গহন_কুসুম_কুঞ্জে ১৮.

0
84

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৮.

তনয়া যখন চিৎকার করে জেগে উঠল তখন ঘড়িতে আড়াইটা বাজে। ওর চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে স্বরূপের। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। তনয়া তখন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।

স্বরূপ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তনয়া, ঠিক আছো?”

তনয়া একটু ধাতস্থ হলে উত্তর দেয়, হ্যাঁ।”

স্বরূপ তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, “খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে?”

তনয়া স্বপ্নটা মনে করতে চায় না। পরপর দুটো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে তার৷ একবার স্টেশনে আরেকবার গ্রামে। দুটো মিলে বিভৎস এক স্বপ্নের রূপ নিয়েছে। সে সব ভুলে থাকতে চায়, এমনিতে অনেকটা ভুলে থাকেও, কিন্তু অবচেতন মন বলেও একটা জিনিস আছে! সে ভোলে না।

তনয়া পানিটা এক চুমুকে শেষ করে বলে, “হাবিজাবি স্বপ্ন দেখেছি।”

স্বরূপ আর স্বপ্নের কথা তোলে না। বলে, “শুয়ে পড়ো। লাইট অফ করব?”

তনয়া একটু বিরক্ত হয়েই বলে, “তোমার এত লাইট অফ করতে ইচ্ছে হয় কেন বলবে? একটু আলো থাকলে কী হয়?” বলতে বলতে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো।

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “আমি কি কাঁদার মতো কিছু বলেছি? এরকম রিয়েক্ট করছো কেন মাঝরাতে?”

তনয়া এবার উত্তরই দিল না। বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে গেল। পাশের খালি ঘরে আলো জ্বেলে বসে রইল। তার ইচ্ছে করছে না কোনো কথা বলতে। বরং ভয় করছে। বুক কাঁপছে। বারবার স্বপ্নে দেখা কালো রোমশ হাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একা ঘরে তার আরও ভয় করতে লাগল। কিন্তু স্বরূপের ওপরও রাগ হচ্ছে। রাতে একটা মানুষ ভয় পেয়ে জেগে উঠলে এরকম কড়া সুরে কথা বলবে কেন? তনয়ার সাথে কেউ কোনোদিন জোরে কথা পর্যন্ত বলেনি। তার এবার সত্যিই ভীষণ মন খারাপ লাগতে শুরু করল। সাথে ভয় তো আছেই। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না৷ একসময় সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।

*

তনয়া চলে যাবার পর স্বরূপ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থেকে শেষে শুয়ে পড়ল। রাত দুপুরে মেয়েদের ন্যাকামি সহ্য করতে পারবে না বলেই সে বিয়ে থা করতে চায়নি। শখ করে এই মেয়েই তাকে বিয়ে করেছে। সামান্য কথা সহ্য করতে না পারলে সারাজীবন মা বাবার পুতুপুতু কন্যা হয়ে থাকা উচিত ছিল!

শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করল স্বরূপ। ঘুমটা হাওয়া হয়ে গেছে। তারচেয়েও বেশি হাওয়া হয়েছে তার বুকের ভেতরটা। খারাপ লাগা জমা হচ্ছে একটু একটু করে। আশ্চর্য তো! সে মেয়েটার ওপরে বিরক্ত হলে তার জন্যই আবার খারাপ লাগবে কেন? যত্তসব বাজে অনুভূতি!

মোবাইলটা টেনে নিল সে। ফেসবুকের পাতা খুলে বসল। আজকাল এই এক জিনিস পৃথিবীর সব ভুলিয়ে দিতে পারে। কত হাসি-ঠান্ডা, বিনোদনে ভর্তি এই জগত! স্বরূপের বড় কঠিন সময়ে এই ফেসবুকিং করে সে লম্বা সময় কাটিয়ে দিত। পরে অবশ্য আরও বেশি হতাশ লাগত, তবুও সময় তো কেটে যেত!

আজ কাটল না। অনেকক্ষণ নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করেও সে দেখল ঘড়ির কাটায় অতিবাহিত হয়েছে মাত্র পনেরো মিনিট! অথচ সাধারণত উল্টোটা হয়।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তনয়ার সাথে যে লাইট নিয়ে কথা কাটাকাটি হলো সেই লাইট সে তখন থেকে জ্বালিয়েই রেখেছে, বন্ধ করেনি!

স্বরূপ শেষ পর্যন্ত উঠে বসল। নিজেও বুঝতে পারল না কখন সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আর কখন পায়ে পায়ে পাশের ঘরে চলে গেছে।

তনয়া তখনো কাঁদছে। তার জামার সামনের অংশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। স্বরূপের এবার সত্যিই দুশ্চিন্তা হতে লাগল। সে পাশে বসে তনয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, “তনয়া, অ্যাই তনয়া…কী হয়েছে তোমার? খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে? নাকি আমার কথায় কাঁদছ? পাগল নাকি তুমি? তনয়া…”

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে রাখল। স্বরূপ নরম সুরে কথা বলায় তার অভিমান উপচে পড়ছে। উহু, গলে পড়বে না সে। যদিও রাগ বা অভিমান কোনোটাই দীর্ঘমেয়াদে তার মনে বসে থাকে না। একা একাই উড়ে চলে যায়৷ তার ওপর এখন একজন বসে বাতাস দিচ্ছে!

স্বরূপ হাত দিয়ে চেপে তনয়ার মুখটা ঘোরানোর চেষ্টা করল। তনয়া শক্ত হয়ে রইল। সে এবার উল্টোপাশে গিয়ে বসল। তনয়া সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এবার তার হাসি পাচ্ছে। “কী মুশকিল! এইমাত্র যেসব কান্না ভেতর থেকে বানের স্রোতের মতো ভেসে আসছিল সেসব কোথায় গেল?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল তনয়া। “না রে তনয়া, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুই একটা চরম বোকা। ইমোশনাল ফুল! না না, আবেগী বেকুব!”

স্বরূপ এদিকে সত্যিই ঘাবড়ে গেছে। সহজ একটা মেয়ে এরকম করছে কেন? গভীর দুঃখ পেয়েছে? সে তো এত কঠোর ব্যবহার কখনো করে না। বরং ওর নরম স্বভাবের জন্য যথাসম্ভব নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করে।

স্বরূপ এবার তনয়াকে জোর করে উঠিয়ে কোলে তুলে নিল। রওনা দিল নিজের ঘরের দিকে।

তনয়া প্রথমে চমকে গিয়েছিল। স্বরূপের কোলে চড়ে তার ভারি মজা লাগল। হাসিও পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি আটকে মুখটা গম্ভীর করে রাখল সে। হয়তো একটু বেশিই অভিনয় হয়ে গিয়েছিল। স্বরূপ ওকে কোলে রেখেই জিজ্ঞেস করল, “তনয়া তোমার কি বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন?”

তনয়া আর পারল না, হেসে ফেলল। স্বরূপ চোখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাহিনী কী?”

তনয়া এবার স্বরূপের গলা জড়িয়ে ধরে স্বাভাবিক সুরেই বলল, “কিছু না। আমার খুব খারাপ লাগছিল। তুমি মন খারাপ ভালো করে দিয়েছ।”

“আমার জন্যই তো মন খারাপ হয়েছিল।”

“পুরোটা তোমার দোষ নয়। স্বপ্নও তো দেখেছিলাম। কিন্তু তুমি বলো, আর এরকম করে কথা বলবে না? আমার কষ্ট হয়।”

“কিরকম করে?”

“এইযে ধমক দিয়ে…”

“তুমি বয়সে কত ছোটো, একটু আধটু ধমক নাহয় খেলে..”

“না। একটুও না। আমি কোনো ধমক চাই না।”

“কী চাও?” স্বরূপ এবার খানিকটা তরল গলায় বলল।

তনয়া কথা বলল না। তার আবারও হাসি পাচ্ছে। সে বুঝে গেছে, চাইলেও কোনোদিন এই মানুষটার সাথে সে রাগ করে থাকতে পারবে না। ওর মুখ দেখে সব অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারবে। একটু আহ্লাদ করলে নিজেকে মেলে দিতে ওর একটুও সময় লাগবে না। এরকম বিধ্বংসী অনুভূতির কি কোনো মানে হয়?”

ওর ঘোর লাগা চোখের দিকে তাকিয়ে স্বরূপের মনে হলো, মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। সে তো তাবিজ কবচ করেনি৷ এত পাগল হওয়ার কী কারন?

“তুমি কি আজকে আমাকে নামাবে না?” বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ফেলল তনয়া।

স্বরূপ ওকে বিছানায় নামিয়ে দিল। পরক্ষণেই তনয়ার হাসি চাপা পড়ে গেল স্বরূপের ঠোঁটের ভাঁজে।

কিছুক্ষণ পর তনয়া টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করতে হাত বাড়াতেই স্বরূপ খপ করে ধরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আজ তো লাইট বন্ধ হবে না। ওটা আলো ছড়াবেই…”

তনয়া শক্ত মুঠির ভেতর থেকে হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে চোখদুটোই বন্ধ করে ফেলল।

*

ওদের ঘুম হয়েছিল শেষ রাতের দিকে। তনয়া ক্লান্তিতে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই শুনেছে স্বরূপ তাকে বলছে, সে অফিসে যাচ্ছে। তনয়া কোনোরকমে চোখ মেলে দেখেছে মভ কালারের শার্ট, কালো প্যান্ট পরা এক ব্যস্ত মূর্তি ঘোরাফেরা করছে। আরেকটু কষ্ট করে পুরোপুরি চোখ মেলতেই চোখে পড়েছে ওর ব্যাকব্রাশ করা চুলের নিচে সুন্দর মুখে ব্যস্ততার ছাপ, আর একটু ভ্রুকুুটি। আহারে!

তনয়া উঠে বসতে বসতে বলল, “আমার জন্য তোমার এত তাড়াহুড়ো করতে হলো তাই না?”

স্বরূপ ঘুরল তার দিকে। “উঠেছো কেন? তোমার কি অফিস আছে নাকি? ঘুমাও!”

“কিন্তু তুমি খাবে না?”

স্বরূপ ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখল। তারপর এক ছুটে এসে তনয়ার গালে চুমু খেয়ে বলল, “এইতো খেলাম। এখন যাই। তুমি খেয়ে নিও। সব আছে ফ্রিজে।”

তনয়ার চোখে আবার ঘুম জড়িয়ে এলো। ঘুমের সাথে মিশে রইল মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ। মনে হলো স্বরূপ আশেপাশেই তো আছে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

[একটি ঘোষণা: ডাক্তাররা বেশি চিনি খেতে নিষেধ করেন। তাই চিনিওয়ালা পর্ব এখানেই সমাপ্ত। এরপর গল্প এগিয়ে যাবে আপন গতিতে। তাই বলে চিনি পুরোপুরি বাতিলও করা হবে না। ওইটা অল্প থাকবেই। এই বাণী শুধু আপনাদের জন্য না, নিজের জন্যও লিখলাম। আমি এসব কী লিখছি আজকাল!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here