হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব১৭

0
336

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৭

কাজিনদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে রাত প্রায় দুইটা বেজে গিয়েছিল। বেশ অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা কোনরকম খাওয়া দাওয়া সেরে, যে যার মতো কক্ষে এসে শুয়ে পড়েছিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছিল নেত্রপল্লবে। সকালে ঘুম ভাঙল রিশতার হাঁকাহাঁকিতে। আড়মোড়া ভেঙে তাই আলসে ভঙ্গিতে বলে উঠলাম

-‘ কি রে, এতো সকালে এমন ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?

কোমড়ে হাত দিয়ে মৃদু চিৎকার করে রিশতা বলল

-‘ ক’টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? মামিমা এসে তোকে ডেকে গেছে কতবার! আজ না আমাদের “ভুতের আড্ডায়” যাওয়ার কথা ছিল। তোর জন্যে আর যাওয়া হলো না আমার।

আমার কর্ণকুহরে রিশতার কথা ঠেকতে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম আমি। দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই দেখতে পেলাম, ঘড়িতে এখন বেলা বারোটা বাজতে চলেছে। এই রে আজ তো সব কাজিনরা মিলে “ভুতের আড্ডায়” যাওয়ার কথা ছিল, আমি তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম!

আক্ষেপের সুরে রিশতা আবারও বলে উঠল

-‘ তুই আর আদ্রিশ ভাইয়া, দুইটাই যে এক গোয়ালের গরু, খালি খালি বলি না আমি। তুইও আজ এমন ভোস-ভোস করে ঘুমিয়েছিস। আর আদ্রিশ ভাইয়ার তো এখনও দরজা খোলার-ই কোন নাম গন্ধ নেই।

রিশতার কথায় আমার কপালে আপনাআপনিই কিঞ্চিৎ ভাঁজ চলে এলো। গতকাল আমাকে আর আহিরকে একসাথে দেখে সেই যে ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে, তারপর আর তার ছায়াও নজরে পড়েনি আমার। বেচারার জন্যে খারাপ লাগছে ভীষণ! এমন করতে তো আমার নিজেরই ভালো লাগছে না। পরক্ষণেই আবার চোয়াল শক্ত করে নিজেকে শান্ত করলাম। আমি আমার সিদ্ধান্তেই অটল রইলাম। ব্যাটা মুখ ফুটে যতদিন না কিছু বলছে, ততদিন আমি এমনই করব বলে মনে মনে পণ করলাম।

-‘ কি রে চুপ করে আছিস কেন? তোদের জন্য তো আমার ঘুরতে যাওয়াটাই ভেস্তে গেল।

করুন সুরে এতোটুকু বলে থামল রিশতা। আমি সরু চোখে ওর দিকে একবার চেয়ে বললাম

-‘ অন্যান্যরা সবাই গেছে?

-‘ তো কি ওরা বসে থাকবে আমাদের জন্য?

-‘ তা তুই গেলি না কেন?

-‘ তোকে ফেলে আমি আর অরনী কিভাবে যাই, বল তো? তোর খালাতো ভাই আহিরও তো যায়নি, তুই যাসনি বলে। শুধু আলভি ভাইয়াই গিয়েছে ওদের সাথে।

আমি আর কোন কথা না বলে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম, রিশতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর স্নো পাউডারের বক্সটা হাতে নিয়ে পুরো গালে ঘষা মাজা করছে। বুঝলাম না ওর হঠাৎ এমন শুভ্র পেত্নি সাজার কি কারণ!

আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম

-‘ কি ব্যাপার এমন ধলা বাঁদরের মতো সাজচ্ছিস যে?

রিশতা পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল

-‘ দ্যাখ, দ্যাখ, আমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে তাই না? আমায় দেখলে তো চোখই ফেরাতে পারবে না ও। আচ্ছা তুই শাড়ি পরাতে পারিস, মেহু?

-‘ আমি নিজেই তো শাড়ি পরতে জানি না। তোকে কি পরাবো?

-‘ আচ্ছা যাক গে, বাদ দে। শাড়ি পরতে পারি না তা তে কি হয়েছে? আমারও কি বুদ্ধি কম নাকি! একটা স্কার্টের উপর একটা সর্ট গেঞ্জি আর তার উপর একটা ওড়না শাড়ির মতো করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরব। এই তো ব্যাস হয়ে গেল আমার ঐতিহাসিক শাড়ি পরা! কি বুদ্ধি আমার তাই না বল?

রিশতার কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বাহ কি চমৎকার বুদ্ধি, নাইস! যে শাড়ি পরার ট্রাডিশন চালু করেছিল, সে জানতে পারলে নির্ঘাত মরার পর আবার নতুন করে পটল তুলে বসত! মনে মনে কথাটা ভেবে আমি আনমনেই হেসে ফেললাম। রিশতা এবার আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল

-‘ শোন না আমার না একজনকে খুব ভাল লাগে! কি সুন্দর যে দেখতে। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার ভীষণভাবে মনে ধরেছে। প্লিজ মেহু তুই কিছু একটা কর না।

আমি কিছুক্ষণ রিশতার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। এই মেয়ে না গতকাল রাতেই মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিল ওকে কেউ পাত্তা দেয় না বলে। আর আজ কিনা সে-ই এসব কথা বলছে। আমায় হা করে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রিশতা আবারও বলল

-‘ কি হলো এমন হাবার মতো হা করে চেয়ে আছিস কেন? তুই একটু আমায় হেল্প কর না মেহু!

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-‘ তোকে বলে কেউ পাত্তা দেয়না? তা তোর মতো শুভ্র পেত্নিকে আবার কোন মামদোবাবাজি পাত্তা দিল?

-‘ হেয়ালি ছাড় মেহু, আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমার একজনকে ভালো লেগেছে তাই আমার এমন সাঁজ!

-‘ তোর আবার কাকে ভালো লাগল শুনি?

রিশতা এবার লজ্জা মাখা এক হাসি দিয়ে লাজুক কন্ঠে বলল

-‘ কেন তোর খালাতো ভাই আহিরকে! ছেলেটা এত্তো ভালো কি বলব। ওর সাথে তো আজ সকালে খানিক সময় ব্যাপী কথা হলো। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল এই ঠাডা পড়া গরম নিয়ে। এ থেকেই ছেলেটার কথার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি।

কথা বলতে বলতেই রিশতা লজ্জায় দিল এক লাফ। আমি হতভম্ব বনে গেলাম ওর এহেন কথাবার্তা আর কর্মকান্ড দেখে। এ মুহুর্তে ঠিক কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত তা বোধগম্য হলো না আমার। একটা মানুষ গরম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কিভাবে প্রেমে যায় রে ভাই? ও ভাই মারো মুঝে মারো! আমি মাথায় হাত দিয়ে তাই হা হুতাশ করে বলে উঠলাম

-‘ এই গরমে, মানুষের গরম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েও প্রেম হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কিনা সেওরা গাছে ঝুলে রয়েছি এখনো! এমন চলতে থাকলে তো আমার লটকে যেতে দুদিনও সময় লাগবেনা!

আমার কথা শুনে ফিচালো হেসে রিশতা বলল

-‘ আরে এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোর। আমি আছি না ইয়ার? সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি! তুই শুধু আমার আর আহিরের সেটিংটা করিয়ে দে। তারপর তোরটা আমি আর অরনী দেখে নিব।

আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি! অগত্যা রিশতার পাগলের প্রলাপ না শুনে আমি বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম সোফার উপরে পা ভাঁজ করে, মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে আহির। আমি আহিরের পাশে বসতে বসতে হাসিমাখা মুখে বলে উঠলাম

-‘ বাসায় বসে বসে মোবাইল চালাতে বোর লাগছে না আহির? শুধু শুধু ঘুরতে যাওয়া মিস দিলি কেন, বল তো?

আমার কথায় মোবাইলটা রেখে, পূর্ণ দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় আমার দিকে আহির। অধরের কোণে মুচকি হাসির রেখা ঝুলিয়ে শান্ত স্বরে বলল

-‘ তোকে ছাড়া কোথাও যেতেও ভাল লাগে না মেহুবুড়ি। আর তাছাড়া আমি গেলে তোর খারাপ লাগতো। এজন্যই যাইনি।

আমি হালকা হেসে বললাম

-‘ তাই বুঝি?

আহির মাথা চুলে ফিক করে হেসে ফেলল।

কি নিয়ে যেন রিশতা এক প্রকার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে লাগল আমার কাছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল, ছুটে আসতে গিয়ে পায়ের সাথে ওড়না জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রিশতা। দুম করে শব্দ হতেই আমি গিয়ে দ্রুত ধরে ফেলি রিশতাকে। আর এ দিকে আহির বেচারা হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বলে উঠল

-‘ আরে মিস চিংড়ি মাছ, তোমার এতো বেশি গরম লেগে গিয়েছিল যে এভাবে লাফালাফি করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে?

আহিরের কথায় লজ্জায়, অপমানে রিশতা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে আবার দৌড়ে চলে যায়। যেতে গিয়ে আবারও এক দফা শুকনো মাটিতে আছাড় খেল ও। কোথায় গেল তার ঐতিহাসিক শাড়ি! সব খুলে এখন মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। পড়নে শুধু রয়েছে তার ঐতিহাসিক স্কার্ট আর গেঞ্জি।

আমি এবার নিজেও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আহিরের পাশে গিয়ে বসে হে হে করে হেসে উঠলাম আমি। আমি আর আহির দুজনে হাতে হাত মিলিয়ে হেসেই চলেছি এক নাগারে। আমাদের হাসির তোড়ে পুরো ড্রয়িং রুম কেঁপে উঠল বোধহয়। কিন্তু আমাদের হাসি কিছুতেই থামছে না যেন।

এমন সময় আদ্রিশ ভাইয়ার আগমন ঘটল। সরু চোখে আমাদের একবার পরোখ করে নিয়ে, ডাইনিং টেবিলের উপর থাকা পাউরুটি মুখে পুড়তে পুড়তে আবার চলে যেতে নিয়ে কি মনে করে যেন আবার থেমে যায় সে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরে থমথমে গলায় বলে উঠল

-‘ মেহরুন, একবার আমার ঘরে আয় তো। তোর সাথে আমার কিছু হিসেব বাকি পড়ে রয়েছে।

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে গটগট পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। আমি পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। থমথমে গলায় বললেও তিনি যে বেজায় চটে আছেন, তা বুঝতে আমার একটুও বেগ পেতে হলো না।

আহির আমার হাত চেপে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল

-‘ আদ্রিশ ভাই হয়তো তোর উপর বেজায় চটে আছে রে মেহু। তুই শিগগিরই যা। নয়তো আমাদের পিঠের উপর তাল পড়তে বেশি সময় লাগবে না রে। আর তাছাড়া আমি এতো দ্রুত পটোল তুলতে চাইছিনা। আমার এখনও বিয়ে করা বাকি। এই বয়সে ওমন রামধোলাই খেলে শেষমেশ আমার কপালে আর বউ বাচ্চা জুটবে না রে বইন।

আমি মাথায় হাত দিয়ে থম মেরে আগের জায়গাতেই বসে রইলাম। মনে মনে শতবার আওড়ালাম, “আমার মতো যেন আর কারো কপালে এমন ঠেরষ মার্কা আদ্রিশ ভাইয়া না জোটে।”

#চলবে ~

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৮

-‘ উহু, এই মুহুর্তে আমি আর কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না মেহরুন। তোকে যা বলেছি তুই তাই কর আগে।

আমি ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে। মানুষ এতোটা নির্দয় কিভাবে হতে পারে? আমার মতো একটা নিষ্পাপ শিশুকে নির্যাতন করে, উনি দাঁত কেলিয়ে হাসছেন! ওনার কি বিন্দুমাত্রও মায়া হচ্ছে না আমার প্রতি?

কিছুক্ষণ আগে…

আমাকে আদ্রিশ ভাইয়া ডেকে যাওয়ার পরও আমি যাইনি। প্রথমত ওনার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে ছিল না আমার। তাই আমি তেমন ভ্রুক্ষেপ করিনি তার কথায়। ভাবলেশহীনভাবে আহিরকে নিয়ে আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানটাতে এসেছিলাম। নতুন করা হয়েছে আমার এই শখের বাগানটা। বাগানে রয়েছে সারি সারি ফুলের গাছ! ও কখনো আমার করা বাগান দেখেনি, তাই নিয়ে এলাম। ঘুরে ঘুরে বাগান দেখতে দেখতে আহির হুট করে বলে উঠল

-‘ মেহুবুড়ি! আদ্রিশ ভাই ডাকার পরও তো তুই গেলি না। ওনার ভাবেসাবে মনে হলো বেজায় চটে আছেন আমাদের উপরে। তার উপর আবার উনার কথার খেলাপ, এখন কি হবে আমাদের?

আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেশ ভাব নিয়ে বললাম

-‘ আরে ভয় পাস না তো! আমি কি ভয় পাই নাকি তাকে? উল্টে আমায় দেখলে আরও ভয়ে পালায় আদ্রিশ ভাইয়া।

কথাটা বলেই শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। আহির মুখে জোরপূর্বক হাসি ফোটালেও পরক্ষণেই কি মনে করে মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। আগের বারের থাপ্পড়টা এখনো মনে পড়লেই তার গালটা কেমন যেন নড়ে ওঠে। বিলাপ করে তাই বলল

-‘ তুই যা বলেছিস, আমি কিন্তু তা-ই করেছি। কিন্তু এখন যদি তোর চাচাতো ভাই এসে আমার এমন শুকনো পাটকাঠির মতো শরীরে বেদম প্রহার করে তাহলে কেউ আর আমাকে পটল তোলার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না রে। আমি এতো তাড়াতাড়ি ম’রতে চাই না। ও বউ কোথায় তুমি? বাঁচাও আমারে!

আমি আমার চুল উড়িয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললাম

-‘ আরে তুই শুধু শুধুই টেনশন করছিস ভাই। আদ্রিশ ভাইয়ার কিছু বলার সাহস আছে নাকি…

আমার কথার মাঝেই কর্ণকুহুরে এক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই থেমে গেলাম আমি। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে মেকি হাসার বৃথা চেষ্টা করলাম মাত্র।

আহির দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুটস্বরে বলল

-‘ মেহুবুড়ি, তুই আজ শেষ রে! আমি চলি নয়তো আমিও…

আদ্রিশ ভাইয়া আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আলতো হেসে বলল

-‘ আরে আহির যে। কেমন আছো ভাই আমার?

আহির কোনো মতে মেকি হাসি দিয়ে বলল

-‘ এই তো ভাই ভালো আছি। আপনি মেহুর সাথে কথা বলেন, আমি তবে যাই।

-‘ আরে আরে তুমি পালাচ্ছো কেন আহির? আমি তো তোমার বড় ভাইয়ের মতোই, তাই না?। বড় ভাইকে দেখলে পালাতে হয় বুঝি?

আদ্রিশের হঠাৎ এমন ভালো মানুষী রূপ দেখে কিছুটা ভড়কে যায় আহির। আমতা আমতা করে তাই বলল

-‘ না মানে ভাই আসলে আমার না এখনো বিয়ে করা বাকি পড়ে রয়েছে। আমি তাহলে যাই।

আদ্রিশ কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে সন্দিহান চিত্তে বলল

-‘ এই তুমি না সবে এসএসসি দিলে? তো এই বয়সেই বিয়ে করার শখ জেগেছে তোমার! ইশ বাচ্চা বাচ্চা পোলাপানও আজকাল বিয়ে করতে চায়। কি করলাম তবে আমি এই জীবনে? আমার যে বউ থাকতেও বউ নাই!

শেষোক্ত কথাগুলো বিলাপের সুরে বলে থামল আদ্রিশ।
আমার দিকে এগিয়ে এসে আদ্রিশ ভাইয়া পুনরায় আহিরের উদ্দেশ্যে বলল

-‘ আচ্ছা আহির তুুুুমি মেহমান মানুষ। যাও ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি একটু তোমার মেহুবুড়ির সাথে জরুরি কথা বলে আসি, কেমন?

আহির মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। যেন পালিয়ে বাঁচতে পারলেই ছেলেটা বাঁচে। হুট করে ওর আচরণের এমন আমূল পরিবর্তন দেখে আমার সন্দেহ হয়, আদ্রিশ ভাইয়া আবার সত্যি সত্যিই ছেলেটাকে ধোলাই দিয়ে বসল না তো?

-‘ কি ব্যাপার মেহুপাখি, চুপ করে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো যে? চলো আমার সাথে। তোমার একটু খাতির যত্ন করার সুযোগ দাও এই অধমকে!

আদ্রিশ ভাইয়ার এমন মিষ্টি মিষ্টি বুলি শুনে এ মুহুর্তে আমার মনে ভয় জেঁকে বসল। এখন তো এতো ভালো ব্যবহারের কথা নয়, তাহলে কি তার মনে অন্যকিছু চলছে? নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আঁটছে, আমায় শায়েস্তা করার জন্য। ভয়ার্ত চাহনিতে আমি একবার দৃষ্টিপাত করলাম তার মুখশ্রীর পানে। এক দৃষ্টিতে একদম শান্ত চাহনিতে সে চেয়ে রয়েছে আমার পানে। আজ তার নেত্রের মাঝে কোনো চঞ্চলতার ভাব নেই। এটা কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো? এসব ভেবেই আমার মুখটা একেবারে পাংশুটে হয়ে গেল যেন।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার আর কোনো কথা না বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের কক্ষে। আমি বাঁধা দিতে চাইলেও পারলাম না। ঘরে এসেই ঠাস করে দরজা দিয়ে দেয় আদ্রিশ ভাইয়া। আমার বুকটা ধক করে ওঠে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম তাই। উনি এ মুহুর্তে ঠিক কি করতে চাইছে, তা বোঝা বড় দায়। সে আমার দিকে যত এগিয়ে আসছে, আমার ভয় তত বেড়েই চলেছে! মনের কোণে সন্দেহের দানা উঁকি দিল, ‘ওনার মনে খারাপ কিছু নেই তো?’ আমার পড়নে থাকা কামিজটা খামছে ধরলাম আমি। তবুও নিজেকে শান্ত রাখলাম।

আমার দিকে এগিয়ে এসে কন্ঠে কিছুটা গাম্ভীর্যতা এনে বলল

-‘ তুই এমন কেন মেহু? তুই কি সত্যিই কিছু বুঝিস না, নাকি না বোঝার ভান করিস?

তার কথায় আমি চকিত তাকাই। আমি জানি সে কি বলতে চাইছে। তবুও তার মুখ থেকেই শোনার জন্য আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার আমার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে করুন সুরে বলল

-‘ তুই সবটা জেনেও এমন করছিস কেন মেহু? তোর পাশে অন্য কাওকে সহ্য হয়না যে আমার!

আমি তবুও নির্বিকার রইলাম। উৎসুক হয়ে তার পানে চেয়ে রইলাম। এবার সে আমার হাতটা ছেড়ে দেয়। মুখে কিছুটা কাঠিন্য ভাব এনে শক্ত কন্ঠে বলল

-‘ নেক্সট টাইম যেন তোর পাশে আহিরের ছায়াও না দেখি আমি। তা না হলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ কেউ হবেনা।

আমি এবার চুপ থাকতে পারলাম না। মৃদু স্বরে বললাম

-‘ আহির তো আমার খালাতো ভাই হয়। ও আমার সাথে থাকলে কি সমস্যা?

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া থমথমে গলায় বলল

-‘ খালাতো ভাই হোক বা পাড়াতো, যে ভাই-ই হোক না কেন সবার থেকে দশ ফিট দূরে থাকবি তুই। খবরদার আমার কথার যেন নড়চড় না হয়।

আমি এবার কিছুটা অবাক হয়ে বললাম

-‘ তাহলে সবার আগে তুমি দূরে সরো। তুমি তো আমার চাচাতো ভাই, আপন ভাই তো আর নও।

এবার আদ্রিশ ভাইয়া বোধহয় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। দ্বিগুণ তেজে তাই বলে উঠল

-‘ এমনিতেও ভুল করেছিল। তার উপর আবার আমার মুখে মুখে তর্ক! এই এক্ষুনি দুশোবার কান ধরে উঠবস কর। এটা তোর পানিশমেন্ট।

তার দিকে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আরে আমি ভুলটা কি বললাম। এই ব্যাটা বলে কি এসব।

আমায় হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিশ ভাইয়া টেবিলের উপর থেকে একটা স্টিলের স্কেলটা নিয়ে এসে বলল

-‘ এই তুই কান ধরে উঠবস করবি নাকি আমার হাতে স্টিলের স্কেলের মাইর খাবি, কোনটা?

এই রে স্টিলের স্কেলের মাইর তো সাংঘাতিক! একবার স্কুলে বাঁদরামি করার জন্য স্যার মেরেছিল। মনে পরলে এখনো জ্বলে ওঠে পিঠটা! না বাবা এর থেকে কান ধরে উঠবস করা ঢের ভালো। তবে আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে কাভি নেহি!

উপায়ন্তু না পেয়ে তাই আমি এবার মিথ্যা কান্নার অভিনয় জুড়ে করুণ সুরে বললাম

-‘ সরি ভাইয়া, আর হবেনা কখনো।

পানিশমেন্ট মওকুফের জন্য ইনিয়েবিনিয়ে আরও নানান কথা বলেও ঠেড়ষটার মন গলাতে পারলাম না। শেষমেশ সে আমায় উপরোক্ত কথাটা বলে বসল।

আমায় নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিশ ভাইয়া তাড়া দিয়ে বলে উঠল

-‘ কি হলো, দাঁড়িয়ে আছিস যে? ফটাফট দুশোবার কান ধরে উঠবস কর। এটাই তোর মতো বিচ্ছুর জন্যে পারফেক্ট শাস্তি!

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ে। মেয়েদের কান্নায় নাকি পাথরেরও মন গলে। আমি এবার তাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে উঠলাম

-‘ এমন করছো কেন ভাইয়া? আমার মতো একটা নিষ্পাপ নাদান বাচ্চাকে শাস্তি দিতে তোমার খারাপ লাগছে না একটুও।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার আমার একদম কাছাকাছি এসে কিছুটা ঝুঁকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল

-‘ সিরিয়াসলি তুই বাচ্চা? তাহলে তোর আচার আচরণ এমন ইচরেপাকাদের মতো কেন?

আমি নিরুত্তর। তবে মনে মনে ওনার চৌদ্দ গুষ্টির শ্রাদ্ধ পড়াতে গিয়ে নিজেকেই নিজে ধমক দিলাম। আরে ওনার চৌদ্দ গুষ্টি মানে তো আমারও চৌদ্দ গুষ্টি। ছি ছি নিজের বাপ দাদা পূর্বপুরুষদের কি কেউ গালি দেয়!

আদ্রিশ ভাইয়া এবার থমথমে গলায় বলে উঠল

-‘ তুই যে আমার ডায়রি পড়েছিস, তা বুঝতে আমার বাকি নেই। তুই তো সবই জানিস, তাহলে এমন না জানার ভান ধরেছিস কেন? এতোকিছুর পরেও তুই কেন বুঝতে চাইছিস না যে তোকে আমি ঠিক কতটা ভা…।

আমি উৎসুক হয়ে শুনছিলাম তার কথা। কিন্তু ব্যাটা প্রত্যেকবারই ভা ভা করতে করতেই মাঝপথে থেমে যায়। কোনদিন পেত্নীতে এসে ভাউ দিবে তখন বুঝবে ঠ্যালা। এবার সত্যিই আমার মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়ে গেল। ইচ্ছে করছে কামড়ে দিতে, কিন্তু আফসোস আমি তো আর রাক্ষসী নই!

আদ্রিশ ভাইয়া আবারও মুখ খোলার পূর্বেই দরজায় টোঁকা করে। আমার ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো যেন। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলাম গরম খুন্তি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মামনি। সুযোগ পেয়ে আমিও কান্নার সুর জুড়ে দিয়ে সবকিছু বলে দিলাম। সব শুনে মামনি রেগে যায়। মামনি খুন্তি নিয়ে তাড়া করে আদ্রিশ ভাইয়াকে। পশ্চাৎদেশে গরম খুন্তির ছ্যাকা পড়তেই ‘উহ’ করে মৃদু চিৎকার করে ওঠে আদ্রিশ ভাইয়া।

তাড়া করতে করতে ক্ষিপ্ত গলায় মামনি বলল

-‘ তবে রে! তোর এত্তো বড় সাহস, আমার মেয়েকে কান ধরে উঠবস করানো। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।

পশ্চাৎদেশে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে আদ্রিশ ভাইয়া আকুতি ভরা কন্ঠে বলে উঠল

-‘ আম্মু আমি আর জীবনেও মেহুকে কান ধরে উঠবস করানোর কথা স্বপ্নেও ভাববো না। উহ, পেছনটা বোধহয় ঝলসে গেল রে বাপ!

মা ছেলের এমন কান্ডকারখানা দেখে আমি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম। এবার বোঝ ঠ্যালা আদ্রিশ চাঁন্দু! এই মেহরুন ইবনাত খানের পেছনে লাগতে আসলে ওমনই গরম খুন্তির স্পেশাল ছ্যাকা খেতে হয়। ভা ভা করতে গিয়ে এখন বেচারা ম্যা ম্যা করছে🧛🏻‍♀️

#চলবে ~

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here