#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ৩১
সন্ধ্যার দিকে কিচেনে রান্না করছিলো মাহানুর। জয়া বেগম পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আরহামের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কথা বলছে দুইজন। রাবেয়া সকাল থেকে ভীষণ অসুস্থ। জ্বর হয়েছে তার তাই মেডিসিন নিয়ে সারাদিন ঘুমিয়েই ছিল। রুমকি আবার তাদের সাথেই আছে। আরহাম এখনো কল করেনি। মাহানুরের একটুআরেকটু চিন্তা হচ্ছে। এতো সময় লাগে একটা কল করতে! রিদের সাথে মাহানুরের বিকালে কথা হয়েছিলো। সুন্দর মতো নিজের একাকির সংসার গুছিয়ে নিয়েছে সে। মাহানুরের যেকোনো দরকারে যাতে কল দেয় সেটাও বলে দিয়েছে।
রিদ একজন সুপুরুষ মাহানুরের নজরে। একটু ছন্নছাড়া হলেও মানুষকে অনেক জলদি আপন করে নিতে পারে সে। যদি না আজ রিদের বাবা কোনো গেঞ্জাম করতো তাহলে এখন অহনা আর রিদের একটা সুন্দর সংসার হয়ে যেত! কিন্তু আপসোস হলো না।
-আমি তোমার বড়মার মুখে শুনেছিলাম তুমি নাকি অনেক ভালো নাচতে পারো মাহানুর?
-একটু আরেকটু পারি মা।
-হয়েছে এখন লজ্জা পেতে হবে না। আর কী কী পারো তুমি?
-আর তেমন কিছু পারি না মা।
-ওহ। আরহাম কী এই কয়দিনে তোমার সাথে কোনোরকম রাগারাগি করেছে?
-না মা। বরং আমিই উল্টো রাগ দেখিয়েছি তার সাথে।
-যাক। আমি তোমাদের বিয়ের পর থেকে একটা ভয়ের মধ্যে ছিলাম। আরহাম অনেক বেশি রাগী আর ঘাড়তেড়া স্বভাবের। এই কয়দিন ওকে তোমার সাথে এতো স্বাভাবিক ব্যবহার করতে দেখে ক্ষণে ক্ষণে আমি অবাক হয়েছি।
মাহানুর কাজ করতে করতে মুচকি হাসলো। আরো কিছুক্ষন কথা বলল দুইজন মিলে। রাতে ডিনার কমপ্লিট করে রাবেয়াকে মেডিসিন খাইয়ে নিজের রুমে আসে মাহানুর। দরজা লাগিয়ে ওড়না ছুঁড়ে ফেলে সোফায়। ঘরের আনাচে কানাচে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সুবাস ঘুরপাক খাচ্ছে। চুপচাপ থাকলেই মাহানুরের মস্তিকে চেপে বসছে আরহাম আর আরহাম। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলানো আরহামের ছবিগুলো মাহানুরকে একদম পাগল বানিয়ে ফেলছে। এই বুঝি ছবি থেকে বের হয়ে আসলো আরহাম! এই বুঝি কঠিন স্বরে তাকে ধমক দিলো! অসভ্য মার্কা কথা বলে তাকে লজ্জায় ফেললো! ভাবনায় বিভোর মাহানুর ল্যাপটপ আর কিছু ফাইল নিয়ে সোফায় বসলো। চার্জার খুলে ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনে কতগুলো মিসড কল দেখতে পেলো। অহনা কল দিয়েছিলো তার বাবার নাম্বার দিয়ে। মাহানুর অভিমানে মুখ ভেংচি কাটলো। পাশেই রেখে দিলো ফোন। ফাইল চেক করতে করতে তার শামীরের ইনফরমেশনের ফাইলটা নজরে পরলো। আগ্রহী হয়ে ফাইল খুলে দেখতে শুরু করলো। নাম শামীর আহমেদ, বয়স সাতাশ বছর। সে আগেও কয়েকটা বড় বড় কোম্পানিতে জব করেছে। কিন্তু অবাকজনক বিষয় হলো সে বাংলাদেশের নাগরিক না। তার ন্যাশনালিটিতে জাপান দেওয়া। হতেই পারে অন্য দেশ থেকে এখানে কাজের জন্য এসেছে। ফ্যামিলি, ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তেমন কোনো ইনফরমেশন নেই। মাহানুর শুধুই এটা নিয়ে আর মাথা ঘামালো না।
মাহানুরের কাজে মন বসছে না আজ। মন যে একটাই সেটাও আবার এখন অন্য একজনকে দিয়ে দিয়েছে তাহলে অন্যকিছুতে কিভাবে বসবে! আবারো ফোন হাতে নিলো। আরহামের ছবি বের করে দেখতে থাকলো। তাঁদের মেঘালয় থাকাকালীন আরহামের অনেকগুলো ছবিই জমা হয়েছে তার ফোনে। অনেক সময় নিয়ে ছবি দেখা হলে আয়াসকে কল করলো। এখন যদি আয়াসের সাথে কথা বললেই তার মুড ভালো হয়! অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরও কল রিসিভ করলো না আয়াস। মাহানুর একটু চিন্তিত হয়ে সায়রিনকে কল করলো। প্রথমবারেই কল রিসিভ করে সে।
-হ্যালো। মাহানুর?
-হ্যাঁ ভাবি ভালো আছো? বাসার সবাই ভালো আছে?
সায়রিন কিছুক্ষন সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
-হ্যাঁ আমরা ঠিক আছি। তুমি বলো জামাইকে ছাড়া কেমন লাগছে?
-একদম ফাটাফাটি লাগছে।
-কী বলো! তোমার ভাইয়া কাজের জন্য বাহির দেশে গেলে তো আমার কলিজাই ছিঁড়ে যায়!
-কোথায় আপনারা আর কোথায় আমরা! যাক বড়মার মুখে শুনেছিলাম তুমি নাকি অসুস্থ। কী হয়েছিলো?
-আ আসলে সত্যি কথা এখনো কাউকে বলিনি বাট তোমার থেকে আর কী লুকাবো। তুমি হয়তো ফুঁপ্পি হবে মাহানুর।
-সত্যি! কবে জানলে তুমি? কয়মাস চলছে? ভাইয়া জানে?
খুশিতে আত্মহারা মাহানুর। এই দিনের জন্য কতকাল অপেক্ষা করেছে সে। একটা ছোট বাবু আসবে তাঁদের পরিবারের। একদম গুলুমুলু। অনেক আদর করবে সবাই তাকে! আদৌ আদৌ কণ্ঠে তাকে ফুঁপ্পি বলে ডাকবে। সায়রিন মাহানুরের এতো প্রশ্ন শুনে বলে,
-কাম ডাউন ননদিনি। আমি এখনো কাউকে জানাই নি কারণ আমি নিজেও সিউর না। আগামীকাল হসপিটাল যাবো তারপর সবাইকে জানাবো।
-ওহ আচ্ছা। একা হসপিটাল যেয়েও না আবার।
-না একজন ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাবো।
-আচ্ছা। সিউর হওয়ার পর আমাকে জানিও। এখন রাখি তাহলে।
-ঠিক আছে।
-নিজের খেয়াল রাখবে। বায় বায়।
কল কেটে ফোন হাতে নিয়ে বসে রইলো মাহানুর। এখন যদি আরহামের একটা কল আসতো।আপসোস আসবে না। সহসা আবারো অহনা কল দিলো তার বাবার ফোন দিয়ে। মাহানুর কিছুক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে কল রিসিভ করলো।
-কোথায় ছিলি তুই? আমি কতবার কল দিলাম!
-একটু ব্যস্ত ছিলাম।
-অফিস জয়েন করেছিস বলে? কেমন কাটলো প্রথমদিন?
-মোটামুটি ভালোই।
-ঐখানের সবাই ভালো আছে?
-আছে।
-সিয়ামের সাথে কথা হয়েছিলো বিকালে। আরহাম ভাই নাকি চলে গিয়েছে?
-হুম।
অহনা মাহানুর কঠিন কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলো মাহানুর এখনো তার ওপর রেগে আছে। অহনার মন চাইলো ইচ্ছে মতো কান্নাকাটি করে বেস্টফ্রেন্ডকে মনের সকল কথা খুলে বলতে। সেও যে ভালো নেই ঐখানে। ভিতর ভিতর দম বন্ধকর অবস্থা তার। না পারছে চিৎকার করে কাঁদতে আর না পারছে কাউকে মনের কথা বলতে। ঐপাশের মাহানুরও চুপ অহনাও চুপ। অহনা দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,
-কিছু বলছিস না যে?
-কী বলবো?
-তুই কী কোনোদিনও আমাকে মাফ করবি না মাহানুর?
-কিসের মাফের কথা বলছিস?
-কিছু না। ঐখানের সবাই ভালো আছে?
-একবার না জিগ্যেস করলি।
-ওহ হ্যাঁ! ভুলেই গিয়েছিলাম।
-রিদ ভাইও ভালো আছে।
অহনা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সে ইনিয়ে বিনিয়ে মাহানুরকে রিদের কথাই জিগ্যেস করছিলো। যাক মাহানুরও বুঝে ফেলেছে। কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বলল,
-সে ভালো থাকুক বা খারাপ থাকুক তাতে আমার কোনো আহে যায় না। আমি জাস্ট তোদের সবার কথাই জিগ্যেস করেছিলাম।
-আচ্ছা।
-রাখি।
-রাখ।
কথা শেষ হতেই মাহানুর সোফায় ছুঁড়ে ফেললো হাতের ফোন। দুইহাত দিয়ে মাথা চেপে নির্বাক হয়ে বসে রইলো। কেউই ভালো নেই। না অহনা সেখানে গিয়ে শান্তিতে আছে! না রিদ আর না সে। সবাই দিনশেষে অসুখী! শুধুমাত্র ঐ শয়’তা’ন বেটার জন্য। ছাড়বে নাতো মাহানুর তাকে।
__________________
ছাদের দোলনায় বসে আছে সুনহেরা। চোখ বন্ধ করে দুলছে শুধুই। আয়াসের সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। বিয়ের পর আজই প্রথম ঝগড়া তাঁদের। দুপুরে আবার সেই মেয়েটির ঘটনা। সুনহেরা নিজেই মেয়ের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ দিয়ে এসেছে। মেয়ের সাথে একটা সাইড ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগে মেয়েটার ফোন পায়। সুনহেরা তৎক্ষণাৎ মেয়ের পরিবারকে কল দিয়ে বিষয়টা জানিয়ে দেয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে দুইজন মধ্যবয়স্ক মহিলা আর একজন যুবক আসে। সুনহেরা তাঁদের পরিচয় জিগ্যেস করলে তারা বলে দুইজন মহিলা মেয়েটির মা আর খালা আর যুবক মেয়েটার ভাই। সুনহেরা তাঁদের সবটা খুলে বলে। তারা অনেক কৃতজ্ঞ সুনহেরার ওপর। এতো কিছুর মধ্যে আর মার সাথে দেখা করতে যেতে পারেনি সে। বিকালে বাসায় চলে আসে। হাজেরা, লুৎফা তার পরিহিত জামায় রক্ত দেখে সেইসময় বিচলিত হয়ে পরে। সুনহেরা পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বলে নিজের রুমে চলে আসে। লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে আয়াসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সন্ধ্যার দিকে সবাই একসাথে নাস্তা করছিলো তখন বাসায় আসে আয়াস। এলোমেলো চুল, গায়ে এপ্রোন বুকের দিক দিয়ে ছেঁড়া। কেমন উস্কোখুস্ক দেখাচ্ছে! হাজেরা দৌড়ে যায় ছেলের কাছে। সুনহেরাও পিছু পিছু যায়। হাজেরা চিন্তিত হয়ে বললেন,
-বাবা এই অবস্থা কেনো তোর? কারো সাথে মারামারি করেছিস তুই?
আয়াস কোনো উত্তর না দিয়ে সবাইকে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে ওপরে চলে গেলো। হাজেরা কাঁদো কাঁদো হয়ে ওপরে যেতে নিলে হামজা খান তাকে আটকান। গুরুগম্ভীর স্বরে তিনি বললেন,
-তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই হাজেরা। সুনহেরা মা তুমি যেয়ে দেখো তো।
-জি বাবা।
সুনহেরা ওড়না চেপে ধরে একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে। রুমে প্রবেশ করে দেখতে পায় আয়াস শার্ট খুলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাতে লজ্জা করলেও সুনহেরা আপাদত লজ্জাসরম বিসর্জন দিয়ে আয়াসের দিকে তাকালো। ফর্সা বুকে অনেক জায়গায় আঘাত লাগায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পিঠেও কয়েক জায়গায় একই অবস্থা। সুনহেরা এগিয়ে যেতে যেতে উৎকণ্ঠা হয়ে বলল,
-এতো আঘাত কিভাবে পেলেন আপনি?
আয়াস প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। নিজের মতো দুই পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পরলো। সুনহেরা শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে আয়াসের পাশে বসলো। আমতা আমতা করে বলল,
-আমার দিকে ঘুরে বসুন।
-আহামরি কিছু হয়নি তাই এতো আদিখ্যেতার প্রয়োজন নেই।
-জায়গায় রক্ত জমে আছে আর আপনি বলছেন আহামরি কিছু হয়নি! চোখ কী বাহিরে রেখে এসেছেন?
আবারও গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে রইলো আয়াস। রাগে মাথা টনটন করছে তার। সুনহেরা অনেকবার আয়াসকে তার দিকে ঘুরে বসতে বলে। শেষে বিরক্ত হয়ে নিজেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়াসের মুখ বরাবর মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে পরলো। চোখ মুখে চিন্তার রেশ তার। যেই আয়াসের বুকে হাত লাগাতে যাবে বিকট শব্দে ধমক দিয়ে উঠলো আয়াস।
-কিসের এতো আলগা দরৎ দেখাচ্ছেন আপনি? আমি যেহেতু একবার বলেছি আমি ঠিক আছি কারো দেখানোর মাত্র সেবার প্রয়োজন নেই আমার তারপরও কেনো জোর করছেন সুনহেরা?
কেঁপে উঠলো সুনহেরা। হাত পা ধরধর করে কাঁপছে তার। বুঝদার হওয়ার পর জীবনে প্রথম এইরকম ভয়ংকর ধমক শুনলো সে। তবুও এক পা ও নড়লো না। আয়াসের মুখোমুখিই বসে উল্টো রণরণে স্বরে বলে,
-এখন আমার সেবা করা যদি আপনার আলগা দরৎ মনে হয় তাহলে সেটাই হোক। তবুও আমি এখন বেন্ডেজ করেই এখন থেকে উঠবো।
-আমি একবার যেটা না করেছি সেটা না-ই। বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না।
সুনহেরা কিছু বলল না। তুলায় খানিকটা মেডিসিন লাগিয়ে হাত বাড়াতে গেলেই আয়াস ধপ করে তার হাত ধরে জোর করে দাঁড় করালো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
-কেনো এইরকম ব্যবহার করছে যেনো আপনি আমাকে ভালোবাসেন! মিথ্যে নাটক আমি দুই চোখে সহ্য করতে পারি না মনে রাখবেন এটা।
-আমি কোনো নাটক করছি না আয়াস। আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারেননা আপনি।
আয়াস তাচ্ছিল্যা হেসে দূরে সরিয়ে দিলো সুনহেরাকে। চিৎকার করে বলল,
-সরে যান আমার কাছ থেকে। আমার নিজের জন্য আমি নিজেই এনাফ আপনাকে আমার একটুও প্রয়োজন নেই।
শেষের কথাটাই যথেষ্ট ছিল সুনহেরার নরম মনকে চুরমার করে দিতে। টলমলে নজরে শুধুই তাকিয়ে রইলো আয়াসের দিকে। ধুরুম ধুরুম পা ফেলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মনে মনে ভাবলো আর কখন আয়াসের সাথে কথা বলবে না সে আর না কোনো আদিখ্যেতা দেখাতে যাবে। তখন থেকেই ছাদে এসে বসে আছে সে।
এভাবেই ঘন্টাখানিকের মতো কেটে গেলো। সুনহেরা ভেবেছিলো আয়াস হয়তো আসবে। কিন্তু আসলো না। ব্যথিত মন নিয়ে দোলনায় পা তুলে মাথা গুঁজে বসে রইলো সুনহেরা। অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে তার। পছন্দের পুরুষরা এতো উপেক্ষা কেনো করে? তারা কেনো বুঝে বা বোঝার প্রয়াস করে না আমাদের হৃদয়ের কথা! দুনিয়ার সবচেয়ে বেকুব মানুষ তো তারাই!
মনে মনে এইরকম হাজারো কথা ভাবছে সুনহেরা এমন সময় কাঁধে কারো ছোঁয়া অনুভব করে। চট জলদি মাথা তুলে তাকায়। হাজেরা এসেছে। ধাতস্থ নিজেকে ঠিক করে একটু সরে বসলো সে। হাজেরা বিমর্ষ। সুনহেরার পাশে বসলো। হাত বাড়িয়ে সুনহেরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মৃদু স্বরে ফোঁপাচ্ছে সুনহেরা। হাজেরা বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে।
-আয়াস এইরকম ব্যবহার করবে আমার ভাবনায়ও ছিল না রে মা। অনেক বড় কিছু হয়েছে যার জন্যই আমার শান্তশিষ্ট ছেলেটা এতো রেগে গিয়েছে।
-অনেক আঘাত পেয়েছে সে। আপনি একটু যেয়ে ওকে বেন্ডেজ করে দিয়ে আসবেন মা।
-গিয়েছিলাম আমি। রুম অন্ধকার করে শুইয়ে আছে। কয়েকবার ডাকলাম কোনো শব্দ করেনি তারপর চলে আসলাম।
-সে কেনো বুঝে না এভাবে থাকলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।
হাজেরা আনমনে হেসে ফেলল। সুনহেরা মাথা তুলে তার দিকে তাকান। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
-মা হাসছেন কেনো?
-যাক এখন আর ছোট ছেলের জন্য আমার চিন্তা করতে হবে না। আমার মতোই একজন এসে গিয়ে তার জীবনে।
সুনহেরা মুখ ছোট করে ফেলল। একটু একটু লজ্জা পাচ্ছে সে। হাজেরা থুতনি ধরে মাথা ওপরে তুললো তার। মুচকি হেসে বললেন,
-এভাবে সবসময় আমার ছেলের পাশে থেকো মা।
-জি মা।
-এখন এসো খাবার খেয়ে রুমে যাও।
-আমি এখন খাবো না মা। আপনারা ডিনার করে ফেলুন আমি পরে খাবো।
-এটা বললে তো হবে না। এসো।
-মা প্লিজ আমি পরে করি।
-ঠিক আছে। আয়াসকে নিয়ে পরে করিও এখন রুমে চলো।
-জি।
-কিছু বললে আমাকে বিচার দিবে। বুঝলে?
-আচ্ছা মা।
দোলনা থেকে নেমে দাঁড়ালো দুইজন। হাজেরার পিছন পিছন নিজের রুমে আসলো সুনহেরা। আসলেই বিদঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে আছে পুরো কামরা। সুনহেরা সাবধানে পা ফেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। আস্তেধীরে দরজা চাপিয়ে দিলো। সময় তখন দশটা বাজে। ফোনটা কাবাডের ওপরে রেখে ডিমলাইট অন করলো। ক্ষীণ আলোয় কোমল পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। টানটান হয়ে শুইয়ে আছে আয়াস। সুনহেরা পাশে বসলো ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে। আয়াসের কপালে হাত দিয়ে দেখলো সে জেগে আছে কী না। কিন্তু না আয়াস ঘুমে বিভোর। সুনহেরা বড় একটি হাসি দিলো। আলগোছে আয়াসের পরিহিত শার্টয়ের বোতাম খুলে ফেলল। নীল আলোতে রক্তও কেমন যেনো নীল নীল দেখাচ্ছে। সুনহেরা দ্রুত হাত চালিয়ে মেডিসিন দিয়ে বেন্ডেজ করে দিলো। মাথা উঁচু করে গলায় চেক করলো আঘাত লেগেছে কী না। কাজ শেষ হলে পুনরায় আয়াসের শার্টয়ের বোতাম লাগিয়ে দিলো। সস্থির নিঃশাস নিয়ে পাশে ফিরতেই আয়াসে অবহেলায় পরে থাকা ফোনটি তার নজরে পরলো। কী মনে করে হাতে তুলে নিলো ফোন। প্রথমে গ্যালারিতে ঢুকলো। আয়াসের কয়েকটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। মনে মনে বলল,
-ইসসস কী কিউট আমার জামাইটা! যাক সুনহেরা বেবি তুমি জিতছো।
একা একাই হাসতে হাসতে হোয়াটস্যাপ এ ঢুকলো সুনহেরা। সবগুলোই ছেলেদের মেসেজ। সহসা অচেনা একটি নাম্বার দেখে টনক নড়লো সুনহেরার। ভ্রু কুঁচকে নাম্বারে ক্লিক করলো। সাথে সাথেই তার মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে গেলো। হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগলো। ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফোন। আয়াস এই ছবি গুলো দেখেছে! এর জন্যই তার সাথে এইরকম ব্যবহার করছে? আয়াসের নজরে এখন সে চরিত্রহীন মেয়ে! অঝোরে কেঁদে ফেলল সুনহেরা। শব্দ যাতে না হয় তাই নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। কান্না করতে করতে নিঃশাস ভারী হয়ে এলো তার। একসময় ক্লান্ত হয়ে আয়াসের বুকে মাথা রাখলো। কান্নারত্ব স্বরে মিনমিনে বলল,
-আমি জানি আপনি আমাকে অবিশ্বাস করবেন না আয়াস। এতদিনে একটু হলেও তো আমাকে চিনেছেন! বিশ্বাস করুন আপনার স্ত্রী এইরকম মেয়ে না। বিশ্বাস করুন।
_______________________
রাতের খাবার শেষ করে মাত্রই ঘুমানোর জন্য বিছানায় উঠেছিল রিদ। এমন সময় তীব্র ফোনের আওয়াজ শুনে প্রাণ পাখি যেনো উড়ে গেলো তার। এমনেই এতো বড় ফ্লাটে রাত কাটাবে ভেবে ভয়ে বারে বারে ঘেমে যাচ্ছে তারওপর রাতবিরাতে এইরকম হুটহাট ফোনে আসলে ভয় কী লাগবে না! বিছানা থেকে নিচে পরে গিয়েছিল রিদ। কোমর ধরে কোনোরকম উঠে দাঁড়ালো।
-ওরে বাপুরে কেডা আমারে অকালে মাইরা ফেলতে চায় ভাই!
কিড়মিড় করতে করতে ফোন হাতে নিলো। অচেনা নাম্বার দেখে রাগটা মাথা চড়া দিয়ে উঠলো। কল রিসিভ করে আয়াস বলল,
-কোন শালারে আমারে হার্টস্টোক দিতে এই রাইতে কল দিসে?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।
-এরে ভাই মুখে সুপারি ঢুকিয়ে রেখেছেন নাকি টয়লেটে গিয়ে মেইন কাজ করতে বসে কল দিয়েছেন?
এবারও কোনো আওয়াজ এলো না অপরপাশ থেকে। শুধুই ভারী নিঃশাসের আওয়াজ শোনা গেলো। রিদ এবার দ্বিগুন চটে গেলো। উঁচু শব্দে বলল,
-ধেৎ বা’লছাল! সুন্দরী পোলা পাইলেই খালি পিরিত করতে কল দেন নি মিয়া! আর কল দিলে ফোনের ভিতরে ঢুইকা আপনের গুষ্টি উদ্ধার করুম। একদম।
রিদকে চমকিত করে অপরপাশ থেকে কল কেটে দিলো। রিদ বুঝলো ও না কে ছিল মানুষটি। বালিশ ঠিক করতে করতে রিদ নিজের প্রতি প্রাউড ফীল করে বলল,
-বাহ্ বাহ্! দেখিস রিদ তোকে সবাই ভয় পায়! এবার ভুত আর কিছুই করতে পারবো না। আর যদি ভুত আহে তাইলে ঐটারে বিয়া কইরা ভুতের লগেই সংসার করুম। ভালোই হবে অহনাগহনা একজন সতীন পেয়ে যাবে!
>>>চলবে।
(আসসালামু ওলাইকুম। আমি জানি দেরিতে গল্প দিচ্ছি বলে আপনারা অনেকেই রেগে আছেন। বিশ্বাস করুন আমিও ইচ্ছে করে দেরি করছি না। যারা আমার আগের গল্পগুলো পড়েছেন তারা হয়তো জানেন আমি কখন এতো লেট করে গল্প দেইনি। এবার আমার শরীরের অবস্থা একটু বেশি খারাপ। তারপরও এখন আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের দোয়ায় অনেকটা সুস্থ হয়েছি। প্রতিদিন গল্পও দেবো।
ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ।)