা দুঃস্বপ্নই বটে তার জন্য। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্ত্রী-রা স্বামীকে সরল মনে বিশ্বাস করে বলে স্ত্রীদেরকে ঠকানো অনেক সহজ স্বামীদের জন্য। কিন্তু এই সরল বিশ্বাস যদি একবার ভেঙে যায় তাহলে সেই নারী আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারে না। সেই স্বামীকে আর ভালোবাসতে পারে না। এতো এতো সরল বিশ্বাসের পরেও কিভাবে পারলো মানুষটা তাকে ঠকিয়ে অন্য নারীর সাথে ছিঃ! মানুষ যাদের মন থেকে বিশ্বাস করে,ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় তারাই একসময় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একবার না বহুবার! তাই এইসব মানুষকে বিশ্বাস করাটাও বোকামি। মানুষটাকে বিশ্বাস করে বোকামি করে ঠকে গেলো প্রভা। খুব যত্ন করে মানুষটা তাকে ঠকিয়েছে! শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠলো। ফোপাঁনোর শব্দে আরমানের ঘুম হালকা হয়ে এলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় হাত বাড়িয়ে প্রভাকে খুঁজলো। না পেয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। বারদুয়েক ডাকলো। শুনলেও প্রভা সাড়া দিলো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরমান উঠে লাইট অন করে ওয়াশরুম সহ সারা কামরায় খুঁজলো। না পেয়ে ব্যালকনিতে খুঁজতেই দেখলো মূর্তির মতো নিশ্চল,অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রভা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,”না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন? তুষারপাত হচ্ছে! ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো!
প্রতিত্তোর করলো না প্রভা। হাত ধরতেই ঝাড়া মে’রে ফেলে দিলো। আরমান অবাক হলো। নিজেকে সামলে বলল,”আমার উপর রেগে আছেন কেনো? আপনার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে তো!”
“থাকুক! আপনার কি তাতে? ডিভোর্স দিন আমাকে।”
আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো প্রভা। বিস্ময় নিয়ে প্রভার দিকে তাকালো আরমান। কালতো সবই ঠিক ছিলো। সব ঠিকঠাক করে নিয়েছিলো নিজেদের মধ্যে। এর ভেতরে আবার কি হলো? খুশিমনেই তো মহলে ফিরলো।
“হঠাৎ কি হলো আপনার? ভালোই তো ছিলাম আমরা। অস্বাভাবিক আচরণ করছেন কেনো?এনি প্রবলেম? শরীর খারাপ করেছে?”
“ঘৃণা করি আপনাকে!”
অবিশ্বাস্য নয়নে তাকালো আরমান। কখনো এমন কথা প্রভা বলবে আরমান ভাবতেও পারেনি! নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,”ঘৃণা করার কারণ?”
“আগে বললেই তো পারতেন আমাকে আপনার পছন্দ না! আমি সুন্দরী না! আমাকে আপনার ভালো লাগছে না! আপনার অনেকগুলো সুন্দরী নারীর প্রয়োজন।”
“হঠাৎ এইসব বলার মানে?”
“না জানার ভান করে অভিনয় করছেন আমার সাথে?”
“আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করার রাতেই বলেছি,কোনো কান কথা ধরতে না। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে,ভুল বুঝতে না,সন্দেহ করতে না। আর তা না করে জাজ করছেন?এটা কি ঠিক?কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ এমনটা করতে পারে?”
“আপনাকে জিজ্ঞেস করার কি আছে?যেটা আমি নিজের চোখে দেখলাম।”
“কি বলতে চান আপনি?”
কামরায় ঢুকে লাগেজ থেকে সেই শার্টটা বের করে বলল,”এইসব কী?”
অবাক হলো আরমান নিজেও। এটা লিয়ানার কাজ। আরমান তখন খেয়াল করেনি। জরুরী ফোন আসাতে গায়ে স্যুট জড়িয়ে রিয়াদকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলো। এ-র পরতো বাসায় ফিরলো। খেয়াল করার সময় কই!
“ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি! ছিঃ! আপনাকে সরল মনে বিশ্বাস করতাম! ভালোবাসতাম! সেই বিশ্বাস আমার ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে এইভাবে তার প্রতিদান দিলেন? চরম ঘৃণা করি আপনাকে।”
“ভুল বুঝছেন আমাকে।”
“আপনার কুকর্ম সামনে এসে গেছে তো তাই ঢাকার চেষ্টা করছেন তাই না? লাভ হবে না কিছু। থাকবো না আপনার কাছে। ডিভোর্স দিন আমাকে।”
তপ্তশ্বাস ফেললো আরমান। প্রভা যেভাবে আগুন হয়ে আছে মানাবে কিভাবে? আরমান নিজেকে শান্ত রাখলো। দু’জন গরম হলে হবে না। একজনকে শান্ত থাকতেই হবে। এছাড়াও স্ত্রীর দূর্ব্যবহারকে হজম করা,গিলে ফেলা,ধৈর্য্যধারণ করা,সবর করা,আল্লাহর জন্য ক্ষমা করে দেওয়া হচ্ছে ইবাদাত। প্রভার সামনে গিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিলো। প্রভা ছোড়াছুড়ি করলো। আরমান ছাড়লো না। কোমল গলায় বলল,”এই পৃথিবীতে এতো এতো সুন্দরী মেয়ে থাকতেও কেবল আপনাকে কেনো বিয়ে করেছি একবারও জানতে মন চায় না আপনার?”
“না চায় না। জানা হয়ে গেছে।”
“আমার কথা শুনুন।”
“শুনবো না আপনার কথা। আপনি আমার সকল স্বাধীনতা কেঁড়ে নিয়েছেন,আমার পায়ে অদৃশ্য শিকল পড়িয়ে আমাকে বন্দী করে আমার উপর সমস্ত জোর-জুলুমি,অন্যায়-অত্যাচার করছেন। রক্ষণশীল এবং ইসলামের কথা বলে পায়ের নিচে দলিত করে আপনি আমাকে দাসীর মতো রাখতে চাইছেন। ঘৃণা করি আপনাকে।”
অবাক হলো আরমান।
_____________
চলবে।