বিয়েকথন শেখ জারা তাহমিদ শেষ পর্ব (সমাপ্তাংশ)

0
249

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

শেষ পর্ব (সমাপ্তাংশ)

অনেক কাঙ্খিত মানুষটাকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দ কতটা তীব্র হতে পারে সেটা ওয়াহিদ ভাষায় বর্ণনা করতে পারবে না কখনও। তবে আজ দু’দিন ধরে সব কিছুতে ভীষণ সুখ সুখ অনুভব হয় তার। অপরাজিতাও ভালোবাসে ওকে, এই ব্যাপারটাই যেনো ম্যাজিকাল। সেদিন অপরাজিতার কথায় কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো ও। মন বলছিলো অপরাজিতা হারিয়ে যাবে এবং সেটা ওর-ই দোষে। কিন্তু অপরাজিতা নিজের মনের দ্বন্দ্বে যেমন জিতে গেছে তেমনি জিতিয়ে দিয়েছে ওয়াহিদকেও। মনের জটিলতা মিলিয়ে দিয়ে চমৎকার করে আগলে নিয়েছে ওকে।

ওয়াহিদ, অপরাজিতার মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে ওর বাবার কাছে। আনাম সাহেব মেয়ের কথা জেনে কোনো রিয়াকশন দেননি। শান্ত থেকেছেন। তবুও ওয়াহিদ জানে কী প্রচন্ড আকুলতায় তিনি এই ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। মেয়েকে সময় দিতে হবে, এই উপলব্ধি তার ছিলো বলেই শত অস্থিরতায়ও নিজেকে শক্ত খোলসে আটকে রেখেছিলেন। আনাম হাসনাত! অপরাজিতার বাবা! কি প্রবল আত্মবিশ্বাসে মেয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করেছেন!

***

টিউশন শেষে অপরাজিতা বাসায় ফিরছিলো। সারাদিনের ক্লান্তিটাকে সরিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাত্রই সন্ধ্যে নেমে আসা শহরটাকে ভীষণ আদুরে ঠেকছিলো ওর। মনের মধ্যে থাকা অনেকদিনের অস্থিরতা বিদায় নিয়ে আশ্চর্য এক শীতলতা তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। অভিমানের প্রগাঢ় অনুভূতি ম্লান হয়ে, ঘরে ফেরার প্রখর অনুভতি হয়ে ধরা দিয়েছে। বাবার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত দুচোখ মেলে প্রতিটা মুহূর্ত পার করছে।

কিন্তু অপরাজিতা জানে না বাবা চলে এসেছেন। ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় ওর প্রিয় হাওয়াই মিঠাই নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেই কোন বিকেল থেকে।

***

আনাম সাহেব বসে আছেন অপরাজিতাদের বারান্দায়। তিনি যখন এলেন মুনিরা নামের মেয়েটা দরজা খুলেছিলো। অপরাজিতার বাবা শুনে ভেতরে এনে অপরাজিতার রুমে বসিয়েছে। ব্যস্ত হয়ে অপরাজিতাকে ফোন করতে গেলে তিনি নিষেধ করেছেন। বলেছেন অপেক্ষা করবেন। অপরাজিতা তার সময় মতোই আসুক। মুনিরা তাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। চা খাওয়ার ফাঁকে মুনিরার সঙ্গে কথায় কথায় জানলেন নতুন এক অপরাজিতাকে।

যখন শুনলেন অপরাজিতা প্রায়ই নিশ্চুপ হয়ে বারান্দায় বসে থাকে, উঠে গিয়ে ওখানে বসলেন তখন। গোধূলির আলোমাখা আকাশে তাকিয়ে মেয়ের লুকানো হাজারো দীর্ঘশ্বাস যেনো অনুভব করতে পারলেন। মেয়েকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছেন মনে হতেই অপরাধবোধে, অনুশোচনায় আবারও জর্জরিত হলেন।

অপরাধবোধ, অনুশোচনায় দিশেহারা বাবাকে মুক্তি দিতে, অপরাজিতা বাসায় আসলো সন্ধ্যে পার করে। দরজার বাইরে রাখা বাবার জুতো চিনতে তার ভুল হয়নি একটুও। মনের আনন্দ চোখেমুখে খেলা করলো ওর। অভিমানটাও যেনো মুচকি হাসলো। ঝাপসা চোখে বেল বাজিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটালো। মুনিরা দরজা খুলে, বাবার আসা থেকে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার সবটাই বললো। মুখ ফুটে কিছুই বলতে না পেরে শান্ত ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো অপরাজিতা, যেখানে মন ভালো করার পসরা সাজিয়ে বসে আছে ওর জীবনের জাদুর মানুষটি।

মেয়ে এসেছে, তার ঠিক পেছনেই বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়েছেন আনাম হাসনাত। কিন্তু ঘুরে তাকাতে পারছেন না। চোখ ভিজে আসছে। মেয়ের দিকে ঘুরে তাকানো এতো কঠিন কবে হলো? কেনোই বা হলো?

অপরাজিতা বাবাকে বুঝে ফেললো চট করে। মৃদু হেসে শুধালো, “কফি খাবে, বাবা?” আনাম সাহেব জবাব দিলেন না, বলা ভালো দিতে পারলেন না। অশ্রুজলে তার কন্ঠ বুজে এসেছে। অপরাজিতা অবশ্য বাবার হ্যাঁ-না বলার অপেক্ষা করলো না। নিজের মতো কফি বানাতে চলে গেলো। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। বাবা মানুষটার সঙ্গে তার কোনোকালেই লুকোছাপা ছিলো না। দাদী চলে যাওয়ার পরেও বাবাকে সে মন খরাপ করতে দেখেছে, গুমরে কাঁদতে দেখেছে। সেসব দিনে অপটু অপরাজিতা বাবাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজকের কান্নায় ও শামিল হবে না। আজকের কান্নায় বাবার নিজের ভেতরে থাকা অপরাধবোধ মুছে যাক। ওর জাদুর মানুষটা আবারও মাথা উঁচিয়ে ওর সামনে দাঁড়াক।

***

মুনিরা, অপরাজিতার ব্যাপারে অতো ডিটেইলস জানে না। তবে আজকে ওর বাবার আগমনে এতোটুকু বুঝেছে এই মুহুর্তে বাসায় না থাকাটাই ভালো হবে। অপরাজিতা যখন কফি করতে গেলো তখনই মুনিরা, একটু আসছি বলে বেরিয়ে গেছে। কফিও এতক্ষণে হয়ে গেছে। বড় একটা দম নিয়ে অপরাজিতা বাবাকে ডাকে। এবারে উঠে, ডাইনিংয়ে আসেন আনাম সাহেব। বদলে যাওয়া অপরাজিতাকে দেখেন। মেয়েটা এতো শুকিয়ে গেলো কিভাবে! মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর ইরা যে তার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করবে সেটায় কোনো সন্দেহ নেই।

অপরাজিতা চেয়ার টেনে বাবাকে বসতে দিয়ে নিজেও বসে। কফি খেতে খেতে বাবাকে ভালো করে দেখে। সেদিন ওয়াহিদের ফেইসবুক স্টোরিতে দেখা আর সামনে থেকে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। রেগ্যুুলার মেহেদী দেওয়া বাবার চুলে বোধহয় মেহেদী দেওয়া হয়নি অনেকদিন। সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। আম্মু নিজে সবসময় মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। বাবা-আম্মুর আসলেই কী কিছু হলো? ওর চলে আসাটা আম্মু-বাবার সম্পর্কেও কী এফেক্ট করলো? শিট! দেরি না করে অপরাজিতা প্রশ্ন করে, “আম্মু কেমন আছে, বাবা?” আনাম সাহেব মুখ খুলেন এবার। জবাব দেন, “নিশ্চয়ই ভালো আছে! দেখলে তেমনই লাগে।” বাবার গলায় ঝরে পরা অনুযোগ টের পায় অপরাজিতা। ও চলে আসায় আম্মু কি কথা না বলে বাবাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছে? এই ভাবনায় হাসি পায় ওর। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দও হয়। দারুণ এক উপলব্ধিতে মন জুড়ে প্রশান্তি বয়ে যায়। জগতের সবার কাছে পরিচিত কঠিন ব্যক্তিত্বের আনাম হাসনাত, স্ত্রী-মেয়ের কাছে নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। যার সাথে চাইলেই স্ত্রী রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখতে পারে। মেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছাড়তে পারে।

অপরাজিতাকে চুপ দেখে আনাম সাহেবের অস্বস্তি হয় খুব। শান্ত অপরাজিতাকে কখনোই দেখেননি তিনি। সারাক্ষণ চঞ্চলতায় মাতিয়ে রাখা মেয়েটার সাথে কোনো মিলই যেনো নেই। মেয়েটা কী সত্যিই বড় হয়ে গেলো? এতো তাড়াতাড়ি বড় না হলেই কী চলতো না? তিনি গলায় কুন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন, “আমার নেয়া ভুল ডিসিশনে তুই কি খুব বড় হয়ে গেলি, অপরা?” বাবার প্রশ্নে অপরাজিতা সময় নিয়ে উত্তর দিলো, “বড় আগেই হয়েছিলাম বাবা। কিন্তু তোমরা ছিলে বলে ‘বড় হয়েছি’ এই বোধটুকুর প্রয়োজন ছিলো না। তোমাদের ছেড়ে এসে, একা বাঁচার চেষ্টায় অস্তিত্ব সংকটে যখন উঠেপড়ে লেগেছি তখন বুঝলাম আমি বড় হয়ে গেছি। বারান্দায় যে মানি প্ল্যান্ট গাছটা দেখেছো ওটার সাথে আমার খুব একটা পার্থক্য নেই বাবা। যখন অবলম্বন হিসেবে গ্রিল ছিলো, গাছটা গ্রিল বেয়েই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে। গ্রিল থেকে নামিয়ে দিয়ে যখন এমনি ফেলে রাখলাম, গাছটা বাতাসে দুলতে দুলতে নিচের দিকে নেমে গেছে। নতুন করে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এতটুকু বড় হওয়াতে, কষ্ট হলেও আমি আনন্দ খুঁজে পেয়েছি।” আনাম সাহেব মেয়ের উত্তরে মুগ্ধ হলেন। অপরাজিতা বুঝলো সেটাও। নিজ থেকেই আবার বলে উঠলো, “তোমার নেয়া ডিসিশনের মধ্যে কোনটাকে ভুল বলছো? আমার জন্য ওয়াহিদকে পছন্দ করেছো, সেটা? আমাকে না জানিয়ে সেদিন ওনাদের আসতে বলেছো, ওটা? নাকি হঠাৎ আকদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তটা? কোনটা ভুল, বাবা?”

মেয়ের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে আনাম সাহেব মুচকি হাসলেন। চকিতে একবার অপরাজিতাকে দেখলেন। ওর চোখেমুখের অঘোষিত কৌতূহল যেনো জানান দিলো বাবার কথা শুনতে সে ঠিক কতটা উদগ্রীব। কৌতূহল, প্রশ্ন ফুরিয়ে দিয়ে আনাম সাহেবও এক্সপ্লেইন করলেন তার নেয়া একেকটা সিদ্ধান্তের পেছনের গল্প!

শুরুটা করলেন ওয়াহিদকে প্রথম দেখা থেকে। একে একে বলে গেলেন, কেনো ছেলেটাকে তার ভালো লাগলো। ছেলেটার কোন কোন কোয়ালিটি তাকে মুগ্ধ করলো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে পর করে দেওয়া নয়, বরং ছেলে পাওয়ার যে ইচ্ছে সেটা ঠিক কীভাবে ওয়াহিদ পূরণ করতে পারলো। দারুন আলাপচারিতায় ওয়াহিদ কীভাবে অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে ওকে চাইলো, সবটাই মেয়েকে বললেন। অপরাজিতা শুনলো বিভোর হয়ে। যে ওয়াহিদে ওর বাবা মুগ্ধ হয়েছে, সেই ওয়াহিদে ও নিজেও মুগ্ধ হয়েছে। একজন সেইম মানুষকে ঘিরে বাবা-মেয়ের মুগ্ধতার গল্প যদি একই হয় তবে বলা যায় সেই মানুষটা সত্যিই স্পেশাল। আনাম সাহেব কেনো ওয়াহিদকে পছন্দ করেছিলেন সেটা বিগত দিন গুলোতেই অপরাজিতা বুঝতে পেরেছিলো। তবুও বাবার মুখে শুনে ও নতুন করে রিয়েলাইজ করলো বাবা ঠিক কতটা যাচাই-বাছাইয়ের পর ভেবেচিন্তে ওয়াহিদকে ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই প্রশ্নটা অপরাজিতা করলো বাবাকে, “ওয়াহিদকে তুমি আমার জন্য পছন্দ করেছো। কিন্তু কেনো করলে, সেটা আমিও এখন জানি, বুঝি। উনি আমার জন্য বেস্ট চয়েজ, তা-ও মানি। কিন্তু বাবা, আমাকে জানালে না কেনো? সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে তুমি, আম্মুই শিখিয়েছো। অথচ এই এতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় দিলে কেনো? তোমার পছন্দের ওপর কি তোমার বিশ্বাস ছিলো না? নাকি তোমার পছন্দকে আমি অপছন্দ করতে পারি সেটা ভেবেছিলে? কোনটা?”

আনাম সাহেব মৌন রইলেন। চোখের কোনে আবারও জলেরা ভীড় জমালে অপরাজিতা পরম মমতায় সেটা মুছে দিলো। বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। আনাম সাহেব যেনো এই মমত্ববোধে শক্তি পেলেন। অস্ফুটস্বরে বলতে শুরু করেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, অপরা। তোকে অবিশ্বাস করিনি। নিজের পছন্দেও বিশ্বাস ছিলো। তুই এই দুনিয়াতে আসার আগে পর্যন্ত আমি বুঝিনি বাবা হওয়াটা কতটা ম্যাজিকাল হতে পারে। তুই এনআইসিও থেকে যেদিন তোর আম্মুর কাছে আসলি সেদিন থেকে কী ভীষণ মায়ায় তুই আমাদের জড়িয়ে ফেললি। সেই তোকে ছেড়ে একদিন এই দুনিয়া থেকে আমাকে চলে যেতে হবে। তোর দাদী-দাদা চলে গিয়েও আমি তোকে নিয়ে, তোর আম্মুকে নিয়ে বাঁচতে পারছি। তোকেও আমাদের ছাড়া বাঁচতে হবে। এমন নয় যে আমরা না থাকলে তোর জীবন থেমে থাকবে। তুইও কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাবি, জীবন ঠিক কেটে যাবে। কিন্তু তোর জীবনসঙ্গী যদি অতোটা ভালো না হয়? তোকে যদি আগলে না রাখে? আমি চিন্তায় অস্থির হলাম। তোর আম্মু আমার অস্থিরতায় হাসলো। বললো কিছুদিন গেলে এইসব পাগলামি চিন্তাভাবনা আমার কেটে যাবে। কিন্তু দিন যতো গেলো, যতো তোর বিয়ের প্রস্তাব আসলো আমি ততোটা দিশেহারা হলাম। অনেক অপেক্ষার পর ওয়াহিদ এলো। আমার স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। বিয়ে দিয়ে দিলেই তো তুই চলে যাবি। আমার মেয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাবে। বাড়ির লনে আর শিউলি কুড়াবে না। ভ্যানিলা আইসক্রিম কেনো আনতে ভুলে গেলাম সেই রাগে গাল ফুলাবে না। হাওয়াই মিঠাইয়ের বায়না করবে না। মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিবো আমি? যে মেয়েকে ঘিরে আমি, ইরা -আমরা জীবন সাজালাম সেই মেয়েকে ছাড়া আমাদের দিনগুলো কিভাবে পার হবে? তুই ছাড়া আমাদের আছেই বা কে? এই হারানোর ভয়ে আমি স্থির হতে পারছিলাম না। ওয়াহিদদের আসতে বলতে মন চাইলো না। তবুও একদিন ডাকলাম। শর্ত রাখলাম তুই জানবি না। তোকে রয়েসয়ে বলার ছুতোয়, আরো ক’টা দিন আমাদের কাছেই রেখে দিতে চাইলাম। ওরা এলো। তোকে ওদের পছন্দ হলো। ওরা প্রস্তাব দিতেই নিদারুণ অস্থিরতায়, হারানোর ভয় আমাকে জেঁকে ধরলো। আমি না-ই বলতে যাচ্ছিলাম। তোর বড় ফুপি আমার মন পড়ে ফেললো। শক্ত কন্ঠে বললো আমার মনের এই অমূলক ভয় ঝেরে না ফেললে কোনোদিনই তোকে বিয়ে দিতে পারবো না। যত ভালো ছেলেই হোক আমি এগোতে পারবো না। মনের অমূলক ভয় ঝেরে ফেলার চেষ্টায় আমি সাহস করে রাজি হয়ে গেলাম। মেয়ের জন্য পছন্দ করা বেস্ট চয়েজটা মেয়েও পছন্দ করবে সেই বিশ্বাসে, আমি সাহস দেখিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। বারবার মনে হলো আজকে যদি ওরা চলে যায়, যেই সাহসটা আমি করতে পারছি সেটা আর পারবো না। মেয়ে অন্যের ঘরে যাবে, এই কঠিন সিদ্ধান্ত বারবার নেয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার ছিলো না। চিরকাল ধরে চলে আসা নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে আমি সেদিন রাজি হয়ে গেলাম।”

বাবার কথার এ পর্যায়ে হাপুসনয়নে কেঁদে চলা অপরাজিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলে চললেন, “তোর সিদ্ধান্ত তুই-ই নিবি সবসময়। সেটাই তোকে শিখিয়েছি অথচ সেদিন নিজের কথাই কেবল ভেবেছি। তুই ভেবেচিন্তে জানাবি এই সময়টা তোকে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। তোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তোর হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। স্যরি, মা।”

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই। অপরাজিতার বাবা সেই বাবাদেরই একজন। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরির’ একটা সংলাপের বাংলা করলে দাঁড়ায়, মা-বাবার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য কখনো ভুল হতে পারে না। আনাম সাহেবের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো, তবে অমন হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য খুব কি ভুল ছিলো?

অপরাজিতা বাড়ি ফিরেছিলো সেদিনই। আম্মু ওকে দেখে শুরুতে খুব রাগ দেখিয়েছে। এতো ফোনকল, মেসেজ কিছুতেই মেয়ের মন গলেনি অথচ বাবা যেতেই চলে এসেছে -এই নিয়ে খানিকক্ষণ কপট অভিযোগও করেছে। অপরাজিতা হাসিমুখে সব বকা শুনেছে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী মেয়ে হয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলে ভাব করতে বলেছে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণে মিশে গিয়ে অনেকগুলো দিন পরে আরাম করে ঘুমিয়েছে।

***

আজকে অপরাজিতা-ওয়াহিদের রিসেপশন। দুমাস ধরে চলা আয়োজনের আজকে শেষদিন।

আকদ হয়ে যাওয়ার পরে আবার নতুন করে এনগেজমেন্ট, বিয়ে পড়ানোতে রাজি ছিলো না অপরাজিতা। কিন্তু ওয়াহিদের ‘বিয়ে জীবনে একবারই করছি!’ যুক্তির সামনে তার আপত্তি ধোপে টেকেনি। বহু আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রাম আর ওয়েডিং রিসেপশন, এই তিনে, অপরাজিতা-ওয়াহিদের নতুন পথ চলার শুরু হবে। বিয়ে নিয়ে কারো উৎসাহ-ই কম না। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ইরা, মেঝ ছেলের বিয়েতে জোহরা -কারোই আনন্দের শেষ নেই। রোজ তারা দুজনে ফোনে কথা বলছেন, এটা-সেটা ঠিক করছেন। ছেলে-মেয়েকে একসাথে কি দারুন মানাবে সেই সুখস্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। তাদের এতোসব প্ল্যানিংয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় বোধহয় ছিলো ওয়েডিং প্ল্যানার টিম। তবুও কোনো কিছু থেমে থাকে নি। বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে ওয়াহিদ-অপরাজিতার নতুন ফ্ল্যাট সাজানো সবটাতেই তারা দারুন কাজ দেখিয়েছে। অপরাজিতার মনে হয় এই টিম ছিলো বলেই রিসেপশন পর্যন্ত ও আসতে পেরেছে। বিয়ে ওর। কিন্তু সবার এতো আগ্রহ, এতো এতো মতামত। এরটা শুনলে ও মন খারাপ করে। ওরটা বাদ দিলে এ নতুন আরেকটা বলে। এতোসব আইডিয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে, অপরাজিতা তখন মা-শাশুড়ি আর ওয়েডিং প্ল্যানার শম্পাকে সঙ্গে নিয়ে বসেছে। ক্লিয়ারলি জানিয়েছে, দু’টো হলুদের একটায় হলুদ হলে অন্যটায় সবুজ রং থাকতে হবে। শাড়ি-লেহেঙ্গা যাই হোক তার কোনো সমস্যা নেই। আর রিসেপশনে তার পড়নে গাঢ় লাল রঙ থাকতেই হবে। শাড়ি হতে পারে তবে লেহেঙ্গা বেটার অপশন। ডিজাইন নিয়ে তার কিছু বলার নেই। মায়েরা সবাইকে নিয়ে যেয়ে কিনুক। যেখান থেকে ইচ্ছে কিনুক। জুয়েলারি নিয়েও সেইম। সাজসজ্জায়ও মেকআপ আর্টিস্টের ইচ্ছেই ফাইনাল, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হয়। এরপরে ওকে আর কেউ তেমন বিরক্ত করেনি।

ওয়াহিদ যখন শুনলো রিসেপশনে অপরাজিতা গাঢ় লাল পরবে, তখন ওর মনে হলো ইন্ডিয়া থেকে আনা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়িটাই তো অপরাজিতা পরতে পারে। কিন্তু রিসেপশনের শপিং নিয়ে মা-শাশুড়িসহ সকলের এতো এক্সাইটমেন্ট দেখে সেই কথা শেষ পর্যন্ত আর বলেনি। আবার ওর পজেসিভ সত্ত্বাও অপরাজিতা এই শাড়ি কেবল ওর জন্য পরুক সেই চিন্তায় সায় দিয়েছে! শেষে ওর কেনা শাড়িগুলো অপরাজিতাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ওয়েডিং গিফট হিসেবে। প্রত্যেকটা শাড়ির সঙ্গে আলাদা করে চিরকুট এঁটে দিয়েছে। অপরাজিতা শাড়ি দেখে যতটা খুশি হয়েছে চিরকুট পড়ে ততটাই লজ্জায় রাঙা হয়েছে। কী ভেবে, কোন শাড়ি কেনা হয়েছে সেটা লিখে পাঠালে অনুভূতিরা অমন লাল রঙ ধারণ করে ছোটাছুটি তো করবেই!

সিলভার-পিংক কম্বিনেশনের কাঞ্জিভরম শাড়িটায় শুধু অপরাজিতাকেই মানাবে, ওয়াহিদের জোর দিয়ে লেখা এটুকু কথায় কী ছিলো কে জানে! অনেকবছর আগে, ছোট্ট অপরাজিতার মনে গেড়ে বসা ‘গোলাপি বেগম’ এইবার বোধহয় ধুয়েমুছে যাবেই। ওই ঘটনার পরপর আম্মু-বাবা চেষ্টা করেছিলো ওকে বুঝাতে। কিন্তু ছোট্ট অপরাজিতার কান্নাকাটিতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। বড় হওয়ার পরও জোর করেনি। নিজেরাও এভোয়েড করেছে। ওয়াহিদ এই ঘটনা জানে না। তাই কিনে ফেলতে পেরেছে। অপরাজিতা একসময়ের অতি প্রিয় রঙটাকে আবার ধারণ করলে বাবা-আম্মুও নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে।

বিয়ের শপিংয়ে যখন সবাই ব্যস্ত অপরাজিতা আর ওয়াহিদ নিজেরা মিলে ফ্ল্যাট সাজানোর এটা-সেটা কিনেছে। ওখানেই এক দোকানের কুশন কভার দেখে ওর বেশ পছন্দ হলো। কিনে ফেলতে গিয়ে মনের খেয়ালে বলে ফেললো, আমাদের রুমের সোফার কুশনে এটা খুব মানাবে। বলতেই খেয়াল হলো ওয়াহিদের রুমটা কখনো ওর নিজের হবে কি না সেই শংকা কাটিয়ে দিয়ে, ওয়াহিদ ওকে আস্ত একটা সংসার উপহার দিয়েছে।

গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রামেই একটা ঘরোয়া আমেজ ছিলো। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের বাইরে কাউকেই দাওয়াত করা হয়নি। দু’হাত জুড়ে মেহেদী রাঙানো, হাসিতে মুখরিত অপরাজিতাকে দেখে ওয়াহিদের রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের মতো বলতে ইচ্ছে করেছে, “আমি পাইলাম,’আমি ইহাকে পাইলাম।’ কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।”

সকলের মিলিত হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, বিদায়ের সুরটাও কোথাও একটায় অপরাজিতাকে বারবার কাঁদিয়েছে। মায়া-মমতার চিরচেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে, নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে চলে যাওয়াটা যতটা মন খারাপের ততটাই আবার আনন্দের। পাওয়ার আনন্দ-হারানোর বেদনা, সমানতালে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। আদুরে মেয়ে থেকে নবপরিণীতা হওয়ার এই উপাখ্যান, সকল অপরাজিতাদেরই তো এক!

সন্ধ্যের রিসেপশনে, হাজারো অতিথিদের শুভকামনায় অপরাজিতা-ওয়াহিদের বিবাহিত জীবনের শুরুটা হলো মহাসমারোহে। আত্মজার বিদায়ে সিক্ত হলেন অপরাজিতার আম্মু। জীবনের কঠিন নিস্তব্ধ সময়টায় অপরাজিতার মা হয়েছিলেন তিনি। অনিবার্য এই বিচ্ছেদে অপরাজিতা খুব ভালো থাকুক, এই কামনায় মেয়েকে জড়িয়ে রাখলেন শেষ পর্যন্ত।

বাবা নামের জাদুর মানুষটা চোখে কান্না, মুখে চমৎকার হাসি নিয়ে অপরাজিতাকে তুলে দিলেন, ওর জীবনে ভালোবাসা হয়ে আসা জাদুর মানুষটার কাছে। নতুন স্বপ্ন, গোছালো-অগোছালো ইচ্ছে, হুটহাট রাগ-অভিমান নিয়ে শুরু হলো ওদের নতুন অধ্যায়।

***
ওয়াহিদদের বাসায় টুকটাক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, অপরাজিতাকে নতুন সাজানো ফ্ল্যাটের বেডরুমে কিছুখন আগে রেখে গিয়েছে ওয়াহিদের বোন-ভাবী-কাজিনরা। সকলে চলে যেতেই- সারাদিনের ক্লান্তি, সাজগোজ ধুয়েমুছে অপরাজিতা সময় নিয়ে গোসল সারলো। ওয়াহিদ বাসায় আসেনি তখনও। সেই সুযোগে অপরাজিতা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়ীটা পরে ফেললো। খোলা চুলে, গাঢ় লাল লিপস্টিকে নিজেকে ওয়াহিদের মনমতো সাজিয়ে তুললো। বিয়ের উপহার হিসেবে ওয়াহিদের প্রিয় ব্র্যান্ডের ঘড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকলো।

ওয়াহিদ এলো রেড ভেলভেট কেক নিয়ে। নতুন জীবনের শুরুটা মিষ্টিমুখে হোক! পারফেক্ট এন্ড ডীপ লাভের প্রতিনিধিত্ব করা টিউলিপ ফুল উপহার দিলো, ওর একান্তই ব্যক্তিগত মেয়েটাকে। পূর্ণতার নোনাজলে ভাসিয়ে অপরাজিতার অনামিকায় সবশেষে পরিয়ে দিলো রেডিয়েন্ট কাট ডায়মন্ড রিং। ওর গভীর চাহনিতে মাদকতার ছড়াছড়ি। লুকিয়ে, আঁড়চোখে তাকানোর দিনের সমাপ্তি টেনে, ওয়াহিদ স্পষ্ট মুগ্ধতা নিয়ে নবপরিণীতাকে দেখে। আকুলতায় ডুবে প্রশ্ন করে, “আমি যদি অনেক করে তোমার হই, তবে কি অনেক করে তোমাকে পাবো, অপরা?” ভালোলাগার আবেশে, ঘোরের মধ্যে হারিয়ে অপরাজিতা মাথা দোলালো কেবল।

ঠিক এইভাবে অপরাজিতার একটা ভালোবাসার গল্প হলো। সবখানে এতো মানুষের ভীড়ে, একটা নিজের মানুষ হলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হলো। রাতজাগার সঙ্গী হলো। অনেকখানি মায়ায় জড়ানোর প্রিয় মানুষ হলো।

——————————————————————————–

গল্প শেষ। পুরো সময়টায় যারা সঙ্গে ছিলেন সবাইকে ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here