সুখ_একটি_প্রজাপতি (৫)

0
50

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৫)

লেট লতিফ মৌনতা! বরাবর ই ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে যায়। সেই জন্যেই ঝিল ওকে ভোর থেকে কল করছিল। অবশ্য মৌনতা জেগেওছিল। তবে কল কেটে বালিশকে আগলে নিতেই এক রাশ ঘুম এসে পিঠে হাত বুলায়। আর তারপর এক ঘন্টা লেট! কথা ছিল ৮ টায় ঝিলের বাসাতে চেক ইন করবে অথচ মৌনতা এখনো বাসা থেকেই বের হতে পারল না! ঝিল লাগাতার কল করে যাচ্ছে। কিন্তু রিসিভ করছে না। সে সাহস নেই ধরে। ব্যাগপত্র নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে কল রিসিভ করল।

“ঝিলি, এই তো এসে গেছি বাবু। জানিস তো প্রচন্ড জ্যাম। উফ কি যে গরম। আর একটু অপেক্ষা কর বাবু।”

ওপাশ থেকে দাঁত কিড়মিড় করে ঝিল। মৌনতা একের পর এক মিথ্যে বলছে। সাথে এমন কিছু সাউন্ড করছে যেন সে সত্যিই ঢাকা শহরের অলিগলিতে ভীষণ জ্যামে আটকে আছে!

“কথা কম বলে দ্রুত নেমে আয়। ভাইয়া অপেক্ষা করছে।”

“ওকে।” বলেই থেমে যায় মৌন। একটু সময় নিয়ে বিষয়টা বুঝে। পরপর ঢোক গিলে।

“হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। আমি জানি তুই লেট করবি। তাই এক ঘন্টা আগেই ভাইয়াকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

বিড়াল পায়ে নামছে মৌনতা। কাঁধে বেশ মোটা ব্যাগপ্যাক। হাতেও আছে একটা। চোখে সানগ্লাস। সেমি লং শার্ট গায়ে। একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ওকে। অথচ রোহন দেখছে না। তাকাবে না কোনোভাবেই। মেয়েটির এই জ্বালাধরা রূপ যৌবন কাবু করতে পারবে না রোহন মির্জাকে। কোনো কালেই পারবে না! এ যেন ধনুক ভাঙা পণ!

“হাবার মতো না দাঁড়িয়ে গাড়িতে বসলে সময় বেঁচে যায়।”

কঠিন আর দৃঢ় কণ্ঠের কোপে পড়ে চটপট উঠে বসে মৌন। ব্যাগপত্র পেছনে রেখে সামনে বসতে যেতেই মাথা ঠুকে যায় গাড়ির দরজাতে। রোহন একবার তাকিয়েছিল বোধহয়। মৌন ভীষণ অস্বস্তিতে। গাড়ি স্টার্ট করার সময় রোহনের মুখে কালো মেঘ। ম‍ৌনতার পেটের ভেতর জমে আছে হাজার খানেক কথা। একটু ও শান্তি পাচ্ছিল না। তার উপর জ্যামে আটকে আছে। এমতাবস্থায় মেয়েটি ভীষণ ঘামতে শুরু করেছে। লুকিং গ্লাসে সেটাই দেখছিল রোহন। এসি অন করল। স্বস্তি লাগে কিছুটা।

“থ্যাংকস।”

এক পলক তাকায় রোহন। তারপর গাড়ি চালনায় মননিবেশ করে। মৌন ভেবেছিল কিছু বলবে তবে ওকে ভুল প্রমান করে ছেলেটা ফিরেও তাকালো না। হতাশ হয় মৌন। বুক চিরে বের হয় তপ্ত শ্বাস। হয়ত একেই বলে হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলা।

ট্রিপে যাচ্ছে পনেরো জন। এদের আবার তিনটে টিম। তবে গাড়িতে যাবে একসাথেই। ঘুরাঘুরি হবে তিন ভাগে। ঝিল,মৌনতা, রুদ্রম, মায়রা, আর নিয়ন এক টিমে। ঝিল আর মৌনতাকে দিতে এসেছে রোহন। আহনাফ বাসায় নেই। কথা হয়েছে। জানিয়েছে আজ বিকেলেই ফিরবে। ঝিল আর ম‍ৌন ব্যাগ পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া গাড়িতে উঠার সাহস পাচ্ছে না। মৌনতা এসবে বিরক্ত। সে বুঝতে পারে না এত ভয়ের কি আছে! রোহন রগচটা এমন নয় তবে ওর ব্যক্তিত্ব বড়ই শান্ত। অনেকটা ঝড় হওয়ার আগের সেই গুমোট মুহূর্ত। রুদ্রম নেমে এলো। ট্যুর নিয়ে আলোচনা করছে। ওদের কথার মাঝে যেতে ইচ্ছে হলো না মৌনতার। আনমনেই হাঁটতে শুরু করেছে। এই যে রোহন, কোনো এক কালে মৌনতার প্রতি ভীষণ আসক্ত ছিল। তখন তো মৌনতা সবে কলেজে উঠেছে। সে সময়ে মেয়েটির তথাকথিত একজন নিজের মানুষ ও ছিল। রোহন যখন ওর আশে পাশে ঘুরঘুর করত তখন বড়ই বিরক্ত লাগত। ফিরিয়ে দিয়েছিল রোহনের উত্তপ্ত হৃদয়ের ভালোবাসাকে। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতে মৌনতার সম্পর্কটা চুকে গেল। পথ চলা হলো না একসাথে। সে সময়টা রোহন কে ভীষণ মনে পড়ত মৌনতার। ছেলেটার গুমোট হওয়া মুখ আর ভালোবাসা ভরা চাহনি। সবটাই অনুভব হতে শুরু করে। কিন্তু ভাগ্য, সে কি চেয়েছিল? সে চেয়েছিল ওদের না হওয়া সম্পর্কটার করুণ বিচ্ছেদ। তাই হয়ত এক প্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রোহন। এসব ভাবলে এখন কষ্ট হয়। ভীষণ যন্ত্রণায় ধরে আসে গলা। এমন নয় মৌনতা মুভ অন করতে পারত না। ওর লাইফে অনেক ভালো ছেলে এসেছে। তবে ততদিনে ওর মন প্রাণ রোহনের প্রতি ঝুঁকে গেছে। প্রেমিকের সাথে বিচ্ছিন্নতার পর ছেলেটার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। তবে রোহন চাইল না। আর সেই জন্যেই মৌনতা আজ একা। ভীষণ একা।

হাতে প্রচন্ড চাপ অনুভব হলো মৌনতার। কয়েক ইঞ্চি পাশ দিয়ে চলে গেল মালভর্তি ট্রাক! রোহনের হাত কাঁপছে। অথচ মৌনতা নির্বাক। কি হয়েছে ওর জানা নেই। ও শুধু তাকিয়ে।

“পাগল হয়েছ? মাথাটা গেছে পুরো! একটু হলেই তো চাপা পড়তে। কি হলো মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না এখন! রা স কেল, এভাবেই টেনশনে ফেলতে ভালো লাগে।”

এই যে এত গুলো কথা শুনালো রোহন অথচ ম‍ৌনতা কোনো কথাই বলল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রোহনের চোখে থাকা ভয় ওকে আনন্দ দিচ্ছে। অনেক দিন পর এ চোখে ফের মায়া অনুভব হয়েছে। ভেতরে অদ্ভুত শীতল সমীরণ অনুভব হয়। ঝিল এসে ধাক্কালো।
“কোন জগতে তুই?”

তাকালো মৌন। একটুখানি হাসার চেষ্টা করল।
“ভাইয়া বলল একটুর জন্য ট্রাকের নিচে পড়িস নি। মন কোথায় থাকে? দেখি ব্যথা পেয়েছিস কতটুকু।”

ঝিলের কথায় মৌনতা প্রায় বিস্মিত হলো! হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ক্ষ ত টা। রোহন যখন টেনে সরিয়েছিল তখনি হাত লাগে গাছের সাথে। কাঁটাযুক্ত গাছে লেগে ছিঁলে যায় হাত। অথচ এসবে ওর ধ্যান ই নেই। ঝিল ক্ষ ত স্থান পরিষ্কার করে মলম লাগালো। মৌনতা ইষৎ ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রোহন। চোখে মুখে বিরক্তি। ঝিল হাসছে। সে লক্ষ্য করল তার ভাইয়ের বিরক্তি ভরা চাহনি আর বির বির। সম্ভবত মৌনতার ফোর্টিন জেনারেশন উদ্ধারে ব্যস্ত! তবে ঝিল জানে এর মাঝেও রয়েছে এক আকাশ সমান ভালোবাসা। অথচ চাপা অভিমানের রোষানলে লুকিয়ে রাখার এক বৃথা চেষ্টা।

মাইক্রোবাসে উঠে বসেছে সবাই। ওদের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড রোড থেকে। এখন বাজে প্রায় সকাল এগারোটা। মৌনতা বসেছে ঝিলের পাশে। তবে ঝিল জানালার পাশের সিটের দখল নিয়েছে বহু পূর্বে। নানান নির্দেশনা দিচ্ছে রোহন। সাধারণত ঝিলকে একা ছাড়া হয় না। তবে বন্ধুমহলের সাথে একদিনের ট্যুর হওয়াতে যেতে দেওয়া হলো। অনেকগুলো কথা বলল রোহন। এর মাঝে একবার ও তাকায় নি মৌনতার দিকে। মৌনতা চাতক পাখির মতো চেয়ে। অন্তত একটি বার রোহন বলুক ‘ভালো ভাবে যেও।’ তবে সে ভাগ্য নেই মেয়েটির। রোহন নেমে গেল চটপট। মৌনতার একটু মন খারাপ। তবে এর রেশ বেশিক্ষণ রইল না। সকলে গান শুর করেছে।
‘কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন,
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন।
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস,
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস।’

গান শেষ হতেই সবাই একসাথে চেচিয়ে উঠে। ট্যুরে কিংবা বন্ধুমহলে এসব গান বেশ জমে। মৌনতার মন ভালো হয়ে এসেছে। সবাই চেচামেচি করছে বিধায় রুদ্রম মাইক হাতে নিল। “এটেনশন এভরিওয়ান,গান বাজনা তো চলবে চলতেই হবে। এখন ফটোগ্রাফি হলে কেমন হয়।”

ফটোসেশনের কথা শুনে সবাই ফের চেচালো। এতে রুদ্রম হেসে উঠে। ঝিলকে টেনে উঠায় মৌন। মেয়েটি জানালার পাশে বসে প্রকৃতির হাওয়া অনুভব করছিল। সায়েবাদ থেকে ফরিদপুর ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ের এর দূরত্ব প্রায় ৭০-৭৫ কিলোমিটার। মোটামুটি দেড় ঘন্টার মতো সময় লাগে। ওদের ফটোসেশন শুরু হয়ে গেছে। একেকজন নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। নিয়ন একটু অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলে। বন্ধুমহলকে একাই মাতিয়ে রাখে। সে রুদ্রমের কোলে উঠে যাচ্ছে প্রায়।

“শালা,বউকে এখনো কোলে তুললাম না। আর তুই কোলে উঠে যাচ্ছিস।”

“এগুলো স্মৃতি থাকবে দোস্ত। একটু ওয়েট কর এই মৌন ছবিটা তোল।”

মৌনতা তৎক্ষণাৎ ছবিটা তুলে ফেলল। ছবিতে রুদ্রমের মুখটা হয়েছে দেখার মতো। ওর আলাভোলা, ভঙ্গিমায় বিরক্তিমাখা ছবি দেখে এক চোট হাসল সবাই। বেশ আমোদে গত হলো সময়। আকাশ কিছুটা মেঘলা। ঝিল হাঁপিয়ে উঠেছে। মেয়েটি এবার আরাম করে বসল স্বীয় সিটে। ইষৎ মেঘে ঢাকা আকাশটা ভীষণভাবে টানছে নিজের কাছে। ঝিলের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রঙ মেশানো হাসি। মেয়েটি চোখ বন্ধ করেছে। মৌনতা ও বসেছে পাশে। সবাই এখন যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে ওরা। গ্রামীণ ছোঁয়ার শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। চারপাশে সবুজে ঘেরা। সবে বর্ষার শুরু। এখনো পানি উঠে নি। তবে কিছুদিনের মাঝেই চারপাশ ভরে যাবে টলটলে পানিতে। সেসব কল্পনা করেই ঝিলের মনে প্রজাপতি উড়তে লাগল। মনের মধ্যে এক ভালোলাগা। বাতাবরণের শিহরণে হারিয়ে যায়। ঝিল তখনো ঘোরে ডুবে। তখনি চেচিয়ে উঠল সবাই। ঝিল লক্ষ্য করল ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে দেখা যাচ্ছে। চারপাশটা এত পরিষ্কার আর উজ্জ্বল যে কয়েক সেকেন্ড থমকে থাকে মেয়েটি। ভাঙা মোড়ের রাস্তা গুলো বাংলার বুকে অনন্য সৃষ্টি। এখানে তাকালে মনে হয় এক টুকরো বিদেশী ছোঁয়া। চারপাশের সজীবতা যেন এর সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে মাওয়া যাওয়ার অনেক গুলো পথ রয়েছে। ওরা ট্যুরের পরিধি বৃদ্ধির জন্যই ফরিদপুর ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে উঠেছে। তাছাড়া ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়ের সব থেকে সুন্দর অংশ ভাঙা মোড়। চার লেনের রাস্তাটি মুগ্ধ করেছে সবাইকে। ঝিলের প্রথম মাওয়া যাত্রা। ভীষণ আকর্ষণ অনুভব হয়। মাইক্রোবাসের টোল ২২০ টাকা। টাকা দেওয়ার পর ই সড়কে উঠতে পারল ওরা। ফের দল বেঁধে গান শুরু হয়েছে। একে একে সবাই গান গাইছে। ঝিল কেবল ইনজয় করছে। মেয়েটির ভালো লাগায় পানি ঢালতে কল করল অভিনব। ধক করে উঠে মেয়েটির হৃদয়। না চাইতেও কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে নিঃশব্দে হাসছে অভিনব।
“গত দিন কল করেছিলাম। অথচ আপনি রিসিভ করেন নি। এটা কি ঠিক হয়েছে প্রজাপতি?”

কি বলবে বুঝতে পারে না ঝিল। প্রজাপতি ডাকটি ওর হৃদয়ের গভীরে আন্দোলন তুলে দিয়েছে। অনুরণন হয়ে দখল নিয়েছে মস্তিষ্কের। অভিনব নামের ছেলেটি ওকে ভীষণ জ্বালায়। অথচ ঝিল জানে এই মানুষটির দেওয়া য ন্ত্র ণা গুলো অদ্ভুত ভাবে ওকে আনন্দ দেয়। ঝিল মনের দিক থেকে একটু নরম হলো। তবে কণ্ঠে দৃঢ়তা।
“আপনি কল করলেই রিসিভ করতে হবে এমন কোনো চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছি বলে মনে পড়ছে না।”

ফট করেই উত্তর করে না অভিনব। একটু সময় নিয়ে কণ্ঠে রসিকতার মিশ্রণ ঘটায়।
“তাহলে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করতে চাচ্ছেন?”

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায় মেয়েটি। খানিকটা তুতলে উঠে। অভিনব ফের বলল
“জানেন প্রজাপতি,আপনাকে জ্বালাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আপনার লাল হওয়া নাক, কোমল ঝিম ধরা ঠোঁটের কাঁপুনি আর দিশাহীন চাহনি। এসব এত কাছে ডাকে আমায়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে।”

ওমন সময় ডেকে উঠে তরুণ। ছেলেটার প্রতি বিরক্ত হলেও স্থির রয় অভিনব। ঝিল এখনো ফোন কানে লাগিয়ে। শেষোক্ত কথাটা শুনতে চাইছে। কেন চাইছে জানে না। তবে মন বলছে ও কথা না শুনতে পেলে তোর ম র ণ হবে। তুই শেষ হয়ে যাবি ঝিল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**ভাঙা এক্সপ্রেস হাইওয়ের ছবি পাবেন কমেন্টে।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here