#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৭.
মিলিকে কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া গেল না। তনয়া কৌতুহল চেপে রাখল। কখনো না কখনো তো পাওয়া যাবে তাকে। সে জানালার বাইরে তাকাল। সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মুছে গেছে কখন যেন৷ তারা ফোটেনি আজ। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে।
মা ডাকলেন৷ “তনয়া…চা খেতে এসো…”
তনয়া উঠল। চায়ের সাথে কী করেছে মা? এত ক্ষুধা লাগে তার এখন! চব্বিশ ঘন্টার বারো ঘন্টা বোধহয় সে খাওয়ার কথাই ভাবতে থাকে।
ওদের বাড়িতে সন্ধ্যার চা নাস্তা বরাবর বসার ঘরেই করা হয়৷ টি টেবিল ঘিরে সোফায় বসে কথা বলতে বলতে চা খাওয়া হয়, কখনো টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম চললে সেটা দেখা হয়৷ তবে তনয়ার ওই ঘরোয়া আড্ডাটাই ভালো লাগে। আজ বন্ধের দিন। বাবা বাসায়ই আছেন। বাবা থাকলে আসর জমে যায়। বাবা ভালো গল্প জানেন না, তবে যতটুকুই কথা বলেন, মন ভরে যায়।
তনয়া বসার ঘরে গিয়ে দেখল বাবা বসে আছেন৷ হাতে একটা বই৷ বইয়ের নাম ‘মানসিক শান্তি কেন পাচ্ছেন না?’
তনয়া বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “এটা আজ কিনে এনেছ বুঝি?”
“হুম। বিকেলে হাঁটতে বের হলাম, তখন পেয়ে গেছি সবুজের বইয়ের দোকানে।”
তনয়া কৌতুহলী হয়ে উঠল, “ভালো নতুন বইয়ের কালেকশন এসেছে?”
“কি জানি! খেয়াল করিনি।”
“বাবা, তুমি কি খুব অশান্তিতে আছ?”
“না তো মা।”
“তাহলে এই বইটা পড়ছো কেন?”
বাবা হেসে বললেন, “নামটা ইন্টারেস্টিং লাগল তাই।”
তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বিয়ের সময় বাবা খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ভালো পাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দিচ্ছেন, এবার তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাবা নিশ্চয়ই এটা আশা করেননি। বাবা তাকে ভীষণ সাপোর্ট করেন এটা সত্যি, আবার তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাও কম করেন না৷ মায়ের কাছে সে শুনেছে, বাবা নাকি স্বরূপকে আচ্ছামতো ঝাড়ি দিয়ে এসেছে৷ বাবা তাকে এতটা ভালোবাসে যে সে যেতে চায় না বলে তাকে কখনো স্বরূপের সাথে জোর করে পাঠিয়ে দেয়নি। স্বরূপের সাথে দেখা করার জন্য পর্যন্ত জোর করেননি৷ এরকম সাপোর্ট ক’জন পায়? বেশিরভাগ বাবা মা তো ‘মানিয়ে নে’ বলেই উদ্ধার পেতে চায়। মেয়ের মানসিক অবস্থার কথা ভাবে না। বাবা মা যতই তাকে সাপোর্ট করুক, তারাও ভেতরে ভেতরে চান তার স্বরূপের সাথে মিলমিশ হয়ে যাক৷ সে স্বামীর বাড়িতে ফিরে গিয়ে সুখে সংসার করুক। সম্ভবত স্বরূপ তাদের এতটা বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছে। এখন শুধু তার রাজি হবার পালা। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কি চলে যাওয়া উচিত? গেলে কি সে এই অসহ্য ডিপ্রেসড লাইফ থেকে মুক্তি পাবে? স্বরূপের ওপর বিতৃষ্ণা যে এখনো কাটেনি তার কী হবে?
চায়ে চুমুক দিয়ে বাবা বললেন, “আজকের একটা নিউজ দেখেছ তনয়া?”
“কোনটা? আমি নিউজ দেখি না।”
“না দেখলে কোনটা জিজ্ঞেস করলে কেন? ঠিক নিউজ না, বিজ্ঞাপন। লালটিলায় নতুন একটা রিসোর্ট হয়েছে। ভেতরটা খুবই সুন্দর। পাশে একটা নদী বয়ে গেছে। নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। ছোটো ছোটো কুটিরে থাকার ব্যবস্থা৷ ঘরগুলো মাটির, তবে ভেতরটা আধুনিক। এইসব আরকি। যাবে? চলো সবাই মিলে ঘুরে আসি।”
তনয়ার ইচ্ছে করে না এসব কিছুই। কিন্তু বাবা তার মন ভালো করার জন্য কী না করতে চাইছে। সে আগে হলে যেরকম উৎসাহে লাফিয়ে উঠত, সেরকম উৎসাহে চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, “অবশ্যই যাব।”
“নেক্সর ফ্রাইডে?”
“ওকে ওকে!”
তনয়া ধীরেসুস্থে চা শেষ করে পেয়ালার শেষ কেকের টুকরোটা হাতে নিয়ে কামড় বসাল। এমন সময় ডোরবেল বাজল। মা ইদানীং জামাকাপড় বানানো শিখছেন৷ সপ্তাহে তিনদিন এক মহিলা এসে শিখিয়ে দিয়ে যায়। তারই আসার সময় এটা। মা উঠে দরজা খুলে দিলেন। তনয়া তখন কেকের পুরোটা একেবারে মুখে পুরে দিয়েছে। গেট খোলার পরপর যখন স্বরূপ ভেতরে ঢুকল তখন তার মুখ ফোলা। না পারছে চিবুতে, না পারছে গিলতে।
স্বরূপ ওর চেহারা দেখে হেসে ফেলল।
বাবা বললেন, “আরে স্বরূপ যে, এসো এসো। তনয়ার মা, নতুন করে চা নাস্তা আনো তো।”
মা আগেই রান্নাঘরে গিয়ে দরজি আন্টির জন্য রাখা চা ঢেলে নিয়ে এলেন। পিরিচ গুলো ভর্তি করে দিলেন।
দেখা গেল স্বরূপ ক্ষুধার্ত ছিল। একটু পরেই প্লেটগুলো খালি হতে থাকল। তনয়ার অবশ্য ইচ্ছে করছিল ভাগ বসাতে, নেহায়েতই পার্সোনালিটির প্রশ্ন বলে কিছু করল না। তবে মন চাইল একটু কেক খেতে। উঠে গিয়ে খেয়ে আসবে নাকি? স্বরূপ সব খেয়ে এক পিস কেক আবার রেখে দিল কেন?
বাবা স্বরূপের সাথে টুকটাক কথা বলে কাজের অজুহাত চলে গেলেন৷ মা রান্নার কথা বলে রান্নাঘরে গেলেন। রয়ে গেল স্বরূপ আর তনয়া।
স্বরূপ তার দিকে কেকের টুকরো এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও।”
তনয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল, “থ্যাংস!”
স্বরূপ তার একেবারে সামনে পিরিচটা রেখে দিয়ে বলল, “কেকটা যা মজা! তুমি না খেলে আমিই খেয়ে নেব৷ আজ যা ধকল গেল!”
তনয়ার চাপা দেয়া কৌতুহল আবার মাথাচাড়া দিল। সে না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারল না, “কিসের ধকল?”
“জানতে চাও? লম্বা স্টোরি।”
“ইচ্ছে হলে বলো।”
স্বরূপ মুচকি হাসল। সে দুই তিনদিন ধরে লক্ষ্য করেছে তনয়া তার সকালের অভিসার ধরে ফেলেছে। আঁড়চোখে সেও তার দিকে তাকায়। সে না এলে অপেক্ষা করে বসে থাকে। মাঝেমধ্যে মুচকি হাসে। আজ সে ভেবেই এসেছিল একেবারে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে না।
সে কাহিনীটা বলা শুরু করেছে, এমন সময় মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন৷ বললেন, “তোর খালা মাথা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। কি কান্ড দেখ! হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।”
“বলো কী!”
“হ্যাঁ৷ আমি যাচ্ছি এখন৷ তোর বাবাও যাবে।”
“আমিও যাব।” বলে উঠল তনয়া।
“তোকে ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়েছে না? তুই কোথায় যাবি আবার? তোকে একা রেখে যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস স্বরূপ চলে এসেছে। তোরা থাক, আমরা যাই। রাতে আমি যদি নাও ফিরি, তোর বাবা ফিরে আসবে। স্বরূপ বাবা, তুমি ততক্ষণ থেকো।”
স্বরূপ সবকটা দাঁত বের করে বলল, “মা আপনি যান। আমি থাকতে কোনো চিন্তা নেই।”
মা চলে যেতেই তনয়া স্বরূপের হাতে জোর চিমটি দিয়ে বলল, “আমার খালা অসুস্থ আর তুমি এমন দাঁত কেলিয়ে হাসছ কেন? অসভ্য কোথাকার!”
স্বরূপ মুখ গম্ভীর করে বলল, “স্যরি স্যরি।”
মা বাবা বেরিয়ে গেলে স্বরূপ দরজা আটকে দিয়ে এসে বসল। বলল, “কাহিনীটা বলি এবার? একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর স্টোরি।”
তনয়া গলায় ইচ্ছে করে নিরুৎসাহ ঢেলে বলল, “আচ্ছা।”
স্বরূপ বলতে শুরু করল, “গতকাল রাতে হঠাৎ মিলি ফোন করে বলে বসল কে নাকি তাকে রুমডেটের ইনভাইটেশন দিয়েছে, সে সেখানে যাবে। আমার তো চোখ কপালে! বলে কী মেয়ে! পরে শোনাল আসল কাহিনী…”
স্বরূপ বলতে বলতে খেয়াল করল তনয়া কেকের টুকরোটা মুখে পুরে দিয়েছে। হয়তো নিজের অজান্তেই। মেয়েটা কিছুটা মোটা হয়েছে। পেট বোঝা যায় না এখনো, তবে চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। ভীষণরকম আদুরে লাগছে তাকে। মোটাসোটা টেডি বিয়ারের মতো। ইশ! বাসায় থাকলে সারাদিন একে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা যেত!
তনয়া হা করে কাহিনী গিলছিল। এবার বলল, “আচ্ছা, তাহলে এখন সাফাত ভাইয়া কী করবে?”
“সেটা তার ব্যাপার।”
“আর মিলি আপু?”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ বলেছে আর কিছুই করবে না।”
“সাফাত ভাইয়া যদি তাকে ফিরিয়ে নিতে চায়? ডিভোর্স তো হয়নি।”
“জানি না। খুব সম্ভবত যাবে না। যে একবার চিট করতে পারে সে বারবারই পাবে।”
“হুম।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া।
এমন সময় জানালার পাল্লা জোরে ধাক্কা খেল। ঝড়ো বাতাস বসে গেল ঘরে। স্বরূপ উঠে জানালা লাগিয়ে দিল। “আজ দিনে যা গরম পড়েছিল! বোঝাই যাচ্ছে ঝড় হবে।”
তনয়াও উঠল। স্বরূপ বলল, “আমি করছি, তুমি উঠো না।”
তনয়া পাত্তা দিল না। মা বাবার ঘরের জানালাগুলো আটকে দিয়ে এসে দেখল স্বরূপ তার ঘরের জানালা বন্ধ করছে।
তনয়াকে ঢুকতে দেখে স্বরূপ একটু সংকুচিত হয়ে বলল, “জানালা বন্ধ করতে এসেছিলাম।”
“ঠিক আছে।”
তনয়া বিছানায় বসে পড়ল। স্বরূপও বসল। স্বরূপ এবার যেন অন্যরকম গলায় বলল, “আজ আমার খুব শান্তি লাগছে জানো?”
“কেন?”
“পুরানো কথা তুলব বলে আগেই স্যরি৷ তুমি প্লিজ ট্রমাটাইজ হয়ে যেও না। আমি খুব ইমোশনাল টাইপ ছিলাম একসময়। এখন অন্যরকম হয়ে গেছি যদিও। লোপার সাথে সেই ঘটনার পর বরাবরই ইচ্ছে ছিল ওর ওপর একটা প্রতিশোধ নেবার। কিন্তু বিভিন্ন কারনে পেরে উঠিনি। আজ সাফাতের যেমন চেহারা হয়েছিল, সেটা দেখেই শান্তি পেয়েছি। সাফাত আরও শাস্তি পাবে। প্রতিটা চিটারের সাথে এমন হওয়া উচিত। আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কোনো প্রতিকার করতে পারিনি৷ কিন্তু অন্য কেউ পেরেছে সেটা দেখে ভালো লাগছে। আমার ভেতরে সবসময় একটা চাপা রাগ ছিল, অশান্তি ছিল, সেটা মিটে গেছে। সাফাতকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করেছি ফেরার সময়। ও কিছুই বলেনি। ব্যাপারটা আরও আরামের ছিল। আর এই কথাটা কারো সাথে শেয়ার করারও ভীষণ ইচ্ছে করছিল। তাই চলে এলাম। তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার এসব বলার মতো?”
শেষ কথাটা স্বরূপ এত আন্তরিকভাবে বলল যে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে অশ্রু লুকাতে অন্যদিকে চাইল। স্বরূপ আরও কাছে চলে এলো তার। হাত ধরল। তনয়া মৃদু প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না। ভেঙেচুরে কান্না পাচ্ছে তার।
আকাশ গর্জন করে উঠল। প্রবল ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। লোডশেডিং হওয়ায় অন্ধকারে ডুবে গেল নগরী। আবার যখন বিদ্যুৎ চমকালো, তখন সেই আলোয় দেখা গেল তারা দু’জন খুব কাছাকাছি বসে এখন। দুজনেই কাঁদছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু