#সন্ধ্যারাতে_শালুক_ফোঁটে ❤️
#আদনীন_নিশাত_তারান্নুম_চৌধুরী ❤️
#পর্বসংখ্যা-(১৫)
_______________________________
তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো আরমান। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,”ভ্রুণের বয়স যখন ১২০ বা চার মাস হয়ে যায়,তখন আল্লাহ তাআলা তার মধ্যে রুহ দান করেন। আর রুহ আসার পর বাচ্চা নষ্ট করা কোনো মানুষকে হ’ত্যা করার শামিল। তাই এ সময় ভ্রুণহত্যা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।”
“কিন্তু আপনি তো সেটা বুঝতে চাইছেন না। হ’ত্যা করতে চাইছেন।”
“অনেক হয়েছে। থামুন এবার।”
চেঁচিয়ে উঠলো আরমান।
“আপনার মাথায় যে উপস্থিত বুদ্ধি কম তা ভালো করেই জানি। কেউ কিছু বললেই সাথে সাথে সেটা বিশ্বাস করে ফেলবে। নিজের মধ্যে কোনো বুদ্ধি নেই। মাথামোটা গাধী মেয়ে।”
ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করলো প্রভা।
“মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু। সৃষ্টি করেছেন মানবজাতি,গ্রহ-উপগ্রহ,চন্দ্র-সূর্য সব। মানুষ আল্লাহর এক অপরূপ সৃষ্টি। আল্লাহ সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। কতটা সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন,কিভাবে সৃষ্টি করেছেন,সেটাও আল্লাহ কোরআনে বলেছেন। আল্লাহ বলেন,“আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি,অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি,এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি,অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি,অবশেষে তাকে নতুনরূপে সৃষ্টি করেছি।”(সুরা: মুমিনুন,আয়াত: ১২-১৪)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,“এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত,অতঃপর আমি একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে,আমি কত সুনিপুণ স্রষ্টা।”(সুরা: মুরসালাত,আয়াত: ২২-২৩)
শেষ নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন,“তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন,জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন,গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে,তার (শিশুর) আমল,রিজিক,আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।”(বুখারি,হা/২৯৬৮)
নবীজি আরও বলেন,“আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন,হে রব! এখনও তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান,তখন ফেরেশতা বলেন,হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে,পাপী না নেককার,রিজিক কী পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব,এভাবে তার তকদির মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়।”(বুখারি,হা/৩০৮৭)
রাসূল (সা.) ভ্রুণহত্যাকে ‘গুপ্তহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,“স্মরণ কর ওই দিনকে,যেদিন জীবন্ত সমাধিস্থ নিষ্পাপ বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হবে,তোমাকে কোন অপরাধের কারণে হ’ত্যা করা হয়েছে?”(সুরা: তাকভিরঃ ৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,“যে একটি জীবনকে হ’ত্যা করা থেকে বিরত থেকেছে,সে যেন সব মানুষের জীবনকে হ’ত্যা করা থেকে বিরত থেকেছে ; আর যে একটি আত্মাকে হ’ত্যা করেছে,সে যেন পুরো মানবজাতিকেই হ’ত্যা করেছে।”(সুরা: মায়িদাঃ৩০)
অনেকে মনে করেন,আগত শিশুকে লালনপালন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এই ভয়ে ভ্রুণ মে’রে ফেলেন। এ কাজটি নিতান্তই নিন্দনীয় ও বোকামি। কেননা যিনি তার বান্দাকে এত যত্ন করে সৃষ্টি করেছেন,তিনি তার রিজিকেরও ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,“তোমরা তোমাদের সন্তানকে দারিদ্র্যের ভয়ে হ’ত্যা করো না। আমি তোমাকে ও তোমার সন্তানকে দেখেশুনে রাখি। তাই তাদের হ’ত্যা করা সত্যিকার অর্থেই একটি মহাপাপ।”(সুরা: ইসরা ৩২)
আর এইসব জেনেশুনে আমি কেনো এমন মহাপাপ করবো?”
কিছু বলতে পারলো না প্রভা।
“দ্রুত রেডি হয়ে নিন ডক্টরের কাছে যাবেন।”
নতুন একটি শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলো প্রভা। তা দেখতেই আরমান বলল,”শাড়ি কেনো?”
“তো কি পড়বো?”
“বোরকা পড়বেন তার উপর কটি পড়বেন।”
“বোরকা পড়লে আমাকে সুন্দর লাগে না। আর আমার অভ্যাস নেই।”
“সেদিনও তো পরলেন।”
“সেদিন পরেছি বলে প্রতিদিন পরতে হবে নাকি?”
“হ্যাঁ। এখন থেকে বাইরে যাওয়ার সময় প্রতিদিন বোরকা পরবেন। আর বোরকা সুন্দর লাগার জন্য না সৌন্দর্য ঢাকার জন্য পরবেন। অভ্যাস নেই কিন্তু অভ্যাস করে নিবেন। নিতে হবে একান্ত আপনার,আমার,আপনার বাবা-ভাই এবং আপনার সন্তানের মঙ্গলের জন্য। এছাড়াও একজন নারী যখন বোরকা-হিজাব-নিকাব পরেও এই চিন্তা করে তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে কি-না তখন জেনে নিন দুঃসংবাদ তার জন্য। তার এই পর্দা কাল হাশরে কোনো কাজে আসবে না। আর শুনুন,মেয়েরা বাইরে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়ায় এটেনশন পাওয়ার জন্য। যে যত বেশি স্টাইল করে সে আসলেই ততবেশি এটেনশন চায়। নিজের সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে সে আসলে পরপুরুষের কামুক দৃষ্টিই কামনা করে। এটাই সে চায়। এতেই সে আনন্দ পায়। অন্যরা দেখবে,কামনা করবে,ফ্লার্ট করবে সোশ্যাল মিডিয়াতে অলটাইম এটেনশন দিবে এটাই সে চায়। কোনো হাই ভ্যালু ওমেন তার সৌন্দর্য এভাবে প্রকাশ করে রাস্তায় বের হতেই পারে না। আত্মমর্যাদাহীন হলে এটা সম্ভব।”
“আচ্ছা তা বোরকার সাথে আমার বাবা-ভাই চৌদ্দগুষ্টির সাথে কি সম্পর্ক?”
আরমান হেঁসে উঠে বলল,”একজন বেপর্দা নারীর জন্য চারজন পুরুষ জাহান্নামে যায়।”
“কি বলছেন এইসব?”
“হ্যাঁ যা শুনছেন তাই। সত্য।”
“চারজন পুরুষ মানে? কারা তারা? আর কেনইবা?”
“১) বাবা
২) বড় ভাই
৩) স্বামী
৪) বড় ছেলে।”
“এরা সবাই কেনো?”
“কেননা নারী তার জীবনের কোনো না কোনো সময় এদের দায়িত্বে থাকে। জন্মের পর থেকে পিতার কাছে। বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই এর কাছে। বিয়ের পর স্বামীর কাছে আর স্বামীর মৃত্যুর পর বড় ছেলের কাছে। যেসকল পুরুষ তাদের পরিবারের নারীদের বেহায়াপনা প্রসারে বাঁধা দেয় না তাদেরকে ইসলামি পরিভাষায় দাইয়ুস বলে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,“দাইয়ুস ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন,“হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) দাইয়ুস কে?” উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন,“যে ব্যক্তি তার পরিবারে আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের ব্যপারে কোন তৎপরতা অবলম্বন করে না বরং উপেক্ষা করে চলে।” অন্য বর্ণনায় এসেছে,“দাইয়ুস হলো সে,যে তার পরিবারে বেহায়পনার বাস্তবায়নে সন্তষ্ট ও পরিতুষ্ট।”(মুসনাদে আহমেদ : ৫৮৩৯)
যে নারী এসব জানে আর জানার পরেও কিভাবে তারা পারে তাদের প্রিয় মানুষদের জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিতে?সে পুরুষ কিভাবে পারে তার পরিবারের নারীদের নাসীহা না দিয়ে থাকতে?কোরআনে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ.
“হে লোকজন তোমরা যারা ঈমান এনেছো,তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করো এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর ; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ,তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না,আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়,তা-ই তামিল করে।”(সূরা আত-তাহরীম: ৬)
পর্দার ব্যপারে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন,তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। (মাথার দিক থেকে) এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”(সূরাঃ আহযাব-৫৯)
রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে,এই চাদর উড়নার উপর পরিধান করা হতো এবং চেহারার উপর তা ঝুলিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে দেওয়া হতো। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। এই চাদর মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা হতো এবং মাথার উপর দিয়ে ছেড়ে দিয়ে চেহারা ঢেকে দেয়া হতো। এখানে চাদর বলা হয়েছে কারন আমাদের নবী পত্নী ও কন্যাদের আমলে পর্দা করার জন্য একধরনের মোটা চাদরের প্রচলন ছিলো যেটা দিয়ে উনারা পরিপূর্ণ পর্দা করতেন। যেটা অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো। আর সেই কষ্ট লাঘব করার জন্য পুরো শরীর ঢাকার জন্য “বোরকা” আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মুখমণ্ডল ঢাকার জন্য “নিকাব” আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়,শরীরের কোনো অংশ দেখানো জায়েজ নেই। মুখমণ্ডল,হাত-পা-কে শরীরের অংশ হিসেবে ধরতে হবে।
এছাড়াও যারা যারা মাহরাম তাদেরকে দেখা দেওয়া জায়েজ আছে। অর্থাৎ যাদের সাথে বিয়ে বৈধ তাদেরকে দেখা দেওয়া হারাম! নারীদের জন্য মাহরাম (যাদের দেখা দেওয়া জায়েজ) ব্যক্তিরা হচ্ছেন,
📌নারীর মাহরাম হলেন ১৪ জন ব্যক্তি।
ক.বাবার মত ৫ জন।
১) বাবা
২) চাচা
৩) মামা
৪) শশুর
৫) দুধ-বাবা।
খ.ভাই-এর মত ৫ জন।
১) ভাই
২) দাদা
৩) নানা
৪) নাতি
৫) দুধ-ভাই।
গ.ছেলের মত ৪ জন।
১) ছেলে
২) ভাই-এর ছেলে
৩) বোনের ছেলে
৪) মেয়ের জামাই।
অতএব নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য এই ১৪
জন ব্যক্তি ব্যতীত আর কারো সঙ্গে দেখা করা বা দেখা দেওয়া জায়েজ নয়। (সূরাঃ আন-নূর -৩১)
এর পূর্বে যে রেফারেন্স গুলো দিলাম সেখানে পর্দা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে বুঝার জন্য সেগুলাই যথেষ্ট তবুও আপনার জানার জন্য আরো কিছু হাদিস উল্লেখ করছি। আরেকটি কথা,একেক হাদিস পর্দার একেকটি অংশ নিয়ে। তাই পর্দা সম্পর্কে জানতে হলে বা মানতে হলে পূর্ণ হাদিস অবলম্বন করতে হবে। অর্ধেক অর্ধেক দেখে বললে হবে না যে,এখানে তো মুখ ঢাকতে বলে নাই,এখানে তো হাত-পা ঢাকতে বলে নাই! মুখ ঢাকার ব্যপারে,হাত-পা ঢাকার ব্যাপারে আলাদা আলাদা হাদিস এসেছে তাই সবগুলো হাদিস অবলম্বন করুন।”
মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো প্রভা। আরমান বলতে লাগলো,””ইসলাম বিশ্বজনীন এক চিরন্তন ও শাশ্বত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে রয়েছে নারীর সম্মান,মর্যাদা ও সকল অধিকারের স্বীকৃতি,রয়েছে তাদের সতীত্ব সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী। তাদের সম্মান,মর্যাদা ও সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখতেই ইসলাম তাদের উপর আরোপ করেছে হিজাব বা পর্দা পালনের বিধান।
মূলত ‘হিজাব বা পর্দা’ নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ। নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়। এ বিধান অনুসরণের মাধ্যমে হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,“এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।”(সূরা আহযাব: ৫৩)
ইসলাম পর্দা পালনের যে বিধান আরোপ করেছে তা মূলত অশ্লীলতা ও ব্যভিচার নিরসনের লক্ষ্যে এবং সামাজিক অনিষ্টতা ও ফিতনা-ফাসাদ থেকে বাঁচার নিমিত্তেই করেছে। নারীদের প্রতি কোনো প্রকার অবিচার কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করেনি। বরং তাদের পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষার্থেই তাদের উপর এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,“আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”(সূরা আহযাব: ৩৩)
এ জন্য পর্দা-বিধান ইসলামী শরীয়তের পক্ষ থেকে সাধারণভাবে সমাজ-ব্যবস্থার এবং বিশেষভাবে উম্মতের নারীদের জন্য অনেক বড় ইহসান। এ বিধানটি মূলত ইসলামী শরীয়তের যথার্থতা,পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ এখন সময়ের দাবি।
“পর্দা” শব্দটি মূলত ফার্সী। যার আরবী প্রতিশব্দ ‘হিজাব’ পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ আবৃত করা,ঢেকে রাখা,আবরণ,আড়াল,অন্তরায়,আচ্ছাদান,বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া,আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়,নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন,নারী তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপলাবণ্য ও সৌর্ন্দয পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ইসলাম প্রণয়ন করেছে তাকে পর্দা বলা হয়। মূলত হিজাব বা পর্দা অর্থ শুধু পোশাকের আবরণই নয়,বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা,যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারী আচরণ রোধের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।
পর্দার বিধান সম্পর্কে জানুন। পর্দা ইসলামের সার্বক্ষণিক পালনীয় অপরিহার্য বিধান। কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল প্রমাণাদির ভিত্তিতে নামায,রোযা,হজ্জ,যাকাত ইত্যাদি বিধানাবলীর মতো সুস্পষ্ট এক ফরয বিধান। আল্লাহ তায়ালাই এ বিধানের প্রবর্তক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,“যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।”(সূরা আহযাব: ৫৩)
এ বিধানের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত থাকাই ঈমানের দাবি। এ বিধানকে হালকা মনে করা কিংবা এ বিধানকে অমান্য করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা ইসলামী শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধানের বিরোধিতা করার অধিকার কারো নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,“আল্লাহ এবং তার রাসূল কোনো বিষয়ের নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা কোনো মুমিন নারীর জন্য সে বিষয় অমান্য করার কোনো অধিকার থাকে না। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করে সে অবশ্যই পথভ্রষ্ট।”(সূরা আহযাব: ৩৬)
পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,“হে নবী আপনি আপনার স্ত্রী,কন্যা ও মুমিন নারীদেরকে বলুন,তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।”(সূরা আহযাব: ৫৯)
এ আয়াতে পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে যে,পর্দার সহিত চলাফেরা করলে সবাই বুঝতে পারবে তারা শরীফ ও চরিত্রবতী নারী। ফলে পর্দাশীল নারীদেরকে কেউ উত্যক্ত করার সাহস করবে না। প্রকৃতপক্ষে যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে অধিকাংশ সময় তারাই ইভটিজিং ও ধর্ষণসহ নানা রকমের নির্যাতনের সম্মুখীন হয় এবং রাস্তাঘাটে তারাই বেশি ঝামেলার শিকার হয়। তাই নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরু রক্ষার্থে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীস শরীফেও পর্দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,“নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়।”(তিরমিযী: ১১৭৩)
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন,একদা তিনি রাসূল (সা.) এর নিকটে ছিলেন। তখন নবী (সা.) (সাহাবীদের উদ্দেশ্যে) বললেন,“মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি?” তারা চুপ হয়ে গেলেন। (কেউ বলতে পারলেন না) অতপর আমি ফিরে এসে ফাতেমা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম,“মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় কোনটি?” তিনি বললেন,“কোনো পরপুরুষ তাকে দেখবে না।”(অর্থাৎ নারী পর্দাবৃত থাকবে) তারপর আমি ঐ বিষয়টি নবী (সা.) এর নিকট উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন,“নিশ্চয় ফাতেমা আমার অংশ,সে সত্য বলেছে।”(মুসনাদুল বাযযার: ৫২৬)
এতে পর্দার গুরুত্ব পরিস্ফূটিত হয়। আর পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনায় বিবেকের দাবীও তাই। এছাড়াও পর্দা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। কেননা হাদীস শরীফে বলা হয়েছে,আল্লাহ তায়ালা পর্দানশীনদের ভালোবাসেন। আর কোরআনে বলা হয়েছে,“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।”(সূরা হুজুরাত: ১৩)
প্রকৃত অর্থে তাকওয়া সম্পন্ন বা মুত্তাকী হলো ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর নির্দেশসমূহ মেনে চলে। আর সর্বসম্মতিক্রমে পর্দা আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ। যেহেতু পর্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য অবশ্য পালনীয় নির্দেশ সেহেতু পর্দা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত ও মর্যাদা সম্পন্ন হতে পারে। এছাড়াও পর্দা-বিধান সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে,এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হিফাযত হয়। পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় হয়। কারণ,পর্দা পালনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পরকিয়াবিহীন পবিত্র জীবন গঠিত হয় এবং চরিত্রহীনতা ও অবিশ্বাস তাদের থেকে বিদায় নেয়। তাই মুসলিম উম্মাহ অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে,দুনিয়া ও আখিরাতে পর্দার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
পর্দাহীনতার কারণে অশ্লীলতা,বেহায়াপনা,নির্লজ্জতা,অপকর্ম ও ব্যভিচারের মতো নিকৃষ্ট পাপের সূচনা হয়। যার কারণে ইভটিজিং,ধর্ষণ ও যৌন সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে নানা অঘটনসহ ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। যার বাস্তব চিত্র নিত্যদিনের সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে। এছাড়াও পর্দাহীনতার কারণে পরকিয়া ও চরিত্রহীনতার মতো ঘৃণিত কর্মের সূত্রপাত হয়। যার ফলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস উঠে যায়। এতে পরিবারে অশান্তি ও বিপর্যয় নেমে আসে। যার বাস্তবতা আজ আমাদের নখদর্পণে। মূলত পর্দাহীন নারীরা হচ্ছে জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট নারী। তাদের ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেন,“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারাই যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে।”(বায়হাকী: ১৩২৫৬)
তাই আমরা বলতে পারি যে,সুসভ্য ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী নারী কিছুতেই পর্দাহীন হতে পারে না। এমনকী অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল (সা.) তাদেরকে লানত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন,“নবী করিম (সা.) লানত (অভিশাপ) দিয়েছেন সেসব নারীদেরকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। অর্থাৎ পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে।”(আবু দাউদ: ৪০৯৭)
এছাড়াও পর্দাহীনতার কারণে আল্লাহর বিধানকে অমান্য করা হয়। আর এ অবাধ্যতার কারণে আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,নবী (সা.) বলেন,দুই শ্রেণীর জাহান্নামীদেরকে আমি দেখিনি। (অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে সমাজে তাদের দেখা যাবে)
১) এমন সম্প্রদায়,যাদের হাতে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে,আর সেই চাবুক দিয়ে তারা (অন্যায়ভাবে) মানুষকে প্রহার করবে।
২) এমন নারী,যারা পোশাক পরিধান করা সত্ত্বেও নগ্ন। তারা অন্যদেরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা হবে উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না,এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না,অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ অনেক অনেক দূর থেকেও পাওয়া যায়।(মুসলিম: ৫৪৪৫)
এ হাদীসে মূলত পর্দাহীনতার ভয়াবহ পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে যে,তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এমনকী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। এ বিষয়টি অন্যত্র আরো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
১) পিতা-মাতার অবাধ্যকারী।
২) দাইয়ুস (অর্থাৎ এমন পুরুষ,যে তার অধীনস্ত নারীদেরকে পর্দায় রাখে না।)
৩) পুরুষের ন্যায় চলাফেরা করা নারী (অর্থাৎ বেপর্দা নারী) (মুসতাদরাকুল হাকিম: ২৪৪)
এ হাদীস থেকে পর্দাহীনতার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানা যায় যে,তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। তাই জান্নাত প্রত্যাশী কোনো নারী কিছুতেই পর্দাহীন হতে পারে না। এ হাদীস থেকে আরো জানা যায় যে,যেসব পুরুষ তাদের অধীনস্ত নারীদের পর্দায় রাখার চেষ্টা করে না,তাদের জন্যও অনুরূপ পরিণতি।
_______
চলবে।