#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৮)
ট্যুর থেকে ফেরা হয়েছে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে অভিনব কল করল না। ঝিল নিজেও বসে নেই কলের অপেক্ষায়। সেই ছেলেটির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। এমন সবই নিজেকে বুঝিয়েছে মেয়েটি। তবে সব কিছু ঠেলে ঠিকই চেয়ে রইল ফোনের পানে। বেলা বাজে দুইটা। এ সময় ওদের বাসায় লাঞ্চ হয়। সকলে একসাথে। ঝিল উঠে এলো। গত কয়েকদিন হেলায় দিন পার করেছে। এভাবে চললে পাপা আর ভাইদের মনে সন্দেহ হবে। ঠিকই খুঁজে বের করবে এর পেছনের কারণ। আর তারপর,তারপর কি হবে ঝিল জানে না। ভাবতেও চায় না। ওর মন বলে সব ঠিক থাকুক। ডাইনিং এ আগে থেকেই বসা ছিলেন ইকবাল মির্জা। মেয়েকে দেখে কাছে ডাকেলন। “এসো মামুনি, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“ভাইয়ারা কোথায় বড় পাপা?”
“আসবে,তুমি বসো আগে। কথা আছে।”
ঝিল বসতেই নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন ইকবাল মির্জা।
“ট্যুর কেমন হলো?”
“ভালো বড় পাপা।”
ঝিল খাবার মুখে তুলল। আজকাল ওর সব খানেই অস্বস্তি। একটা ঘটনা কতটা বদল ঘটিয়েছে। ইকবাল মির্জা উঠে এলেন। মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি। সত্যি বলতে ঝিলের সাথে বেশি কথা হয় না। খুবই অল্প সময়ের আলাপ। এত ব্যস্ততা জীবনে না থাকলেও পারত। তাহলে হয়ত মেয়েটিকে আরেকটু ভালো রাখতে পারতেন।
অভিনব গত রাত্রিতে খুব ব্যস্ত আর ক্লান্ত থাকায় আলাপ করতে পারে নি মাহেরা। সকাল হতে না হতেই উঁকি ঝুকি শুরু। অভিনবর অভ্যাস সকালে গোসল করা। ছেলেটা সবে গোসল করে এসেছে। বলিষ্ঠ বুকে জমে আছে পানি কনা। পেশিবহুল ফর্সা হাত দেখলেই লোভ জাগে। ভদ্রতা জানে মাহেরা। তাই শুরুতেই নক করল।
“আসব?”
মেয়েটিকে একবার কি দুবার দেখেছে অভিনব। আরফান ভাইয়ের শালিকা। তবে পরিচয় নেই। অনুমতি পেয়ে প্রবেশ করে মাহেরা। ততক্ষণে টি শার্ট পড়ে নিয়েছে অভিনব। ছেলেটির সৌন্দর্য্য নিয়ে বরাবরই ভীষণ আগ্রহ। তবে সেটার বহিঃপ্রকাশ করল না। অতি সাধারণ ভাবে পরিচয় দিল।
“হায় আমি মাহেরা, মুনতাহা আপুর ছোট বোন।”
“হ্যালো। গত দিন আপনাকে দেখেছিলাম। ভীষণ পরিশ্রান্ত থাকায় কথা হয় নি।”
“উম ব্যাপার না। এক বাড়িতে আছি যখন তখন কথা হবেই।”
“তা অবশ্য ঠিক। আপনি বসেন প্লিজ।”
“থ্যাংকস। আচ্ছা অভিনব, মোস্ট প্রবাবলি আপনি আমেরিকায় স্ট্যাবল। এম আই রাইট?”
“হ্যাঁ।”
চমৎকার হাসল অভিনব। মাহেরা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে। এ চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না ছেলেটার। তবু ভদ্রতার খাতিরে কথা আগায়। মাহেরার ব্যবহার চমৎকার। দেখতেও দারুণ সুন্দরী। কিন্তু অভিনব, সে কি চাইবে এই মেয়েটির হাত?
আজও মৌনতা লেট! ওকে ফেলেই শপিং এ চলে গেছে সবাই। মেয়েটি বোকা নয় তবে কাজে ধীর। বিশেষ করে ঘুমের জন্য। এই ঘুম ই ওকে এক ধাপ পিছিয়ে নিয়েছে। চলতে চলতে আচানাক জুতো ছিঁড়ে গেল। ইচ্ছে করছে এখানে বসেই কান্না জুড়ে দিতে। কিন্তু সময় নেই। একি বিপদ। কান্নার জন্যও সময়ের প্রয়োজন! জুতো হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। উঁহু নেই কোনো কাকপক্ষীও। এমন হলে চলে নাকি!
অসময়ে বন্ধু হয়ে এলো তরুণ। ছেলেটা এ পথেই যাচ্ছিল। ওকে দেখেই গাড়ি থামিয়েছে। হাতে জুতো দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে। এসবে মৌনতার ভ্রু বেঁকে বসে। একটা বিরক্তি নামে। ঝিল ঠিক ই বলে অভিনব আর তরুণ দুই বন্ধু এক ধাঁচের ই প্রানী। অদ্ভুত আর আস্ত
শ য় তা ন!
“লজ্জা করে না বিপদে পড়া এক মেয়েকে দেখে এভাবে হাসতে?”
মেয়েটিকে পাত্তাই দিল না। বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। এসবে ভীষণ রাগ হয় মেয়েটির। কোনো কিছু না ভেবেই হাতে থাকা হ্যান্ড পার্স দিয়ে আঘাত করে বসে। তরুণ প্রায় হতভম্ব! ঝিল যদি হয় লঙ্কা তবে মৌনতা সেই লঙ্কার ঝাল।
“কোথায় যাবে?”
“যাব না কোথাও।”
“ওমা, তাহলে বের হয়েছ কেন?”
“জানি না।”
“আচ্ছা, স্যরি। তোমরা দুই বান্ধবী এক একজন অষ্টম আশ্চর্য।”
মৌনতা প্রায় হুংকার তুলে বলল “কি?”
“রিলাক্স, এত হাইপার কেন হও? কোথায় যাবে বল নামিয়ে দিব।”
মেয়েটি ইষৎ অস্বস্তি বোধ করছে। তরুণ চাঁপা হাসল। ভরসা দিয়ে বলল “আমি খারাপ নই।”
সামান্য লজ্জায় পড়ে মৌন। এদিকে লেট হয়ে গেছে। রিক্সার দেখা নেই। মিলবে ও না বোধহয়। নিশ্চয়ই ওরা শপিং শেষ করে ফেলবে। আর কথা বাড়ায় না মেয়েটি। নীরব কৃতজ্ঞতায় উঠে বসে গাড়িতে। মাথা হেলায় সিটে। তরুণ হাসে। দুই বান্ধবীই ভীষণ অদ্ভুত!
রোহনের চোখ লাল হয়ে আছে। ঝিল প্রায় ছুটে এসে বলল “কি হয়েছে, মৌন কোথায়? আনো নি?”
কথা নেই রোহনের মাঝে। ঝিল বুঝতে পারছে না কিছুই। হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি এসে থামল। তরুণকে ধন্যবাদ জানিয়ে এপথেই আসছে মৌন। ঝিল বুঝতে পারল কারণটা। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একরাশ ব্যথা অনুভব হয়। মৌনতা আর রোহনের সম্পর্কটা সম ধর্মী চার্জের মতো। এরা সর্বদা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
.
ঝিলের দ্বারা একটি ভুল হয়েছে। অভিনব এতদিনে কল করেনি একটিবার। মনের ভেতর উসখুস লাগছিল। নাম্বারটা বার বার রিপিট করছিল। আর তখনি হাত লেগে চলে যায় কল। মেয়েটি আঁতকে উঠে। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আর তারপর, ফোন অফ করে বসে থাকে। এই ভয়ের জন্য প্রায় তিন ঘন্টা ফোন অফ করেছিল। একটু আগেই আহনাফ কল করে ফোন বন্ধ পায়। খবর পাঠায় ফোন অন করার জন্য। কিন্তু ভয়ের চোটে ফোন অন করতে পারছে না। মাথায় একটা যন্ত্রণা চেপে বসেছে। একটি ছেলে ওর জীবনটাই বদলে দিল। ভয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফোন অন করে ঝিল। আহনাফকে কল করলে আহনাফ জানায় ফিরতে লেট হবে। খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে। অন্যদিন এমন হলে ওর মন খারাপ হতো। ভাইয়ের সাথে অভিমান করত। আজ তেমন কিছুই হলো না। বরং চাঁপা আনন্দের উদয় হলো। কল রেখে চাতক পাখির মতো বসে রইল। বার বার দেখছে ফোন। ইস যদি শোনা যায় মানুষটির কণ্ঠ!
সে রাত্রিতে কল এলো না। অভিনবর বেহিসেবি বিচরণ ঝিলকে পীড়া দেয়। বড্ড অভিমান জাগে। এর কোনো মানে নেই তবু মনে হয় কেন এলো না কল? রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। ভোর রাতে শীত শীত অনুভব হচ্ছিল। কুকরে যাচ্ছিল শরীর। প্রতিটা লোমকূপ ভীষণ সজাগ।মেয়েটির ঠোঁট উল্টানি দেখে অভিনব হেসে ফেলল। ঝিলের এই বিশেষ ধরণের স্বভাব ওর ভালো লাগে। ইচ্ছে করে আদর করে দিতে। ইচ্ছাকে মূল্য দিল মেয়েটি। মেয়েটির তেলচিটচিটে গালে নাক ঘষতে লাগল। এ স্পর্শ ঝিলের চেনা নয়। তবে ভীষণ ভালো লাগছে। ঘুমের ঘোরে হাত বাড়িয়ে আরেকটু কাছে টানল। অভিনবর টনক নড়ে। চটপট সরে আসতে চাইল। অথচ মেয়েটি নাছোড়বান্দা। ফের চেষ্টা করল না ছেলেটি। ওভাবে বসে রইল। আঙুলের অগ্রভাগ ঠোঁটে ঠেকিয়ে চেয়ে রইল নিরন্তর।
ভোরের আলো এসে স্পর্শ করতেই মেয়েটির ঘুম ভাঙল। হাতে একটু টান অনুভব হয়। মাথাটা উঁচু করতেই দেখতে পায় বলিষ্ঠ দেহের মানুষটিকে। বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করে না। ছেলেটার অবিন্যস্ত চুলে আনমনেই হাত গলিয়ে দেয়। অভিনবর ঘুম পাতলা। হাল্কা স্পর্শেই জেগে যায়। তবে বুঝতে দেয় না। দেখতে থাকে ঝিলের কান্ড। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সে অনুভূতি। ঝিল গর্জে উঠে, “ফের এসেছেন! আপনি কি আমায় শান্তিতে থাকতে দিবেন না।”
মেয়েটির হঠাৎ গর্জনে অভিনব উঠতে বাধ্য হয়। আড়মোরা ভেঙে বলে “আপনিই তো ডেকেছেন প্রজাপতি।”
“আমি ডেকেছি মানে!”
“সেটা তো আপনার অজানা নয়। তবে কিসের এত হেয়ালি।”
“হেয়ালি তো আপনি করছেন। একটা মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে ঠিকই সুখে আছেন।”
চমৎকার হাসে অভিনব। ঝিলের নাকের দু পাশে জমে থাকা সারারাতের তেল আঙুলে মুছে নিয়ে বলে “সুখ তো অনেক দামী জিনিস ঝিল। আমি আর সুখের সমীকরণটা হচ্ছে গরীব বামন আর অহংকারী চাঁদের মতোন।”
শব্দগুলো ঝিলের চিত্ত কাঁপায়। আর কিছু বলতে পারে না মেয়েটি। অভিনব নিস্তব্ধ সুরের ইতি টানে। ভরাট গলায় বলে উঠে,
“পালিয়ে যাবেন আমার সাথে?”
অসময়ে এমন অদ্ভুত কথা শুনে ঝিল ভয় পেয়ে যায়। গলা শুকিয়ে হয় কাঠ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতে পারল না। এবার ছেলেটা শব্দ করেই হেসে উঠে। দূরত্ব কমিয়ে কাছে আসে।
“আপনার ভয়ার্ত মুখ, কি যে সুন্দর তা যদি আপনি জানতেন তবে সারাক্ষণ ই ভয় পেতেন।”
কেন যেন মেয়েটি রাগ দেখাতে পারে না। বরং হেসে উঠে শব্দ করে। অভিনবর ভালো লাগে। মেয়েটার মাথায় নরম স্পর্শ করে। এক চিলতে হাসি রাখে ঠোঁটে,
“প্রজাপতি এভাবেই সর্বদা হাসতে থাকুন আপনি। দুঃখ যেন আপনাকে স্পর্শ না করে। আপনার সব দুঃখ আমার হোক আমি আমার সমস্ত সুখ আপনার চরণে দিব।”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
জানেন তো আমার প্রথম বই ‘কৃষ্ণচূড়ার বাড়ি’ বইটির প্রি অর্ডার চলছে। ৩০% ছাড়ে বইটি অর্ডার করেন চটপট।
https://www.facebook.com/100075680003602/posts/197409496125049/?app=fbl