গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৩৫.

0
65

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৫.

তনয়া পরের দিনে রিলিজ পেয়ে গেল। বাসায় যাবার সময়ও স্বরূপ আরেক দফা বোঝাতে এলো তাকে। তনয়ার বাবাকেও অনেক অনুরোধ করল ওকে যেন তার সাথে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু তনয়া কিংবা তার বাবা কেউই রাজি হলো না৷ স্বরূপ বাসায় ফিরল শূন্য হাতে।

এদিকে ওদের ঝামেলা দেখে স্বরূপের মা মিতাকে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে একই সাথে একটা মেয়েদের হোস্টেল দেখে সেখানে তাকে রেখে গেলেন৷ তার মনে হয়েছে, মিতাকে স্বরূপের কাছে একা একা রেখে যাওয়াটা উচিত হবে না৷ স্বরূপ যদিও বিষয়টা পছন্দ করেনি, কিন্তু মা রাজি হলেন না। ছেলের ওপর বিশ্বাস আছে তার। কিন্তু যুগের ওপর একদম নেই।

মা পাঁচদিন থেকে চলে গেলেন। মা যাওয়ার পরপরই স্বরূপকে একাকীত্ব চেপে ধরল। বাসায় ফিরলেই মনে হয় এটা একটা জ্যান্ত কবরখানা। তনয়াকে দেখতে ইচ্ছে করে, বাচ্চাটা কেমন আছে, কোন পর্যায়ে আছে সব জানতে ইচ্ছে করে। কল্পনায় সে দেখে তনয়া এখানেই আছে। তারা খুনসুটি করছে, বাচ্চার নাম কী হবে, ছেলে হবে নাকি মেয়ে, দেখতে কার মতো হবে এসব নিয়ে ঝগড়া করছে।

এরপর অফিস শেষে তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াল তনয়াদের বাসায় যাওয়া। যাওয়া হয় ঠিকই, তবে তনয়া তার সাথে কথা বলে না। সে একশটা কথা বললে একটা জবাব দেয়। তাও কাঠ কাঠ জবাব। স্বরূপ তাতেও খুশি ছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তনয়া দেখা করাও বন্ধ করে দিল।

স্বরূপ ওদের বাসার ড্রইংরুমে ঘন্টা ধরে বসে থাকে। তনয়া আসে না। তার রুমে যাওয়ার সাহস হয় না স্বরূপের। একবার যেতে চেয়েছিল, তনয়া বেশ অপমান করে বলে দিয়েছে তার বাসায় তার বেডরুমে যেন কেউ পারমিশন ছাড়া না ঢোকে।

স্বরূপ বসে থাকলে তনয়ার মা এসে কথা বলত শুরুর দিকে। এখন তিনিও আর আগ্রহ পান না। স্বরূপ একাই বসে থাকে। তনয়ার বাবা এলে ওর সাথে চা খান, দু’একটা কথা বলেন, তারপর চলে যান নিজের ঘরে।

স্বরূপ একসময় বাসায় ফেরে। ভালো লাগে না কিছুই। মাঝরাতে তনয়াকে এলোমেলো মেসেজ পাঠায়,

“কেমন আছো?”
“তোমার একটা ছবি দেবে?”
“বাবু কেমন?”
“ওকে বলে দিও বাবা দেখতে গিয়েছিল।”
“ও কি বাবার কথা বলে?”
“তুমি কি ওকে বাবার কথা জানিয়েছ?”
“I love you.”
“I miss you.”
“Do you miss me?”
“Don’t you love me?”

তনয়া কখনো দেখে, কখনো না দেখেই রেখে দেয়।

স্বরূপ এক ভোরে গাড়ি নিয়ে তনয়াদের বাসার সামনে উপস্থির হলো। তনয়ার বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। তাকে দেখা হয় না অনেকদিন।

স্বরূপকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। তনয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওর বারান্দায় কিছু গাছ আছে। সেগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে একসময় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনতলার ওপরে থাকা তনয়াকে একটু অস্পষ্ট দেখা গেলেও স্বরূপ প্রাণভরে দেখে নিল। দিনটা এত চমৎকার কাটল তার!

এরপর থেকে সে সকালেই যায়। তনয়াকে দেখা হয় রোজ। তাকে তনয়া দেখে ফেলেনি। দেখলে হয়তো বারান্দায় আসা বন্ধ করে দিত।

*

মিলি আয়নায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। লিপস্টিকের শেড আরেকটু গাঢ় হলে কেমন হয়? বেশ হয়! নিজেকে আরেক ধাপ বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। মিলি একটা কালো রঙের ড্রেস পরেছে৷ বেশ দামী ড্রেস। চোখে নীলচে সবুজ কন্টাক্ট লেন্স পরেছে। তাকে আগুন সুন্দরী লাগছে। আজ সেই লোকটার সাথে দেখা করতে যাবে, যে নিজেকে হিমালয় বলে পরিচয় দিয়েছে। লোকটা সোজা ফ্ল্যাটে ইনভাইট করে বসেছে। মিলির মন উত্তেজনায় কাঁপছে। আজ দারুণ আনন্দ হবে!

নিচে নেমে দেখল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চড়ে বসল সে।

“You’re looking amazing!”

মিলি হাসল। সে জানে, তাকে ঠিক কী কী করলে সুন্দর দেখায়।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে লিফটে চড়ল মিলি। পনেরো তলায় ফ্ল্যাট। লিফট থেকে নেমে ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলের ক্যামেরাতে নিজেকে একবার দেখে নিল সে৷ “হুম পারফেক্ট!”

ডোরবেল চাপল। দরজা খুলে গেল কয়েক সেকেন্ড পর। লোকটাকে প্রথম দেখল মিলি। বেশ সুদর্শন, সুঠামদেহী লোক, স্বীকার করতেই হবে। মিলিকে দেখে সে কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসিমুখে বলল, “Welcome! আজকে আমার ছোট্ট পাখির বাসা ধন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে গর্জিয়াস নারীর পদার্পন হতে যাচ্ছে৷ প্লিজ ভেতরে আসুন।”

মিলি ভেতরে ঢুকল। এয়ার ফ্রেশনারের সতেজ সুবাস ঘরময়। পাখির বাসাটা দেখবার মতো। দামী সোফাসেট, ঘরভর্তি অ্যন্টিক, প্রমাণ সাইজের ঝাড়বাতি। রুচি আছে, তবে এত জাঁকজমক বাহুল্য। লোকটা হাসিমুখে বলল, “বসুন। ড্রিংস চলবে?”

মিলি হাসল, “না। কফি চলবে।”

লোকটা চোখ নাচাল। তারপর রান্নাঘরে চলে গেল। মিলি বসেই রইল। জানালা দিয়ে ব্যস্ত অজস্র দানালকোঠা চোখে পড়ছে। লোকটা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কফি নিয়ে উপস্থিত হলো।

মিলি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আসল নামটা জানতে পারি এবার?”

“রওনক। আমার পুরো নাম রওনক চৌধুরী।”

“নাইস নেইম!”

“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

“সমস্যা নেই। আমার গরম পছন্দ নয়।”

“এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেব?”

“নো থ্যাংস! ইটস পারফেক্ট!”

“বাই দ্য ওয়ে, ড্রেসটা আপনার গায়ে চড়তে পেরে বেশ গর্জিয়াস হয়ে উঠেছে!”

মিলি হেসে কফিতে চুমুক দিল। কিছু বলল না।

কফি শেষ হবার আগেই রওনকের মোবাইল বেজে উঠল। সে বোধহয় কলটা কেটে দিত, আবার শেষ মুহূর্তে কী ভেবে কাটল না। রিসিভ করে কথা বলে একটু বিরক্ত হয়ে মিলিকে বলল, “আপনি কি একটু অপেক্ষা করবেন প্লিজ? আমি নিচ থেকে আসছি। কেউ একজন আর্জেন্টলি দেখা করতে চাইছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

“না না, যান। আমি ঠিক আছি।”

“জাস্ট পাঁচ মিনিটে ব্যাক করছি। এনজয় ইয়োর কফি।”

রওনক বেরিয়ে গেলে দরজা আটকে গিল মিলি। তারপর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার বেডরুমে ঢুকল। ওয়ারড্রব, টেবিলের ড্রয়ের খুঁজে কিছুই পেল না। আলমারির চাবিটা খুঁজতে লাগল। সেটা পাওয়া গেল বেডসাইড টেবিলের ড্রয়েরে একটা কী কেসে।

চাবি দিয়ে দ্রুত হাতে আলমারি খুলল সে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল একটা ক্লু। ঘড়ি দেখল একবার। চার মিনিট হয়ে গেছে। স্বরূপ লোকটাকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে কে জানে!

আলমারির একেবারে শেষের তাকে একটা ফাইল পাওয়া গেল৷ ফাইলটা বের করে খোলার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। বুকটা ধ্বক করে উঠল একবার৷ “নাহ, এখন দরজা খোলা যাবে না৷”

সে ফাইলটা খুলল। পেয়ে গেল যা চেয়েছিল। অতিরিক্ত হিসেবে পাশেই একটা অ্যালবামও পেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল মিলির বুক থেকে। সে বিশাল একটা ব্যাগ এনেছে। সেটাতে ফাইল আর অ্যালবাম এঁটে গেল। তাড়াতাড়ি ঘরটা গুছিয়ে ফেলল সে। কোনোরকমে বেসিন থেকে হাত আর গলায় সামান্য পানি ছিটিয়ে টিস্যু হাতে দরজা খুলতে গেল। খুলেই মুখটা করুণ করে বলল, “স্যরি। ওয়াশরুমে ছিলাম।”

রওনক হাসল। “ইটস ওকে ডিয়ার। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনার কী হলো ভেবে।”

ওরা আবারও সোফায় গিয়ে বসল। লোকটা কীসব হাবিজাবি বকবক করে গেল, মিলির ঠিকঠাক কানে গেল না। সে অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় কলিংবেলের আওয়াজের। পাঁচটা তো বাজে। আসবে তো সে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here