গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৬.

0
76

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৬.

“Love is just a myth” – স্বরূপের ফেসবুক প্রোফাইলের বায়ো-তে থাকা লেখাটা কয়েকবার পড়ল তনয়া। সত্যিই কি তাই? কথাটা অনেকবার ভাবায় তাকে। কেন লিখেছে তা তনয়ার জানা। কিন্তু কথাটা কি স্বরূপ মন থেকে বিশ্বাস করে? তনয়া দেখেছে স্বরূপ নিজের মাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সেটাও কি মিথ? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলেও করল না সে৷ বরং আইডিটা ঘুরে আসা যাক।

অনেক পোস্ট শেয়ার করে স্বরূপ। বেশিরভাগই দেশের অর্থনীতি আর রাজনীতি সম্পর্কিত! তনয়া মিনিট দুয়েক ঘুরে বিরক্ত হয়ে আবার ওপরে চলে গেল। ফেসবুক ছবি জমা করে রাখে একটা ফাইলে। সেখান থেকে প্রোফাইলের ছবিগুলো দেখল অনেকটা সময় নিয়ে। একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করার মতো।

স্বরূপের একসময়ের ছবিগুলো যেরকম হাসিখুশি আর উৎফুল্ল ছিল, সেটা আর এখন নেই। বরং অনেকদিন সে প্রোফাইলে কালো পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সেসব দিনে ওর চেহারাটা ছিল নিষ্পাপ মিষ্টি দেখতে। দাড়ি একদমই রাখত না৷ একটা বাচ্চার মতো দেখাত তাকে। এখন অনেকটা পরিণত। এখন যদিও সে আগের তুলনায় সুন্দর দেখতে হয়েছে, তবুও সে সময়ের ছবিগুলোতে যে উৎফুল্ল হাসিটা ছিল সেটা এখন হারিয়ে গেছে। ছবিগুলো নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখল সে। মাঝেমধ্যে দেখবে।

আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। আগামীকাল বিয়ে। একসাথে গায়ে হলুদ হয়েছে। পাশে বসে স্বরূপ মোবাইল ঘাটছিল, সেই ফাঁকে সে আইডির নামটা দেখে নিয়েছে। অবশ্য রূপা আপুর কাছে চাইলে হতো, কিন্তু এখন স্বরূপের বিষয়ে মুখ খুললেই যে কেউ বলে বসছে, সে বিয়ের আগেই স্বামী পাগল হয়ে গেছে! আশ্চর্য!

বিয়ের পরদিন তাদের যেতে হবে স্বরূপদের গ্রামে। গ্রামে নাকি তাদের অসংখ্য আত্মীয়স্বজন। ওখানে একটা অনুষ্ঠান না করলেই নয়। হাজার হোক, গ্রামের একমাত্র স্কুলের হেড টিচার হচ্ছেন ওর শাশুড়ী। তাই বিয়ের পরদিনই গ্রামে চলে যাবে তারা৷ ওখানে একটা অনুষ্ঠান সেরে ক’দিন থেকে ফিরবে।

তনয়ার এতক্ষণ পুরো বিষয়টা খুব আকর্ষণীয় লাগছিল, কিন্তু এখন খানিকটা ভয় লাগতে শুরু করল। আচ্ছা, সে বাবা মাকে ছেড়ে কেমন করে যাবে? বাবা মা থাকবেন কেমন করে? চলে যাবার বিষয়টা মাথায় থাকলেও এতক্ষণ উপলব্ধিতে আসেনি। হঠাৎ কেমন একটা দুঃখবোধ ছুঁয়ে গেল তাকে।

তনয়া উঠে গিয়ে বাবা মায়ের ঘরে উঁকি দিল। মা নেই। বাথরুমে ঢুকেছেন হয়তো। বাবা উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। তনয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আরে, তোর কী হলো আবার?”

বাবার গলাটা বুজে আসায় তনয়া বুঝতে পারল তার চোখে পানি চলে এসেছে। মা বের হলে বললেন, “আমাকে ভুলে গেছ নাকি তোমরা?”

বাবা এক হাত বাড়িয়ে দিতেই মাও এসে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনকে। ওদের তিনজনের মিষ্টি পরিবারটা আগামীকাল দুজনে পরিণত হবে!

তনয়ার জন্মের পর মায়ের কিছু শারিরীক সমস্যার কারনে আর কোনো সন্তান তিনি ধারণ করতে পারেননি। তনয়া সারাজীবন লোকের কাছে শুনে এসেছে, “আহারে, একটা ছেলে হলো না৷ মেয়ে তো পর হয়ে যাবে।” তনয়ার তখন খুব রাগ হতো। আজ ওর নিজেরই মনে হলো, মা বাবার একটা ছেলে হলে বেশ হতো!

*****

স্বরূপ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। মা হঠাৎ বললেন, “তুই তো কাল থেকে পর হয়ে যাবি।”

স্বরূপ হেসে বলল, “কেন আমি কি মেয়ে নাকি?”

“বিয়ের পর ছেলেরাও পর হয়।”

“তাই নাকি? জানতাম না তো। কেমন করে?”

“এই যেমন এখন তুই আমার কাছে বসে আছিস। আমাকে ফোন করে ঘন্টা ধরে কথা বলিস৷ বাড়ি ফিরে আমার খোঁজ করিস সবার আগে। বিয়ের পর করবি? বিয়ের পর আগে থাকবে বউ, তারপর মা।”

স্বরূপ উঠে বসে বলল, “মা, তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেই বলো? আমারও ভালো, তোমারও।”

মা স্বরূপের কান টেনে বললেন, “ওই কপালপুড়ি তোকে কেন বিয়ে করতে রাজি হলো কে জানে! পাজি কোথাকার!”

“ওর কথা বাদ দাও। তোমার তো হিংসে হচ্ছে!”

মা হেসে বললেন, “হিংসে না রে বাবা, হিংসে না। সত্যিটা বললাম। বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এর পেছনে কিন্তু এদের কারো দোষ থাকে না। দোষ হয় সময়ের। বউ বিয়ে করে এসে স্বামীর অধিকার পেতে চায়, আর মা তার জায়গা ছাড়তে চায় না৷ এটাই বলেছি। হিংসে করব কেন? এত লক্ষীমন্ত মেয়েটা! আমার ভারি ভালো লেগেছে। দেখিস তোকে ও মানুষ করে ছাড়বে!”

“তার মানে কি আমি অমানুষ?”

“তা খানিকটা আছিস!”

“মা…”

মা স্বরূপের নাক টিপে দিয়ে বললেন, “আমার ছেলে পৃথিবীর সেরা ছেলে!”

“হয়েছে৷ অফিসের জুনিয়ররা যথেষ্ট তেল দেয়। তাদের দলে শামিল হবার প্রয়োজন নাই।”

মা গালে হাত দিয়ে বললেন, “প্রশংসা করলেও দোষ, খারাপ বললেও দোষ। যাই কোথায় বল তো?”

“মা তুমি একটা ড্রামা কুইন!”

“সে আবার কী?”

“বুঝতে হবে না। আমার চুল টেনে দাও তো।”

স্বরূপ মায়ের কোলে মাথা রাখতেই মায়ের ফোন বাজল। তনয়া ফোন করেছে। ফোন ধরে মা গল্প করতে শুরু করলেন। সে গল্প আর ফুরায় না! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে স্বরূপ উঠে গিয়ে বলল, “তোমার ছেলেটেলে পর হয়নি, আমার মা পর হতে যাচ্ছে!”

মা হাসলেন। কথাটা শুনে ওপাশ থেকে তনয়াও হাসল। স্বরূপের এই অভিমানী গলা তার চেনা নয়।

তনয়ার বান্ধবী লুনার বিয়ে হয়েছে প্রায় দু’বছর আগে। প্রেমের বিয়ে। তবুও সে এখনো বলে, জানিস, প্রতিনিয়ত ওর এমন এমন নতুন বৈশিষ্ট্য বের হচ্ছে না! মনে হয় একটা মানুষকে পুরোপুরি চিনতে সারাজীবন লেগে যায়!

*****

তনয়ার রাতে ঘুম হলো না। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে জেগে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। রাতের আকাশে কোটি তারা জেগে বসে আছে তারই মতো। আগামীকাল রাতটা কেমন হবে? খুব সুন্দর কিংবা খুব কষ্টকর?

সে আনমনেই স্বরূপকে ফোন করে বসল।

স্বরূপ সাথে সাথেই ফোনটা তুলে বলল, “হাই এক্স সিন্ডারেলা!”

“মানে কী?”

“আগে তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমাতে, তাই সিন্ডারেলা ছিলে, এখন দেরিতে ঘুমিয়ে এক্স হয়ে গেছ।”

তনয়া হাসল।

“ফোন করেছ কেন?”

“এমনি।”

“প্রেম করতে?”

“হ্যাঁ করবেন?”

“কিভাবে করতে হয়?”

“আমার কোনো এক্সপিরিয়েন্স নেই।”

“সত্যিই?”

“সত্যি!”

“এদিকে আমার এক্সপিরিয়েন্স জঘন্য!”

“তাহলে আর প্রয়োজন নেই সেকথার।”

স্বরূপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি ভুল করলে তনয়া।”

“কী ভুল?”

“একসময় বুঝতে পারবে। তখন প্লিজ আমাকে দোষ দেবে না।”

“আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।”

“সেই চেষ্টা কম করিনি, তবে তেমন লাভ হয়নি।”

“তাহলে আর তার দরকার নেই।”

“তুমি একসময় বুঝবে। তখন পস্তাবে।”

“আমি কখনোই পস্তাব না। আমার কোনো সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি।”

“কোনোদিন হবেও না এমন কোনো গ্যারেন্টি কার্ড পেয়েছ নাকি?”

“আপনি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন?”

“করছি। চলো একটা বাজি ধরি।”

“বিয়ে নিয়ে বাজি?”

“সেরকম না। তুমি ঠিক দু’বছর পর তোমার বিয়ে করার সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করবে। যদি করো তাহলে আমি বাজিতে জিতব। আর যদি না করো তবে তুমি জিতবে।”

তনয়া ভয়ার্ত গলায় বলল, “বাজি জেতার জন্য আপনি কী কী করবেন?”

“কিচ্ছু না। তোমার বোনকে আমি কথা দিয়েছি তোমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করব না। কথাটা রাখব। আমি যেমন তেমনই থাকব। দেখা যাক তুমি কী করো।”

“ঠিক আছে, দেখা যাবে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here