বিয়েকথন শেখ জারা তাহমিদ সপ্তম পর্ব

0
46

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

সপ্তম পর্ব

আনাম হাসনাতকে যদি প্রশ্ন করা হয় নিজের কোন পরিচয়টা সবচেয়ে পছন্দ, নির্দ্বিধায় তার উত্তর হবে ‘অপরার বাবা’।

ছাত্র হিসেবে তিনি মোটামুটি ছিলেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা করার কোনো রকম উৎসাহ তার ছিলো না। তবুও স্নাতক শেষ করেছিলেন মায়ের জোরাজুরিতে। এক্ষেত্রে তার মায়ের যুক্তি ছিলো, ইন্টার পাশ ছেলের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হবে না! এমন উদ্ভট যুক্তি কে কবে শুনেছে! লোক হাসানোর আগেই তাই চুপচাপ মায়ের কথা মেনে নিয়েছেন। চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় হলেও, মায়ের বড় ছেলে তিনি। তাই হয়তো মায়ের অন্ধ স্নেহের পুরোটাই তার জন্য বরাদ্দ ছিলো। সেই স্নেহে তিনি বিগড়ে যান নি। বরং বাকি ভাই-বোনেরা ভাগে আদর যেটুকু কম পাচ্ছে সেটা নিজে তাদের পুষিয়ে দিয়েছেন।

উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আনাম হাসনাতের জীবনে প্রয়োজনীয় সকল প্রাচুর্য ছিলো। নটা-পাঁচটার চাকরি সেই প্রাচুর্যের স্ট্যাবেলিটি ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু সেসবে তার মন বসে নি। দাদাজানের কাপড়ের ব্যবসায় বরং তার আকর্ষন ছিলো বেশি। নারায়নগঞ্জে মাঝারি আকারের কারখানায় দাদাজানের অনেকদিনের ব্যবসা। তার বাবা-চাচা সেই ব্যবসায় যোগ দেন নি কখনোই। চাকুরে জীবন বেছে নিয়ে নিজেদের আলাদা সত্তা গড়ে তুলেছেন। দাদাজানের মৃত্যুর পর ব্যবসা যখন প্রায় হাতবদল হয়ে যাচ্ছিলো তখনই সেটাকে তিনি আঁকড়ে ধরেন। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের আনাম হাসনাত নড়বড়ে, ঝিমিয়ে আসা ব্যবসাটাকে শেষ থেকে শুরু করেন। পথটা সহজ ছিলো না। প্রথম দু-তিন বছর সীমিত লাভে ক্রেতাকে পণ্য দিয়েছেন, মার্কেট এনালাইসিস করেছেন, সমপর্যায়ের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো মানের আলাদা নকশার পোশাক তৈরি করেছেন, ব্যবসার সম্পূর্ণ মালিকানা এককভাবে নিজের করেছেন। স্নাতক শেষ ততোদিনে। স্নাতকোত্তরে পড়া থেকে শুধু ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়া বেশি লাভজনক মনে করেছেন। মায়ের কথা মানেন নি। সেই সুযোগে মা শর্ত জুড়ে দিলেন। হয় বিয়ে নয় স্নাতকোত্তর! বয়স সবে তখন চব্বিশ। এতো জলদি কে বিয়ে করে! বড় বোন আসমা হাসনাতের বছর আগে বিয়ে হয়েছে, তিনিও মায়ের কথায় সায় দিলেন। বললেন, “আমি শ্বশুরবাড়ি চলে আসায় বাড়ি ফাঁকা। তুই বিয়ে করে সেটা পূরন করে ফেল।”

মা-বড়বোনের অকাট্য যুক্তিতে হেরে তিনি বিয়ে করতে রাজি হলেন। মা, বোনদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকজনকে দেখলেন। শেষ পর্যন্ত বাবার কলিগের মেয়েকে সবার পছন্দ হলো। উনিশ বছরের কলেজ পড়ুয়া ইরাকে তার নিজেরও খুব পছন্দ হলো। চেনা-জানার সুযোগ তেমন পেলেন না। তবে ইরার তাকে অপছন্দ নয় সেটা নিশ্চিত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে ইরাকে বিয়ে করলেন প্রচন্ড শীতের এক বিকালে। বাপ-দাদার মগবাজারের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে সংসার সাজালেন নারায়ণগঞ্জ শহরে।

বিয়ের পরে ইরাকে চিনলেন নতুন করে। কথা কম বলা মেয়েটা চমৎকার সব কথা জানে। সেসব কথার একমাত্র শ্রোতা তিনি। রাঁধতে না জানা ইরার নিত্যদিন রান্না শেখার চেষ্টা৷ শুধুমাত্র তার জন্য। লাল-কালোর আচ্ছাদনে সংসার সাজানোয় মত্ত ইরা। কারন লাল-কালো তাদের পছন্দ। তার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র বড়দিদি’তে লিখেছিলেন ‘যাহার হৃদয়ে ভালোবাসা আছে, যে ভালেবাসিতে জানে-সে ভালোবাসিবেই’। শান্তশিষ্ট ইরার সান্নিধ্যে এসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কথাটা কত সত্যি। নীরবে, নিভৃতে তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া ইরা তাকে যত্ন করে ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ইরার মায়ায় পড়েছিলেন৷ সেই মায়া তার কাটেনি কোনোদিন। বরং মায়ার সঙ্গে ভালেবাসা মিলেমিশে ইরা তার আজীবনের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।

কলেজের পাঠ চুকিয়ে স্নাতকে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা ইরার বয়স তখন বিশ। ক’দিনের জ্বরে ক্লান্ত, দূর্বল শরীর নিয়ে যখন মাথা ঘুরে বারান্দায় পরে গেলো, সঙ্গে থাকা ছোট ননদ আরজু হাসনাত সামলে নিলো তখনকার মতো। তবে বিপদ ঘটলো দু’দিন পরের সন্ধ্যেয়। প্রচন্ড পেটে ব্যাথায় অস্থির ইরার রক্তপাত শুরু হলো। হসপিটালে যতক্ষণে নেয়া হয়েছে, ইরার জ্ঞান নেই। কর্তব্যরত ডাক্তার গাইনী বিভাগে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে জানা গেলো ইরার মিসক্যারেজ হয়েছে। ইরা প্রেগন্যান্ট ছিলো সেটা যেমন তারা বোঝেনি তেমনি মিসক্যারেজ কি করে হলো সেটাও কেউ বোঝেনি। ডাক্তার কারণ হিসেবে জানালেন, প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল নামের যে অঙ্গের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত সরবরাহ হয়, সেটার গঠনে ত্রুটি ছিলো।

এই দুর্ঘটনার রেশ ধরে ইরা চুপ হয়ে গেলো। কম কথা বলা ইরার সব কথারা যেনো এবার একেবারেই ফুরিয়ে গেলো। তার বয়স কম কিন্তু সে তো অবুঝ নয়। কেনো কিছু টের পেলো না? অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। সেসময়টায় পঁচিশের আনাম শক্তহাতে সামলালেন অসুস্থ ইরাকে। সর্বপ্রথম বাসা ছেড়ে দিলেন। নারায়নগঞ্জ শহরের আট মাসের সংসার ছেড়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। মগবাজারের বাসায় সবার মাঝে থেকে ইরা নিশ্চয়ই হাবিজাবি ভাবার সময় পাবে না। ব্যবসা তখন সামনে এগোচ্ছে, সেটাকেও তিনি শক্তহাতে ধরলেন। ঢাকা থেকে রোজ নারায়ণগঞ্জ এসে-যেয়ে ব্যবসার দেখভাল তার জন্য কঠিন ছিলো। কিন্তু ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া ইরাকে দেখা আরো কঠিন ছিলো। যে অতিথি তাদের জীবনে হঠাৎ এসে হঠাৎই চলে গেলো তার জন্য এক অদ্ভুত শূন্যতা তিনি বোধ করতেন। তবে প্রকাশ্যে সেটা কখনোই নিয়ে আসেন নি।

ইরার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বছর পার হলো। বলা যায় আনাম সাহেবের মায়ের সাপোর্টেই সে আবারও পড়াশোনায় ফিরলো। ছেলেকে দিয়ে যে আশা পূরণ হলো না ইরাকে দিয়েই সেটা সম্ভব করলেন আনাম সাহেবের মা। স্নাতক শেষে স্নাতকোত্তর, পুরো সময়টায় প্রিয় ছেলের বউকে আগলে রাখলেন তিনি। এই সময়টায় ইরা প্রতিক্ষণ নতুন কারো আসার অপেক্ষা করেছে। প্রত্যেকবার আশাহত হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে তার জন্য আনাম সাহেব বাবা হতে পারছেন না। কিন্তু তার এসকল কথা-বার্তা, চিন্তা-ভাবনা যে নিতান্তই অবান্তর সেটার প্রমাণ প্রতিবার পেয়েছেন। তাকে নিয়েই জীবন চমৎকার কেটে যাচ্ছে প্রতি মূহুর্তে সেটাই তাকে অনুভব করিয়েছেন আনাম হাসনাত। নতুন অতিথির এই চমৎকার জীবনে আসাটা হবে বোনাস। না এলেও সই। আনাম সাহেবের মা ইরাকে কঠিন হতে শেখালেন। সন্তান না-ই হতে পারে। এটা তার দোষ নয়। এই বাক্যটাই বারংবার তাকে বুঝিয়েছেন। একপর্যায়ে গিয়ে আফসোস করা বাদ দিয়ে জীবনের চক্রকে মেনে নিতে শুরু করা ইরা চাকরিতে যোগ দেন। জীবনে সব পেতে হবে, না পেলে নষ্ট জীবন, সেই চিত্র মন থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন শুরু করলেন।

আনাম সাহেবের ব্যবসা ততদিনে শক্তপোক্ত অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। দেশীয় মার্কেটে তার পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। জীবনের প্রথম গাড়িটা কিনলেন তখন। মা-কে সেই গাড়িতে চড়িয়ে শহর ঘুরে বেড়ালেন। মায়ের চোখেমুখে খেলে বেড়ানো আনন্দেরা তাকে জানালো অপূর্ণতায় ও তিনি পূর্ণ। মায়ের প্রতি ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় অনুভব করলেন কী ভীষন ভাগ্যবান তিনি। তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়াটা সবেই শুরু হয়েছিলো তখন। চাকরিতে ব্যস্ত ইরাকে নিয়ে সময় করে নেপাল ঘুরতে গেলেন। সেখানে পোশাকের চাহিদায় নতুন বিজনেস প্ল্যান মাথায় নিয়ে, ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। দেশে ফেরার মাসখানেক পরে একদিন ইরা জানালো তাদের জীবনের কাঙ্খিত অতিথির আগমন বার্তা। বিস্ময়ে তিনি হতবিহ্বল হলেন। মায়ের আনন্দাশ্রু, ভাই-বোনদের উচ্ছাস, ইরার কান্না, সবকিছুর ভীড়ে তিনি এক সম্পূর্ণ নতুন অনুভতির সাথে পরিচিত হলেন। বাবা হওয়া। বাবা হবেন তিনি।

ইরার প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশনস আছে অনেক। স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলো সে। মাসে দু’বার করে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। হাসব্যান্ড, মায়ের মতো শাশুড়ির যত্নে শুয়ে-বসে দিন কাটে তার। কথা কম বলা ইরা আশ্চর্যজনক ভাবে প্রচুর কথায় মুখরিত তখন। অতি সতর্কতায় প্রতিটাক্ষণ অপেক্ষায় দিন গুনে চলে। তবুও শেষ রক্ষা হলো না।

সাতমাসের নিয়মমাফিক চেক-আপে ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখে জানায় গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা জরায়ুর নিচে অবস্থান করছে। গর্ভফুলের অবস্থান সাধারণত জরায়ুর ভেতরে ওপরের দিকে থাকে। কোনো কারণে যদি এই গর্ভফুল জরায়ুর নিচের দিকে নেমে যায়, তখন তাকে মেডিকেলের ভাষায় বলে ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’। গর্ভফুল জরায়ুর নিচে অবস্থান করলে সন্তান প্রসবের আগেই জরায়ু স্ফীত হয়ে উঠে এবং গর্ভফুল আলাদা হতে শুরু করে। ফলাফল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রক্তশূন্যতা হয়ে মা শকে চলে গিয়ে মারা যায়।

ইরার প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল পর্দার মতো পাতলা। যার ফলে প্রথমবার সঠিক গঠন হয়নি। দ্বিতীয়বারেও সমস্যাটা ছিলো। তবে ডাক্তার আশায় ছিলেন ব্যাপারটা এতো খারাপের দিকে যাবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাচ্চা যতো বড় হচ্ছিলো তত গর্ভফুলের উপর চাপ পরছিলো। গর্ভফুল জরায়ুর লোয়ার ইউটেরাইন সেগমেন্ট অর্থাৎ নিচের দিকে থাকে, চাইলেই গর্ভফুলটা আকারে বড় হতে পারে না। ইরার ক্ষেত্রে গর্ভফুল টোটাল সেন্ট্রাল অবস্থায় আছে অর্থাৎ গর্ভফুল, জরায়ুর সম্পূর্ণ মুখই ঢেকে ফেলেছে। যেকোনো সময় রক্তপাত শুরু হতে পারে। অপারেশন ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। জরায়ুও হয়তো অপসারণ করা লাগতে পারে। বাচ্চাও মায়ের থেকে কোনো পুষ্টি সেরকমভাবে আর পাচ্ছে না। ওজনও কম। এক কথায় অপরিপক্ক। জন্মের পরপর তাকে এনআইসিও তে পাঠাতে হবে। যতদিন না নিজে থেকে নিশ্বাস নিতে পারবে, সেখানেই বাচ্চাটাকে রাখতে হবে। ডাক্তার দুদিন সময় নিলেন। ইরাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। দু’দিনে তার শরীরে স্যালাইনের মাধ্যমে নিউট্রিয়েন্টস চললো বিরতিহীন ভাবে। চার ব্যাগ রক্ত লাগবে, ডোনার খুঁজে বের করা হলো। পুরো সময়টায় ইরা শক্ত রইল। নতুন অতিথির জন্য সকল যুদ্ধে সে যেনো প্রস্তুত। আনাম হাসনাত অবাক হয়ে নতুন এক ইরাকে দেখলেন। বিমুগ্ধ হলেন। সাহস পেলেন। বিশ্বস্ত সেনাপতির মতো সঙ্গে রইলেন।

অতঃপর হালকা শীতের আমেজে, ২০০১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে, সাত মাসের প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চাটা এই দুনিয়ায় এলো। তিন ব্যাগ রক্ত লাগলেও জরায়ু অপসারণ করতে হলো না সেবারের মতো। ইরার জীবনের অপূর্ণতা মিলিয়ে দিয়ে, ২.৩ কেজি ওজনের ছোট্ট বাচ্চাটা চারদিন পরে এনআইসিও থেকে মায়ের কোলে আশ্রয় খুঁজে নিলো। বাবা হওয়ার ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো তার জীবনে এলেও তিনি প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার চমৎকার অনুভূতির তীব্রতা অনুভব করলেন। তেত্রিশের আনাম হাসনাত অনুভব করলেন কী ভীষণ সুখী তিনি। হার না মেনে, বাবা-মা হিসেবে তাদের জিতিয়ে দেয়া বাচ্চাটার নাম রাখলেন অপরাজিতা।

***

অপরাজিতা কে নিয়ে তারা যখন বাড়ি ফিরলো তখন ডিসেম্বর মাস। শীত জাঁকিয়ে বসেছে। ছোট্ট অপরাজিতার অবশ্য সেসবে যায় এলো না। মায়ের কোল থেকে দাদী-ফুপিদের কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার জীবনের প্রথম শীত কেটে গেলো। বাবা তাকে কোলে নেয়ার সাহস করেন না। হাতের ফাঁকফোকর গলে পরে যায় যদি!

সকলের আহ্লাদের অপরাজিতা নিউমোনিয়া বাঁধালো চার মাসের বেলায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে খুব সহজেই রোগ তাকে কাবু করে ফেলে। টানা বারো দিন আবারও হসপিটালে কাটিয়ে অবশেষে অপরাজিতা বাড়ি এলো। এই বারো দিনে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার কোলেও চড়লো সে। হাতে লাগানো ক্যানোলা অপরাজিতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো ভালোভাবেই। কোলে যতখন থাকে ততক্ষণই সে আরাম করে ঘুমায়। হসপিটালের বেডে শোয়ানোর অল্পক্ষণের মধ্যেই জেগে গিয়ে কান্নাকাটি করা যেনো তার প্রিয় কাজ হয়ে গেলো! দিনটা যেমন-তেমন এর-ওর কোলে করে কাটিয়ে দেয়া যায়। বিপত্তি বাঁধে রাতে। ইরা মেয়েকে নিয়ে বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। অপারেশনের ধকল তখনও কাটিয়ে উঠছে সে। সেলাইয়ের স্থানে হালকা ব্যাথা অনুভব করে। উপায় না পেয়ে আনাম হাসনাত মেয়েকে কোলে নিয়ে পুরো রাত কেবিন জুড়ে হাঁটতে শুরু করেন। ক্লান্তি অনুভব করার কথা থাকলেও তিনি অনুভব করতেন অপার শান্তি। ক্যানোলা লাগানো হাতটা পরম যত্নে আগলে রাখতেন। ইরা অবাক হয়ে দেখতো এক বাবাকে। যার মধ্যে কোনো বিরক্তি নেই। শুদ্ধতম ভালোবাসা ছাড়া অন্যসব অনুভূতি অনুপস্থিত মানুষটার চোখেমুখে।

এইযে বাবার কোলে চড়ে অভ্যেস হলো, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও এই অভ্যেস রয়ে গেলো অপরাজিতার। বাবা কোলে নিয়ে হাঁটবে, তবেই সে ঘুমাবে। সারাদিনের কাজকর্মের পরে মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটা সোজা কথা না, তবুও খুশি মনে সেটাই করতেন আনাম হাসনাত। ঘুম গভীর হলে একসময় বিছানায় শুইয়ে দিতেন মেয়েকে। তারপরও ভয়ে ভয়ে থাকতেন, যদি জেগে যায়! অপরাজিতার দাদী এসব দেখে ছেলেকে বলতেন, “নিজে বাপ হইসো, এখন বুঝবা মা’র টান।”

বাবা-মেয়ের বন্ধুত্বটা হলো এইভাবে। বাবাকে দেখলেই দুর্বোধ্য ভাষায় কথার তুবড়ি ছোটায় মেয়ে। বাবা কী বোঝেন কে জানে। তিনিও ফিরতি মেয়েকে শোনান সারাদিনের ব্যস্ততার গল্প। বাচ্চারা সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকেই কথা বলা শুরু করে। তবে অপরাজিতার সময় লাগলো। আটমাসের দিকে সে প্রথমবার বাবলিং শব্দের বাইরে কথা বললো। পরিষ্কারভাবে ‘বাবা’ ডাকলো। মা হিসেবে ইরা অভিমান করতেই পারতো। এতো কষ্ট সহ্য করেছে সে, আর অপরাজিতা কি না প্রথম ডাকলো তার বাবাকে! তবে ইরা খুশি হলো। চোখের সামনে মেয়েকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো আনাম হাসনাতের চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি সে আনন্দ শতগুণে বাড়িয়ে দিলো।

***

আনাম হাসনাতের ব্যবসা তখন দেশের সীমা অতিক্রম করেছে। প্রায়ই বিদেশে যান-আসেন। চার বছরের অপরাজিতা মাকে নিয়ে বাবার সঙ্গী হয় প্রত্যেকবার। কলকল করে কথা বলা অপরাজিতার প্লেনে চড়তে ভালো লাগে। ভুলভাল উচ্চারণে সে মেঘেদের সঙ্গে কথা বলে। সে-ই কথায় ইরা যোগ দেয় চোখেমুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে। আনাম সাহেবের মনে হয় উনিশ বছরের ইরা ফিরে এসেছে। ইরা এখন সবার সঙ্গে কথা বলতে জানে৷ তবে ওর সকল কথারা আনন্দের সাথে যেনো ঠিকরে পড়ে শুধু অপরাজিতার বেলায়।

অপরাজিতাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। মা-দাদী তাকে আনা-নেওয়া করেন। তবুও সে যেনো মুখিয়ে থাকতো বাবার সঙ্গে মাঝেসাঝে স্কুলে যাওয়ার সময়টার জন্য। বাবার হাত ধরে হেলেদুলে স্কুলে যেতে সে বড় আনন্দ পায়। বাবা সঙ্গে গেলেই স্কুলের পাশের লাইব্রেরি থেকে ছবি আঁকার অনেক বই কেনা যায়। ইচ্ছেমতো বেলুন-স্টিকার কেনা যায়। সিনড্রেলা-স্লিপিং বিউটি-স্নো হোয়াইট এই তিন ডিজনি প্রিসেন্সদের ছবি আঁকা পেন্সিল ব্যাগ কেনা যায়। চিপস দু’টোর বেলায় চারটে কেনা যায়। মেয়েকে কোনো কিছুতেই না করতে না পারার এক অদ্ভুত সমস্যায় আনাম সাহেব ভুগছিলেন ইচ্ছে করেই।

অপরাজিতা আরেকটু বড় হতেই আনাম-ইরা দম্পতির সংসারে পিংকের আনাগোনা শুরু হলো। ছোট্ট অপরাজিতার প্রিয় কার্টুন মীনা। মীনার গায়ের জামার রঙ তার অতি পছন্দ। আবার বিদেশ থেকে বাবার এনে দেওয়া বার্বি ডলের রঙও পিংক। যেকোনো খেলনা তার এই রঙেরই হতে হবে। যেকোনো জামা এই রঙের হলে সে মহাখুশি। বিছানার চাদর থেকে ঘরের এটা-সেটায় এই এক রঙের সমাহার। আনাম সাহেবকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো তার পণ্যের বেশিরভাগ রং গোলাপি বা গোলাপির ধারেকাছে কেনো সেটার উত্তরে তিনি আনন্দের সাথেই বলতেন, “পিংক আমার প্রিয় রং।” আনাম-ইরা দম্পতির লাল-কালোর সংসার অপরাজিতায় হয়ে উঠেছিলো গোলাপিময়।

অপরাজিতার গোলাপির ঘোর কেটে গেলো রাতারাতি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় মা তাকে গোলাপি শাড়িতে সাজিয়ে দিয়েছিলো। মিষ্টি দেখতে অপরাজিতাকে নিয়ে ক্লাসের দুষ্ট ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ছিলো। নাম দিয়েছিলো ‘গোলাপি বেগম’। কেঁদেকেটে বাড়ি ফিরে সেই যে পিংকের সঙ্গে আড়ি পাতলো অপরাজিতা আর কখনোই ভাব করেনি।

মিরপুরের ডুপ্লেক্স বাসায় যখন ওরা শিফট করলো অপরাজিতা তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। নতুন বাড়ি নিয়ে তার উৎসাহের শেষ নেই। দাদা-দাদীকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি সে ছুটে বেড়ায়। বাড়ির সামনের লনে লাগানো সাদা বাগানবিলাশ তার খুব পছন্দ হলো। বাবার কাছে আহ্লাদীস্বরে বললো একটা শিউলিফুলের গাছ লাগবে। বাবা পরের মাসেই শিউলি ফুলের চারা লাগালেন। সেই ফুলের সঙ্গে সঙ্গে বড় হলো অপরাজিতাও।

অতি প্রিয় একমাত্র মেয়ের জন্য আনাম সাহেব করতে চাইতেন অনেককিছুই। কিন্তু ইরার চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেছেন অনেকবার। মেয়েকে অপ্রয়োজনীয় কিছুই দেয়া যাবে না। অতি প্রাচুর্যে বিগড়ে গেলে? তবুও তাদের বাবা-মেয়ের গোপন চুক্তি ছিলো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পছন্দের গল্পের বই পড়া, প্রিয় আইসক্রিম খাওয়া, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাবার গাড়ি চালানো শেখা সবটাই অপরাজিতা করতো বাবার আশকারায়।

অপরাজিতার দাদী দুনিয়া ত্যাগ করলেন এক ভোরবেলায়। অপরাজিতা তখন কলেজে পড়ে। দাদীর চলে যাওয়ায় বাবা যে থমকে গেছে সে বুঝলো সেটা। তার মনে হলো বাবাও যদি এমন করে একদিন চলে যায়, সে কীভাবে থাকবে? বাবার কষ্টে সে যেনো হুট করেই বড় হয়ে গেলো। বাবার আহ্লাদী মেয়েটা বাবাকে আগলে রাখতে শিখে গেলো। খাওয়ায় অনিয়ম করা বাবাকে তার সামনে বসে থেকেই খেতে হবে জেদ করলো। সেই প্রথম আনাম সাহেব বুঝলেন তার মা চলে গিয়েও রয়ে গেছেন কোথাও না কোথাও। মেয়েরা তো মা’ই হয়।

তবে দুঃখ পিছু ছাড়লো না। দাদী চলে যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে দাদাও চলে গেলো। অপরাজিতার বাবা-ফুপি-চাচারা এতিম হলো। সেই শোক সামলে উঠতে সকলের সময় লাগলো। শোক সামলে উঠলেও ক্ষত কী কখনও সেরে উঠেছিলো? আনাম সাহেবের সঙ্গে তার বাবার মাখোমাখো সম্পর্ক ছিলো না। তবে তিনি জানতেন বাবার ছায়াটা আছে। সেই ছায়া হারিয়ে তিনি অনুভব করলেন বিশাল পৃথিবীতে তিনি না থাকলে তার মেয়েও একা। মেয়েকে আগলে রাখার মতো কাউকে কী কখনো পাবেন?

মেয়ে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলো তখন থেকেই তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। চেনাজানা ব্যবসায়ী বন্ধু, কাছের দূরের আত্মীয়, এলাকার ঘটক সবাই যেনো লাইন ধরে দাঁড়ালো। কে কত ভালো পাত্র নিয়ে আসতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলো। তিনি যতই বলেন এখনই মেয়ে বিয়ে দেবেন না, কেউ সেটা যেনো বুঝতেই চাইলো না। মেয়ে তার অথচ মাথা ব্যাথা হয়ে গেলো সবার। তিনি আরো গুটিয়ে গেলেন। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো, মেয়ের জন্য যোগ্য কাউকে তিনি যদি বাছাই করতে না পারেন?

সময় যত গড়ালো, মনের চিন্তাও তত ডালপালা মেললো। কাউকেই পছন্দ না করার ভীড়ে ওয়াহিদকে ভালো লাগলো। এতো বছরের ব্যবসায় কম মানুষ দেখেন নি। ওয়াহিদের মনের ভাব তিনি ওর চোখেই পড়ে ফেললেন। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করার মতন। তিনি মুগ্ধ হলেন। প্রথমবারের মতো তার মনে হলো অপরা ভালো থাকবে। তিনি না থাকলেও অপরাকে ওয়াহিদ আগলে রাখবে। এতোসব বোঝাপড়ার খেলায় মেয়ে কে না জানিয়ে ওদের বাড়ি ডেকে ফেললেন। এবং ভুল করে ফেললেন। মেয়ের নিজেরও যে কিছু বলার থাকতে পারে সেটা বেমালুম ভুলে বসলেন। মেয়ের মত পাবেন সেই বিশ্বাস তার ছিলো। কিন্তু অপরার অভিমান হতে পারে সেটা কখনোই ভাবেন নি। অপরা যখন তার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠালো তক্ষুনি বুঝলেন মেয়ে কষ্ট পেয়েছে। ভীষণ কষ্টে বাড়ি ছাড়তে চাইছে। তিনি আটকালেন না। ইরার এতো অনুরোধ কান্নাকাটিতেও কিছুই বললেন না। মেয়েকে যেতে দিলেন। বলা ভালো মেয়েকে সময় দিলেন। ওয়াহিদকে জানালেন অপরার চলে যাওয়ার খবর। সরাসরিই বললেন, “তোমাকে কেনো পছন্দ করেছি সেটা অপরাকে বোঝাও। কী দেখে তোমাকে আমার পারফেক্ট লাগলো সেটা অপরাকে বুঝতে দাও। দেখতে দাও।”

নিজেকেও মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরী করতে লাগলেন। কিন্তু পারছেন কোথায়? কিসের এক জড়তায় থমকে যাচ্ছেন। মেয়ের এই অভিমান কাটবে কী না সেই চিন্তায় বড্ড দিশেহারা বোধ করেন। মায়ের অভাবটা গত একমাসে নতুন করে অনুভব করেছেন। অপরাজিতার শূন্যতায় মায়ের শূন্যতা এতটা প্রকট হয়ে উঠবে সেটা তো তিনি জানতেন না। আচ্ছা অপরাজিতা যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে তখন কী করে থাকবেন তিনি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here