গহন_কুসুম_কুঞ্জে ২৫.

0
64

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৫.

পরের দিন ওরা সকালে বের হয়ে ফিরল বিকেলে। সারাদিন পথে পথে ঘুরেছে৷ সেদিন স্বরূপের দেয়া টাকার সাথে তনয়া নিজের কিছু টাকা মিলিয়ে দান করেছে যাকেই অভাবী পেয়েছে তাকে। দুপুরে একগাদা পথশিশুদের সাথে বসে ফুটপাতে বসে খাবার খেয়েছে৷ বিকেলটা বলা চলে ঘুরে কাটিয়েছে৷ সন্ধ্যায় ফিরে তনয়া খেয়াল করল ওর পা আর চলছে না। ব্যথায় ভারী হয়ে আসছে।

কোনোমতে গোসল করে এসে সে শুয়ে পড়ল। স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “হলো কী?”

“পা ব্যথা।”

স্বরূপ কিছু না বলে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর চা বানিয়ে নিয়ে এলো দুজনার জন্য। তনয়াকে উঠিয়ে বসে চা খেতে খেতে আজকের দিনেরই আলোচনা হলো। চা শেষ হলে স্বরূপ নিজেই সব নিয়ে গেল ধুয়ে রাখতে। তারপর রাতের খাবারের আয়োজনে লেগে গেল। খুব বেশি কিছু না, ভাত, আলুভর্তা আর ডাল।

রান্না শেষে তনয়াকে জোর করে ওঠাল সে৷ ততক্ষণে নামাজের সময় হয়েছে। স্বরূপ বেরিয়ে গেল নামাজ পড়তে। তনয়া ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। স্বরূপ ফিরল হাতে জিলাপি নিয়ে। কে যেন মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছে।

তনয়া ভীষণ আগ্রহ করে খেল দেখে স্বরপ হেসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার জিলাপি পছন্দ?”

“খুব!”

“আচ্ছা এবার খাবে চলো। আজ জলদি শুয়ে পড়ব।”

“ওকে!”

খাওয়া শেষে স্বরূপ এবারও তনয়াকে কিছুই করতে দিল না। নিজেই সব গুছিয়ে রাখল। ওকে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে গেল।

দু’জনেই ক্লান্ত ছিল, বিছানায় মাথা দিতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

স্বরূপের ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। কেন ভাঙল? মনে হলো ক্ষীণ কোনো শব্দ তাকে বিরক্ত করছিল। শব্দটা কিসের? কিছুক্ষণ খেয়াল করে বুঝতে পারল ওটা তনয়ার কাছ থেকে আসছে। ও অস্থিরভাবে পা দুটো বারবার এপাশ ওপাশ করছে। স্বরূপ মৃদু স্বরে ডাকল, “তনয়া…”

জবাব এলো, “হু?”

“পায়ে ব্যথা কমেনি?”

“উহু।”

পায়ে হাত পড়তেই চমকে উঠে সরে যেতে চাইল তনয়া। “আরে! করো কী?”

“তুমি ঘুমাও। আমি একটু টিপে দেই।”

তনয়া স্বরূপকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি ঘুমাও প্লিজ! এটা কী করছো?”

“চুপ, একদম চুপ। শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

স্বরূপের শক্ত হাত তনয়াকে ধরে শুইয়ে দিল। পা টিপে দিতে থাকল। এবার তনয়ার আরামে চোখ বুজে এলো আপনাআপনি।

জানালা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় তনয়ার মুখটা আবছা দেখা যায়। স্বরূপের ভীষণ মায়া হলো ওকে দেখে। সে দুপুর থেকেই অবাক হয়ে আছে। সে নিজে নাহয় গ্রামে বড় হয়েছে, তার অত বাছাবাছি নেই। কিন্তু তনয়া কেমন করে ফুটপাতে বসে বাচ্চাগুলোর সাথে একসাথে খেল! মেয়েটা সারাদিন ছুটোছুটি করেছে। বুঝতে দেয়নি কষ্ট। এখনো ব্যথায় ঘুমাতে পারছিল না, তবুও তাকে ডাকেনি। এত নরম মনের একটা মেয়েকে তার কাছেই আসতে হলো? সে কি ওকে ডিজার্ভ করে? চমৎকার কোনো ছেলের সাথে তনয়ার বিয়ে হতে পারত। যে ওকে ভীষণ ভালোবাসত। ওর মতো করে পাগলামি করত, দিনরাত ভালোবাসি বলত।

চিন্তাটা একবার মাথায় আসতেই স্বরূপের শরীরে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। নিজের চিন্তার জন্য নিজের ওপরেই রাগ লাগছে। অন্য কাউকে তনয়ার পাশে ভাবার ক্ষমতা তার নেই। যত্তসব বাজে চিন্তা! যা হয়েছে ভালো হয়েছে। সে নিজেই ওর বর হিসেবে ভালো। অন্য কেউটা আসছে কোথা থেকে?

তনয়া এবার ক্ষীণ স্বরে বলল, “ব্যথা কমেছে এখন।”

“তুমি ঘুমাওনি।”

“না, তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। আসো প্লিজ!”

স্বরূপ এবার শুতে গেল। মাথার চিন্তাটা যাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করল, “তনয়া, তোমার যদি এমন কারো সাথে বিয়ে হতো যে তোমাকে খুব ভালোবাসত, তাহলে ভালো হতো না?”

তনয়া স্বরূপের গলা জড়িয়ে বলল, “নাহ।”

“কেন?”

“তোমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতেই পারে না।”

“সেকি! আমি তোমাকে ভালোবাসি একথা কখন বললাম?”

“সব বলতে হয় না।”

তনয়া ঘুমিয়ে গেল। স্বরূপ জেগে ভাবতে লাগল, সে ভালোবাসে? কেমন করে? তনয়া যত সহজ ভাবছে তত সহজ না। আজকের বিষয়টাকে বড়জোর বলা যায় empathy.

*

তনয়ার পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে এটা সে জানল পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। সে সংসার নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে পড়াশুনার একটা অংশ ঝুলে আছে ভুলেই গিয়েছিল। এক সকালে তার বান্ধবী ঝুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুই কি পরীক্ষা দিবি না?”

তনয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “পরীক্ষা কবে?”

“সামনের সপ্তাহে।”

“আমাকে কেউ বলল না কেন?”

“কেউ কি আলাদা করে কাউকে বলে? সবাই খোঁজখবর রাখে। ফেসবুক গ্রুপে কবেই রুটিন দিয়েছে। মেসেঞ্জারে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। তুই কিছুই দেখিসনি? এতদিনেও তোর কোনো রেসপন্স না পেয়ে আমি ভাবলাম তুই পরীক্ষা দিবি না। এজন্য ফোন করলাম।”

তনয়া ভারি অবাক হলো। ফেসবুকে সে থাকে না তেমন একটা। আর মেসেঞ্জারে পড়াশোনার গ্রুপে সারাদিন টুংটাং মেসেজের জ্বালায় সে মিউট করে রেখে দিয়েছে। সেজন্য কিছুই জানে না। এটা এখন কাকে বোঝাবে?

তনয়া দুঃখিত গলায় বলল, “আমি দেব পরীক্ষা। তুই একটু বস একদিন আমার সাথে। বুঝিয়ে দে কিছু। পাশ তো করতে হবে।”

“ঝুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আমরা রোজই ক্যাম্পাসে যাই। তুই এলেই সবাইকে পাবি।”

রাতে তনয়াকে অন্যমনষ্ক দেখে স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “ঘটনা কী?”

তনয়া সব খুলে বলতেই স্বরূপ এত বড় একটা হা করল যে তনয়ার মনে হলো যে ওর মুখের ভেতর আস্ত ফুটবল ঢুকিয়ে দেয়া যাবে।

অনেকক্ষণ পর কথা বলল স্বরূপ। “আমি জীবনে এমন মানুষ দেখিনি। যারা পড়াশুনার ধারেকাছেও থাকে না তারাও এত কেয়ারলেস হয় না তনয়া। ভারী স্যাড!”

“স্যরি।”

“আমাকে স্যরি বলছ কেন? নিজেকে বলো।”

“ওকে।”

“পরীক্ষার বইপত্র কিছু আছে?”

“বই পড়ার সময় কোথায়? কাল গিয়ে নোটস জোগাড় করব।”

“তাই করো। কাল থেকে পড়তে বসবে। আর কোনো ফাঁকিবাজি না। ফেল করলে তোমার তো তোমার, আমারও কোনো মানসম্মান থাকবে না।”

তনয়া কাঁচুমাচু মুখে বলল, “এখন একেবারেই পড়তে ইচ্ছা করে না।”

স্বরূপ অদ্ভূতভাবে তার দিকে তাকাল। কিছুই বলল না।

পরদিন তনয়া ইউনিভার্সিটিতে গেল পরীক্ষার নোটস জোগাড় করতে। একেকজনের থেকে একেকটা নোট নিয়ে ফটোকপি করল। ভাগ্যিস পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপের একদিন বাকি ছিল। সেজন্যও অনেকটা সময় বেরিয়ে গেল। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে যখন বাসায় পৌঁছুল তখন সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে।

পৌঁছে দেখল স্বরূপ বাসায়। সাথে আরও কিছু লোক। হচ্ছেটা কী?

শোবার ঘরে ঢুকে ঘটনা বুঝতে পারল। পড়ার টেবিল আনা হয়েছে। সেটা সেট করে দিতেই লোকগুলো এসেছে।

তনয়া বলল, “এর আবার কী দরকার ছিল? খাবার টেবিলে বসেও পড়া যেত। ক’দিন আর পরীক্ষা থাকবে?”

স্বরূপ বলল, “মা বলেছে টেবিল চেয়ার আনতে।”

“অপ্রয়োজনীয় খরচ।”

“কিন্তু মায়ের কথা অন্য।”

“কী কথা?”

“তোমার পড়াশুনা শেষ হলে কী হবে, আরও মানুষ বাসায় আসবে, তাদের পড়াশুনা হবে এখানে।”

“ওহ মিতা তো আসছে।”

“তুমি একটা মাথামোটা।”

“মিতা ছাড়া আর কে এসে পড়াশুনা করবে শুনি?”

“মিতা কি আমাদের বেডরুমে বসে পড়বে?”

“না, তো?”

“ভাবো ভাবো। সবসময় আমরা বর্তমান মানুষদের নিয়ে কেন ভাবব? ভবিষ্যত মানুষদের নিয়েও ভাবতে পারি।”

তনয়া এবারও ঠিকঠাক বুঝতে পারল না। মানুষের আবার বর্তমান ভবিষ্যৎ কী?

*

দুদিনেই তনয়া বুঝতে পারল তার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। সে একটা জ্যান্ত অগ্নিকুণ্ডে বসে আছে। স্বরূপ তাকে রুটিন করে দিয়েছে। কোনদিন কোন সাবজেক্ট কতটুকু পড়বে এসব ঠিক করে দিয়ে সে অফিসে যায়। অফিস থেকে ফিরে পাই পাই করে পড়াশুনার হিসাব নেয়। অফিসে থাকলে আগে বড়জোর একটা কল করত সে। এখন চার পাঁচবার কল করে জিজ্ঞেস করে পড়াশুনার কী খবর৷ এটা বাদে আর একটা শব্দও বলে না।

রান্নাবান্নাও তাকে করতে দেয় না। দূরী খালাকে বলে দিয়েছে, তিনিই রান্না করে দিয়ে যান। তনয়ার মোবাইলের Wellbeing অ্যাপ রোজ চেক করে দেখে সে কতক্ষণ স্ক্রিনটাইম দিয়েছে। মোটকথা, তনয়ার অবস্থা চিঁড়েচ্যাপটা। এদিকে পড়াশোনা মাথায় ঢুকতে চায় না। মন এদিক ওদিক চলে যায়। জানালা দিয়ে যে নারকেল গাছের ডাল দেখা যায় সেটার দিকে ঘন্টা ধরে চেয়ে থাকতেও ভালো লাগে।

স্বরূপ রোজ তাকে বকা দেয়। পড়া না হলে ঘুমাতে যায় মাঝখানে দুটো বালিশ দিয়ে। তনয়ার কান্না পায়। তবু কান্না গিলে রাত জেগে পড়ে। কিছুই করার নেই।

অসম্ভব রকমের পড়াশুনার পর প্রথম পরীক্ষাটা তনয়ার ভালোই হলো। প্রশ্ন যদিও কঠিন হয়েছিল, তবুও তনয়া অনেক কিছুই লিখতে পারল। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে প্রথমেই তার মনে হলো, স্বরূপ এই কড়াকড়িটা না করলে সে নির্ঘাত ফেল করত!

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েই যার কথা ভাবছিল তার দেখা পাওয়া গেল। ভুরু তুলে সে জিজ্ঞেস করল, “কেমন হলো?”

“ভালো।”

“আইসক্রিম খাবে?”

“চলো।”

আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফেরার পথে তনয়ার মনে হলো আবার আগের স্বরূপকে ফেরত পেয়েছে। কিন্তু বাসায় পা দিয়ে ভুল ভাঙল। আবার যে কী সে!

পরীক্ষা চলল একের পর এক। স্বরূপও মাঝেমধ্যে ওর সাথে রাত জানে। বেশি রাত হলে দুধ গরম করে দেয়, নুডলস বানিয়ে আনে। তনয়ার এখন পড়াশোনা অনেকটা অভ্যাস হয়ে এসেছে। একটা পরীক্ষা ভালো হলে পরেরটা আরও ভালো দেবার আগ্রহ চলে আসে।

এভাবে একের পর এক পরীক্ষা চলতে থাকল। এর মধ্যে একটা মজার কান্ড ঘটল।

স্বরূপ বাসায় ফিরল খুব উত্তেজিত হয়ে। তনয়া কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, “জানো, কী হয়েছে?”

তনয়ার মনে হলো ও একটা দশ বছরের শিশুর সাথে কথা বলছে যে তার ভীষণ কাঙ্ক্ষিত খেলনাটি খুঁজে পেয়েছে৷

সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“তুমি রকিবকে চেন? আমার বন্ধু। রূপারও বন্ধু।”

“হ্যাঁ চিনি।”

“ও আমেরিকা সেটেল হয়ে গেছে। দ্রুতই চলে যাবে।”

“তো?”

“ওর গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যাবে। আমি বলেছি আমি নেব।”

“সেকেন্ড হ্যান্ড?”

“হ্যাঁ, নতুন কেনার টাকা জোগাতে কত বছর লাগবে কে জানে! সেকেন্ড হ্যান্ডই চলবে। আর ওর গাড়িটা একদম নতুন। আমি কেনার সময় সাথে ছিলাম। দারুণ পছন্দ হয়েছিল।”

“কিন্তু সেটার জন্যও তো অনেক টাকা লাগবে।”

“অল্প অল্প করে দেব। ওর তাড়া নেই কোনো।”

“বাহ! দারুণ তো!”

স্বরূপ হাতে হাত ঘষে বলল, “দারুণ মানে! ফ্যান্টাস্টিক!”

তনয়া ওর খুশি দেখে হেসে ফেলল। স্বরূপ বলল, “গাড়িটা পেয়ে যাব সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। তোমার পরীক্ষাও শেষ হবে। শেষ পর্যন্ত ভালো পরীক্ষা দিতে পারলে তোমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাব।”

“তুমি ড্রাইভিং পারো?”

“ডিয়ার তনয়া, আমি ড্রাইভিং শিখেছি আরও পাঁচ বছর আগে।”

“তখন তোমার গাড়ি ছিল?”

স্বরূপ হাসল, “নাহ, উবার চালাতাম।”

“ওহ।”

“টাকাপয়সার সমস্যার জন্য না, গাড়ি চালানোর জন্য।”

তনয়া অদ্ভূত চোখে তার দিকে তাকাল। শখ বটে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here