গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৩৬.

0
71

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৬.

দ্বিতীয় কলিংবেলটা বাজল কয়েক সেকেন্ড পরেই। রওনক বিরক্ত হয়ে উঠল। দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। বাইরে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে এখানে এই মুহূর্তে সে কষ্মিনকালেও আশা করেনি।

তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফাত জিজ্ঞেস করল, “মিলি এখানে?”

রওনক কথা বলতে পারল না। সরে গেল দরজা থেকে। ভেতরে ঢুকল সাফাত। মিলি সোফায় বসে বাঁকা হেসে তার দিকে তাকাল। সাফাত অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলল, “সমস্যা কী? এখানে কেন আসতে বলেছ?”

“বসো। বলছি।”

“বসবার সময় নেই।”

“আহা বসো, তোমার প্রিয় গার্লফ্রেন্ড, না স্যরি শয্যাসঙ্গীকে মিস করছ নাকি?”

রওনক এগিয়ে এলো, “হচ্ছেটা কী এসব?”

“সেটা আপনি একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”

সাফাত আর রওনক দুজনেই অবাক হয়ে রহস্যময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চাইছে কী? সাফাত খেয়াল করল মিলিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এত সেজেছে কেন? মানুষকে দেখাতে ইচ্ছে করে রূপ?

আবারও বাজল কলিংবেল। রওনক এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। কাঁদতে কাঁদতে রওনকের মুখে চুমু খেতে থাকল। বলল, “ঠিক আছো তুমি বেইবী? ভালো আছো? তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলাম…”

মেয়েটা প্রথমে খেয়াল করেনি ভেতরে আরও মানুষ আছে৷ যখন দেখল তাদের, তখন ঝট করে সরে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে গেল।

সাফাত আর মিলি চেয়ে চেয়ে দেখছিল সাফাতের প্রেমিকা শিখাকে।

সাফাত চিৎকার করে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল ইজ গোইং অন?”

দরজা খোলাই ছিল। এবার স্বরূপ ভেতরে ঢুকে সবার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যালো!”

মিলি হাসল। বলল, “বোস। কাহিনী বলি। তুই তো জানিস হালকা পাতলা। পুরোটা বললে বুঝবি।”

সাফাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “পুরোটা কী?”

মিলি একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “শিখা আর রওনক বিবাহিত৷ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়েটা হয় আরও প্রায় নয় বছর আগে৷ ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন ফার্স্ট ইয়ারে তারা বিয়ে করে।”

সাফাত শিখার দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু শিখা, তুমি..তুমি তো বলেছিলে…”

মিলি বলল, “ও নিজেকে অবিবাহিতা বলেই বরাবর পরিচয় দিয়ে আসছে। বিয়ের কথা এমনকি ওর পরিবারও জানে না। সম্ভবত বিয়ের কয়েক বছর পর তারা একে অপরের ওপর আগ্রহ হারায় এবং বিভিন্ন মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়ায়৷ ওরা নিজেরা এক্ষেত্রে নিজেদের কাছে সৎ ছিল। দু’জনই জানত অপরজন কখন কাকে ডেট করছে।

রওনক বাবার বিজনেসের উত্তরাধিকার হয়েছে। কিন্তু তার ফুর্তিবাজ স্বভাব৷ প্রচুর টাকা সে তার প্রেমিকাদের পেছনে খরচ করে। শিখা বুদ্ধিমতী। সে বুঝতে পারে এভাবে চলতে থাকলে একসময় রওনকের কিছুই থাকবে না৷ এদিকে শিখার লেটেস্ট আবিষ্কার ছিল সাফাত। সাফাত তার পুরানো কলিগ৷ সে বহুদিন অবজার্ভ করার পর বুঝতে পারে সাফতের ধৈর্য আছে, কাজের ডেডিকেশন আছে, সে অনেকদূর যাবে৷ এদিকে তার পৈতৃক সম্পত্তিও কম নয়৷ শিখা তাই ঠিক করল সে রওনককে ছেড়ে দিয়ে সাফাতকে বিয়ে করবে৷

এমনিতে রিলেশনে থাকলেও সে কোনে ছেলের সংসার ভাঙত না৷ কিন্তু সাফাতকে বিয়ে করতে হলে আমাকে পথ থেকে সরাতেই হতো। এজন্য সে খুব ডেস্পারেট হয়ে ওঠে। অল্প সময়েই এদের নোংরামি তুঙ্গে উঠে যায়। সাফাত মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না, কিন্তু একটা ট্রেইনড মেয়ের ক্রমাগত ছলাকলা ইগনোর করার মতো শক্ত মানসিকতাও রাখত না৷ শিখা ওকে ভড়কেছে, আমার বিরুদ্ধে কানপড়া দিয়েছে৷ শেষে আমার বাসায় এসে উঠেছে৷

রওনক আবার এতকিছু জানত না৷ শুধু জানত সাফত শিখার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড। শিখার থেকেই সে আমার কথা জানতে পারে। আমার ছোটো ছোটো ডিটেইলস সম্ভবত সাফাতের থেকে শিখা হয়ে রওনকের কাছে পৌঁছায়। আমাকে তার পছন্দ হয়৷ সে আমার সাথে ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করতে থাকে।”

সাফাত যেন এতকিছু দেখে শুনেও মানবে না। সে তার মনপ্রাণ দিয়ে শিখাকে বিশ্বাস করে বসে আছে। শিখার কাছে গিয়ে সে হাত ধরে বলল, “শিখা, এসব কি সত্যি? কেমন করে হয়? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। সত্যটা তুমি বলো। একজন এসব মিথ্যে কথা বলবে আর তুমি কিছুই বলবে না?”

শিখা চুপ করে রইল। তার বোধহয় কথা সাজিয়ে বলার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে।

মিলি তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করল যেটা রওনকের আলমারি থেকে পাওয়া গেছে। রওনক আর শিখার বিয়ের সার্টিফিকেট। আর অ্যালবামে তাদের বেশকিছু যুগল ছবি।

সাফাতকে দেখিয়ে বলল, “এরপরেও বিশ্বাস না হলে তোমার মরে যাওয়া উচিত৷ এত কম ব্রেইনওয়ালা লোকের সাথে এতদিন থেকেছি ভেবে নিজের ওপর রাগ লাগছে।”

স্বরূপ এবার জিজ্ঞেস করল, “তুই এতকিছু বের করলি কী করে?”

“এরা নিজেরাই এসে ধরা দিয়েছে। আমার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছিল রওনক। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমার এক স্কুলফ্রেন্ড, তুই চিনিস হয়তো রিফাতকে, আইটি সেকশনে চাকরি করে। ওকে বলেছিলাম নাম্বার ট্রেস করে লোকটার পরিচয় বের করে দিতে। তবে রওনক চালাক। সে ইন্টারনেট থেকে নিজের মতো নাম্বার বানিয়ে কল করত যেগুলোর বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। তবে সে ভুল করে একবার নিজের নাম্বার থেকেই কল করে ফেলে। তখনই ধরা খায়৷

ওর কললিস্ট আমাকে দিয়েছিল রিফাত। সেখানে আমও শিখার নাম্বারটা দেখি৷ সাফাতকে রাত বিরাতে কল করা এই নাম্বার আমার পরিচিত। তখন বুঝতে পারি এদের লিংক আছে।

এরপর বাকি গল্পের কিছুটা গোয়েন্দাগিরি করে বের হয়ে গেছে, কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছি।”

স্বরূপ জোরে হাততালি দিল, “প্রাউড অফ ইউ মাই ফ্রেন্ড।”

মিলি হেসে বলল, “তোর প্ল্যানটাও খারাপ ছিল না। দুজনকে টোপ ফেলে এনেছি। রওনককে নিচে পাঠিয়ে কাগজটা জোগাড় করেছি। এসব তো তোরই আইডিয়া ছিল।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে যাওয়া যাক! এদের প্রবলেম এরা সলভ করুক বসে বসে।”

ওরা তিনজনের কেউই কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে রইল যার যার মতো। মিলি আর স্বরূপ বেরিয়ে গেল। যাবার সময় সাফাত খেয়াল করল মিলির জামাটা কালো রঙের। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, প্রিন্সেস ডায়ানার কথা। সেও তার স্বামীর পরকীয়ার কথা জানার পর কালো রঙের ড্রেস পরে পার্টিতে গিয়েছিল যেটা পরিচিত ‘রিভেঞ্জ ড্রেস’ হিসেবে। ডায়ানার স্বামীর কখনো আফসোস হয়েছে কি না জানে না, কিন্তু তার নিজের মনে হলো, সে সবকিছুই হারিয়েছে।

*

তনয়ার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। রাতে এখন জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ইউটিউব দেখে দেখে কিছু পদ্ধতিতে ঘুম আনানোর চেষ্টা করলে ঘুম একসময় চলে আসে। সবচেয়ে কাজ করে সব চিন্তাভাবনা মাথা থেকে দূর করে হাত পা রিলাক্স করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলে। বাচ্চার কথা ভেবে মনটাও সে ভালো রাখার চেষ্টা করে। তবে ঘুম যত রাতেই আসুক না কেন, ভেঙে যায় কাকভোরে।

ইদানিং ঘুম থেকে উঠেই তার প্রচন্ড খিদে লাগে। মনে হয় পেটের ভেতর ড্রাম বাজতে থাকে। ফল বা বিস্কুট খেলে খিদে মোটেও যায় না। মা তাই নামাজ পড়তে উঠে আগে ভাত বসিয়ে দেন৷ আগের দিনের তরকারি গরম করে রাখেন কিংবা ডিম ভেজে দেন৷

খাওয়া শেষে শান্তি লাগে তনয়ার। শরীরে আরাম লাগতে থাকে। সে এরপর এক কাপ চা বা কফি বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। সকালের সতেজতা তাকে দিনের অর্ধেকটা সময় ভালো রাখে।

সমস্যা শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। কেমন যেন অবসাদ গ্রাস করতে থাকে তাকে একটু একটু করে। কিছুই ভালো লাগে না। কিছুই সহ্য হয় না। সে ছটফট করতে থাকে। মায়ের সাথে বসে, বাবার সাথে বসে, ঘরে শুয়ে থাকে, মোবাইল/ টিভি দেখার চেষ্টা করে, সবকিছুই বিরক্ত লাগে। এমনও না যে স্বরূপের কথা তার মনে পড়ে। ওর কথা ভাবলে আরও অসহ্য লাগে। তার কেন যেন মনে হয় দিন দিন ডিপ্রেশন পেয়ে বসছে তাকে। কিন্তু এখন এরকম হলে চলবে? বাচ্চার কথাও তো তাকে ভাবতে হবে।

স্বরূপ যখন রাতে এসে বসে থাকত, প্রথম প্রথম সে দেখা করত। কিন্তু সেই একই কথা, “আমি স্যরি, অনেক ভুল হয়ে গেছে। ফিরে চলো, ফিরে চলো, ফিরে চলো…”

তনয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হতো, “কেন ফিরব? বাচ্চাটা না থাকলে তুমি ফিরতে বলতে? ওর খবর জানার আগে দেখতে এসেছিলে?”

সে অবশ্য কিছু বলত না। চুপচাপ স্বরূপের কথা শুনত। ওর ঘ্যানঘ্যান শুনলে রাতে আর ঘুম আসত না। মাথার মধ্যে একটাই গান বাজতে থাকত, “ফিরে চলো..ফিরে চলো…”

একসময় সে দেখা করা বন্ধ করে দিল। তারপরেও স্বরূপ রোজ আসত। তনয়ার কান্না পেত ওকে দেখলে। শুধু মনে হতো ওর জন্য তার বাচ্চাটার এত কঠিন অবস্থা। যদি সেদিন মিসক্যারেজ হয়ে যেত? কার দোষ হতো?

এরপর স্বরূপ আসা বন্ধ করে দিল। তনয়ার তাতেও অস্বস্তি। সন্ধ্যা থেকে মনে হতো, আজ আসবে। এসে বসে থাকবে। তনয়া কখনো উঁকি দিয়ে দেখে আসত তাকে। ওকে দেখলে আরও কষ্ট হতো, তবুও। কী এক অদ্ভূত পরিস্থিতি! সে বুঝতে পারে না।

একদিন সে সকাল সকাল বসেছে বারান্দায়। হঠাৎ গলির একপাশে পার্ক করা কালো গাড়িটা চোখে পড়ল তার। স্বরূপের গাড়ি এটা! দূর থেকেও চিনতে পারল তনয়া।

এরপর খেয়াল করল মানুষটাকেও৷ দোকানের ঝাঁপি আর বৈদ্যুতিক খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না৷ সে অবশ্য খুব চেষ্টা করেছে নিজেকে লুকোবার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে৷

তখন থেকে তনয়া প্রতিদিনই তাকে আসতে দেখে। ওর কাজকর্ম দেখে তার এত হাসি পায়! ভাবে তনয়া তাকে দেখে না৷ তনয়া ইচ্ছে করেই না দেখার ভান করে থাকে। কিন্তু দেখতে পায় সবই। নিজের বউকে দেখতে কত লুকোছাপা! হাস্যকর!

তনয়ার এই সকালের অভিসার মন্দ লাগে না। রাতে তাকে যতটা অসহ্য লাগে তেমন সকালে লাগে না। বরং ভালোই লাগে।

এখন সন্ধ্যা৷ তার আবারও সেই অস্বস্তি শুরু হয়েছে। এমন লাগে কেন? কেন মনটা এত ভার হয়ে থাকে?

মোবাইল হাতে ফেসবুকে ঢুকল সে। স্বরূপের পোস্ট পড়ল সবার সামনে। সে অনেকদিন কোনো পোস্ট বা ছবি দেয় না৷ আজ দুটোই দিয়েছে। ব্যাপার কী?

পোস্টটা অতি আজব!

“শহর থেকে আপনি সব মশা মেরে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু একটিও যদি মারেন, ধরে নিতে পারেন একজন মানুষকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।”

তনয়া কিছুই বুঝল না। কমেন্ট দেখেও মাথায় কিছু ঢুকল না।

আর যে ছবি পোস্ট করেছে সেটাতে স্বরূপ একা না, ওর সাথে মিলি। হাসিমুখের সেলফি। মিলিকে ভয়াক সুন্দর লাগছে। এই ছবির ক্যাপশনে লেখা, মিশন সাকসেসফুল৷

তনয়ার ভীষণ কৌতুহল হলো। ঘটনাটা কী? স্বরূপকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। সে কি মিলিকে একটা ফোন করবে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here