অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_২

0
133

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

গোলাপী রঙের ছোট খাটো একটা লাগেজ। লাগেজটার পানে তাকিয়ে তুর্যর দৃষ্টি কিছুটা নরম হলো। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল সেদিকে। এই লাগেজটা তুর্য তার বউয়ের জন্য এনেছিল। এই যে গোলাপি রংটা একদম পছন্দ নয় তুর্যের, দেখলেই কেমন গা গোলয়। অথচ নিজের শক্তপোক্ত পুরুষালী গম্ভীর সত্ত্বা ভেঙে এক প্রকার চোখ নাক বন্ধ করে দোকান থেকে সে এই রং এর একটি লাগেজই বাছাই করে এনেছে। ছোট বেলা থেকে নিজ ব্যক্তিত্তবোধে বরাবারই নারী সঙ্গ এড়িয়ে চলেছে ছেলেটা। সেই কারন বশত নারীদের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান নেই তুর্যর। তবে সে খুব করে চেয়েছিল তার তরফ থেকে দেওয়া প্রথম উপহারটা যেন পছন্দ হয় তার মাত্র ১৭ বছরের বাচ্চা বউয়ের। তাই তো দোকানে গিয়েই সে দোকানীকে শুনিয়েছিল,

-“মেয়েরা কোন রং টা বেশি পছন্দ করে?”

দোকানী দারুন কন্ঠে জবাব দিয়েছিল,

-“গোলাপী।”

তুর্য আর ডানে বামে তাকায়নি। নিজের অপছন্দের কথা চিন্তা না করে চিন্তা করেছিল তার কিশোরী বউয়ের পছন্দের কথা। ব্যস কিনে নিয়েছে এই গোলাপী রঙের লাগেজটা। পুরো লাগেজ ভরেছে অসংখ্য চকলেট, ছোট ছোট পুতুল, চুলের‌ ব্যান্ড, হাতের ব্রাসলেট, কানের দুল আরও মেয়েলী সামগ্রীতে। ভেবেছিল এই এত বছর পরে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই মুখ দর্শন করবে বউয়ের। খুব যতনে তার মান ভাঙাবে। মেয়েটাও হয়তো এত বছরে জমে অনেক অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসবে তার সম্মুখে। তুর্য সে অভিযোগগুলো ভীষন মন দিয়ে শুনবে। আদুরে ভঙ্গিতে বউকে বুকে আগলে নিবে। অথচ এটা কি হলো? বাড়ি ফিরে দেখলো তার বউই নেই। তার বিশ্বাসঘাতক পরিবারটা তার ছোট্ট বউটাকে ধরে রাখতে পারেনি। তুর্য বসে পড়লো বউয়ের জন্য আনা গোলাপী রঙের লাগেজটার পাশে। লাগেজে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যস্ত হলো পুরোনো স্মৃতি চারনে।

আজ থেকে সাত বছর আগে তখন তুর্যর বয়স মাত্র বিশ বছর। সদ্য তরতাজা এক যুবক সে, শরীরে টগবগে রক্তের দাপট। কেবলই অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েছিলো রাজনীতি নামক বেড়াজালে। সারাদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি থাকতো দলের সাথে। ছোট খাটো এক নেতাও হয়ে উঠেছিল। তেমনই একদিন কলেজ শেষে বন্ধু বান্ধবের সাথে এক সমাবেশে উপস্থিত থাকাকালে মোফাজ্জলের চৌধুরী কল করে বাড়িতে আসার তাগিদ দিল। প্রথমে সভা ছেড়ে তুর্য বাড়িতে আসায় রাজি না হলেও বাবার জোরাজুরিতে শেষে রাজি হয়েছিল। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরেও এলো। বাড়ি ফিরতেই বাবা জানালো তার বিয়ে। তাও কার সাথে! তার মায়ের বান্ধবীর মাত্র দশ বছরের মেয়ের সাথে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে মাত্র। মেয়েটাকে সে দেখেছে। বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় মেয়েটা প্রায়ই থাকতো এ বাড়িতে। ছোট খাটো চঞ্চল দেহী এক মেয়েটা দৌড়ে বেড়াতো পুরো বাড়িময়। তবে কখনও অতটা ভালোভাবে খেয়াল করে দেখা হয়নি। আর আজ কিনা তার সাথে বিয়ে? হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের সাথে? যার সাথে তার বয়সের পার্থক্য প্রায় ১০ বছরের। আচমকা এমন সংবাদে হতবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পড়েছিল তুর্য। কয়েক মিনিট কেটেছিল তার ঘোরের মধ্যে। ঘোর কাটতেই বাবা মাকে চিৎকার করে সে বলেছিল,

-“এই বিয়ে আমি করবো না।”

কিন্তু কেউ শোনেনি তার কথা। এক প্রকার ধরে বেঁধে বসিয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। তখনও তুর্য জেদ ধরে বসেছিল কবুল বলবে না। কিন্তু মোফাজ্জল চৌধুরী তেজ্য করার ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কবুল বলিয়েই ছেড়েছিল। সেও নিজের ক্রোধ আর জেদের বশেই কবুল বলার পর মুহুর্তে বউয়ের মুখ না দেখেই বিয়ের আসর ছেড়েছিল। যাওয়ার আগে অত্যন্ত ক্রোধের সাথে বলে গিয়েছিল,

-“বিয়ে করতে বলেছো বিয়ে করেছি এর বেশি আমার থেকে আর কিছু আশা করবে না। আমি না এই বিয়ে মানি আর না কখনও মানবো।”

বিয়ের আসরের সাথে সাথে তুর্য সেই দিনই বাড়িও ছেড়েছিল, উঠেছিল হোস্টেলে। বাবা মা বাড়ির সবাই অনেক চেষ্টা করেও বাড়িতে ফেরাতে পারেনি ছেলেকে। ঐ ক্রোধের বশেই মাত্র তার এক মাসের মাথায়ই দেশও ছেড়েছিল সে। ধীরে ধীরে ক্রোধ কমলো। অবচেতন মন বারবার জানান দিল তার বিয়ের কথা। হোক জোর করে বিয়ে, কিন্তু বিয়েটা তো তার হয়েছে। তবে বয়সের পার্থক্যের কথা ভেবে তুর্য দমাতে চেয়েছিল নিজের ভিতরকার চেতনাকে, পারেনি সে। দিন দিন কেমন ঐ ছোট্ট মেয়েটার প্রতি অনুভূতি প্রখররূপ ধারন করতে শুরু করলো। অদৃশ্য এক পিছুটান অনুভব করলো তার ফেলে আসা বউয়ের প্রতি। এই বুঝি পবিত্র সম্পর্কের টান! এই বুঝি ঐ কবুল বলার মাহাত্ম্য। তুর্য প্রাণপন চেষ্টা করেছিল নিজেকে দমাতে। ছোট্ট মেয়েটার থেকে মন সরাতে ঝুঁকতে চেয়েছিল অন্য নারীর প্রতিও। কিন্তু সে পারেনি। কোনো মেয়ের পানে পুরোপুরিভাবে তাকাতে গেলেই ভিতর থেকে বাঁধা দিতো কেউ একজন। স্বপ্নে এসে একটা ছোট খাটো মেয়ে শাসিয়ে বলে যেতো,

-“আমি ব্যতীত একদম অন্য কোনো মেয়ের পানে তাকাবেন না। তাহলে গলা টি’পে মেরে দেব একদম।”

ধীরে ধীরে সময় গড়ালো আরও। তুর্য অবাধ্য এক পিছুটানে আটকে গেল বাজেভাবে। একটা সময় বুঝলো সে নিজের অজান্তেই ভালোবাসে ফেলেছে তার বাচ্চা বউকে। অদেখা , না মানা বউটা ডা’কা’তে’র ন্যায় গ্রাস করে নিয়েছে তুর্যর হৃদয়কে। দিনে দিনে বউয়ের জন্য অস্থিরতা বাড়লো। বারবার সে ফিরে আসতে চেয়েছিল দেশে। কিন্তু সে পথ সে নিজেই বন্ধ করেছে। পড়াশোনা না করে দেশে ফেরা সম্ভব ছিল না। দিনের পর দিন ছটফটিয়ে মরেছে। একটা বার বউয়ের মুখটা দেখার জন্য হৃদয় উতলা হয়ে উঠেছিল ভীষনভাবে। বারবার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো বউয়ের সাথে। একটা বার কন্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তবে চক্ষু লজ্জায় কাউকে সে কথা বলতে পারেনি কাউকে। যেভাবে বউ মানবে না বলে দেশ ছেড়েছিল তাতে কারো কাছে বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা হচ্ছিলো। আর বাড়ির লোকও কখনও যেচে তার বউয়ের কথা বলেনি তাকে। তবে তুর্য ভেবেছিল তাকে যেভাবে জোর করে বিয়ে করিয়েছিল তেমনভাবেই তার পরিবার বউটাকেও জোর করে রাখবে। কিন্তু রাখেনি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সাথে। এক রাজাকারের পাল্লায় পড়ে ঘষেটি বেগমের ন্যায় আচরন করেছে। কোনো রকমে পড়াশোনার পাঁচ বছর শেষ করেই অবশ্য দেশে ফিরে চেয়েছিল তুর্য। কিন্তু মোফাজ্জেল চৌধুরী ব্যবসার কাজে আটকে দিল আবারও। শেষে সব কাজের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরলো প্রায় সাত বছর পর। আর ততদিনে সে বউ ছাড়া। কি এক যন্ত্রনার ব্যাপার।

৩.
ভোরের আলো ফুটেছে, নীল সুন্দর আকাশটাকে গ্রাস করে নিয়েছে উজ্জ্বল এক সূর্য। প্রতিদিনের তুলনায় আজ যেন সে একটু বেশিই দীপ্তি ছড়াচ্ছে। নিজের কক্ষ থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে একদম তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো তুর্য। ফর্সা শরীরে জড়িয়েছে কালো প্যান্ট আর সাদা সার্ট। কাঁধে ঝুলছে একখানা কালো কোর্ট। এর মধ্যে দেখতে দেখতে প্রায় দিন পাঁচেকের মতো কেটে গিয়েছে। তুর্য প্রান পন এই কয়দিন চেষ্টা করছে নিজের বউকে খুঁজে পাওয়ার। বাবা মা পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ খবর নিয়ে , চাপ সৃষ্টি করে এখনও অব্দি এই টুকু জানতে পেরেছে যে তার রাজাকার শ্বশুরটার নাম পলাশ সিকদার আর শ্বাশুড়ির নাম সুফিয়া বেগম। আর তারা রাজশাহীতে রয়েছে। কিন্তু তারা এখন রাজশাহীর ঠিক কোন স্থানে আছে সে খবর জানে না কেউই। তাছাড়া তারা এখান থেকে চলে গিয়েছে অনেক বছর। তাই এখানকার কারো সাথে তাদের যোগাযোগও নেই তেমন। ধুপ ধাপ পা ফেলে তুর্য এসে বসলো খাবার টেবিলে। কাঁধের কোর্টটা ঝুলিয়ে রাখলো চেয়ারের সাথে। ইতমধ্যে তুর্যের মা বাবা, ছোট দুই ভাই তৌফিক, তারেক এবং চাচা চাচীরা খেতে বসে পড়েছে টেবিলে। তুর্য নিজের প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল,

-“মা আমার বউটা কেমন ছিল?”

-“জানি না।”

তাহমিনা বেগমের কাঠকাঠ কন্ঠের জবাব। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তুর্যর। এই কয়দিন ধরে বউয়ের একটা ছবি চেয়েছিল তার মা তাকে দিতে পারেনি। এখন অন্তত এই টুকু তো বলবে তার বউকে দেখতে কেমন। নাহ তাও বলতে চাইছে না। কপালে ভাঁজ ফেলে তুর্য তাকালো নিজের বাবার পানে। সন্দিহান সুরে প্রশ্ন করলো,

-“আব্বু তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সাথে কি ঘষেটি বেগমের কোনো সম্পর্ক ছিল। মানে পূর্বপুরুষ…”

থামলো তুর্য। আবার বলল,

-“স্যরি ওটা পূর্বপুরুষ হবে না, পূর্বনারী হবে। ঘষেটি বেগম কি তাদের পূর্ব নারীদের মধ্যে কেউ একজন ছিল?”

ছেলের কথায় কিছুটা অবাক হলেন মোজাম্মেল চৌধুরী। তার শ্বশুর বাড়ির সাথে আবার ঘষেটি বেগমের সম্পর্ক কেন থাকবে? অবাক কন্ঠেই মোফাজ্জল চৌধুরী শুধালেন,

-“কেন?”

-“নয়তো তোমার বউ এই ঘষেটি বেগমের মতো আচার আচরণগুলো কোথা থেকে পেয়েছে বলোতো?”

তাহমিনা বেগম কটমট করে তাকালেন ছেলের পানে। এই ছেলের জন্য কিনা সে রাত দিন এক করে কেঁদেছেন। বারবার অনুতপ্ত হয়েছেন এটা ভেবে যে তার জন্য ছেলের জীবন নষ্ট হয়েছে? সে যদি ক্ষুনাক্ষরেও টের পেতেন তার ছেলেটা দিনে দিনে বিদেশের মাটিতে এমন বজ্জাত পয়দা হয়েছে তাহলে দেশে আসতেই বারন করে দিতেন। অবশ্যই কল করে বলে দিতেন,

-“তোমার বাবা দেশে ফেরার দরকার নেই। তুমি ঐ দেশের মাটিতেই ঘাঁটি গাড়ো।”

তবে তাহমিনা বেগম মুখে বললেন না কিছুই। এ ছেলের সাথে কথা বলা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন মিশে আছে বজ্জাতি আর নির্লজ্জতা। এরপর আর খাবার টেবিলে কথা হলো না তেমন। চুপচাপ হয়ে গেল সবাই। তুর্যও খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লো। আজ রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হবে সে। পুরো রাজশাহী চশে ফেলবে তবুও তার বউকে চাই ই চাই।

৪.
ব্যস্ত সড়কে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার ক্ষানিক পর পর ধীর গতিতে চলে উঠছে গাড়িগুলো। সময়টাও দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকালের দিকে ঠেকেছে। তুর্যরা কেবলই রাজশাহীর মধ্যে ঢুকেছে। ছোট খাটো একটা জ্যামে পড়ে আছে তাদের গাড়িটা। আরুশ সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আর পিছনের সিটে বসে ল্যাপটপে নিজের কিছু কাজ সারছিল তুর্য। আরুশ গাড়ির জানালা গলিয়ে তাকালো সম্মুখ পানে। দেখলো জ্যাম ছেড়েছে তবে তাদের সামনের গাড়িট চলছে না। ছেলেটা এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করে দেখলো সামনের গাড়ির পাশে ফাঁকা আছে চাইলেই ওভারটেক করার যায়। বাংলাদেশী রাস্তায় এই ওভারটেক আর কি? সাধারণ একটা ব্যাপার। আরুশ গাড়ি স্টার্ট করলো। সম্মুখের গাড়িটা ওভারটেক করে উঠতেই হুট করেই কেউ একজন এসে পড়লো গাড়ির সম্মুখে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here