অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১ ( সূচনা পর্ব

0
153

১.
-“বউ! আমার বউ কোথায়?”

তুর্যের আকস্মিক তর্জন গর্জনে কম্পিত হলো সুবিশাল চৌধুরী বাড়ি। ছেলের প্রায় সাত বছর পরে দেশে ফেরার আনন্দে এতক্ষন যে জলসা বসেছিল মুহুর্তেই ভাটা পড়লো তাতে। তুর্য চেঁচিয়ে উঠলো আবারও। অত্যন্ত ক্রোধের সাথে বলল,

-“আমার বউ চলে গেছে মানে কি? কোথায় গেছে সে?”

তুর্যের হঠাৎ এহেন আচরণে বাকরুদ্ধ চৌধুরী পরিবার। যে বউকে মানে না আর না কখনও মানবে বলে দেশ ছেড়েছিল তুর্য। আজ এত বছর পরে দেশে ফিরে ঘরে প্রবেশের পরবর্তী মুহুর্তেই বউয়ের খোঁজ করছে? উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে পড়েছে যেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। তুর্যকে ঠিক কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না কেউই। তবে ছেলেটার এই তর্জন গর্জন খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারলো না তার মা তাহমিনা বেগমের উপরে। তিনি এগিয়ে এলেন ছেলের পানে। কপাল কুঁচকে শুধালেন,

-“কিসের বউ? কার বউ?”

তুর্য যেন অবাক না হয়ে পারলো না। কার বউ মানে কি? তুর্য কপাল টানটান করে জবাব দিল,

-“অবশ্যই আমার বউ।”

-“সেটাই তো তোমার বউটা এলো কোথা থেকে?”

তুর্য কপাল কুঁচকালো। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“মা মজা করো‌ না তো। আমার বউকে বের করে আনো।”

তহমিনা বেগম দাঁতে দাঁত চাপলেন। তীক্ষ্ম কন্ঠে বললেন,

-“কোনো বউ নেই।”

-“মানে কি মা? আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার আজ থেকে সাত বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। সেই অনুপাতে আমার এখন ছোট খাটো মুরগির বাচ্চার মতো একটা বউ থাকার কথা। সেই বউ কোথায় আমার?”

-“সে বিয়ে তুমি তখন মানোনি। তাইতো কবুল বলার পর মুহুর্তে বউয়ের মুখ না দেখেই বিয়ের আসর ছেড়েছিলে, আর তারপর দেশ।”

তুর্যের মুখ খানায় কিছুটা অস্থিরতা প্রকাশ পেল। তবে কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বলল,

-“তাই বলে তো আর বিয়েটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। বিয়ে যখন করেছিলাম তখন সে আমার বউ। তাছাড়া তখন বিয়ে মানিনি এখন মানছি। আমার বউকে আমার কাছে ফেরত দাও।”

-“তখন যেহেতু মানোনি এখনও মানার দরকার নেই। ধরে নাও তোমার বিয়েই হয়নি।”

বিস্ময়ে তুর্যের চোয়াল ঝুলে পড়লো। একজন বিবাহিত পুরুষকে তার মা কি সুন্দর অবলীলায় বলল “ধরে নাও বিয়েই হয়নি।” এ কেমন কথা? তুর্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“পারবো না। বউ লাগবে আমার।”

-“এত বছর তো লাগেনি। এখন কি কারনে বউ লাগবে?”

তুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মায়ের পানে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,

-“তোমাকে বাবার যে কাজে লাগে আমারও আমার বউকে এখন সেই কাজেই লাগবে।”

ছেলের এহেন লাগামহীন কথার দাপটে পাশেই সোফায় বসে থাকা মোজাম্মেল চৌধুরী কেশে উঠলেন খুক খুক করে। ছেলেটা তার ছোট বেলা থেকেই নির্লজ্জ, লাগামহীন, জেদি এবং রাগচটা ধাঁচের। তাই তো ছেলেটাকে বেঁধে ফেলতে ঐ বয়সে বিয়ে করিয়েছিলেন কিন্তু হলো কি? হিতে বিপরীত। এখন তো আবার এই ছেলে এত বছর বিদেশে কাটিয়েছে। নিশ্চই নির্লজ্জতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন তাহমিনা বেগম। শক্ত কন্ঠে বললেন,

-“আমরা তোমাকে পৃথার সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম ওদের পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্কটা মজবুত করার উদ্দেশ্যে। তুমি ভালোভাবেই জানো ওর মা আর আমি সেই ছোট বেলা থেকে খুবই ভালো বান্ধবী ছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল ওর সাথে সম্পর্কটা দৃঢ় করার। নয়তো একজন বিশ বছরের তরতাজা যুবকের সাথে মাত্র ১০ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু তুমি বিয়েটা মানতে পারলে না। ভয় দেখিয়ে কবুল বলানোর পর মুহুর্তে বিয়ের আসর ত্যাগ করলে। বাচ্চা মেয়েটার মুখটা পর্যন্ত দেখলে না।”

এইটুকু বলে থামলেন তাহমিনা বেগম। আবার বললেন,

-“বিয়ের আসর ছাড়ার আগে একটা মুহুর্তের জন্যও ভাবলে না তোমার এমন পদক্ষেপে ঐ বাচ্চা মেয়ের উপরে কি নেমে আসবে। আমাদের সমাজ মোটেই ভালো নয়। তারা বিবাহের পর স্বামীর ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীকে মোটেই ভালোভাবে দেখে না। হয়তো পৃথা ছোট ছিল তবে ওর উপরেও তোমার পদক্ষেপের আঁচ আসতে শুরু করেছিল। মেয়েটা বাইরে বের হতে পারতো না, কেউ খেলতে নিতো না, মানুষ তিরস্কার করতো। ধীরে ধীরে শুধুমাত্র তোমার কারনে ওদের সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। আর ওর পরিবার চায়নি ওর উপর এই ঘটনার বিশাল কোনো আঁচ আসুক। ভুল বলো আর অন্যায় বলো আমাদের বড়দের ছিল ঐ ছোট্ট মেয়েটার তো ছিল না। এমনকি তখন ও বিয়ের মানেটাও ততটা বুঝে উঠতে পারেনি। মেয়েটা ছোট ছিল তাই ওর সাথে ঘটা কঠিন বিষয়গুলো বোঝার আগেই ওরা এলাকা ছাড়লো। তোমার বিদেশে পাড়ি দেওয়ার ছয় মাসের মাথায়ই ওরাও অন্যত্র চলে গেল।”

মায়ের সব কথা শুনে একটু নরম হলো তুর্য। শান্ত কন্ঠে বলল,

-“কোথায় গেছে ওরা?”

-“আমাদের জন্য এলাকা ছেড়েছে নিশ্চই আমাদের বলে যাবে না কোথায় গেছে।”

থামলেন তাহমিনা বেগম আবার বললেন,

-“দেখো ভুল যা করেছি আমরা বড়রা। এখানে তোমারও কোনো দোষ নেই কোনো। তুমি তখন বলেছিলে বিয়েটা তুমি করতে চাও না কিন্তু আমরা শুনিনি, জোর করেছি। আমরা আমাদের ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং তোমার কথাই মেনে নিয়েছি। গোপনে বিয়ে হয়েছিল আবার গোপনেই এই বিয়েটা দুই পরিবারই ভেঙে দিয়েছি এক প্রকার। শুধু বাকি রয়েছে তালাকটা। তা পৃথার বাবা বলেছেন মেয়ে প্রাপ্তবয়স্কা হলে নিজ দায়িত্বে তালাক নিয়ে নিবেন। সুতরাং এই বিষয়ে আর ঝামেলা করো না। যে বিয়ে তুমি কখনও মানোনি সেই বিয়ে নিয়ে চোটপাট দেখিও না।”

“তালাক!” শব্দটা কর্ণে পৌঁছাতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তুর্যর। যে বউয়ের জন্য এতকাল অপেক্ষা করেছে, এতকাল ছটফটিয়ে ম’রে’ছে সেই বউকে কিনা তালাক দিবে? অসম্ভব। তবে নিজের চিন্তার মধ্যভাগেই ছেলেটার মাথায় হুট করে আরেকটা চিন্তা হানা দিল। পিটপিট করে সে তাকালো মায়ের পানে। সন্দিহান সুরে বলল,

-“আচ্ছা তুমি আবার কোনোভাবে আমার থেকে পৃথাকে লুকিয়ে রাখোনি তো মা?”

তুর্যের এহেন কথায় বেজায় বিরক্ত হলেন তাহমিনা বেগম। এতকিছু বুঝিয়ে বলার পরও ছেলে কেমন উদ্ভট প্রশ্ন করছে? তিনি তো এতকাল জানতেন ছেলে কোনোদিন এই বিয়ে মানবে না তাই তো বিদেশ গিয়ে ঘাপটি মে’রে রয়েছিল। তাহলে পৃথাকে লুকিয়ে রেখে তার কি লাভ? ছেলের কথার উত্তর দিলেন না তাহমিনা বেগম। কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তুর্য মায়ের থেকে চোখ ঘুরালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“আরুশ!”

তুর্যের এমন ভ’য়ং’ক’র গম্ভীর কন্ঠে কেঁপে উঠলো আরুশ। ছেলেটা তুর্যের এসিস্ট্যান্ট। আজ প্রায় দুই বছর ধরে আরুশ রয়েছে তুর্যের সাথে। এর মধ্যে সহস্রবার তুর্যকে রেগে যেতে দেখেছে সে কিন্তু এতটা চোটপাট করতে দেখেনি। আরুশ কম্পিত কন্ঠে বলল,

-“জজ্বী স্যার।”

-“আমার বউকে খুঁজে বের কর।”

আরুশ মাথা চুলকালো। আমতা আমতা করে বলল,

-“আমি তো ম্যামকে চিনি না স্যার। যদি একটু বিস্তারিত বলতেন।”

আরুশের কথায় বিরক্ত হলো তুর্য। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-“আমার বউয়ের নাম পৃথা, পৃথা ইসলাম আর তার…”

থামলো তুর্য। মায়ের তাকিয়ে বলল,

-“আমার বউয়ের রাজাকার বাপটার নাম যেন কি মা?”

-“জানি না।”

তুর্যর মুখশ্রী গম্ভীর রূপ ধারন করলো। মায়ের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে সে তাকালো বাবার পানে। ছেলের দৃষ্টি নিজের উপর পড়ার সাথে সাথে অন্যদিকে ফিরলেন মোজাম্মেল চৌধুরী। তুর্য ভ্রু কুঁচকানো। বাবার দিকে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো মেঝ চাচা আব্বাস চৌধুরী আর ছোট চাচা আনিক চৌধুরীর পানে। তারাও দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে তাকালো অন্য দিকে। এরপর আবারও দৃষ্টি ঘুরালো সে, চাচি আর ঘরের ভাইবোনদের উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার আগেই দেখলো সব হাওয়া। দাঁতে দাঁত চালো তুর্য। কটমট করে বলল,

-“এই এরা! এরা আমার পরিবার? মোটেই না। এরা এক একটা বিশ্বাসঘাতকের গোডাউন। ঘষেটি বেগমের শিষ্য। এরা সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে আমার বউকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে তার রাজাকার বাপের হাতে তুলে দিয়ে আমাকে বউ ছাড়া করেছে। সব কটাকে আমি দেখে নিব, সব বিশ্বাসঘাতকের দল।”

এই টুকু বলে থামলো তুর্য। আদেশের সুরে বলল,

-“যত দ্রুত সম্ভব আমার বউকে খুঁজে বের কর আরুশ। নয়তো তোকে আমি পঁচা নর্দমায় গোসল করাবো।”

কথাটা বলেই ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল তুর্য। আরুশ বেচারা পড়লো মহা বিপদে। এখন সে কিভাবে তুর্যের বউকে খুঁজে বের করবে? এত বড় বাংলাদেশে শুধু নাম দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা যায়? কি এক যন্ত্রনা!

২.
তুর্য ধুপ ধাপ পা ফেলে নিজের কক্ষে এলো। ক্রোধে শরীর জ্বলছে ভীষন সাথে অন্তরও পুরছে। ঠিক কতটা আশা নিয়ে সে ফিরে এসেছিল দেশে। ভেবেছিল ছোট্ট বউটাকে আপন করে নিবে এবার। কিন্তু নাহ, সে বউটাই তো নেই তার। পরিবারের লোকেরা খুব তো তাকে জোর করে বিয়ে দিতে পেরেছিল তখন। তেমনি জোর করে বউটাকে রেখে দিতে পারেনি? চারদিকে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা আর বিশ্বাসঘাতক। তুর্য ক্রোধে জর্জরিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালো। হঠাৎ একটা লাগেজের পানে চোখ আটকে গেল তার। গোলাপি রঙের ছোট খাটো একটা লাগেজ। লাগেজটার পানে তাকিয়ে তুর্যর দৃষ্টি কিছুটা নরম হলো। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল সেদিকে।

চলবে…..

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১ ( সূচনা পর্ব )

NOTE : এই গল্প নিয়ে কিছু কথা –
১। সব লেখনীই যে সাহিত্য ঘেরা হবে তেমন নয়। কিছু লেখা হবে হাস্যরসাত্মক, কিছু প্রেমময়, কিছু বিষাদে পরিপূর্ণ। তেমনি এই গল্পটিও। আপনারা দয়া করে এর ভিতরে খুব বেশি সাহিত্য খুঁজতে আসবেন না। কিছু কিছু লেখা আছে লিখতে গেলেও হাসি পায়, মন ভালো হয়। এই লেখাটা আমি লিখছি শুধুমাত্র আমার মানসিক শান্তি এবং আপনাদের বিনোদনের জন্য।

২। এই গল্পটা আমার অন্যান্য গল্পের মতো প্রতিদিন পাবেন না। এটা শুধুমাত্র আমার যখন ইচ্ছে হবে তখনই লিখবো। এক প্রকার মানসিক শান্তির জন্য লিখবো। সুতরাং যারা ধৈর্য্য ধরতে পারবেন না বা অপেক্ষা করতে পারবেন না। মনে হবে, “প্রতিদিন দিতে পারবে না তাহলে দিয়েছে কেন?” তারা দয়া করে গল্পটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর একসাথে পড়বেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here