গহন_কুসুম_কুঞ্জে ১৫.

0
417

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৫.

শেষ রাতে ঘুম ভাঙল তনয়ার। গতকালের রেশ মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় জাগিয়ে রেখেছে তার। সে ডেকে তুলল স্বরূপকে। “কী হয়েছে?” ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল স্বরূপ।

তনয়া উত্তর দিল, “নামাজ পড়ব।”

“পড়ো!” বলে উল্টোদিকে ফিরে শুল স্বরূপ।

তনয়া এবার ধাক্কা দিল তাকে। “তুমিও পড়বে। ওঠো!”

“এখন উঠতে পারব না। ঘুম হয়নি।”

“পরে ঘুমিও আবার, এখন ওঠো, প্লিজ!”

স্বরূপ তনয়ার বালিশটা টেনে নিয়ে মাথর ওপর চেপে ধরে কম্বলটা আরেকটু টেনে নিল।

তনয়ার এবার রাগ হতে লাগল। আস্ত পাজি লোক তো! সে স্বরূপের হাত ধরে টানাটানি করল কিছুক্ষণ, কাতুকুতু দেয়ার চেষ্টা করল, ঘরের লাইট অন করে দিল, ওর চোখের সামনে মোবাইলের ফ্ল্যাশলইট অন করে ধরে রাখল। শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কাজ না হওয়ায় পানি ছিটিয়ে দিল চোখেমুখে।

স্বরূপ এবার উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, “কাল রাতে যদি তোমাকে ঘুমাতে দেই তো আমার নাম স্বরূপ না।”

“ওকে, তোমার নতুন নামকরণের ভার আমাকে দিও প্লিজ! আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার বরের নাম হবে ঝন্টু মিয়া।”

“উইল ইউ শাট আপ?”

“নো।”

স্বরূপ উঠে বাথরুমে ঢুকল। তনয়া একটু পর বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওযু করে বের হবে কিন্তু… তুমি কি ওযু করতে পারো?”

“না না, সব তো তুমি একাই পারো।” ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলল স্বরূপ।

একটু পর বের হলো সে। দেখে মনে হলো ওযু করেই বের হয়েছে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “মসজিদে যাবে?”

“না, মসজিদ অনেক দূর। ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে যাবে।”

“কাল আরও তাড়াতাড়ি ডেকে দেব তাহলে৷ এখন একটু অপেক্ষা করো। আমি ওযু করে আসি। একসাথে নামাজ পড়ি।”

দু’জন একসাথে নামাজ পড়ল। ভোরের আলো ভালো করে ফুটলে তনয়া জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। ভোরের স্নিগ্ধ শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে। ঘরটাও আলোকিত হলো। সে মশারি তুলে বিছানা ঝাড়ল, ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে রইল। তনয়ার কাজ শেষ হলে সে বলল, “জানো, অনেকদিন পর ফজরের নামাজ পড়লাম।”

“কেমন লাগছে?”

স্বরূপ সেটার উত্তর না দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

দু’জনের আর কথা হলো না৷ চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইল তারা। তনয়ার গতদিনের ট্রমা অনেকটা কেটে গিয়েছে। যদিও মন থেকে বিষয়টা মুছতে অনেক সময় লাগবে, তবুও প্রাথমিক ভয়টা কেটে যেতেই শান্তি লাগছে।

গ্রামের মানুষের কাজকর্ম দ্রুত শুরু হয়। জানালা দিয়ে লোকজন দেখা যাচ্ছে সেই আলো ফোটার পর থেকেই। সবাই ভোর থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা হতে হতে কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের শহুরে জীবনটাও এমন হলে বেশ হতো! চেষ্টা করা যায় না কি? স্বরূপকে বলে দেখতে হবে তো! মায়ের ডাক শুনে সে বেরিয়ে গেছে একটু আগেই। আজ বাড়িতে তাদের বিয়ে উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া হবে। তনয়াকেও তৈরি হতে হবে। রোদের দেখা মিললে সে গোসল করে ফেলল।

*

তনয়া বিয়েতে বিশাল মেকআপ বক্স উপহার পেয়েছে। স্বরূপের হয়ে কেনাকাটা করে দিয়েছে তার বন্ধুরা। এই মেকআপের জিনিসগুলো যে কিনেছে তার চয়েজ অসাধারণ! সব ভালো ব্র্যান্ডের জিনিস। লিপস্টিকের পুরো সেট দিয়েছে। তাতে এত সুন্দর সব রঙ যে তনয়ার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!

সে যখন সাজতে বসেছে তখন গ্রামের অনেক মেয়েরাই এসেছে তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু এসব প্রোডাক্ট দেখে কেউ ধরতে সাহস পায়নি। তনয়া একাই সাজগোজ করেছে। তারপর নিজেই বলেছে অন্য যারা সাজবে তারা যেন তার কাছে এসে বসে।

এরপর শুরু হলো তার সাজানো। শেষ আর হয় না। তনয়ার মনে হলো সে ভয়াবহ একটা ভুল করে ফেলেছে। বিশাল লাইন পড়ে গেছে সাজবার। তবুও সে হাসিমুখেই অনেককে সাজিয়ে দিল।

একসময় চাচী এসে হায় হায় করে বললেন, “এইটা কী হয়? বউ মানুষ সবাইরে সাজাইতাছো কেন? বিয়া ওগো না তোমার?”

তনয়া হেসে বলেছে, “সাজাই না চাচী, সমস্যা কী?”

“না কুনু দরকার নাই। যা সব, বাইর হ এইখান থেকা।”

তিনি ছাগল তাড়াবার মতো করে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি একটু জিরাও। পরে বাইরের ঘরে নিয়া যাব। অনেক আত্মীয়স্বজন আসতেছে। খাওয়া হইয়া গেলেই তারা বউ দেখব।”

চাচী বের হয়ে গেলে তনয়া মোবাইলটা নিয়ে বসল। মাকে ফোন করে কথা বলে নিল। কাল থেকে কথা হয়নি। মায়ের কাছে গতকালের ঘটনা বলতে চায় না সে৷ এমনিতেই ট্রেন মিস করার ঘটনা শুনে মা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে বলেই তার এত ভয়। তনয়ারও খারাপ লাগছে। বিয়ের পর থেকে মায়ের সাথে একটুও দেখা হলো না। এতদিন তো সে মাকে ছেড়ে কখনো থাকেনি।

ফোন রেখে তনয়ার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মা বাবাকে আজ দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মা অসুস্থ বলে আসতে পারেননি তারা। তনয়ার বাড়ি যেতে যেতে আরও চার পাঁচদিন। এতদিন মাকে না দেখে থাকতে হবে। তার চোখে পানি চলে এলো।

“আরে আরে নতুন বউ কাঁদে কেন?” গ্রাম্য পরিবেশে শহুরে একটা আওয়াজ তনয়াকে একটু অবাক করল। সে চোখ তুলে দেখল স্বরূপের বন্ধু মিলি। সব বন্ধুবান্ধবকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তবে সবারই দেখা গেছে কোনো না কোনো সমস্যা। সকালে বলছিল স্বরূপ ওদের কথা। তবে মিলি আপু যে আসবে সেটা বলেনি।

মিলি কাছে এসে তনয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

তনয়া মাথা নাড়ল। মিলি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “পড়বেই তো। কিন্তু কাঁদলে কি মা আসবে বলো? আরও তার কষ্ট হবে। তুমি খুশি থাকো, দেখবে মাও খুশি থাকবে।”

তনয়া হাসার চেষ্টা করল। মিলি বলল, “তোমাকে যা সুন্দর লাগছে মেয়ে! তোমার বরের তো সারাদিন তাকিয়ে থাকার কথা। কোথায় সে? এসে তো দেখলাম না।”

তনয়া অভিমান করে বলল, “আপনার বন্ধু কি আর সেরকম মানুষ নাকি?”

মিলি ম্লান হেসে বলল, “ও খুব ভালো মানুষ তনয়া। তুমি যদি ওকে ঠিকঠাক বোঝো তাহলেই আর একথা মনে হবে না।”

তনয়ার গতকালের কথা মনে হলো। মিলি আপু হয়তো সত্যিই বলছে।

*

দিনটা ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধ্যার অনেকটা পর যখন সব মেহমান চলে গেছে, তখন ঘরে ঢুকল তনয়া। ইচ্ছে হলো কোনো জাদুমন্ত্রবলে যদি শাড়িটা বদলে নরম জামা হয়ে যেত! আহা!

স্বরূপের দেখা নেই। এখনো হয়তো কাজ করছে। তনয়ার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। যদিও সে বসেই ছিল, তবে কখনো কখনো বসে থাকাটাও খুবই যন্ত্রণাদায়ক।

সে উঠে কাপড় বদলে মেকআপ ধুয়ে এলো। বিছানার চাদর বদলে ফেলল। আজ এত মানুষ এসেছে যে এটাতে শোওয়া যেত না৷ কাজ করতে করতে সে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রাখতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠল সে। নাঁকি একটা সুরে কেউ যেন গান গাইছে। কান পাতল তনয়া। গান? নাকি কিছু একটা বলছে? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। আবারও ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। একসময় কথাগুলো একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে এলো, “স্ব…রূ…প… কো…থা…য়. .তু…মি… তোমা…র…ঘ…রে…কে…এটা… তু…মি…নে…ই…কে…নো…. ও… স্ব… রূ…প… তু… মি…বি… য়ে.. কে…নো… ক…রে…ছো…আমি…তোমাকে…বলেছিলাম…না… স..তী…নে…র…ঘর…করবো…না…”

তনয়া অস্ফুটে বলল, “কে? কে কথা বলে? কে?”

কণ্ঠটা একটু থামল। তারপর কাচের চুড়ি ভাঙার মতো রিনরিনে কণ্ঠে কে বলে উঠল, “আমি চন্দ্রা…চন্দ্রাবতী… তোমার সতীন গো সতীন…”

তনয়া বুঝতে পারছিল না শব্দটা আসছে কোথা থেকে। তবে কি স্বরূপ সত্যিই বলেছিল? কেউ আছে এরকম? ঘরের আলো অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে চারদিকে ছায়ারা জেগে উঠে নাচানাচি করছে। তনয়া ফুঁপিয়ে উঠল। ভয়ে তার গা শিরশির করছে। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানে না তনয়া।

একসময় দরজা খুলে গেল। স্বরূপ ঢুকে তাকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তনয়া? আবার কিছু হয়েছে?”

তনয়া ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। স্বরূপ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “আরে কাঁদো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

তনয়ার শান্ত হতে একটু সময় লাগল। তারপর সে সব খুলে বলল। স্বরূপকে খুব চিন্তিত মনে হলো। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা একটা কাজ করো তো…” বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল বের করল সে। কী একটা অ্যাপ বের করে তনয়ার মুখের সামনে মোবাইল ধরে বলল, “কিছু একটা বলো।”

“কী বলব?”

বলার পরেই অদ্ভূত একটা ব্যাপার হলো। অদৃশ্য কোথাও থেকে নাঁকি সুরে ভেসে এলো, “কী…ব…ল…বো…”

তনয়ার কয়েক সেকেন্ড লাগল বিষয়টা বুঝতে। সে প্রচন্ড রাগে স্বরূপের দিকে তাকিয়ে দেখল সে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তনয়া বালিশ দিয়ে ইচ্ছেমতো তাকে মারতে শুরু করল। স্বরূপের হাসি তাতে থামল না। তনয়ার এরপর বলা সব কথা প্রতিফলিত হয়ে নাঁকি সুরে ফিরে ফিরে আসতে লাগল। স্বরূপের হাসিও বাড়তে লাগল। একসময় তনয়া ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। তারও এখন নিজের বোকামিতে হাসি পাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কেন করলে এটা?”

স্বরূপ কোনোমতে বলল, “নাম বদলে ঝন্টু হতে চাই না বলে।”

“তোমাকে আমি আজ থেকে ঝন্টুই ডাকব। হুহ…”

স্বরূপ পেট চেপে বলল, “ডেকো, আমি তোমাকে ডাকব ভুতু।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here