গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৯.

0
78

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৯.

সকালের খাওয়া শেষে সবাই গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাত এগারোটার ট্রেন৷ স্বরূপের মা বাসে যাতায়াত করতে পারেন না বলে ট্রেনই ভরসা। তনয়া প্রথমবার ট্রেনে যাবে। সে বেশ উত্তেজিত হলেও এই মুহূর্তে ঝামেলায় আছে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী কী নেবে। বাপের বাড়ি থেকে বিশাল চারটে স্যুটকেসে যাবতীয় জিনিসপত্র এসেছে। মা গুছিয়ে দিয়েছেন। সে জানেও না কোথায় কোন জিনিসটা আছে। তার ওপর কী কী নেবে না নেবে সেটাও একটা প্রশ্ন।

স্বরূপের মা নিজের গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে স্বরূপ সেই যে সকালে বের হয়েছে, তার খবর নেই। তনয়া কয়েকবার তাকে ফোন করল, স্বরূপ ফোন তুলল না৷ তনয়ার ইচ্ছে হলো নিজের চুল ছিঁড়তে। সবগুলো স্যুটকেস খুলে জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে সে আরও এলোমেলো করে ফেলল।

সন্ধ্যা সাতটায় স্বরূপ ফিরল। সাড়ে আটটার মধ্যে রওনা দেবে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশন কাছেই, তবু আগে পৌঁছে যাওয়া ভালো।

ঘরে ঢুকে অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত পড়ল। পুরো ঘর এলোমেলো। শাড়ি, গয়না, কসমেটিকসের ভিড়ে তনয়া বসে আছে। সে নিজেও এলোমেলো। স্বরূপ হতভম্ব স্বরে জিজ্ঞেস করল, “হচ্ছেটা কী?”

“বুঝতে পারছি না।”

“কী বুঝতে পারছ না?”

“কোনটা নেব আর কোনটা নেব না।”

স্বরূপ ঘরের চারদিকে আরেকবার চোখ বোলাল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। সে বিছানায় বসে একটু স্থির হয়ে বলল, “তোমার যে জিনিসগুলো খুব দরকার শুধু সেগুলো নাও।”

“কিন্তু আমার সবই প্রয়োজন।”

“এত জিনিস নিতে চাইলে পুরো ট্রেন ভাড়া করতে হবে।”

“করে ফেলো প্লিজ!”

স্বরূপ তনয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে কি না! তনয়া কাচুমাচু মুখে বলল, “আমি কোনোদিন দূরে জার্নি করিনি। জানব কী করে কিভাবে প্যাকিং করতে হয়? কী কী নিতে হয়?”

“এসব কে গুছিয়ে দিয়েছিল আসার আগে?”

“মা।”

“সবই মা? তোমার সাথে মাকেও নিয়ে আসা দরকার ছিল।”

“আনলেই পারতে।”

“এরচেয়ে সহজ তোমাকে মায়ের কাছে রেখে আসা। বিয়ের আগে কিছু শিখতে টিখতে হয় নাকি!”

তনয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “এখনই খোঁটা দিচ্ছ? বাকি জীবন কী করবে? হে আল্লাহ! আমাকে এ কী শাস্তি দিলে তুমি!”

স্বরূপ ভুরু কুঁচকে বলল, “ঢং তো ভালোই পারো।”

“বিয়ের জন্য ওইটুকু পারলেই হয়।”

“ওইটুকু ছেলে পটাতে কাজে লাগে। সংসারে নয়।”

“শোনো, বারবার উল্টোপাল্টা কথা বলবে না! সবার চরিত্র একরকম হয় না।”

“আচ্ছা এই টপিক বাদ। কয়টা বাজে দেখেছ? সর্বনাশ! আমার জিনিসপত্রও প্যাক করা বাকি। তুমি একটা…ধ্যাৎ! ওঠো! নতুন শাড়ির ওপর বসে আছো কেন?”

তনয়া উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিচে পড়ে সুন্দর শাড়িটা মোটামুটি ভর্তা হয়ে গেছে। আসলে সে এত পাগল হয়েছিল যে এতক্ষণ বুঝতেও পারেনি কোথায় বসে আছে।

স্বরূপ বিড়বিড় করছে রাগে। সেই সাথে কাজও করছে।

একটা স্যুটকেস খালি করে ফেলল সে। তারপর বলল, “সবার আগে জামাকাপড়। আমরা পাঁচদিন থাকব, তাই পাঁচদিনের জামাকাপড় নিলেই চলবে।”

এর মাঝে একদিন অনুষ্ঠান, সেদিনেরটা সহ মোট পাঁচটা শাড়ি নিয়ে নিল সে। তনয়া সেগুলোর সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট আর অন্তর্বাস গুছিয়ে দিলে স্বরূপ সুন্দর করে ভাজে ভাজে গুছিয়ে ফেলে বলল, “এবার?”

“শাড়ি পরতে ইচ্ছে না হলে সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। তাই পাঁচ সেট কামিজ নিতে হবে।”

স্বরূপ চোখ কপালে তুলে বলল, “ফাজলামো নাকি?”

“সত্যি!”

স্বরূপ আর কথা বাড়াল না। সালোয়ার কামিজ নিল। রাতে পরার জন্য নরম জামা নিল। এরপর এক এক করে গোছানো হলো কসমেটিকস, গয়নাগাটি। দুটো স্যুটকেস তালাবদ্ধ করার পর তনয়া আমতা আমতা করে বলল, আরো কিছু জিনিস…”

“আরো কী?”

“একটা হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার, আর…”

“আর একটা টিস্যুও নেবার জায়গা নেই। এসবেই চলবে। চুপ করে বসো।”

তনয়া বসে পড়ল। স্বরূপ ওর বাকি জিনিসগুলো আগোছালোভাবেই আলমারিতে তুলে রাখল। গোছানোর সময় নেই। এবার সে নিজের জামাকাপড় গোছাতে শুরু করল।

তিনটা শার্ট, তিনটা টিশার্ট, একটা পাঞ্জাবি, কোট, প্যান্ট, দুটো ট্রাউজার, পারফিউম আর শেভিংয়ের সরঞ্জাম ঢুকিয়ে স্যুটকেস বন্ধ করে দিল। দশ মিনিটের ব্যাপার। তনয়া হা করে দেখল শুধু।

স্বরূপ ওর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, “কী হলো?”

“হয়ে গেল?”

“জি। হয়ে গেল। এরচেয়ে কম জিনিসেও হয়।”

“ভাগ্যিস ছেলে হয়ে জন্মাইনি!”

স্বরূপ চোখ গোল করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম উল্টোটা বলবে, আহারে! যদি ছেলে হয়ে জন্মাতাম!”

“এখানেই তো তোমার আমার চিন্তার পার্থক্য!”

“কিন্তু ছেলে হতে চাও না কেন?”

“ছেলে হয়ে তোমাকে তিনটা স্যুটকেস গোছাতে হলো। আর আমি মেয়ে বলে চুপচাপ বসে দেখলাম। কিছুই করলাম না। এজন্যই ছেলে হতে চাইনি।”

স্বরূপের মুখটা দেখার মতো হলো। সে মুখ বাঁকা করে বলল, “তোমার মতো অলস আর অকর্মা মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আবার বড়াই করে বলছো!”

“এজন্যই তো আল্লাহ তোমাকে পাইয়ে দিলেন বলো!”

“তোমার কী মনে হয় আমি সবসময় তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দেব? আর এই ঝামেলা পোহাব না বলে দিলাম।”

“আর দাও বা না দাও, আজ তো দিলে। একদিনেই পয়সা উসুল!”

স্বরূপ কী যেন বলতে যাচ্ছিল, মা ঘরে ঢুকলেন এমন সময়। তনয়াকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “হায় হায় তৈরি হবে কখন? সাড়ে আটটা বাজতে চলল!”

“এইতো মা এখুনি রেডি হচ্ছি।”

তনয়া জামাকাপড় নিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল৷ স্বরূপ মাকে বলল, “তোমরা সবাই রেডি?”

“আমি তো অনেকক্ষণ আগেই তৈরি হয়ে বসে আছি।”

“তুমি তো লক্ষী মেয়ে। আচ্ছা, বাবা থাকতে তুমি তোমার জিনিসপত্র নিজেই গোছাতে নাকি বাবাকে দিয়ে করাতে?”

মা ইঙ্গিত বুঝে মুখ টিপে হেসে বললেন, “আমার ব্যাগ গোছানো তোর বাবার কোনোদিনই পছন্দ হতো না৷ নিজে থেকেই গুছিয়ে দিত সবসময়।”

স্বরূপ আপনমনেই বলল, “বিষয়টা তাহলে জেনেটিক্যাল। এজন্যই এই অকর্মার ঢেকির জন্য এতকিছু করে ফেলছি। নয়তো আমার কোন ঠেকা পড়েছে…”

“কী বলছিস এসব?”

“না না, কিছু না। চলো সব নিচে নামিয়ে রাখি। গাড়ি চলে আসবে এখুনি..”

*****

স্টেশনে গিয়ে তারা জানতে পারল ট্রেন আসতে এক ঘন্টা লেট হবে। সবাই ওয়েটিং রুমে বসে রইল। তনয়া স্টেশনে আসার পর থেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখছে। স্টেশনে শুয়ে থাকা ভিখিরি থেকে শুরু করে পানির বোতলওয়ালার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগল। সবকিছু কেন যেন সুন্দর লাগছে। তার পাশে বসে স্বরূপ বিরক্ত মুখে মোবাইল স্ক্রল করছে। তনয়া মাঝেমধ্যে আঁড়চোখে দেখছে। স্বরূপ আপাতত ভিডিও অপশনে ঘুরছে। সুন্দরী সংবাদ পাঠিয়ে কীসব হাবিজাবি বলছে, সেটা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। শুনছে নাকি মহিলাকে দেখছে? ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না তনয়া।

একটু পর আরেকটা ভিডিও এলো। বিদেশী একটা প্রোগ্রাম। মহিলার ওপরে একটা টপস পরেছে যার প্রায় পুরোটাই স্বচ্ছ। এটাও স্বরূপকে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে দেখা গেল। তনয়ার ইচ্ছে করতে লাগল মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে।

একপাশে মা, চাচীরা বসে গল্প জুড়েছে, যেসব গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই তনয়ার অচেনা।

সময় কাটতে লাগল। এক ঘন্টা পার হবার পর জানা গেল ট্রেন আরও লেটে আসবে। কখন আসবে কেউ জানে না। তনয়ার ভালোলাগা ক্রমাগত বিরক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। স্বরূপ মোবাইল থেকে চোখ পর্যন্ত তুলছে না। তার মোবাইলে এখন খাওয়াদাওয়ার ভিডিও চলছে। এক মহিলা বিশাল হা করে তাতে একসাথে চারটে ডিম ঢুকিয়ে দিল!

তনয়ার বমি পেয়ে গেল। এদিকে বাথরুমে যাওয়া দরকার। মহিলারা সবাই একটু আগেই গিয়েছিল। তনয়ার তখন প্রয়োজন হয়নি। এখন না গেলেই নয়। সে স্বরূপের হাত টানল, “ওয়াশরুমে যাব।”

স্বরূপ মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই বলল, “কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?”

“উফ! শুধু সাথে যাবে।”

“এখানেই তো ওয়াশরুম। নিজের কাজ করতে শেখো। আমি তোমার সার্ভেন্ট নাকি?”

“তুমি একটা নোংরা লোক!”

স্বরূপ দাঁত বের করে হেসে বলল, “বুঝতে বড় দেরি করে ফেললে সুন্দরী…”

তনয়া একাই ওয়াশরুমের দিকে গেল। কিন্তু পাবলিক টয়লেটের যা অবস্থা তা দেখে তার ভেতরের নাড়িভুঁড়ি পাক খেতে শুরু করল। কোনোরকমে বের হয়ে হাতে মুখে পানি দিয়ে একটু সুস্থ হবার চেষ্টা করল সে।

ফিরে যাবার সময় দেখল এক মহিলা বেশ বিপাকে পড়েছেন। তার কোলের ছোটো বাচ্চা কাঁদছে। তনয়া কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হবে।”

“ওইযে রুম আছে তো মায়েদের জন্য৷ ওখানে চলে যান।”

মহিলা বললেন, “আমার ব্যাগগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। সাথে আর কেউ নেই। এগুলো রেখে যাব কার কাছে? ভরসা করার কাউকে পাচ্ছি না।”

তনয়া বলল, “আমি দেখছি, আপনি যান।”

মহিলা খুশি হলেন। তার কোলের বাচ্চা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। তিনি তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলেন মাতৃদুগ্ধ পান করানোর ঘরটাতে।

তনয়া বসল। তার এখন ঘুম পাচ্ছে। রাত কত হলো? ঘড়ি নেই তার কাছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাই তুলল সে। ট্রেন কখন আসবে?

******

ট্রেন হঠাৎই চলে আসায় স্টেশনে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এতগুলো ব্যাগ তুলতে তুলতে অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ল স্বরূপের। সেগুলো তুলে জায়গামতো রেখে নিঃশ্বাস ফেলে বসল সে৷ মোট দুটো ডাবল সিটের কামরা ভাড়া করেছে তারা। ওপর নিচ করে সবার এতেই হয়ে যাবে। বাইরে তখনো ভিড়ভাট্টা, হৈচৈ।

মা অন্য ঘর থেকে এই ঘরে এসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “অ্যাই স্বরূপ, তনয়া কই?”

স্বরূপ চারদিকে তাকাল। তনয়া নেই। “ওই রুমে নেই?”

“না তো! ও কি ওঠেনি নাকি?”

ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। স্বরূপ দৌড়ে অন্য রুমে গেল। সেখানে নেই। পুরো বগিতে, ওয়াশরুমে, কোথাও তনয়া নেই। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ বোলাল। কোথাও তনয়াকে দেখা গেল না৷ তনয়ার নাম্বারে ডায়াল করল সে। ফোনটা বেজে উঠল তারই অন্য পকেটে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে স্বরূপ লাফিয়ে নামতে যাচ্ছিল, তখন মা ধরে ফেললেন তাকে। “করিস কী?”

“মা, ও রয়ে গেছে।”

“রয়ে যাবে কেন? হয়তো ভুলে অন্য বগিতে উঠেছে।”

স্বরূপ বুঝতে পারল না কী করবে। মেয়েটা এত কেয়ারলেস! দেখা হলে সবার আগে সে একটা চড় মারবে।

পরের স্টেশনে যেতে যেতে স্বরূপ পুরো ট্রেন খুঁজে ফেলল। কোথাও তনয়াকে পেল না। যে আশাটুকু ছিল, সেটা নিভে যেতেই ভয় জেঁকে ধরল তাকে। তনয়ার কাছে মোবাইল, টাকা কিছুই নেই। রাত দেড়টায় সে বাড়িতেও ফিরতে পারবে না৷ কী করবে একা একা? অন্য কারো মোবাইল দিয়ে তাকে কল করতেও তো পারে, তা করছে না কেন? বোকা মেয়েটা কোনো বিপদে পড়বে না তো?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here