হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব২৩

0
233

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৩

সকালের নাস্তা সেরে চোখ বুঁজে কপালে এক হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম খানিক সময়। পূর্বের তুলনায় এখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি। এমন সময় মাথায় কারো শীতল স্পর্শে চোখ মেলে তাকালাম সেদিক পানে। মা অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে রয়েছেন আমার পানে, সাথে আলভি ভাইয়া আর আহিরও আছে।

আমার কাজিনদের বিদায়ের পর মা, আলভি ভাইয়া আর আহির গিয়েছিল আমার নানাবাড়িতে, অসুস্থ বৃদ্ধা নানীকে দেখতে। আমাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল তবে আমার ভালো লাগছিল না বিধায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। ওরাও আর তখন জোড়াজুড়ি করেনি আমায়। মা যাওয়ার আগে মামনিকে বলে গিয়েছিলেন আমার খেয়াল রাখতে। ফিরতে বেশ খানিক সময় লাগবে তাদের। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরপরই আকাশ ভেঙে নেমে আসে বৃষ্টির বারিধারা। সারারাত মুষলধারে বৃষ্টির দরুন তাদের পক্ষে আর সেই রাতে রওয়ানা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মামনির কাছ থেকে আমার অসুস্থতার খবর পেতেই হন্তদন্ত হয়ে ভোরের দিকেই রওয়ানা দেয় তারা। রাতের দিকে নাকি বাবা এসে আমার মাথার কাছে বসেছিল। যদিও তখন আমি ঘুমিয়েছিলাম। পরবর্তীতে রিশতার কাছ থেকে জানতে পারি সেসব।

আলভি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল

-‘ এখন কেমন আছিস বোন?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘আগের চাইতে কিছুটা ভালো।’

আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বিচলিত হয়ে বললেন

-‘ হ্যাঁ রে মা, জ্বর এলো কিভাবে তোর? আলভি, আমি আর আহির একটু তোর নানাবাড়ি গিয়েছিলাম। আর সেখানে পৌছাতে না পৌছাতে শুনলাম, তোর নাকি জ্বর এসেছে। সারারাত তোর চিন্তায় ঘুমোতে অবধি পারিনি। মুহুর্তে মুহুর্তে ভাবির কাছে ফোন দিয়ে তোর খোঁজ খবর নিয়েছি।

এতোটুকু বলে থামলেন মা। দেখে বোঝা যাচ্ছে, গতরাতে ঘুম হয়নি মায়ের। মাকে এমন উদ্বিগ্ন হতে দেখে আমি শান্ত গলায় বললাম

-‘ মা শুধু শুধু এতো চিন্তা করো না তো আমার জন্য। আমি এখন ঠিক আছি তো।

-‘ তোর চিন্তায় আমার ঘুম হয়না আর তুই বলছিস চিন্তা না করতে। যখন মা হবি তখন বুঝবি, সন্তানের জন্যে মায়েদের চিন্তার কোনো শেষ নেই।

আমি আর কিছু বললাম না, মায়ের দিকে চেয়ে নির্বিকার বসে রইলাম।

-‘ তোমার মেয়ে জ্বর বাধিয়েছে কিভাবে শুনবে না, মামিমা?

থমথমে গলায় উক্ত কথাটি বলতে বলতে কক্ষে প্রবেশ করল অরনী। মা ফিরে তাকালেন ওর দিকে। আমি চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম বলতে। তবুও আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে অরনী বলল

-‘ জানে যে, বৃষ্টিতে ভিজলেই ওর জ্বর আসে। তবুও গিয়ে ওনার বৃষ্টিতে ভেজা চাই। ওর আর রিশতার পাল্লায় পড়ে আমারও ভিজতে হয়েছে। এখন আমার মাথা ধরেছে ভীষণ। মেহরুনের মতো আমার না আবার জ্বর চলে আসে, মামিমা!

অরনীর কথার বিপরীতে আমি প্রতিবাদের সহিত বললাম

-‘ এই আমি বা রিশুর কেউ কিন্তু তোকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলিনি। তুই-ই তো নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলি।

-‘ সে যাইহোক। আমরা কেউ তো আর তোর মতো জ্বরে পরিনি। তুই বৃষ্টিতে ভিজে তুই জ্বর বাধিয়েছিস, এটা তোর দোষ।

অরনীর কথার পিঠে আবারও কোনো কথা বলার জন্য উদ্যত হতেই, আমায় থামিয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে মা বললেন

-‘ চুপ, আর কোনো ঝগড়া আমি শুনতে চাই না।

মায়ের ধমক খেয়ে চুপসে গেলাম আমরা। মা এবার আমার দিকে ফিরে মৃদু স্বরে কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন

-‘ বাড়ির থেকে একদিন একটু বেরিয়েছি আর ওমনি শুরু হয়ে গেল বাঁদরের বাঁদরামি! কত করে বলেছি, বৃষ্টিতে ভিজবি না কিন্তু কে শোনে কার কথা। আল্লাহ আমার মেয়েটারে একটু সুবুদ্ধি দাও!

মায়ের সাথে সহমত পোষণ করে অরনী বলল

-‘ হ্যাঁ মামিমা ঠিকই বলেছ। রাতে না ঘুমিয়ে ওকে জ্বরপট্টি দিয়ে দিলাম, সকালের স্যুপটাও আমি বানিয়ে দিলাম। আর এতোকিছুর পর ও কেমন করছে আমার সাথে! দেখেছো মামিমা!

কাঁদো কাঁদো মুখ করে উক্ত কথাটা বলে ফেলল অরনী।আমি চোখ গরম করে তাকালাম ওর দিকে। মেয়েটা ইচ্ছে করে মায়ের কাছে নালিশ দিচ্ছে আমার নামে। বিচ্ছু একটা। ওকে শুধু একবার আমার বাগে পাই, তারপর দেখাচ্ছি ‘কত ধানে কত চাল!’

মা এবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বিচলিত হয়ে বললেন

-‘ বড় ভাবি কোথায় অরু? ওনাকে দেখছি না যে! যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলাম আমার মেয়েটার একটু খেয়াল রাখতে, আর উনি? সেই তো বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাল মেয়েটা আমার। একদিন একটু সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম আর ওমনি শুরু হয়ে গেল। মানে আমি না থাকলে একটা না একটা অঘটন ঘটতেই হবে! এদের নিয়ে আর সত্যিই পারিনা বাপু!

কথাগুলো বলতে বলতেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মা। মায়ের পিছু পিছু অরনীও চলে যায়।

আলভি ভাইয়া আমার সাথে বেশ কিছু সময় কথাবার্তা বলে সেও বেরিয়ে পড়ল নিজের কাজে। দুদিন পর আলভি ভাইয়ার পরীক্ষা! পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভবঘুরে হয়ে বেড়ানো, এটা কিন্তু মোটেও কাম্য নয়।

ঘরের মধ্যে এখন শুধু পড়ে রইল আহির। এতোক্ষণ যাবত নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করলেও এবার মুখ খুলল সে। আমার পাশে এসে বসে আহির বলল

-‘ এখন কেমন বোধ করছিস মেহুবুড়ি? নানাবাড়িতে দুদিন থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই অসুস্থ শুনে আমিও চলে এলাম খালামণির সাথে!

-‘ আগের চাইতে বেটার। আচ্ছা শোন, নানিআপু কেমন আছে এখন?

তপ্ত শ্বাস ফেলে আহির বলল

-‘ ঐ আগের মতোই রে। বৃদ্ধ মানুষ, এই সুস্থ এই অসুস্থ!

আহিরের কথাটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার। শৈশবের স্মৃতি গুলো মনে পড়ে ভীষণ। আমাদের কাছে ডিসেম্বর মানেই ছিল আনন্দের একটা মাস। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমরা সবাই মিলে বেরাতে যেতাম নানাবাড়িতে। আমরা খালাতো মামাতো ভাইবোনেরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠতাম আর তাতে নানাভাইও যোগ দিতেন। শীতের দিনে রান্নাঘরে বসে নানিআপু হাসিমুখে আমাদের জন্যে শীতের সুস্বাদু পিঠা বানাতেন! আর এখন সেসবই স্মৃতি! নানাভাই মারা গেলেন বছর খানিক হতে চলল। আর নানিআপু এখন শয্যাসায়ী। নানিআপুর মতো মামিমাও অবশ্য এই রেওয়াজটা ধরে রেখেছেন কিন্তু নানিআপুর মতো তো আর হয়না।

আহিরের ডাকে পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আহির পুনরায় ডেকে উঠে বলল

-‘ কি রে কি এতো ভাবছিস মেহুবুড়ি?

হালকা হেসে মাথা নাড়ালাম আমি।

অনেকক্ষণ যাবত বিছানায় শুয়ে থাকায় বিরক্ত হয়ে পড়লাম আমি। আবার ওয়াশরুমেও যাওয়া প্রয়োজন।এজন্য কিছুটা বল প্রয়োগ করে তাই বিছানা থেকে উঠতে নিলেই আবারও ধপ করে বসে পড়লাম আমি। জ্বর সেরে গেলেও মাথা ঝিমঝিম ভাবটা মেলায়নি এখনো। এজন্যই এমনটা হয়েছে। আমায় এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে দেখে আহির বিচলিত হয়ে বলল

-‘ এনি প্রবলেম মেহরুন? তোর সমস্যা হলে, তুই আমার সাহায্য নিতে পারিস।

আমি মাথা নাড়ালাম। বলে ফেললাম

-‘ আমি একাই পারব আহির। ঐ একটু মাথাটা চক্কর দিচ্ছিল আরকি।

আহিরকে বলতে বলতে এবার উঠে দাঁড়ালাম আমি। কয়েক কদম পা ফেলতেই আবারও মাথাটা ঘুরে উঠল আমার। পড়ে যেতে নিলেই খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেলল আহির। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল

-‘ তুই ঠিক আছিস তো মেহরুন?

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই কোথ থেকে আদ্রিশ ভাইয়া ছুটে এসে গম্ভীর গলায় বলল

-‘ শোনো আহির তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তাই তোমাকে আমি যথেষ্ট স্নেহ করি। তবে এমন কিছু করো না যাতে আমি রেগে যেতে বাধ্য হই।

আদ্রিশ ভাইয়ার এহেন বাক্যে আমি আহির দুজনেই হতভম্ব বনে যাই। আদ্রিশ ভাইয়া এবার কিছুটা ধমকের সুরে আহিরকে বলল

-‘ হাতটা ছাড়ো মেহরুনের। নেক্সট টাইম আমার সম্পদের দিকে হাত বাড়ালে, তোমার কিন্তু খবর আছে আহির!

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আহির দ্রুত হাতটা ছেড়ে দেয় আমার। আহির কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ ভাইয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বলে উঠল

-‘ ছোট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি কি এসব দেখার জন্য? খবরদার বলছি, এই আহিরকে যেন তোর আশেপাশেও না দেখি আমি। এর অন্যথায় হলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবেনা!

এতটুকু বলেই যেপথ দিয়ে এসেছিল সেপথেই আবার গটগট করে চলে যায় আদ্রিশ ভাইয়া। তার কথার ভাঁজে স্পষ্ট রাগের আঁচ পাওয়া যায়! তবে আচমকা ওনার এমন আচরণে আমি আর আহির দুজনেই একে অপরের দিকে হা হয়ে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

#চলবে~

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here