সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৭)

0
39

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৭)

ঝিলের মেহেদী রাঙা হাতের মাঝে লাভ সেইপটা ফাঁকা। আর্টিস্ট মেয়েটি হাসি মুখে বলল, “ভালোবাসার মানুষের নাম কি আপু?”
ইষৎ চমকে উঠল ঝিল। ভালোবাসার মানুষ তো একজনই। তবে সে নামটি বলবে কি? এত দ্বিধা নিয়ে নামটি আর বলা হলো না। মেয়েটি উঠে এলো। কয়েকটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে। নেট খারাপ বিধায় ছবিটা আপ হচ্ছে না। ভেতরের দিকে আসার পথেই একটি ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে।
“স্যরি,স্যরি। আমি আসলে দেখতে পাই নি মিস”

“ইটস ওকে।”

ছেলেটি খুব দ্রুত সরে গেল। সম্ভবত মিউজিকের লোক। তবে বাংলাদেশী। আয়ুষ বলেছিল বিদেশী ব্যান্ডটা এসেছে বাংলাদেশের এক মিউজিক ব্যান্ডের আমন্ত্রণে। তাদেরই কেউ হবে। ঝিল বেশি সময় নিল না। দ্রুত ঘরে চলে এলো। এবার ছবি আপ হয়েছে। সীম কার্ডটা কাজ করছিল না বিধায় বড্ড মন খারাপ হয়েছিল। আয়ুষের দেওয়া সীম কার্ডটায় আবার নেট প্রবলেম। যন্ত্রণা যখন আসে তখন চার পাশ থেকেই আসে। মেহেদী শুকানো অবধি নিজ ঘরেই অবস্থান করল মেয়েটি। গায়ে সাধারণ এক কুর্তি। বিকেলে আবার হলুদের জন্য সাজতে হবে। এই সময়ে অভিনবর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ছেলেটা যদি দেখতে পেত। ওর ভাবনায় ছেদ ধরিয়ে অভিনবর কলটা এলো।
“প্রজাপতি, আপনি কোথায়?”

“ঘরে বসে আছি।”

“আহা, ঘরে কেন বসে আছেন। নিচে নেমে আসুন দ্রুত।”

“নিচে আসব কেন?”

“আরে আসুন না। এত কথা কেন বলেন।”

মেয়েটি অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। খানিক বাদে নেমে এলো। অভিনব নিচে কেন আসতে বলল? সে কি এসেছে? তবে কোথায় আছে! কেউ দেখে নি তো? যদি দেখে তাহলে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হবে। চারপাশে চোখ বুলিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ঝিল এবার আশাহত হলো। চার পাশে এত এত মানুষ!

“কাম উইথ মি।”

একটা লম্বা করে বিদেশী ছেলে। ঝিল বুঝতে পারছে না কিছুই। ছেলেটা জানালো অভিনব এসেছে। গেস্ট হাউজের দিকে। মেয়েটি এক সেকেন্ড সময় নিল না। ছুটে গেল প্রায়। ছেলেটা এবার বলল, “বি নর্মাল।”

থামল মেয়েটি। ছেলেটির সাথে ধীরে স্বস্তে হেঁটে এলো। অভিনবর পিঠের দিকটা দেখতে পেয়ে ঝিলের হৃদয়ের বিট গুলো থেমে এলো। অভিনব হাসছে। লুক কিছুটা চেঞ্জ করেছে। মাথায় ক্যাপ চোখে সানগ্লাস মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। খুব কাছ থেকে না দেখলে চেনা মুশকিল।
“প্রজাপতি, দূরত্ব বজায় রাখবেন প্লিজ।”

শুরুতে কথাটা বুঝতে পারল না ঝিল। তবে অভিনব বাঁধা দেওয়াতে থেমে গেল। আর কাছে এলো না।
“চারপাশে এত সিকিউরিটি যে আমি চাইলেই আপনাকে কাছে নিতে পারছি না। কি ভাগ্য বলুন তো!”

“ওসব রাখেন। আপনি এত কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? কেউ দেখে নিলে সর্বনাশ হবে। আমি চাই না আপনি ঝামেলায় পড়েন।”

“এভাবে কেন বলছেন ঝিল? আমার সব সুখ দুঃখ তো আপনার জন্য। আপনি ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। কবে এতটা কাছাকাছি হলাম বলেন তো।”

“ছেলে মানুষি করবেন না প্লিজ।”

“সব অনুভূতি কি ছেলে মানুষি?”

“আমার জানা নেই। তবে সব সম্পর্ক গুলো নেহাতি বোকামির। আগা গোড়া জুড়ে দিয়ে সম্পর্ক গড়া যায় তবে সেটা পূর্ণতা পায় না।”

নীরবতায় যেন হু হু করে উঠে। ঝিলের চোখের কোণে জল। অভিনব কিছুটা কাছিয়ে এলো। আদুরে হাতের স্পর্শ করে বলল, “সব অভিযোগ আমি মাথা পেতে নিব। শুধু সময় দিন। আপনার ডায়েরির শেষ অংশটা আমি পড়েছি।”

ওদের আর কথা হলো না। দমকা হাওয়ার মতো দুজনকেই সরে যেতে হলো। ঝিল শেষ বারের মতো তাকালো। জীবনে এই ছোট ছোট বিচ্ছেদ গুলো সত্যিই ভয়ানক হয়।

হলুদের শাড়ি গুলো চোখ ধাধানো সুন্দর। এত বাহারি কালেকশন যে কোনটা রেখে কোনটা নিবে বুঝে আসছে না। রজনী এসে সাহায্য করল। সব থেকে সুন্দর শাড়িটা দিয়ে দিল ওকে। ঝিল অবাক হয়ে বলল, “এটা তো সবাই তোমার জন্য চুজ করেছিল।”

“তো কি হয়েছে?”

“আমি এটা নিব না। অন্যটা চুজ করে দাও।”

“বোকার মতো কথা বলছো কেন? শাড়ি দিয়ে কি হবে? দোয়া করো যাতে আমি সুখী হতে পারি।”

রজনী চলে যাবার পর ঘরে প্রবেশ করল আয়ুষ। ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ত। ছোট বোনের বিয়ে বলে কথা।
“পার্লার যাবি?”

“না ভাইয়া।”

“আচ্ছা তাহলে আমি ওদের কেই নিয়ে যেতে বলি।”

আয়ুষ চলে যেতেই অভিনব কল করলো। বলল পার্লারে যাওয়ার কথা। বাড়ির ভেতরে থেকে সরাসরি কথা বলা যাচ্ছে না। ঝিল তখুনি ছুটে গেল। হাঁপিয়ে উঠেছে।
“আয়ুষ ভাইয়া আমিও যাব।”

“তখন না করলি কেন?”

“না মানে পরে ভেবে দেখলাম রজনী আপু ও তো যাবে। বোর হতে হবে না।”

“ঠিক আছে। আমি বলে দিচ্ছি। তৈরি হয়ে নে।”

বিকেল হয়েছে সবে। কয়েক কিলোমিটার দূরে নামকরা পার্লার রয়েছে। অভিনব অনেক আগেই পৌছে গেছে। কিছু সময় পর ঝিলদের গাড়ি থামল। সবাই ভেতরে চলে এসেছে। গাড়িতে ব্যাগ ফেলে আসার ছুঁতোতে রয়ে গেল ঝিল। অভিনব এবার কাছে এলো।
“আধ ঘন্টা সময় হবে না?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আসুন।”

ওরা একটু দূরে চলে এলো। নদীর পাড় ঘেঁষে রয়েছে সারি সারি গাছ। কিছু দূর পর পর আবার বেঞ্চ করা। সেখানেই বসেছে। দুজনের নিশ্বাস গুলো চারপাশের সৌন্দর্য্যের সাথে মিশে গেছে। সময়টা সুন্দর।
“একটা সত্যি কথা বলবেন ঝিল?”

“হু।”

“আমাকে আপনার সত্যিই মনে নেই?”

“হঠাৎ এ প্রশ্ন!”

“জানা জরুরি। আপনার ডায়েরি অন্য কথা বলে।”

মেয়েটি নিশ্বাস ফেলল। অভিনবর হাতটা খুব নিকটে। হাল্কা স্পর্শ করে বলল, “মনে আছে। সব মনে আছে আমার।”

“তাহলে, চুপ কেন ছিলেন প্রজাপতি?”

“চুপ না থেকে কোনো উপায় ছিল কি? একটা কথা বলেন তো অভিনব, বারো তেরো বছর বয়সী এক কিশোরীকে যখন ব্যবহার করা হয় শুধু মাত্র পারিবারিক রোষ মুক্ত করার জন্য তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয়।”

“আপনি শুধু নিজের বিষয়টাই দেখলেন? আর আমি, আমি কি সেক্রিফাইজ করি নি।”

ঝিল কথা বলল না। অভিনব এগিয়ে এসে মেয়েটির গালে স্পর্শ করল, “শুরুতেই কি আমাকে চিনেন নি আপনি?”

“এটা সত্য যে আমি আপনাকে শুরুতেই চিনতে পারি নি। কিন্তু মুখের আদলের পরিবর্তন হলেও মানুষটা তো একই রয়েছে। পুরনো ছবিটা দেখে চিনেছিলাম।”

“তাহলে দূরে কেন যেতে চাইতেন?”

“গত ছয় বছর পরিবার ছাড়া আমার পাশে কেউ ছিল না। এখন প্লিজ এটা বলবেন না আমার মায়েদের মৃ ত্যু র খবর আপনারা জানতেন না।”

ঝিলের চোখে পানি এসে গেছে। আঙুলের অগ্রভাগে মুছে নিয়ে বলল, “চেয়েছিলাম দূরে সরে যেতে। কিন্তু চাইলেই তো দূরে যাওয়া যায় না। আপনি যে আমার ভাগ্য।”

পুনরায় কথা বলার মতো শক্তি পেল না অভিনব। ঝিল আর ওর মাঝে এখন তৈরি হয়েছে লম্বা এক অভিমানের পথ। ছেলেটার শরীর কাঁপছে। ছয় বছর পূর্বের ঘটনা গুলো কেবল চোখে ভাসছে।

নিউইয়র্ক শহরে বেড়ে উঠা অভিনব এখন বাইশ বছরের যুবক। এই বয়সের ছেলেরা সাধারণত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে। অথচ অভিনব প্রেম নামক শব্দটি এড়িয়ে চলে। দেশ বিদেশ ভ্রমণ করা ওর বিশেষ শখ। প্রতিবছর দেশের বাহিরে ট্যুর থাকে। এবার ও আছে। পেরুতে অবস্থিত বিখ্যাত জঙ্গল আমাজনে। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ওমন সময় অভিনবর মা ইহরিমা সরকার জানালেন বাংলাদেশে যাওয়ার কথা। দেশটি সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা আছে ওর। মায়ের দেশ বলে কথা। অবশ্য ওর পূর্ব পুরুষরাও বাংলাদেশী। অনেকটা উত্তেজিত হয়েই ট্যুর ক্যানসেল করে ছেলেটা। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসে। ততদিনে মা বাবার সাথে মামাদের অভিমানের পার্ট চুকে গেছে। বেশ সাদরে গ্রহণ করা হয় ওদের। সপ্তাহ খানেক পরই বদলে যায় চিত্র। মা বাবা হঠাৎ করেই বললেন বিয়ে করার কথা। তা ও নিজের চেয়ে দশ বছরের ছোট এক মেয়েকে। অভিনব বুঝতে পারছিল মামাদের সাথে মা বাবার স্নায়ু যুদ্ধের কথা। মির্জাদের সাথে ঝগড়ার সম্পর্কটা শেষ করার জন্য এই পদক্ষেপ। অভিনবর প্রতি বিশেষ স্নেহ রয়েছে ওর মামাদের। তার বউ যদি হয়‍ মির্জা বংশের মেয়ে তবে এই রোষানলের সম্পর্কটা ফুলের মতো সুন্দর হয়ে উঠবে। এই ধারণা থেকেই সেদিন অভিনব আর ঝিলের বিয়ের আয়োজন হয়। এসবে মত ছিল না মির্জা বাড়ির ছেলেদের। আর না মত ছিল অভিনবর মামাদের। দু পক্ষের কথা ছিল এমন, সবাই মিলে বিয়ের পস্তাব নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কেউ আগে যেতে চাইলো না। একটা অহংকার বোধ সম্পর্কটা হতে দিল না। এর মাঝে অনড় ছিলেন অভিনবর বাবা মা আর ঝিলের মা চাচিরা। ওনারা চাইছিলেন সব ঠিক ঠাক হোক। বাবা মায়ের মন রক্ষার্থে অভিনব সেদিন গিয়েছিল একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। অচেনা সেই বাচ্চা মেয়েটি সেদিন কেন এসেছিল তা জানে না অভিনব। প্রশ্নটা করতেই মৃদু হাসল ঝিল। বসা থেকে উঠে এসেছে সে।
“আপনার কি মনে হয় বারো তেরো বছর বয়সী একটি মেয়ে বিয়ের জন্য নাচতে নাচতে চলে আসবে?”

“সত্যিই আমার জানা নেই। আপনার কাছে অপশন ছিল ঝিল। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার বাবা মা দুজনেই চেয়েছিলেন বিয়েটা হোক। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো তেমনটা নয়। তাহলে কেন এসেছিলেন?”

“বাধ্য ছিলাম। দিনকে দিন চোখের সামনে পরিবারের অশান্তি দেখতে কার ভালো লাগে বলতে পারেন? দুটো পরিবারের মাঝে সর্বদা ঝামেলা লেগেই থাকে। পাপারা রাতে বাড়ি ফিরে না। ভাইয়েরা ও তাই। প্রায়শই র ক্তা ক্ত হতে দেখেছি। মা বলেছিল এটাই নাকি পথ।”

বাক্যটি শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঝিল। অভিনবর মাথা নিচু করা। ঝিল হেসে বলল, “কিন্তু একটা সত্য কি জানেন আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম আমি। আর এর থেকেও সুন্দর বিষয় ছিলেন আপনি। এক পলক দেখেছিলাম আপনাকে। মনে হয়েছিল সময়টা ভুল হলেও আমি ঠকি নি। বয়সটা তখন ভালো লাগার। আপনাকে সত্যিই আমার চোখে লেগেছিল।”

**পর্বটা মাথার উপর দিয়ে যেতে পারে। পরর্বতী পর্ব এলে ক্লিয়ার হবেন।**

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here