সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৮)

0
131

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৮)

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ঝিল আর অভিনব দুজনেই নিস্তব্ধ। একে অপরের খুব কাছে বসে। ব্যাগ থেকে ঝিলের ডায়েরীটা বের করে মৃদু স্বরে অভিনব বলল, “এটা ফেরত নিয়ে নিন ঝিল।”

“কেন?”

“আমায় কষ্ট দেয়। সকালে আপনি ম্যাসেজ করেছিলেন আমি ডায়েরীটা সম্পূর্ণ পড়েছি কি না। নানান ঝামেলায় পড়া হচ্ছিল না। তাই তখুনি পড়ে ফেলি। আর শেষ পাতাতে একটাই লাইন পেয়েছি।”

চমৎকার করে হাসল ঝিল। অভিনবর থেকে ডায়েরীটা নিয়ে শেষের পাতাটা খুলল। লেখাটা এখনো চকচক করছে।
“প্রেমিক পুরুষ, আপনি তো আমার নামে দলিল হয়ে গেলেন। তবু কেন এত দূরত্ব আমাদের মাঝে! আমার কথা কি কখনো মনে আসবে আপনার?”

কিশোরী হৃদয়ের আবেগ থেকে অগোছালো কিন্তু অনুভূতিতে ঠাসা লেখাটা লিখেছিল ঝিল। এই লেখাটাই শেষ লিখেছিল ডায়েরীতে। মেয়েটির গলায় একটি লকেট রয়েছে। লকেটটা ছোট হলেও বেশ সুন্দর। সর্বদা চকচক করে। অভিনব সেটাই দেখছিল। ও লক্ষ্য করেছে মেয়েটি এটা সর্বদা আগলে রাখে। ছেলেটির মুখের ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারল প্রশ্নটি।
“এটাতে আমার ছয় বছরের আশা জমা করা ছিল। আপনার মুখটা হাল্কা মনে আসলেও নামটা ভুলে গিয়েছিলাম আমি।”

কথাটা শুনে অভিনব হাসল। সত্যিই কি অদ্ভুত ওদের জীবন।

লকেটটা হাতে নিয়ে অভিনব বলল, “কি আছে এটার ভেতর?”

“নিজেই খুলে দেখুন।”

অভিনব তৎক্ষণাৎ খুলল লকেটটা। ছবিটা দেখে বলল, “আমার ছবি!”

“হ্যাঁ। মা লকেটটা আমায় বানিয়ে দিয়েছিল। আর এটার ভেতরই ছবিটা ছিল। মায়ের স্মৃতি বিধায় যত্নে রেখেছিলাম। ট্যুরে যাবার সময় এটা পরেছিলাম। ভেতরের ছবিটা সেদিনই নজরে এলো। আপনাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয় নি।”

“কিন্তু তার আগে তো চিনতে পারেন নি। তাহলে প্রথমদিন জড়িয়ে ধরার পর ও কেন চুপ ছিলেন? আমার জন্য কেন চিন্তা করছিলেন?”

“এটা সত্যিই আমার জানা নেই। কিন্তু মনে হচ্ছিল মানুষটা আমার আপন। আমার খুব কাছের। যাকে সবটা উজাড় করে দিলেও পাপ হবে না। একটা ইনার কানেকশন অনুভব করেছিলাম।”

“অথচ এতে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।”

বিস্মিত হয়ে তাকালো ঝিল। অভিনব মেয়েটির হাত বুকের মাঝে এনে বলল, “মনে আছে শপিংমলে আপনাকে ইগ্নোর করেছিলাম।”

“হ্যাঁ তাই তো। ইগ্নোর করেছিলেন কেন?”

“দুটো কারণ।”

“কি কি?”

“প্রথমত আমাকে নজরে রাখছিলেন মামা। আর দ্বিতীয়ত আপনি আমার বাড়াবাড়ি গুলো এলাউ করছিলেন। এটা মানতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।”

“কষ্ট কেন হচ্ছিল?”

“আপনি আপনার স্বামীকে ভুলে অন্য পুরুষকে অন্তরে জায়গা দিচ্ছেন কষ্ট হবে না?”

এবার সত্যিই ঝিলের হাসি পেল। শব্দ করে হেসে ফেলল সে। অভিনব একটু মন খারাপ করে বলল, “যদি সত্যিই আমায় মনে না রাখতেন। আর এভাবে অন্য কাউকে স্থান দিতেন।”

“তবে কি হতো?”

“তাহলে অভিনব সত্যিই পাগল হয়ে যেত। গত ছয় বছরে একটি বাচ্চা মেয়ে আমায় পাগল করে দিয়েছে। আমার সমস্ত কাজে মেয়েটি ঘুরপাক খেয়েছে। সব মিলিয়ে শুরুর দিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আপনি বললেন না এত বড় নিউজ পাওয়ার পর ও কেন আমরা আসি নি খোঁজ নিতে। এটা সত্যিই ভুল। মম আর পাপা বার বার এসেছে। কিন্তু সবাই তো ওদেরই দোষারোপ করেছে। সবার ধারণা মম আর পাপার জন্যই তোমার ফ্যামিলির সবাই মা রা গেছেন। বিষয়টা মম আর পাপাকে ভেঙে দিয়েছিল। সে সময়ে মামারা ও খুব রেগে যায়। কারণ ওদের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। আর তোমার ফ্যামিলি সমস্ত দোষ দিয়েছিল মামাদের আর মম পাপাকে। আমরা সব দিক থেকে আ ঘা ত পেয়ে ইউ এস এ ফিরে যাই। মম আর পাপাকে সামলাতে সামলাতে আমিই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়। আর আমরা খবর নিয়ে জানতে পারি তোমার ব্রেনে আ ঘা ত লেগেছে। কিছু মনে করতে পারছো না। শুধু দুর্ঘটনাটা ছাড়া।”

কান্নার শব্দে থেমে গেল অভিনব। ঝিলের চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে। মেয়েটির দুটি চোখ থেকে ঝরছে নোনা জল। অভিনবর মন হু হু করে উঠল। বুকের মাঝে আগলে নিল মেয়েটিকে।
“সেদিন আমি কেন মা রা গেলাম না অভিনব? সেদিন আমি মা রা গেলে এত ঝামেলা থাকত না। সত্যিই এত কষ্ট নিতে হতো না।”

“চুপ করুন ঝিল।”

অভিনবর বুকের মধ্যে ওভাবেই থেমে রইল ঝিল। সে দিনটা হয়ত কখনোই ভোলার নয়। একটা দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল! অভিনব আর ঝিলের বিয়ের মুহুর্তটা অল্প সময়েই ঘটে যায়। এক পলকের দেখা দুজনের। শুধুমাত্র পেপার সাইন করার সময় একে অপরকে দেখেছিল। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই ফিরে আসে ঝিলরা। বাড়িতে আসার পর শুনতে পায় মির্জা আর শিকদারদের মাঝে পুনরায় ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার মাত্রা এতই বেশি যে বিয়ের খবরটা জানানোর পরিস্থিতি থাকে না। অগোচরেই রয়ে যায় বিষয়টা। বদলে যায় সমস্ত ঘটনা।
কেটে যায় একটি মাস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিলই না। কিন্তু এভাবেও তো চলে না। এদিকে বেঁকে বসেছেন জাফর মির্জা। শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন শিকদাররা এলে ওনি মেয়ের বিয়ে দিবেন। কিন্তু এখন কিছুতেই দিবেন না। অপমানিত হয় শিকদাররা। এই নিয়েই ঝামেলার শুরু হয়। ঝিলের মা জেহেনাজ চৌধুরী ভেবেছিলেন এবার সত্যিটা জানানো প্রয়োজন। তিনি বলেন ঝিলের বিয়ে তিনি আগেই দিয়ে দিয়েছেন। কথাটা শোনার পর পরিস্থিতি আরও হাতের বাহিরে চলে আসে। প্রচন্ড কোন্দলের মাঝে জাফর মির্জা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে বসেন। দুঃখটা সহ্য করতে পারেন নি তিনি। মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন। ওনার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেন বাড়ির বাকি দুই বউ ও। সেদিনটা এখনো মনে আছে ঝিলের। হাইওয়ে দিয়ে চলছিল গাড়ি। হঠাৎ করেই একটা ট্রাক এসে ধাক্কা লাগে। সেখানেই প্রাণ হারান সবাই। কোনো এক ভাগ্যের জোরেই গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে ঝিল। আর বেঁচে যায়। ঘটনাটা সব নিউজ চ্যানেলে দেখানো হয়। ছুটে আসেন অভিনবর মা বাবা। কিন্তু ততক্ষণে মির্জারা শিকদারদের নামে অভিযোগ করে বসেছে। ঝড় থামার বদলে ঝড় নেমে আসে পুনুরায়। একটা দুর্ঘটনা ঝিল আর অভিনবর জীবন বদলে দেয়। মেয়েটি শুরুর দিকে কান্না করত কেবল। স্যালাইনের জোরে বেঁচে ছিল। একটা সময় একাকিত্ব এসে চেপে ধরে। স্মৃতিরা সব হারাতে থাকে। অনেক ঘটনাই ঝিলের মনে ছিল না। কিন্তু এই টুকরো টুকরো স্মৃতি ওকে ঘুমাতে দিত না। মাস খানেক পর সুস্থ হয় মেয়েটি। সবটাই মনে আসে। রোজ পুলিশ আসত শিকদারদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড়ের আশায়। মেয়েটির ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝেছিল এসব কেবল একটা দুর্ঘটনা। তাই তখন থেকে শুরু হয় অভিনয়। মেয়েটি জানায় কিছুই মনে নেই ওর। কেইস সেখানেই ক্লোজ হয়। বিয়েটা পরিবারের সকলের মতো,সে নিজে ও ধরে নেয় কেবল এক দুঃস্বপ্ন। শুরু হয় এক অভিমানের গল্প। যে গল্পের নায়ক অভিনব আর নায়িকা ঝিল।

শীতল হাওয়া নেমেছে। ত্বকে স্পর্শ করতেই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। ঝিলের কান্না থেমেছে। অভিনবর বুকের মাঝে মাথাটা এলোনো। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়াতে ঝিলকে যেতে হলো এবার। রজনী শুরুতেই প্রশ্ন করল, “একটা ঘন্টা কোথায় ছিলে?”

“বাইরেটা ঘুরছিলাম আপু।”

“বসে যাও। সময় নেই হাতে। সাজাতে টাইম লাগবে তো।”

“হুম।”

ঝিলকে সাজানো হয়। মেয়েটি পুরোটা সময় একদমই চুপ ছিল। সাজ শেষে নিজেকে দেখে অবাক হয়। তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অথচ মেয়েটি সর্বদা হাল্কা সাজে সেজে থাকে। সন্ধ্যায় ফিরল ওরা। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ছেলের বাড়ি থেকে দলে দলে লোক আসছে। বেশ নামজাদা পরিবারে বিয়ে হচ্ছে রজনীর।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**কোনো কনফিউশন কিংবা তথ্য মিসিং থাকলে কমেন্টে জানাবেন প্রিয় পাঠকরা।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here