#সুখ_একটি_প্রজাপতি(৩)
ক্লান্তির ঘুম সব উবে গেছে। টুলুটুলু চোখ এখন সটান। বড় রসগোল্লার মতো করে তাকানো। রাতের নিস্তব্ধতা অভিনবর এক একেকটা ব্যকুল ছোট নিশ্বাসের স্বাক্ষী। বারংবার বুকে থু থু দিচ্ছে ঝিল। চোখে ভরপুর এক আকাশসম অবিশ্বাস। এই মানব সেলফোন নাম্বার পেল কোথায়! তাছাড়া কল, মাঝ রাতে কল করেছে কেন? ঘুমে জড়ানো কণ্ঠ সতেজ করে ঝিল। না না ভয় পেলে চলবে না। সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। করতে হবে তীব্র প্রতিবাদ। তবে অন্তরে যে সয় না সে বানী। সমস্ত কাঠিন্য উড়ে যায় প্রজাপতির মতো ডানা ঝাপটে। শ্বাস ধরে রাখে ঝিল। তেজ মেশানো কণ্ঠটা ধীরে ধীরে নুইয়ে যায়।
“কেন কল করেছেন?”
“আপনার খোঁজ নিতে কল করেছি প্রজাপতি।”
“খোঁজ!”
“হু। আপনার তো অভ্যেস নেই। এই যে অতো সময় ধরে আমার বাহুডোরে ডানা ছাটা পাখির মতো ছটফট করলেন। বৃষ্টির গোল গোল ফোটা ভিজিয়ে দিল গাল। আপনার চিবুকের রক্তিমতা। ঠোঁটের উষ্ণতা। সর্বাঙ্গে কাতরতা। সব মিলিয়ে আপনি অশান্ত হয়ে গেলেন। আপনার খোঁজ তো নিতেই হয় প্রজাপতি।”
ঝিলের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ছেলেটা এমন করে কথা বলে কেন?
“আপনি কি শুরু করেছেন। এগুলো কেমন অসভ্যতা! কোনো কথাতেই লাগাম নেই।”
“এগুলো প্রেমের অসভ্যতা প্রজাপতি।”
কান্না পাচ্ছে ঝিলের। এই লোকটা এত মায়া দিয়ে কথা বলছে কেন? এত খানি আবেগ মিশে আছে কেন এই কণ্ঠে। অভিনব নিশ্চুপ। ঝিল ধরা গলায় বলে,
“দেখুন খুব খারাপ হচ্ছে। আমি বিরক্ত হচ্ছি।”
“কোনটায় বিরক্ত প্রজাপতি? আমার ফোন কলে নাকি আমার কণ্ঠে?”
নিরব হয়ে গেল ঝিল। চোখ দুটো পিট পিট করছে। অভিনব দৃঢ় গলায় ফের শুধালো।
“ঔষধ খেয়েছেন?”
“উহু।”
“জানতাম এমনটাই করবেন। দ্রুত ঔষধ খাবেন প্রজাপতি। আপনি অসুস্থ হলে আমি কিন্তু হুট করে চলে আসব।”
উত্তরের আশা না করে কল কেটে দিয়েছে অভিনব। ঝিলের হাত থেকে শব্দ করে ফোন পড়ে গেল। অথচ বিন্দু মাত্র ব্যকুলতা নেই এই ফোন উঠানোর। ঠায় বসে রইল মেয়েটি। আর বেমালুম ভুলে গেল মেডিসিন নেওয়ার কথা।
ইববান শিকদার ফাইল হাতে ছুটোছুটি করছেন। একটা জমি নিয়ে দারুণ ঝামেলা চলছে। নেহাত ই বাপ দাদার সম্পত্তি! না হলে কিছুতেই এতটা কাঠ খড় পোড়াতেন না তিনি। বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্য ফুল। আদুরে কন্যা এসে কাছে দাড়িয়েছে। ইববান সাহেব আড়চোখে তাকালেন ভাতিজির দিকে।
“কি হয়েছে মামুনি?”
“ইহান ভাইয়া ফোন করেছে।”
কপালে বিষদ ভাজের উদয় হলো। একটা মানুষের এত খানি ধৈর্য্য! তিনি উদাস হলেন। ফুলের থেকে ফোন নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“তুমি যাও ফুল ঝুটি।”
মামার কণ্ঠে অভিনব হাসল। ভদ্রলোক নিজেকে কঠোর দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলে, অভিনব জানে ভেতরটা ঠিক ডাবের সাস এর মতো তুলতুলে।
“কেমন আছ মামা? ”
“ভালো আছি।”
“জিগ্যেস করবে না আমি কেমন আছি?”
বুকে হাত দিয়ে দাবানল শীতল করলেন ইববান সাহেব। অভিনব আদুরে গলায় ফের বলে,
“আমার কি দোষ মামা? আমি তো তখন সবার গুড বয়। না করতাম কি করে?”
“বাড়ি আসবে কবে?”
“আসতে তো চাই। তুমি যদি অনুমতি না দাও তাই আসি না।”
“চলে এসো। তোমার বাড়ি তুমি আসবে বারন করবে কে?”
চোখ টলমল করছে ইববান শিকদারের। ভাগ্নে কে খুব ভালোবাসেন তিনি। কতদিন পিঠে চরিয়ে এই ঘর ঐ ঘর ঘুরেছেন। কল না রেখেই হাঁকডাক ছাড়লেন,
“রাতুল, ঠান্ডা পানি নিয়ে আয় তো।”
ওপাশ থেকে এক বিস্তর হাসল অভিনব। কতটা শান্তি লাগছে ভাষায় বোঝানো যাবে না। আসলেই তো, অভিনব বাবা মায়ের গুড বয়। এখন মামাদের ও গুড বয় হবে।
ভাঙা টেপরেকর্ডার এর মতো বেজে চলেছে মৌনতা। ঝিলের জ্বর এসেছে ভোর রাতে। খুব বেশি না তবে সকলের মাঝে উদয় হওয়া ব্যকুলতা দেখে মনে হয় জ্বর এর মাত্রা ১০৪! বকবকানিতে মুখ থেকে থার্মোমিটার নামিয়ে নেয় ঝিল।
“একটু চুপ থাক মৌন।”
“কেন চুপ থাকব। তখন তো অনেক বার বললাম ঝিলি যাস না রে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। সহ্য হবে না শরীরের। তুই শুনলি না আমার কথা।”
চোখ রাঙালো ঝিল। মৌন কিছুটা চুপ হলো। রোহন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। নুইয়ে যায় ঝিল। নিজেকে বাঁচাতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,
“ইচ্ছে করে ভিজি নি। পড়ে গিয়েছিলাম আর তখনি”
“মিথ্যে বলা লাগবে না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি আমি। চুপচাপ শুয়ে থাক।”
“ভাইয়া আমি আসলেই বুঝতে পারি নি।”
“যা হবার তা হয়ে গেছে। ঔষধ খাবি হা কর।”
নাক কুচকে ঔষধ মুখে নেয় ঝিল। কি বিশ্রি এর স্বাদ! ভেতরটা তিক্ত হয়ে আসে। তবে বারণ করার সাধ্য নেই। ইদানিং ঝিল বড় শান্ত হয়ে গেছে। সবাই কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় না। বলতে গেলে আমূল পরিবর্! এ যেন আকাশ মাটির বন্ধুত্ব।
দুদিনের মাথায় জ্বর বাড়লো দ্বিগুণ। এর মাঝে একটা বারের জন্য ও অভিনব কল করল না। এতে অজান্তেই মনের ভেতর চাঁপা অভিমান জেগেছে মেয়েটির। টিস্যু বক্স খালি করে ফেলল নাকের পানি মুছে। ভয়ে তটস্থ হয়ে রইল কখন না আবার চোখের পানি বেরিয়ে আসে। ভেতরে ভেতরে কান্নার বর্ষণ নেমেছে।
“আমার কথা অমান্য করেছেন প্রজাপতি। এটা কি উচিত হলো?”
“আপনি!”
“হুস কথা না। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।”
“সরুন, সরুন বলছি।”
“চাতক পাখির মতো ছটফট করছেন কেন প্রজাপতি। আপনি তো আমার মনে ঝড় তুলে দিয়েছেন। জানেন না বুকের বা পাশটায় ব্যথা হয়।”
চোখ বুলায় ঝিল। দু ধারে তাকিয়ে ঠিক অভিনবর বুক বরাবর ধাক্কা দিল। একটু দূরত্ব সৃষ্টি হতেই ঝিল উঠে পড়ল। লাইট অন করতে যেতেই বাহু ধরে টেনে ধরল। এই নির্জন রাত্রিতে দু একটা শব্দ কানে এসে বারি খায়। সচকিত হয় ঝিল।
“ভাইয়া, ভাইয়া নাইট ওয়াক করে। এখন কি হবে! আপনি লুকান। প্লিজ লুকান।”
“প্রজাপতি, আপনি ব্যস্ত হবেন না। কিছু হবে না। আপনার শরীরে তাপমাত্রা বেশি। বসুন স্থির হয়ে।”
“আহ আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“চুপ থাকেন ঝিল।”
“কিন্তু ভাইয়া যে”
“আর একটা টু শব্দ হলে আমি কিন্তু সেই কাজ আবার করব। তখন তো অল্পতে ছেড়েছি আজ ছাড়ব না একদম।”
কড়া হুমকি। অথচ ঝিলের খেয়াল হলো না। এদিক সেদিক তাকালো। চোখ দুটো ব্যলকনিতে গিয়ে থেমে গেল। তবে এদিক দিয়েই এসেছেন তিনি। ঝিলের হাত পা ঠান্ডা। মোটে ও চায় না অভিনবর সাথে ধরা পড়তে। ছেলেটাকে দেখলে অবাক হতে হয়। সাথে জমে এক রাশ প্রশ্ন! কে এই অভিনব? কেন নিয়েছে তাঁর পিছু। কোথাও উত্তর মেলে না। অবাক করার মতো হলে ও ঝিল মনে মনে অভিনবর ভালো চায়। ছেলেটার ক্ষতি হোক মোটে ও আশা করে না। রুগ্ন শরীরে ধাক্কালো কয়েক বার। ব্যর্থ প্রচেষ্টায়! এমন সুঠাম শরীরের সাথে ঝিলের পুচকে শরীর পারবে কি করে? অভিনব নিশব্দে হাসল। একটু আলগা করে রইল হাত। ঝিল আবার চেষ্টা করল। উহু পারল না!
“ছুটোছুটি করে লাভ নেই প্রজাপতি। আপনি স্থির করে বসেন।”
“দয়া করে ছাড়েন আমায়।”
“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি ঝিল। আপনি তাকান আমার দিকে।”
সরাসরি চোখ রাখে না ঝিল। তবে আঁধার আলোতে অভিনবর সাদা চোখে বাদামি রঙের মনি দেখে বুকটা ধুকপুক করছে। লাল হয়ে আছে সাদা অংশটি। মনে হয় ঘুম হয় না অনেকদিন।
“প্রজাপতি আপনার ত্বকের তাপমাত্রা আমার সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়।”
শীতল কণ্ঠস্বর। লোকটা নিশ্চিত ভাবে পাগল! ঝিল ব্যর্থ চেষ্টাটা আর করল না। শুধু মুখে বলল।
“কে আপনি? কেন আমার সাথে লেগে আছেন। এগুলো আমার সহ্য হয় না। ছাড়েন বলছি, আমায় এভাবে স্পর্শ করবেন না।”
“আগেই বলেছি ছাড়ব না। আর স্পর্শের ব্যপারটা না হয় তোলা রইল।”
“প্লিজ ছাড়েন।”
“একদম ইমোশনালি আ ঘা ত করবেন না ঝিল। তাহলে আমি বাধ্য হব আপনার ত্বকে নিজের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে।”
প্রশ্ন নিয়ে তাকায় ঝিল। অভিনব স্মিত হাসে। ঝিলের কোমর জড়িয়ে মেঝেতে বসে। অস্বস্তি হয় খুব। নড়ে উঠে ঝিল। অভিনব এবার কোলে মাথা রাখে। বিদ্যুৎ লাগার মতো করে পিছিয়ে যায় মেয়েটি। তবে সেই পুরুষালি বাঁধনেই আটকা পড়ে। ঝিলের দৃষ্টি ব্যকুল। এধার ওধার তাকায় ভয় লুকাতে। কিয়ৎক্ষন অপেক্ষা করে অভিনব বলে,
“শুয়ে পড়েন।”
“আপনি?”
“পাশে আছি।”
“আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যান। না হলে আমি সত্যিই চেঁচামেঁচি করব।”
“মুখে কস্টেপ লাগিয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। করেন না চিৎকার। অভিনব এক চুলও নড়বে না।”
কান্না আসে ওর। ভীষণ বদ লোক এই ছেলেটা! অভিনব ত্রস্ত হাতে ঝিলকে শুয়ে দেয়। হাত দিয়ে মুখের ত্বকে স্পর্শ করে। ঝিল চোখ খিচে রাখে। দম বন্ধ হয়ে আসে। এ কেমন অত্যচার?
খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে ঝিলের। হাত দুটো টান টান করে ক্লান্তি হটায়। হাই তুলে পাশ ফিরতেই মনে পড়ে অভিনবর কথা! দ্রুত বেগে ব্যলকনিতে আসে। যাক তবে চলে গেছে ছেলেটা। কাল রাতের করা অদ্ভুত সব পাগলামি চড়াও হয় মস্তিষ্কে। ত্বকে হাত রেখে বুঝতে পারে জ্বর নেমেছে। ঝিলের পুরোপুরি স্মরণে রয়েছে, ঔষধ খাইয়ে দিয়ে কপালে জল পট্টি দিচ্ছিল অভিনব। চোখ দুটো ছিল অবিন্যস্ত আর বিচলিত। যেন প্রাণ বেরিয়ে আসবে। আর তারপর হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়ে ঝিল। খুব সম্ভবত ভোর রাত্রিতে প্রস্থান করেছে ছেলেটা। কারণ টেবিলে রাখা পট্টি এখনো ভেজা। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। ঝিল বুঝে এটা মৌন। ভাগ্যিস অভিনব থাকাকালীন আসে নি। না হলে কি হতো সেটা আল্লাহ মাবুদ ই ভালো জানেন। দরজা খুলে ঝিল। মৌনের টুলুটুলু চোখ। ভেতরে ঢোকার পথে হাই তুলল বেশ কয়েকবার। হঠাৎ ই খেয়াল হলো পট্টির কথা। আর তখনি প্রশ্ন করে উঠে মৌন।
“কাল রাতে পানি পট্টি দিল কে? আমি তো কত রাত্রি তে গেলাম।”
“আমিই দিয়েছি।”
ঝটপট উত্তর। মৌন কি বুঝল কে জানে তবে প্রশ্ন করে না দ্বিতীয় বার। মুখের কাছে দু আঙুল দিয়ে শব্দ করে হাই তুলে। তারপর ই গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে সটান হয়ে। ঝিল অবাক ই হলো। মেয়েটার কান্ড দেখে কে অসুস্থ এ নিয়ে মনে জাগ্রত হয় জটিল প্রশ্ন!
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
পাঠকমহল :https://facebook.com/groups/2944711092471263/