গহন_কুসুম_কুঞ্জে ২৩.

0
351

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৩.

সকালে চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প হলো মা ছেলের। তনয়া তখনো ঘুমে। বিয়ের চক্করে গতবার মায়ের সাথে জমিয়ে গল্প করা হয়নি স্বরূপের। তাই নামাজ পড়তে ওঠার পর তনয়া আরেক দফা ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লেও সে না শুয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। আজ স্কুল ছুটি। মা নাস্তা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পিঠা বানানো হবে।

গতকাল চাল গুড়ো করে আনা হয়েছে। বাজারের দিকে চাল ভাঙানোর মেশিন থাকলেও মা চাল ভাঙাতে দেন জরীর মায়ের কাছে। বিধবা মহিলা স্বামী মারা যাবার পর তার ফেলে যাওয়া সম্পদ বলতে পেয়েছে ওই এক ঢেকি। মায়ের বড় মায়া হয় গ্রামের গরীব মানুষগুলোর জন্য। এত সামর্থ্য না থাকলেও যার জন্য যতটা পারেন, তিনি করেন।

এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল দু’জনের। ভোরের মিষ্টি বাতাস বইছিল সাথে। মা জিজ্ঞেস করলেন, “থাকবি ক’দিন? তোর তো অফিসে ছুটি নেয়া আছে।”

“না মা, আজ রাতেই চলে যাব ভাবছি।”

“কেন? ট্যুরটা কি চাইলে এখন দেয়া যাবে?”

স্বরূপ বলল, “না। তা যাবে না৷ ক্যান্সেল করে দিয়েছি পুরোপুরি। ভাবছি অফিসের ছুটিটাও ক্যান্সেল করব। এখন ছুটিটা কাটালে আর এক বছরে ছুটি দেবে না। তনয়ার অনেক মন খারাপ হয়েছে না যেতে পেরে।”

মা হেসে বললেন, “বিদেশে যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? তারচেয়ে এখন দেশেই কোথাও চলে যা। দেশের ভেতর বেড়াতে তো আর ঝঞ্ঝাট নেই। খরচও অত পড়বে না।”

স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “না মা, যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানেই যাব৷ দেশে তো চাইলে শুক্র শনিবার করে ঘুরে ফেলা যাবে। পরে ওখানে আর যাবার সুযোগ না পেলে?”

“হুম। আচ্ছা এবার বল তো, বিয়ে করবি না বলে যে মাথার পোকা খেয়ে ফেলেছিলি, এবার কী হলো? কে বিয়ে করল? আর কার বিয়ে করে চেহারা ঘুরে গেল?”

স্বরূপ গালে হাত ছু্ঁইয়ে বলল, “চেহারা ফিরেছে মানে?”

“আয়নায় দেখিস না নাকি? তোর চেহারা যে ভূতের সর্দারের থেকে আস্তে আস্তে মানুষ হচ্ছে বুঝিস নাই?”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “কে জানে!”

“ঘুম হয়?”

“হুম।”

“আগে কিন্তু হতো না।”

স্বরূপ ভাবল কথা সত্যি। অথচ নিজের এই ব্যাপারটা সে নিজেই ধরতে পারেনি। ঘুম একটা বড় সমস্যা ছিল। যখন একা ছিল, তার ঘুম আসতে অর্ধেক রাত পেরিয়ে যেত। যাও বা ঘুম হতো, শান্তি লাগত না। আজেবাজে স্বপ্নেরা ভিড় করে ঘুমে বাগড়া দিত। অথচ তনয়ার পাশে শুয়ে ওর সাথে হাবিজাবি বকবক করতে করতে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না। তনয়াই কথার মাঝখানে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে ঘুমন্ত দেখলে স্বরূপেরও ঘুমে চোখ ছোটো হয়ে আসে। অফিসে কে যেন বলছিল তার চোখের ডার্ক সার্কেল কমে গেছে। কোনো প্রোডাক্ট ইউজ করেছে কি না।

গল্পের মাঝে এক বুড়ি এসে হাজির। বুড়ির বয়স হলেও শক্তপোক্ত আছে। হেঁটে হেঁটে গ্রাম পাড়ি দিতে পারে। দুই গ্রামের প্রতিটা বাড়ির গল্প তার জানা।

তার হাতে ছোট্ট পানের বাটা। নিজের বানানো পান কিছুক্ষণ পরপর মুখে না দিলে তিনি কথা বলতে পারেন না।

এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমুন আছো নানা?”

স্বরূপকে বুড়ি বরাবরই আদর করেন। তিনি এলেই স্বরূপ তার পানের বাটা থেকে নিজেই পান বানিয়ে মুখে পুরে দেয়। আজও তাই করল।

বুড়ি প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, “আমি তো ভালোই। আপনি কেমন?”

বুড়ি জাঁকিয়ে বসে বলল, “আল্লায় বালা রাখছে। তা বউ কই? শাশুড়ীডা একলা কাম করে, হ্যায় কী করতাছে?”

মা হেসে বললেন, “ঘুমায়।”

বুড়ি একটু মন খারাপ করে বললেন, “এর লাইগ্যাই কইছিলাম শহরের মাইয়া বিয়া করান লাগব না। আমগো গেরামেই কত বালা মাইয়া পইড়া আছে। হেগোর কারো লগে বিয়া দিলে অহন তুমারে মুখে তুইল্যা খাওয়া দিত। একলা কাম কইরা বউরে খাওয়ান লাগতো না।”

স্বরূপ কী বলবে বুঝতে পারল না। মায়ের হাসি চওড়া হলো। বুড়ি সেটা দেখে বললেন, “হাসির কতা কুনডা কইলাম আমি?”

মা বললেন, “খালা, এইটা আমার সংসার। ওরা বেড়াইতে আসছে। দুইদিনের বউরে দিয়া কাজ করাবো কেন? সে কি মাটির চুলায় রাঁধতে পারে? আমি তো পায়ের উপর পা তুলে খেতে ছেলে বিয়ে করাই নাই। বিয়ে করাইছি যাতে ছেলে ভালো থাকে। সে ভালো আছে। দেখেন তার চেহারা ফিরছে না? ব্যস, আমার আর কিছুই লাগবে না।”

বুড়ি স্বরূপের দিকে তাকিয়ে ওর গালে কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, “আহারে! পোলাডা কত হুগাইয়া গেছে। তুমি অইলা মডান মা। শিক্ষিত অইয়া চোক্ষে বেশি দেহো। বউ কী না কী খাওয়ায়, মায়ের কাছে থাকলে পোলার চেহারা এমন অয়?”

মা এবারও হাসলেন। কিছুই বললেন না।

বুড়ি সমালোচনায় আরাম না পেয়ে উঠে চলে গেলেন। অন্য বাড়িতে নিশ্চয়ই বউয়ের দেরিতে ওঠা নিয়ে কথা শুরু করলে চমৎকার আসর বসে যাবে!

ওরা মা ছেলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলল। বুড়ি বরাবরই এমন৷ স্বরূপের মায়ের কোনো কথা পছন্দ না হলেই সে বলবে বেশি শিক্ষিত হয়ে তার মাথাটা গেছে! তবে ওরা রাগ করে না৷ বুড়ির মন ভালো। স্বরূপের বাবা মারা যাবার পর যে ক’জন মানুষ সত্যিকারের পাশে থেকেছে ইনি তাদের একজন।

*

আজও ওরা ফিরবে রাতের ট্রেনে। তনয়ার বিকেলের দিকে হঠাৎ মনে হলো, বিয়েতে তাদের অনেক ছবি আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের সাথে ভালো ছবি নেই। কেন নেই? কারন তাদের মা ছবি তোলার সময় বড়ই লাজুক। তার ওপর ফটোগ্রাফারের সামনে পোজ দেয়াতে তো তার মহা আপত্তি!

মা ঘরে বসে স্কুলের কিছু কাজ নিয়ে বসেছিলেন। তনয়া তাকে টেনে নিয়ে এলো। নিজের মেকআপ সামগ্রী দিয়ে কতকটা জোর করেই সাজিয়ে দিল। মা নিজেকে আয়নাতে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা দিয়ে বসে রইলেন। তনয়া বলল, “মা, আজ কিন্তু ছবি তুলব অনেক। আপনার ছেলেই তুলবে, তাই কোনো অযুহাত শুনব না।”

মা করুন চোখে তাকালেন৷ এ কি যন্ত্রণা!

স্বরূপ গ্রামের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তনয়া তাকে ফোন করে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো। ইমার্জেন্সি!”

স্বরূপ কিছু বলার আগেই সে ফোন কেটে দিল। স্বরূপ ব্যস্ত হয়ে সাথে সাথে ফোন করল। তনয়া ইচ্ছে করেই ধরল না। সে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল।

তনয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বরূপকে দেখে বলল, “ঘরে গিয়ে দেখো তো মায়ের কী হয়েছে!”

স্বরূপ ছুটে ঘরে ঢুকে দেখে মা নতুন শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে ভেবেছিল অসুখবিসুখ হয়েছে। কিন্তু মা তো দিব্যি বসে আছে! কিন্তু ঘোমটা কেন? হচ্ছেটা কী?

তনয়া এসে জোর করে ঘোমটা সরাল। স্বরূপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তনয়ার ওপর রাগ হয়েও হলো না। মাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তার মা এত মায়াবী সুন্দর! অথচ তার অতিরিক্ত পরিশ্রম আর আটপৌরে জীবনযাপন সেই সৌন্দর্যকে ঢেকে রেখেছে।

তনয়া বলল, “আমাদের ছবি তুলে দাও এখন।”

*

ট্রেনে বসে ছবিগুলো দেখছিল স্বরূপ। তনয়া আজ তার কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম আসছে না কেন যেন। আজ বিকেলটা এত সুন্দর ছিল! আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মায়ের সাথে তার কোনো ছবি ছিল না। আজ তোলা হয়েছে। মায়ের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে তোলা ছবিটা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে। ছবিটা ওয়ালপেপারে দিতে গিয়ে কী মনে করে দিল না। বরং ওদের তিনজনের কিছু ছবি তুলেছিল টাইমার সেট করে। সেগুলোর একটা দিয়ে রাখল।

তার জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল, যখন প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। নিজেকে সে রোজ আত্ম-হত্যা থেকে বাঁচিয়ে রাখত একটা মানুষের কথা ভেবে। সেটা ছিল মা।

তবে একাকী শহুরে জীবনে তার সব রঙ উড়ে গিয়েছিল। রঙগুলো একটু একটু করে ফিরে আসছে। যে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেও তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছে।

সে ফেসবুকে ঢুকল। ‘Love is just a myth’ লেখা নিজের বায়োতে চোখ পড়তেই সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “What is love?” সে কি ধীরে ধীরে ভালোবাসায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে? নাকি সংশয়বাদী?

লোপার সাথে তার প্রেম ছিল উত্তাল, বাঁধাহীন, প্রবল! প্রেমের জন্য পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়াও যেন কোনো ব্যাপার ছিল না৷ অথচ তনয়ার জন্য তার কোনো প্রবল আবেগ কাজ করে না। বরং ও পাশে থাকলে শান্তি লাগে। এটা কি প্রেম? নাকি স্বস্তির জায়গা?

লেখাটা পরিবর্তন করল না সে। কল্পকথারাও হয়তো কখনো সত্যি হয়ে যায়। সে অপেক্ষায় রইল। হয়তো হবে। সে উত্তাল ভালোবাসার টানে ছুটে যাবে এই মেয়েটার কাছে। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হাসল স্বরূপ। এও কি সম্ভব?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here