সুখ_একটি_প্রজাপতি (৪)

0
56

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৪)

টিনেজ বয়সে সাধারণত এমন পাগলামি করে থাকে ছেলেরা। পছন্দের মানুষটির স্কুল, কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা কোচিং টাইমে পিছু নেওয়া টিনেজদের জন্য খুবই কমন ব্যপার। তবে এসব কি ঊনত্রিশ বছর বয়সী অভিনবকে মানায়? হয়ত বা মানায়। না হলে ছেলেটা কেনই বা অপেক্ষা করছে ঝিলের ভার্সিটি গেটে! আজকের আকাশ অত মেঘলা নয়। রৌদ্র উঠেছে। ফালি ফালি রোদ এসে স্পর্শ করছে ত্বক। এতে অভিনবর ত্বকে ইষৎ অস্বস্তি অনুভব হয়। বাংলাদেশে এসে এই সমস্যাটা অনুভব হয়েছে শুরুর দিকেই। ধীরে ধীরে এর প্রভাব কমে যাবে। অভিনবর ত্বক অনেকটাই সংবেদনশীল। অথচ ছেলেটা ঘুরাঘুরি করতে অতিরিক্ত পছন্দ করে। এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ায়। শুরুর দিকে ত্বকে লাল লাল দাগ উঠে যেত। তবে সময়ের সাথে সাথে সবটাই বসে গেছে। মানিয়ে গেছে পরিবেশ। এখন আর অতো সমস্যা হয় না। অনেকক্ষণ ধরেই গেটের কাছে ঘুরঘুর করছে ঝিল। বের হতে পারছে না। অভিনব কে দেখতে পেয়েছে অনেক পূর্বেই। ছেলেটা আবার কেন এসেছে! এভাবে চলা মুশকিল। কি হবে জানা নেই। এমনিতেই ওমন ঘটনার পর পাপাদের সামনে যেতে লজ্জা হয়। মনে পরে সেদিনের কথা। অনেকটা দিক ব্যকুল হয়ে পড়ে ঝিল। মৌন এসে ধাক্কা দেয়। সম্ভিৎ ফিরে মেয়েটির।

“এমন করছিস কেন?”

“কেমন করলাম।”

“তখন থেকে দেখছি হাত কচলেই যাচ্ছিস। আর এই তিন ফুট জায়গাতেই পায়চারি করেই যাচ্ছিস। থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। ব্যপার কি বল তো।”

“কিছুই না। আমি আসলে তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

“আচ্ছা, তাহলে দাঁড়িয়ে কেন? চল যাওয়া যাক।”

আলগোছে হেঁটে আসে ঝিল। কপালে বিন্দু কয়েক ঘাম। নাক জ্বালা করছে। চোখ দুটো বিরস হয়ে আছে। আর একটু এলেই অভিনবর সাথে চোখাচোখি হয়। ওমন সময় ঝিলের এক বন্ধু এলো। কিছু কথা চলে। রুদ্রম জানায় দুদিন বাদে এক ট্যুর অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে। যেতে চাইলে টাকা দিয়ে আজই কনফার্ম করতে হবে। প্ল্যান এক সপ্তাহ পূর্বের। ওরা আসে নি বিধায় জানে না। অনেকটা মন খারাপ নিয়েই মৌনতা বলল “আমাদের বোধহয় আর যাওয়া হচ্ছে না।”

“কেন?”

“কাল বাদে পরশু ট্যুর। একদিনে কি ব্যাগপ্যাক করা পসিবল?”

“কেন পসিবল হবে না। তোকে বলে লাভ নেই। অলস একটা। ঝিল তুই বল, যাচ্ছিস কি না।”

ঝিলের মন এমনিতেই ভালো নেই। একটু ঘুরাঘুরি করলে ফুরফুরে অনুভব হবে। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেলে অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও ভুলে থাকা যাবে অভিনব নামক রহস্যময় মানবকে। এ সুযোগ ছাড়ল না মেয়েটি। কোনো প্রকার না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিল। টাকা দিয়ে কনফার্ম করে নিল দুজনের যাওয়া। মৌনতা অবাকের সপ্তম আকাশে! যে মেয়ে নখ কাটতে গেলেও ভাইদের জিজ্ঞাসা করে সেই মেয়ে ট্যুরের জন্য হ্যাঁ বলে দিচ্ছে বিনা সংকোচে!

“একটা কথা বলবি তুই।”

“বল।”

“ইদানিং তোকে দেখলে আমার ভয় হয়।”

“ওমা ভয় কেন হয়! আমার মাথায় তো শিং গজায় নি।”

“আজকাল সব কিছুতে ফাজলামি করিস তুই।”

হেসে উঠে ঝিল। মৌনতার কাঁধে হাত রেখে বলে “রাগ করিস না বাবু। সিরিয়াস হচ্ছি আমি।”

“তাহলে বল, ট্যুরের জন্য রাজি কেন হলি। আগে তো কত বাহানা করতি।”

“বড় হয়েছি। একটু আধটু সাহস ও বেড়েছে। এই তো, তাছাড়া ট্যুরটা আমার প্রয়োজন। কোলাহল, আর ইট পাথরের দেয়ালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাত্র এক দিনের ট্যুর। প্যাকিং করতে হবে না তেমন কিছুই।”

ঝিল একদম ই খেয়াল করে নি। বিষয়টা খুব ই বিব্রত করল ওকে। গসিপের এক পর্যায়ে অতর্কিতভাবে অভিনবর বুকে গিয়ে ঠেকে মাথাটা। মৌনতার মুখে হাত। মেয়েটি মিটিমিটি হাসে। অভিনবর লম্বা সুঠাম দেহের সামনে পুচকে ঝিল অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে। গুটিয়ে থাকা বিড়াল ছানার মতো লাগে। মেয়েটি কয়েক সেকেন্ডেই সরে দাঁড়ায়। নত করে মাথাটা। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক শ্বাস নেয়।

“স্যরি। আমি আসলে দেখতে পাই নি।”

চটপট চোখ খুলে ঝিল। অভিনবর বলা সহজ স্যরিটাই হজম হলো না।

“আরে আরে। হিরো তো চলে গেল। উফ কি সিন রে দোস্ত।”

মৌনতা আরও কিছু বলল বোধহয়। তবে ঝিল বিস্মিত! এক ঘর লোকের সামনে যে ছেলে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারল। সে ছেলেটি শুধুমাত্র মৌনতার উপস্থিতে এত পরিবর্তন ঘটালো! আগা গোড়া কিছুতেই পার্থক্য হচ্ছে না। অভিনব নামের ছেলেটি ধীরে ধীরে রহস্যের রাজপ্রাসাদ তৈরি করে চলেছে। মস্তিষ্ক বুনে যাচ্ছে রহস্যের জাল। না জানি কি হতে চলেছে সামনের দিন গুলোতে। ভেতরটা দুমড়ে আসে। চোখের পাতাতে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ঝিল।

অনেক রাতে কল করল অভিনব। ঝিল চাইছে না কল রিসিভ করতে। তবে মস্তিষ্ক আর মনের মাঝে সংঘর্ষ ঘটে যায়। সমস্ত দ্বিধা পেরিয়ে ফোন হাতে নেয় মেয়েটি। অভিনবর শীতল কণ্ঠ শোনার জন্য বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হয়। এখন প্রায় দুটো বাজে। এত রাত অবধি ঝিল কি কখনো জেগেছে! তবে আজ কেন জেগে? অনেকক্ষণ ভেবে মেয়েটি স্বীকার করতে বাধ্য হয় অভিনবর কলের অপেক্ষাতেই ছিল হতচ্ছড়া মন! দু চোখের পাতার সাথে ঘুমের আবার ভীষণ আড়ি। মেয়েটি ভাবনার অতলে হারিয়ে কল রিসিভ করতে ভুলে যায়। যখন ধ্যান ফিরে তখন কল কেটে গেছে। সে রাতে আর কল এলো না। ঝিল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারল না নিজ থেকে কল দিতে। অনেকটা অস্বস্তিতেই গত হয় রাত। পরদিন শপিং করতে আসে। কিছু টপস দেখছিল। ঠিক সেই সময়েই হাতে টান পড়ে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস মৌন?”

“দোস্ত, সেই হিরো চলে যাচ্ছে।”

হিরো কথাটা বুঝতে সময় লাগল ঝিলের। অভিনব ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। মৌন ছুটে এসেও পারল না লিফ্ট ধরতে। ঝিল লক্ষ্য করল অনেকটা পালিয়ে বাঁচল অভিনব! মেয়েটির পুরো দিন অসহনীয় যন্ত্রণায় পার হয়। সন্ধ্যায় ফিরে নিজ রুমে আটকে থাকে। পরিশ্রান্ত দেহ। ক্ষণিকেই ঘুমে হারায়।

.

আরফানের স্ত্রীর নাম মুনতাহা। মেয়েটি শিকদার বাড়ির বউ হয়ে এসেছে প্রায় চার টি বছর। স্বভাবে নম্র,ভদ্র। বড়দের সামনে মাথা তুলে কথা অবধি বলে না। এমনকি আরফান যখন রেগে যায় তখন চুপ করে থাকে। মুখের উপর দুটি কথা নেই। এসব দেখেই হয়ত ইববান শিকদার নিজের বড় পুত্র বধু হিসেবে মুনতাহাকে চয়ন করেছেন। অথচ শুরুর দিকে আরফানের ঘোর আপত্তি ছিল! সে চাচ্ছিল না এমন আনস্মার্ট সাদামাটা মেয়েকে বিয়ে করে বন্ধুদের কাছে বিব্রত হতে। অথচ বিব্রত হওয়া তো বহুদূর দিন শেষে প্রত্যেকেই বলেছে মুনতাহার মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। এতে অবশ্য আরফানের ধারণা বদলায় নি। সে সর্বদা চেয়েছে ক্লাসি মেয়ে। যে ওর সমানে সমান। এ দিক থেকে মুনতাহা একেবারেই শূন্য। দেখতে সুন্দরী বিধায় চার বছর ধরে টিকে আছে সংসারটা। নচেৎ বহু আগেই চুকে যেত আগা গোড়ায় ব্যন্ডেজে টিকে থাকা সম্পর্ক। আজকের আয়োজন একটু ভিন্ন। মুনতাহার বাপের বাড়ি থেকে লোক আসবে। লোক বলতে ওর ভাই বোনরা আসবে। এ বাড়িতে ওদের সুনাম বেশ। হয়ত মুনতাহার গুণের কারণেই আদর যত্নের পরিমান একটু বেশি। সকাল সাড়ে ছয়টায় লাল রঙের গাড়িটা এলো। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে মুনতাহা। ভাই বোনদের জড়িয়ে ধরে আবেগপ্লুত হয়ে যায়।

“কেমন আছিস তোরা?”

“খুব ই ভালো আপু। বাট তুই বরাবর ই কেঁদে আমাদের মন খারাপ করে দিস।”

চোখের পলকে চোখ মুছে নেয় মুনতাহা। মাহেরের ভীষণ গরম লাগছিল। তাই বহু পূর্বেই ভেতরে চলে এসেছে। বরফের দেশে থেকে থেকে শরীরে হীম ধরেছে। একটু গরমেই ঘেমে নেয়ে একাকার!

এ বাড়িতে আফরা প্রথম বার এসেছে এমন নয়। তবু ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর। বিষয়টা লক্ষ্য হতেই ধাক্কায় মাহেরা। দাঁত কামড়ে বলে “এমন করছিস কেন?”

“চলকেট বয়ের জন্য। ওর কথা ভাবলেই আমার হৃদয়ে হাওয়া লাগে।”

কথাটা নীচু স্বরে বললেও শুনে ফেলে মুনতাহা। ঠোঁট টিপে হাসে। সরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে “তোর চকলেট বয় এক মাস ধরে বাসায় নেই।”

বৈশাখের কালো মেঘ এসে রাঙিয়ে দেয় আফরার মুখ। মাহেরা খোঁচা মেরে বলে,
“দিলে তো মন ভেঙে। প্রিন্সেস আফরার হৃদয় যে ব্যকুল হয়ে আছে। তার চকলেট বয়ের সাথে স্বাক্ষাৎ করবে বলেই তো এসেছে।”

“মিথ্যে। আমি কারো সাথে দেখা করতে আসি নি।”

ঘোর প্রতিবাদ করে আফরা। হেসে উড়িয়ে দেয় মাহেরা। সোফাতে আরাম করে বসে। ফোন নিয়ে বসে সেল্ফি তুলতে। দু একটা তুলে নানান পোজে। ছবি দেখার সময় লক্ষ্য করে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে নামছে অভিনব। এর আগে ওদের দেখা হয় নি। এক মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে যায়। মন হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। অভিনব কোথাও বের হচ্ছে।
“কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?”

“হ্যাঁ ভাবি। একটু ঘুরে আসি। ঘরে থেকে বোর লাগছিল। নাস্তা বাহিরে করব।”

অভিনব চলে যায়। তবে তার রেশ থেকে যায়। মাহেরার চোখে ভাসে অভিনবর দৃঢ় সুঠাম দেহ। স্লিকি হাল্কা ব্রাউন চুল। কোমল ত্বক। সব মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ছেলেটি মাহেরা নামের চুজি মুডি মেয়েটিকে কাত করে ফেলে!

বাংলাদেশে এসেই বাইক নিয়েছে অভিনব। বিদেশের মাটিতে সাইকেল দারুণ চললেও বাংলাদেশের মাটিতে মলিন লাগে। এখানে সাইকেল চালানোর মতো রাস্তা নেই। সবটাই ভীষণ ব্যস্ত। একমাত্র বাইকটাই মানানসই। দূরন্ত গতিতে ছুটছে বাইক। ভোর রাতে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ অভিনবর একটু বেশিই ভালো লাগে। মনমাতানো গন্ধ ওকে আকুল করে তুলে। সে সময়টায় চারপাশের সবকিছুই হারিয়ে যায় কোথাও একটা। অভিনবর মনে হয় এ পৃথিবীতে এত এত সৌন্দর্য্য রয়েছে তার একাংশ যদি মানুষ অনুভব করতে পারত তবে উপলব্ধি হতো জান্নাতের সৌন্দর্য্য কত ভয়াভয় সুন্দর। কিন্তু আপসোস মহান আল্লাহর সৃষ্টির একাংশ আমরা অনুভব করতে পারি না। বাইক থামালো অভিনব। আর মাত্র কয়েক কদম। এর পরেই শুরু হয়েছে মির্জাপুর। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য্য বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলের সাথে লড়াইয়ের উপযুক্ত। তিন বছর আগে এই অঞ্চলটি অভিনবর নিকট অতি সামান্য ঠেকলেও এ সময়ে দাঁড়িয়ে বড্ড আপন মনে হয়। তরুণ এলো ঠিক দশ মিনিট পর।

“মামা বাড়ির পিঠা খাইতে লাগে মিঠা। বাহ ভাই বা। এতদিনে আমি নামক বন্ধুটি স্মরণে এসেছে।”

“স্মরণে তো সব সময় আছিস। আজ একটু সময় নিয়ে স্মরণ করলাম।”

হেলমেট খুলে ফেলেছে তরুণ। চুল গুলো বড় হওয়ায় হাতের সাহায্যে তা গুছিয়ে নিল। একটু সময় নিয়ে জবাব দেয়।
“বলুন জাহাপানা আপনার জন্য কি করতে পারি।”

“আপাতত ঘুরতে গেলেই হবে।”

“ঘুরতে! এই অসময়ে?”

“অসময় দেখিস কোথায়! এখনি তো সুইট টাইম। দেখ গাছের পাতাতে এখনো পানি। পাখির কলরব। এই যে ভেজা নরম মাটি। চিকন রোদ। এসব ই তো আমাদের মুগ্ধতা।”

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here