সুখ_একটি_প্রজাপতি (২১)

0
141

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২১)

অভিনবর শ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। পরিশ্রান্ত ও ব্যথাহত দেহ নিয়ে তবু উঠে বসার চেষ্টা করল সে। রজনী এগিয়ে এল। সাহায্য করল বসতে। ছেলেটার শরীরে ভীষণ জ্বর। ব্যথার কারণেই জ্বরটা এসেছে। এক গ্লাস পানি দিল মেয়েটি। চোখ দুটো জলে ভেজা। অভিনব পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “প্লিজ কেঁদো না। আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে।”

রজনী কথা বলতে পারছে না। মেয়েটির খুব কষ্ট হচ্ছে। সে আলগোছে বেরিয়ে এল। বুকের ভেতরে জ্বলছে খুব। দানেশ বাইরে দাঁড়িয়ে। ফোন করছে কাউকে।
“কি হলো,পেয়েছ কাউকে?”

“নেটওয়ার্ক কাজ করছে না।”

“ভাইয়ার শরীরে ভীষণ জ্বর।”

“দেখি কি করা যায়। তুমি একটু খেয়াল রাখ।”

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল দানেশ। রজনী পুনরায় অভিনবর কাছে এল। ছেলেটার পায়ে ভীষণ চোট লেগেছে। চলতে পারছে না এখন। পাহাড়ি এলাকায় চিকিৎসার ও সু ব্যবস্থা নেই। এদিকে ওর ফোন কোথাও একটা হারিয়ে গেছে। দানেশ বার বার চেষ্টা করছে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু নেটওয়ার্ক খুবই বাজে। রজনী অভিনবকে দেখে পুনরায় ভেঙে পড়ল। ব্যথা নিয়েই চলার চেষ্টা করল অভিনব। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পুনরায় বসে পড়ল। কতবার চেষ্টা করেছে হিসেব নেই। চোটটা খুব বেশিই লেগেছে।

দুপুরের দিকে দানেশ এল। ঘামে ভেজা শার্ট। রজনী ছুটে এসে বলল, “কাউকে পেলে?”

“এক বন্ধুকে পেয়েছি, তবে সমস্যা হচ্ছে ও দেশে নেই।”

“তাহলে এখন কি করবে?”

“ইহানের পায়ের চিকিৎসা করা জরুরি। ভাবছি রাহিনের সাথে যোগাযোগ করব। এই সময়ে ওকেই ভরসা করতে পারি।”

“তাহলে তাই কর। ভাইয়ার যন্ত্রণা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

রজনীর কান্নাভেজা মুখে হাত বুলিয়ে দিল দানেশ। মেয়েটি আবেগী ভীষণ। রাহিন খাবার রেখে পুনরায় বেরিয়ে গেল। কিছুদূরে গিয়ে নেট পেল। রাহিন কল রিসিভ করতেই দানেশ অনুনয় করে বলল, “দোহাই লাগি ভাই। তুই ছাড়া এখন কেউ সাহায্য করতে পারবে না। প্লিজ হেল্প কর আমায়।”

ওপাশ থেকে রাহিন হ্যালো হ্যালো করে কল কেটে দিল। দানেশের মন খারাপ হলো। রাহিনও বুঝি মুখ ফিরিয়ে নিল! ছেলেটা মন খারাপ করে বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এল। দানেশ ভয় পেয়ে কলটা কেটে দিল। তারপরই ম্যাসেজটা এল।
“আমি রাহিন, কল রিসিভ কর।”

আবার কল আসতেই রিসিভ করল দানেশ। রাহিন ফিসফিস করে বলল, “কি ব্যাপার কোথায় আছিস তুই!”

“সব বলব। তার আগে কথা দে হেল্প করবি।”

“এতটাই অবিশ্বাস করছিস!”

“ভাই প্লিজ হেল্প কর। আমি একা সামলাতে পারছি না।”

“আছিস কোথায়?”

দানেশ লোকেশন দিল। সন্ধ্যার পূর্বেই এসে পড়ল রাহিন। দানেশের মুখ দেখে অবাক হলো। কদিনেই কেমন নেতিয়ে পড়েছে।
“একি অবস্থা তোর।”

“আমার কথা ছাড়। ডাক্তার এনেছিস?”

“ডাক্তার আনি নি। আগে বিষয়টা খুলে বল। সব না শুনে তো অ্যাকশন নিতে পারছি না।”

“তার আগে ভেতরে আয়।”

ঘরে গিয়ে অভিনবকে দেখে দ্বিগুণ বিস্মিত হলো রাহিন। সঙ্গে সঙ্গে অভিনবর কপালে স্পর্শ করে বলল, “একি অবস্থা!”

“ওর গায়ে ভীষণ জ্বর উঠেছে।”

“কিন্তু এমনটা হলো কি করে?”

তখনি রজনীকে চোখে পড়ল। রাহিনের ভ্রু কুচকে এসেছে। মেয়েটিকে এক দেখাতেই চিনে ফেলল সে। দানেশ হতাশ কণ্ঠে বলল, “রজনীকে আমি বিয়ে করেছি।”

হলুদের দিন মাঝ রাত অবধি অভিনবর নিকটই ছিল ঝিল। সময়টা খুব দ্রুত পেরিয়ে গেছে। ছেলেটার ইচ্ছে করছিল মেয়েটিকে নিয়ে আরেকটু সময় কাটাতে। কিন্তু চাইলেই তো সব হয় না। ঝিলকে নিয়ে ফিরতে হলো। মেয়েটিকে গেটের কাছে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় হাঁটতে লাগল সে। এভাবে আর কতদিন আলাদা থাকতে হবে ওর জানা নেই। এই ঝামেলা ভালো লাগছে না। দুটো পরিবারের ক্ষোভের কারণে দুটি হৃদয় একে অপরের থেকে এত দূরে। একটা বৈধ সম্পর্ক পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই আঁধার পেরিয়ে চলছিল সে। ঠিক সে সময়টায় একটা সত্য ধরা দেয় অভিনবর নিকট। ফিস ফিস কণ্ঠটা বলছে, “তুমি ভেবে বলছ তো? আমি চাই না এটা নিয়ে পরে আপসোস হোক তোমার।”

ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি কি বলেছে অভিনব জানে না। কিন্তু দানেশ বলল, “আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমার আগে অন্য কিছু নয়। এই সত্যের বাহিরে আর কিছু নেই। তুমি বের হয়ে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

দানেশ কল রাখতেই অভিনবর মুখোমুখি হতে হয়। অভিনব এক আকাশসম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। ছেলেটাকে শুরুতেই চিনতে পারে নি দানেশ। তাই ভরকে গিয়েছে।
“তুই এখানে!”

কণ্ঠটা শুনে দানেশের প্রাণ ফিরে। ও নিজেও অভিনবকে এখানে আশা করে নি। তবে মির্জা বাড়ির মেয়ের সাথে অভিনবর কিছু একটা রয়েছে এটা জানা ছিল। তাই সে চুপ করে রইল। অভিনব দ্বিগুণ জোর দিয়ে বলল, “কে আসবে দানেশ?”

“ভাই হেল্প কর প্লিজ। তুই প্লিজ বাঁচা আমায়।”

“আমি বুঝতে পারছি না।”

“চৌধুরী বাড়ির মেয়ে, রজনীর সাথে আমার দীর্ঘদিনের প্রণয়। পারিবারিক ঝামেলার কারণে সম্পর্কটা সম্ভব না। তাই এসেছি ওকে নিয়ে পালাব বলে।”

তখন অভিনবর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মস্তিষ্ক খালি হয়ে যায়। ওদের সম্পর্কটা যেখানে টানাপোড়েনে সেখানে আরেকটা সম্পর্ক অসম্ভব! তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারে নি ছেলেটা। দানেশ ওর হাত ধরে অনুনয় করে। ভীষণ ভালোবাসে রজনীকে। অভিনব সেটা বুঝতে পারে। তাছাড়া ভালোবাসার যে কি যন্ত্রণা তা ওর থেকে ভালো কে জানবে?
ছেলেটা দানেশকে সঙ্গ দেয়। ওদিকে গ্রামের ছেলেপেলের জন্য বের হতে পারছে না রজনী। তাছাড়া শিকদার বাড়ির সবাইকে মোটামুটি চেনে এই গ্রামের মানুষ। সেহেতু রাহিন গেলে ঝামেলা হওয়ার চান্স রয়েছে। তাই অভিনব বাড়িতে প্রবেশ করে। সাবধানে বের করে নিয়ে আসে রজনীকে।
এর পরের ঘটনাটা খুবই বেদনার। সে রাতেই বন্ধুদের সাহায্যে রজনী আর দানেশের বিয়ে হয়ে যায়। ওদের সেলফোন ফেলে দিতে হয়। ওরা আগেই প্ল্যান করেছিল দু এক বছর সবার থেকে আলাদা থাকবে। এর জন্য বেস্ট মনে হয় পাহাড়ি অঞ্চল। শেষ রাতে ওরা রওনা হয়। কিন্তু কে জানত সেখানেও আরেক বিপত্তি অপেক্ষা করছে। কিছু লোক রজনীর উপর হামলা চালায়। আর সেখান থেকেই উদ্ধার করার সময় অভিনবর পায়ে আ ঘা তটা লাগে। সেই পরিস্থিতিটা অনেক কিছুই বদলে দিল। পুরো ঘটনা শুনে রাহিন বিস্মিত হয়ে পড়ল। ওর মাথায় হাত। দানেশ স্বভাবে শান্ত তাই বলে এমন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে একবার ভাববে না? এই সম্পর্কটা কখনোই মানবে না দু পরিবার। সে হতাশার শ্বাস ফেলল। দানেশ রাহিনের বাহুতে হাত রেখেছে। চোখে মুখে আতঙ্ক।
“হেল্প কর ভাই।”

“তাই বলে চৌধুরী বাড়ির মেয়ে?”

“এটাই তদের সমস্যা। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বলে কি ও মানুষ না?”

বিরক্তিতে ভরে উঠল রাহিনের মুখ। ও এখন কিছু বলতে চাইছে না। আগে অভিনবর চিকিৎসা প্রয়োজন। ছেলেটা ব্যথায় ভুগছে। এত সময় অভিনব চুপ ছিল। এই মুহূর্তে ঝিলের মুখটা ভাসছে। মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। ওর নিজের ফোনটাও সাথে নেই। কে জানে কোথায় পড়ে গিয়েছে। অভিনব রাহিনের সাহায্যে উঠে বসল। রাহিনের ভীষণ খারাপ লাগছে।
“ডাক্তার নিয়ে আসব নাকি শহরে ফিরে যাবি?”

“আগে তোর ফোনটা দে।”

“ফোন, ফোন দিয়ে কি হবে?”

“দে প্লিজ।”

রাহিন ফোন এগিয়ে দিল। খুব সহজেই পেয়ে গেল তরুণের নাম্বারটা। কিন্তু নেটওয়ার্কের প্রবলেম। ছেলেটার চোখের ভাষা পড়তে পারল রাহিন। ওর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাইরে আসতেই নেটওয়ার্ক পেল। তরুণ কল রিসিভ করেছে।
“আমি অভিনব বলছি।”

“হ্যাঁ অভিনব বল।”

“তুই একটা হেল্প কর। মৌনতাকে কোনো ভাবে ঝিলের কাছে পাঠা। আর আমি যা যা বলছি সেসব বলতে বল।”

অভিনব অল্প কথায় সবটা শেয়ার করল। রাহিন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে।
“ঝিল, মির্জা বাড়ির মেয়ে?”

“হুম।”

“মাই গড! ঝিলের মামাতো বোনই তো রজনী?”

“হ্যাঁ।”

“তোরা ভাই কি শুরু করেছিস! পৃথিবীতে আর মেয়ে নেই?”

অভিনব হাসল। পায়ের পাতা মাটিতে রাখতেই পুরো শরীর শিরশির করে উঠল। যন্ত্রণায় টনক ধরে গেছে।
“এসব বুঝবি না তুই।”

“বোঝার দরকার ও নেই। এখন বল কি করব তোকে নিয়ে?”

“গাড়ি আছে না সাথে?”

“হুম।”

“তাহলে শহরে যাব। পরে দেখা যাবে দানেশের বিষয়টা।”

তখনি রওনা হয় ওরা। একটা নিদারুণ যন্ত্রণায় কাঁপছে শরীর। অভিনবর হৃদয়ে কেমন ব্যথা হচ্ছে। বার বার ভাসছে ঝিলের মুখ। মেয়েটি ঠিক আছে তো?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here