গহন_কুসুম_কুঞ্জে ২৪.

0
62

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৪.

তনয়ার সত্যিকারের একটা নতুন জীবন শুরু হলো এবার। বিয়ের পর থেকে একটার পর একটা ব্যস্ততা তাকে থিতু হতে দিচ্ছিল না৷ এবার যেন প্রথমবার সে হাত পা ছড়িয়ে আরামসে নিজের সংসারটা ভালো করে দেখল। গুছিয়ে এখানে জাঁকিয়ে বসার একটা চিন্তা তাকে বেশ আনন্দই দিল। এই যে পর্দাগুলো, বদলে ফেলবে সে। গাছ লাগাবে। দেয়ালের রঙ বদলে দেবে। ফার্নিচারগুলো সুন্দর, তবে বিন্যাস ভালো হয়নি, ঠিক করতে হবে। কত কাজ!

তনয়া রোজ মার্কেটে যায়। এটা সেটা কিনে আনে। রান্নাঘরের টুকিটাকি, নতুন কোনো শোপিস, পেইন্টিং কিংবা বই। প্রথম প্রথম সে নিজের জমানো টাকাই খরচ করত৷ আর স্বরূপ এত ব্যস্ততার মধ্যে খেয়ালই করেনি ঘরে কী হচ্ছে। হঠাৎ এক শুক্রবার তার মনে হলো বসার ঘরটা অনেকটা বদলে গেছে। সে অবাক হয়ে তনয়াকে ডাকতে শুরু করল।

তনয়া তখন রান্নাঘরে ময়দা মাখছে। ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত এক বিশেষ রেসিপি তৈরি হচ্ছে স্বরূপের জন্য। অখন্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল সে, মাঝে ছেদ পড়ল। ময়দা হাতেই তনয়া এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার সমস্যা কী? সকাল সকাল ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?”

স্বরূপ চোখ সরু করে বলল, “আমি ষাঁড় হলে তুমি নিশ্চয়ই গাভী!”

“উফ! কী হয়েছে সেটা বলবে?”

“ঘরটা তো আগে এমন ছিল না। এই দুটো ফুলদানি আর দেয়ালের ছবিটা নতুন এসেছে তাই না? আর খাবার ঘরের ঘড়িটাও!”

তনয়ার মনে হলো স্বরূপ তার বাড়ির এই পরিবর্তন পছন্দ করছে না। সে কিছুটা সংকুচিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, কেন খারাপ হয়েছে?”

স্বরূপ আরেকবার চারদিকে চেয়ে বলল, “না, সুন্দর হয়েছে। কিন্তু কবে করলে বলো তো?”

“একটু একটু করে করেছি।”

“বাহ! কিন্তু টাকা পাচ্ছো কোথায়?”

“আমার টাকা আছে।”

“তুমি যে বড়লোক তা জানি। কিন্তু এসব কিনতে থাকলে যে সম্পদ কদিনেই ফুরিয়ে যাবে তা বুঝতে পারছো? তারপর কী করবে?”

“জানি না।”

“বাবার কাছ থেকে নিয়ে নিজের সংসার সাজাবে?”

“জানি না।”

“আমারই ভুল। আমার উচিত ছিল তোমাকে কিছু টাকা দেবার। একেবারে মনে ছিল না।”

তনয়া বলল, “বিয়ের আগে যে বলেছিলে সংসারে সমান সমান কন্ট্রিবিউট করতে হবে।”

স্বরূপ হাসল। সোফায় গা এলিয়ে বসে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “সেজন্য কন্ট্রিবিউট করছো নাকি? কিন্তু এসব তো তোমার বাবার টাকা। তোমার টাকা কই?”

“চাকরি করলে তারপর…”

“তনয়া একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“তুমি চাকরি করতে চাইলে আমি কখনোই নিষেধ করব না৷ সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমার পরামর্শ চাইলে বলব, তুমি এভাবেই সুন্দর।”

“এভাবে বলতে?”

“এইযে এলো খোঁপা, কপালে ঘাম, ভোরবেলা উঠে নাস্তা বানাতে বসে যাওয়া, এই তনয়া ভীষণ সুন্দর। আমি জানি না কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পরিপাটি হয়ে অফিসে গিয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়া আত্মবিশ্বাসী তনয়ার চেহারা কেমন হবে। আমাকে ভুল বুঝো না। আমার নিজের মা কর্মজীবী মানুষ। তোমাকে বাড়িতে বসিয়ে রাখার মতো মানসিকতা আমি রাখি না। শুধু বলতে চাই, তোমার যদি ইচ্ছের ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রোফেশনাল লাইফে যাবার কোনো জোর নেই। তুমি পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারো।”

তনয়া মনে মনে হাসল। সে এবার সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “তাহলে বাকি রান্নাটা তুমিই করো।”

স্বরূপ কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। দুজনেই হাসল কিছুক্ষণ। তারপর তনয়া উঠলে স্বরূপও উঠে রান্নাঘরে গেল। খাবার দু’জন মিলেই তৈরি করল। শেষে যেটা তৈরি হলো সেটা খুবই জঘন্য খেতে হলেও দু’জন হাসিমুখে সাবাড় করল।

রাতে স্বরূপ তনয়ার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “এখন থেকে যা লাগবে, এখান থেকে খরচ করবে।”

“এটা কি আমার হাতখরচ?”

“বলতে পারো।”

“ধরো, আমি চাকরি করলাম। তখনও কি এভাবে টাকা দেবে?”

“তুমি চাইলে দেব।”

তনয়া হেসে বলল, “মানুষ কত অলস তুমি জানো? তোমার কি মনে হয় এত পেয়ে পেয়ে এরপর আমার ইচ্ছে করবে চাকরির জন্য পড়াশুনা করতে? এমনিতেই পড়ায় কোনো মন নেই। সারাদিন ঘর সংসার নিয়েই আছি। তুমি আমার মাথাটা খেয়ে ফেলেছ।”

“কেমন করে খেলাম?”

“কচকচ করে চিবিয়ে খেয়েছ।”

স্বরূপ হেসে বলল, “শার্পনারের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষয়ে হয় এখন শার্পনারের দোষ দিলে হবে? তুমি একা একা পাগল হচ্ছো। আমি কিছু করিনি।”

তনয়া আর কিছু বলল না। স্বরূপের কথা সত্য। সে এটাও জানে, সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। সে চাইলেও তার শাশুড়ীর মতো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না। চাইলেও দিনরাত পড়ে চাকরির জন্য দৌড়াতে পারবে না। সে হয়তো হতে পারবে একজন পারফেক্ট হাউজওয়াই। হাউজওয়াইফ শব্দটা এখন অনেকে ক্ষুদ্রার্থে বলে। ছোটো করে দেখে। কেন বাপু? চাকরিও তো মানুষ সংসারের জন্য, সম্মানের জন্য করে। যে দুটোই ঘরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছে তার দোষ কী? বরং সবার বাইরের জগতে কম্পিটিশন করে দৌড়ে দৌড়ে জীবনটা শেষ করে দেয়ার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। তার ভাবভঙ্গি স্বরূপ ভালেই বোঝে। তাই তো পালে হাওয়া দিতে বলে দিল, চাকরি না করলেও চলবে।

টাকাটা সে ব্যাগে তুলে রাখল। এই টাকা দিয়ে সে কী করবে তাও ঠিক করে রাখল। সেজন্য ছুটির দিন লাগবে। কিন্তু স্বরূপের বেরসিক অফিস সপ্তাহে একদিন কষ্টেসৃষ্টে ছুটি দেয়। সেদিনের অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই

*

তনয়া কদিনে অনেক গাছও লাগিয়েছে। একটা বারান্দায় সব পাতাবাহার, একটায় সব ফুলের গাছ। বারান্দাগুলো বড় বলে এখনো অনেকটা ফাঁকা রয়ে গেছে। অনেকটা সময় তনয়ার বাগানের পেছনে চলে যায়। এদের রোজ যত্ন লাগে। পাতা ছেটে দাও, পানি দাও, মাটি একটু খুঁচিয়ে দাও, কোনটায় ফুল আসছে তার একটু আলাদা যত্ন নাও। তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া দক্ষিণমুখী বারান্দায় ফুলের গাছগুলো লাগানে। প্রচুর বাতাস থাকে সবসময়। তনয়ার ভারি ভালো লাগে ফুলের সাথে সময় কাটাতে। সে এরপর একটা দোলনা কিনবে। দু’জন এঁটে যাবে এমন। তার পরিকল্পনা শেষ হতে চায় না।

গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ আজও খানিকটা ভার। সাথে ভীষণ বাতাস। গাছগুলোতে আজ আর পানি দেবে না তনয়া। শুধু মরা পাতাগুলো সাফ করছিল সে। সাথে গুনগুন করছিল কী একটা সুর। কোথায় শুনেছে নিজেও জানে না।

ফোনের শব্দে উঠল সে৷ কে আবার সকাল সকাল?

দেখল শাশুড়ী মা। ফোন ধরে কুশল বিনিময় শেষে মা বললেন, “একটা কথা ছিল গো মা।”

“বলুন মা।”

“মিতার জন্য তো অনেক করলে। আরেকটু করো। ওকে পড়তে পাঠাব তোমাদের কাছে। এদিকে তো ভালো কোচিং নেই। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কত যে ইচ্ছে মেয়ের! তা তোমাদের কাছে থাকলে ভালো কোচিংয়ে পড়ে পরীক্ষা দিতে পারবে।”

তনয়া খুশি হয়ে বলল, “পাঠিয়ে দিন না। কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা। আমি আগেই বলে রাখলাম। ওর তো এইচএসসি এখনো শেষ হয়নি। হলেই পাঠিয়ে দেব। তোমরা ব্যবস্থা করে রাখো।”

“আচ্ছা মা।”

মিতার সাথেও ফোনে কথা হলো তনয়ার। সকাল সকাল ভারি ভালো লাগল তার। মাঝে মাঝে একা লাগে। মিতা এলে দারুণ হবে!

*

বৃহস্পতিবার রাতে দেখা গেল পূর্ণিমা পড়েছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। এই শহরে আলাদা করে পূর্ণিমা চোখে পড়ে না। আজ পড়ল তার কারন লোডশেডিং। আজকাল লোডশেডিং বড্ড বেড়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি না কী যেন সমস্যা। স্বরূপ ভীষণ বিরক্ত। রাত বিরাতে কারেন্ট চলে গেলে উঠে বসে রাগে গজগজ করতে থাকে। গালাগাল করতে থাকে অথরিটিকে। দেশটা নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে। নানা হাবিজাবি রাজনৈতিক প্যাচাল। তনয়ার বিরক্ত লাগলেও সে শোনে। স্বরূপ খুব আগ্রহ করে ওকে বোঝায়। ও বুঝল কি না খেয়ালও করে না। সে বলতে পেরেই খুশি।

ইদানীং গরম পড়ে যাচ্ছে বলে লোডশেডিং হলে জানালা খুলে দিতে হয়। জানালা খুললে আবার ঝাঁকে ঝাঁকে মশা হাজির। ডেঙ্গুর ভয় আছে। স্বরূপ বলেছে জানালায় আর বারান্দায় নেট লাগিয়ে দেবে। তনয়ার ঘোর আপত্তির জন্য ব্যাপারটা থেমে আছে। স্বরূপ কিছুটা বিরক্ত। মাঝে মাঝে বলে বসে সে, “তোমার অতিরিক্ত রোমান্টিসিজমের জন্য কবে যেন ডেঙ্গু হয়ে মরে যেতে হবে! তখন ভালো করে আকাশ দেখো।”

তনয়া পাত্তা দেয় না। হাসে শুধু। রাগ হলে স্বরূপকে যা সুন্দর লাগে! সে কখনো কখনো ইচ্ছে করে রাগায়। ওর রাগান্বিত মুখের ছবিও তুলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। স্বরূপ বেশি রেগে গেলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। হাতটাত চেপে ধরে কামড়ে দিতে আসে। যদিও ব্যাপারটা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স না হয়ে শেষমেশ রোমান্টিক সীনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আজ লোডশেডিংয়ের পর জানালা খুলতেই দেখা গেল মস্ত চাঁদ। তনয়া তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিল। আলোয় ভেসে যাওয়া ঘর। কী সুন্দর! আহা!

সে স্বরূপকে শোওয়া থেকে জোর করে তুলে নিয়ে এলো। স্বরূপ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তনয়ার পাগলামিতে। সে হাই তুলতে তুলতে বসার ঘরে আসে। সত্যিই সুন্দর লাগছে। কিন্তু তার চোখে প্রকৃতি এত সুন্দর হয়ে ধরা দেয় না। বরং আগামীকাল অফিস নেই ভেবে আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

তনয়া ওর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, “চোখ খোলো! কত সুন্দর জ্যোৎস্না দেখো!”

“তুমি দেখো।”

স্বরূপ তনয়ার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেলে। তনয়া মাথাটা সরায় না। নিজের মনেই বলে, “একটা পাখি আছে জানো, চাঁদের আলো খায়। সে আজকের জ্যোৎস্না পেট ভরে খেতে পারবে তাই না? আমারও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

“কী?”

“যা কিছু সুন্দর লাগে সব। এই যেমন চাঁদের আলো, সুন্দর ফুল, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা আর..তোমাকে…”

স্বরূপ উঠে বসে চোখ গোল করে বলল, “আমাকে? তা খাও না, কে নিষেধ করেছে?”

সে নিজের মুখটা এগিয়ে দেয়।

তনয়া হেসে দুই হাতে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে, “যাও তোহ!”

স্বরূপ বলে, “চাঁদটা দেখেছ? আজকের চাঁদ সুকান্তের ভাষায় ঝলসানো রুটি। শহরের কত লোক আজ না খেয়ে শুয়েছে গুনে শেষ করা যাবে না হয়তো। ওদের কাছে মনে হচ্ছে চাঁদটা আলো না হয়ে রুটি হয়ে ধরা দিলে বেশি কাজে দিত।”

তনয়া সোজা হয়ে বসে বলল, “ভালো কথা মনে করেছ। আমার ইচ্ছে ওদের জন্য কিছু করার।”

“তুমি আমি কী বা করতে পারব বলো!”

“যতটুকু পারি। এই ধরো পথশিশুদের এক বেলা খাওয়ালাম। কিংবা বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে কিছু কিনে দিলাম।”

স্বরূপ মাথা দুলিয়ে বলল, “আগে আমি প্রায়ই পথশিশুর একটা গ্যাংয়ের সাথে সময় কাটাতাম। বিয়ের পর তোমাকে সময় দিতে গিয়ে ওদের থেকে দূরে সরে গেছি।”

“চলো না কাল যাই।”

স্বরূপ তনয়ার নাক টেনে দিয়ে বলল, “ওক্কে সুইটহার্ট।”

স্বরূপ প্রথমবার তনয়াকে এমন কিছু ডাকল। এর আগে মজা করে সিন্ডারেলা, ভুতু, মাথামোটা ইত্যাদি ডাকলেও এভাবে কখনো ডাকেনি। তনয়া লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল। স্বরূপ বিষয়টা খেয়াল করে তনয়ার আরেকটু কাছ ঘেঁষে এলো। কানে কানে বলল, “চাঁদের আলো আমাকে বলে গেছে, এত সুন্দর সময়টা আজেবাজে কথা বলে নষ্ট না করতে। অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে…”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here