#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩১.
স্বরূপ ক’দিন ধরে অফিসের কাজে গোলমাল করে ফেলছিল। ঠান্ডা মাথায় কিছুই করতে পারছিল না৷ পারার কথাও নয়, বহুদিন সে ঘুমাতে পারে না। মাথা গরম হয়ে থাকে সারাক্ষণ। আজ বস তাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়লেন। স্বরূপ কিছু বলতে চাইলে বললেন, “আপনার অযুহাত শোনার সময় আমার নেই। ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে করুন, না পারলে আমাদের অনেক অপশন আছে।”
স্বরূপ নিজের ডেস্কে ফিরে মাথা চেপে বসে রইল। আধঘন্টা ধরে চেঁচিয়েছে লোকটা। এত কড়া ভাষা! মাথা ধরে যায়। বস বলেই একটা মানুষ অন্য একজনকে এভাবে হেনস্তা করতে পারে? এত সহজ? তার দিকটা একটা বারও ভেবে দেখল না লোকটা? কথাগুলো ভালোভাবেও বলা যেত। নিজের বাসার ফ্রাস্ট্রেশন এখানে এসে ঝাড়ে!
এলোমেলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা অপরাধবোধের বাতাস ধাক্কা দিয়ে গেল তাকে। সে সেদিন তনয়ার সাথে এরচেয়েও খারাপভাবে কথা বলেছিল। আজ তবুও তার অনেকগুলো দোষ আছে। সেদিন তনয়ার আদতে কোনো দোষ ছিল না। মেয়েটা শুধু তাকে কাছে ডাকছিল। আর কিছুই তো নয়। সেও অন্য একটা বিষয়ের রাগ ওর ওপর ঝেড়েছে।
স্বরূপের হঠাৎই যেন চোখ খুলে গেল। এতদিন তার মনে হচ্ছিল ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে, তার জের ধরে তনয়া চলে গেছে। কিন্তু আজই প্রথমবার মনে হলো, ঝগড়াটা একতরফা ছিল, শুধুই তার পক্ষ থেকেই।
সে পুরুষ মানুষ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ সে মেয়েদের তুলনায় অনেক ভালোই পারে। তবুও বসের চেঁচামেচি শুনে অসহ্য লাগছে। তনয়া তো মেয়ে। তার ওপর এত নরম মনের। সে তার নিষ্ঠুর আচরণে নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে?
সে তনয়াকে সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত পছন্দ করে। ওর ছোটো ছোটো কাজ, কথা, ছেলেমানুষী, আহ্লাদ সবটা তার পছন্দ। অথচ এই ক’দিন সে কিসের মধ্যে ছিল যে একটা বিস্বাদের ছায়া তার মনের ভেতরটা দেখতে দিচ্ছিল না?
অপরাধবোধে মাথা নিচু হয়ে আসছিল স্বরূপের। তনয়া কি অনেক কষ্ট পেয়েছে? খুব কেঁদেছে নিশ্চয়ই। বেচারি এত ভালো একটা মেয়ে! না জানি কত অভিমান জমিয়ে বসে আছে!
কিন্তু এটা বুঝতে তার এতটা সময় লেগে গেল কেন?
সেদিন সে প্রচন্ড রেগে ছিল৷ তনয়াকে সে রাগের মাথায় ঠিক কী কী বলেছে নিজেরও মনে নেই। শুধু মনে পড়ছে শেষে তনয়ার চোখভর্তি পানি দেখে সে কান্না নিয়েও কিছু একটা বলেছিল।
স্বরূপের নিজেরই চোখে পানি চলে আসছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে৷ কিন্তু আজ কাজ ফেলে গেলে আগামীকাল নির্ঘাত টার্মিনেশন লেটার হাতে বসে থাকতে হবে।
*
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কৃত্রিম আলোয় বাইরের একচিলতে বাগান দেখছিল তনয়া৷ চমৎকার কিছু মৌসুমি ফুল ফুটে আছে। যে কোনো গাছ দেখলে তার প্রথমে নিজের ছোট্ট বারান্দা-বাগানের কথা মনে পড়ে। কেমন আছে গাছগুলো?
সন্ধ্যের শেষ আলো কখন নিভে গেছে! তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে কান্নার মতো। ওদের পাশাপাশি দেখা গেলেও আসলে ওরা একে অপরের থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। ওদের কি একাকী লাগে না? কত হাজার কোটি বছর ধরে এই এভাবেই নিঃসঙ্গ তারারা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে মাথা কুটে মরছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে…
মানুষও কি তাই নয়? সারাজীবন সে সুখ নামক কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে ঘুরে যায় কিসের আশায়? কতটুকুই বা পায় তার থেকে?
বাবা-মা কোথায় যেন গেছেন ওকে রেখে। তনয়ার মনে হলো তারা ডাক্তারের সাথে কোনো গোপন পরমার্শ করতে গেছেন। সেসব কথা তারা তাকে জানতে দিতে চান না।
ওরা ফিরে তনয়া আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন ডাক্তার?”
বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, “বলেছে তোমার কানে ধরে ঘুম পাড়াতে।”
তনয়া হেসে বলল, “কানে ধরলে ঘুম আসবে?”
“আসবে মানে? ঘুমের বাবা আসবে।”
তনয়া খুব সাবধানে গাড়িতে উঠে বসল। সে তো আর একা না যে ধুপধাপ যা খুশি করে ফেলবে। একটা ছোট্ট মানুষও তার সাথে আছে। যদিও সে এখনো পুরোপুরি মানুষের আকৃতি পায়নি, ৭ সপ্তাহ বয়সের মানুষটি নাকি একটি মুড়ির দানার সমান বড় হয়েছে, তবুও তনয়ার মনে হলো এই খুদে মানুষটি তাকে ভালোবেসে দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে।
সন্দেহটা তনয়ার অনেক আগেই হয়েছিল। তার পরীক্ষার মধ্যে পিরিয়ডের ডেট পড়ায় সে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল লম্বা লম্বা পরীক্ষাগুলো কিভাবে দেবে সেটা ভেবে। কিন্তু পিরিয়ড মিস হলো! এমনটা সচরাচর হয় না। তার ওপর খাওয়াদাওয়ায় অরুচি আর বমি বমি ভাব তো হতোই। স্বরূপকে সে কয়েকবার বলতে চেয়েছে কথাটা। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি৷ এমনকি সে শেষদিনও এটাই বলতে চেয়েছিল। স্বরূপ যদি একবার শুনত, এখন পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া। পরিস্থিতি এখন কেমন? সে বুঝতে পারে না। কতগুলো দিন হয়ে গেল, স্বরূপ একবারও এলো না৷ তার তো ভীষণ ইচ্ছে করে ওকে দেখতে। স্বরূপের কি একবারের জন্যও ইচ্ছে হয় না তাকে দেখার? সম্পর্কটা এতটা ঠুনকো নিশ্চয়ই ছিল না। তবে? সে চলে এসেছে মানে কি স্বরূপ ধরে নিল সে তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে এসেছে? বোধহয় বোঝা মুক্তির আনন্দে সে বেশ আরামে আছে। মা বাবার চোখ এড়িয়ে তনয়া চোখের পানি মুছে ফেলল। মুখটা হাসি হাসি করে বাইরে তাকাল। মা বাবা ভয়ানক দুশ্চিন্তায় আছেন। এতদিন কিছুই বলেননি। আজ না বলে ছাড়বেন না।
তনয়ার জ্বরটা ভালুকের মতো আসছিল যাচ্ছিল ক’দিন ধরে। এই একেবারে নেই, আবার দেখা যেত রাত বিরাতে বিকট রূপে হাজির! বাবা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এলে ধরা পড়ল সে প্রেগন্যান্ট। খবরটা শোনার পর থেকে তনয়া বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে৷ তার ভয়ানক কান্না পাচ্ছে। ভেতর থেকে কষ্টগুলো পাক খেয়ে উঠছে, সে প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে কান্নাকে পরাজিত করে স্বাভাবিক মুখে বসে আছে৷
বাড়ি ফিরে সে নিজের ঘরে চলে গেল। মাকে বলল ঘুমাবে। তাকে যেন বিরক্ত না করে কেউ।
মা একটু পরে ওর জন্য গরম দুধ নিয়ে এসে দেখলে ঘর ভেতর থেকে বন্ধ।
তিনি চিন্তিত হয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, “জামাইকে আসতে বলো। সে আমার ফোন ধরেনি৷ এখন কথা বলা খুব জরুরি। এসব কী হচ্ছে?”
বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, “আগে মেয়ের সাথে কথা হোক, তারপর ওরটা শুনব।”
*
স্বরূপ অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল বাসা তালা দেয়া। পাশের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই বলতে পারল না। নিচে দারোয়ান জানাল সবাই বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে সে জানে না। স্বরূপ ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করল। ফোন সে দুপুরেও কয়েকবার করেছে, বারবারই কেটে দিয়েছে তনয়া৷ এখন আবার করলে রিং বেজে বেজে শেষ হয়ে গেল। কোনো সাড়া এলো না। একসময় স্বরূপের মনে হলো ওরা হয়তো রাতে ফিরবে না। আর অপেক্ষা করে লাভ হবে না। সে ফিরতি পথ ধরল।
বাড়ি ফিরে গোসল করে নামাজ পড়তে গেল স্বরূপ। মসজিদে মিলাদ পড়ানো হয়েছে। সবাইকে জিলাপি দিচ্ছে। জিলাপি দেখে স্বরূপের মনে পড়ল তনয়া খুব পছন্দ করে। কী যে খুশি হয় মসজিদের জিলাপি পেলে! সে দুটো নিল।
ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে একবার কলিংবেল চেপেই তার মনে পড়ল বাসায় কেউ নেই। হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে এতক্ষণ ধরে ভেবেছে বাসায় গিয়ে তনয়াকে পাবে। তাকে জিলাপি খেতে দেবে। আগে পরের কিছুই মনে ছিল না এতক্ষণ। এটা কেমন করে হলো? কেন সে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল তনয়া নেই?
জিলাপি দুটো আর খাওয়া হলো না। সেগুলো একটা পিরিচে করে ফ্রিজে রেখে দিল সে। কাল তনয়াকে নিয়ে আসবে। তখন ও খেতে পারবে।
*
স্বরূপের ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। সে সোফায় বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল মাত্র কয়েক মিনিট আগে। এখন জেগে উঠে মাথা ভোঁতা লাগছে। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। এই সময়ে কে এসেছে? তনয়া?
স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল দরজা খুলতে। সে ধরেই নিয়লছিল তনয়া এসেছে। দরজা খুলে হা হয়ে গেল।
মা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পেছনে মিতা। সাথে একগাদা ব্যাগপত্র। মা ওর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে চেয়ে একগাল হেসে বললেন, “কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, হু?”
স্বরূপ অনিশ্চিতভাবে মাথা ঝাঁকাল। সারপ্রাইজই বটে!
মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন, “তনয়া কোথায়?”
স্বরূপ ঢোক গিলল। মাকে সে এখনো প্রচন্ড ভয় পায়। সে কী করেছে জানলে মা তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। আমতা আমতা করে সে জানাল, “তনয়া তো… ওর বাবার বাড়িতে গেছে.. তোমরা আসবে জানলে যেত না।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু