#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৬
ড্রয়িং রুমে আমরা সবাই মিলে গোল হয়ে বসে গল্প করছিলাম এমন সময় সবার মধ্যে থেকে আদ্রিশ ভাইয়া আমাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসল।
-‘ বল তো এমবিবিএস মানে কি?
-‘ আমি বলবো ভাই! এমবিবিএস মানে হচ্ছে মা বাবার বেকার সন্তান!
আদ্রিশের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ৩২ পাটি দাঁত বের করে কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে উক্ত কথাটি বলে উঠল আলভি।
সবেমাত্র পানির পটটা হাতে নিয়ে পানি খেতে যাচ্ছিল আদ্রিশ, এমন সময় ফট করে আলভির এহেন উত্তরে হাত থেকে পানির পট পড়ে যায় তার। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে থমথমে মুখে বলল
-‘ মানে আমায় দেখলে কি তোর বেকার বলে মনে হয় আলু! সবেমাত্র এমবিবিএসটা শেষ করলাম। নিশ্চয়ই এখনই কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে আমারে কেউ নেবে না। এখনও অনেক প্রসেসিং বাকি। এসব বললে তোদের একটার মাথাতেও ঢুকবে না। তাই আর বেকার বেকার বলে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি।
একে নাগারে এতোটুকু বলে মেঝে থেকে পানির পট উঠিয়ে, উঠে দাঁড়ায় আদ্রিশ। আলভি এগিয়ে এসে বলল
-‘ ভাই মজা করেছিলাম আপনার সাথে, রে’গে গেলেন নাকি?
-‘ আজকাল আমায় নিয়ে মজাও করছিস দেখি, বাহ শুনে ভালো লাগল খুব।
আলভি কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই, ওকে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ বলে উঠল
-‘ আচ্ছা শোন সবাই। আমার কিছু বলার আছে।
আমরা সবাই উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম তার পানে। তপ্ত শ্বাস ফেলে সে বলল
-‘ এবার অনেকদিনই তো বাড়িতে ছিলাম। এভাবে আর কতদিন! আমাকে তো আমার নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে তাইনা? আগামী কাল সকালেই তাই ফিরে যেতে হবে আমায়। তোদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো মিস করব ভীষণ!
এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলে থামল আদ্রিশ। আদ্রিশের আচমকা এমন কথার আগামাথাও বুঝলো না কেউ। আলভি তাই আদ্রিশের কাঁধে হাত রেখে বলল
-‘ ভাই কি হয়েছে আপনার? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ!
আদ্রিশ কিয়ৎক্ষণ নির্বিকার থেকে, ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। আলভিকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে, কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল
-‘ এমবিবিএস শেষ করেই তো একলাফে কার্ডিওলজিস্ট হয়ে যায় না কেউ। এখনো অারও ধাপ বাকি। সে উদ্দেশ্যেই আগের জায়গায় ফিরে যাব আমি। যদিও বাড়িতে থেকেও স্টাডিটা কনটিনিউ করা যেত কিন্তু এতে দুজনেরই কর্নসার্নট্রেট ব্রেক হতে পারে, সেইজন্যই এমন সিদ্ধান্ত! আশা করি বুঝতে পেরেছিস।
আলভি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। আদ্রিশ দৃঢ় চিত্তে পুনরায় বলে উঠল
-‘ তোর কিন্তু অনেক দায়িত্ব আলভি! আমার পরিবর্তে আমাদের বাপ চাচার ব্যবসাটা তুই দেখিস ভাই। কেননা পরিপূর্ণ ডাক্তার হওয়ার পর রোগী দেখব নাকি এসব ব্যবসা সামলাবো, বল তো? বাবাকে বোঝালেও তো মানতে চায়না। তবুও অনেক কষ্টে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি তাকে। আর নিশ্চয়ই তুই তোর দায়িত্বের হের ফের করবি না, এ বিশ্বাস আছে তোর প্রতি আমার।
আলভি মন দিয়ে শোনে আদ্রিশের কথাগুলো। হুট করে ভারী গলায় আলভি বলে উঠল
-‘ আপনাকে খুব মিস করব ভাই!
-‘ এমন একটা ভাব করছিস যেন মনে হচ্ছে আমি আর জীবনেও ফিরব না! ক’টা দিনেরই তো ব্যাপার।
এতোটুকু বলে হেসে ফেলে আদ্রিশ। আলভির কাঁধ চাপড়ে আবারও সে বলে উঠল
-‘ যা বললাম তা কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে পালন করা চাই!
আলভি আবারও মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। তা দেখে শুধু মুচকি হাসে আদ্রিশ কিন্তু মনে মনে যে তার অন্তর্দহন চলে!
আদ্রিশ ভাইয়া আবারও চলে যাবে শুনতেই একরাশ বিষন্নতায় মন ছেয়ে যায় আমার। আমি তাই সেখানে বসে না থেকে নিজের কক্ষে চলে এলাম। মাথাটা ভীষণ ধরেছে তাই মাথায় তেল দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাটিতে তেল ঢেলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে পড়লাম।
-‘ তোর মাথায় তেল দিয়ে দিবো আমি?
কক্ষে প্রবেশ করতে করতে উক্ত কথাটা বলে উঠল রিশতা। ওর দিকে ফিরে মাথা নাড়ালাম শুধু। ও এগিয়ে এলো আমার দিকে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তেলের বাটিটা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। আমার হাত থেকে নিতে গিয়ে হুট করে হাত ফোসকে মেঝেতে পড়ে গেল বাটিটা। তা দেখে আমি কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলাম
-‘ বোকা নাকি! সামান্য একটা তেলের বাটিও ধরতে পারিসনা?
আমার এমন তিরস্কারে রিশতা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
-‘ মেহুবুড়ি আসবো?
দরজার দিকে উঁকি দিতেই আহিরকে দেখতে পেলাম। অধরের কোণে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ালাম শুধু। আমার অনুমতি পেতেই ও চলে এলো। কক্ষে প্রবেশ করতে করতে পুনরায় বলে উঠল
-‘ তোর পছন্দের মিষ্টি নিয়ে এলাম আর তুই এখনো মুখেও তুললি না!
আহির কথার পিঠে কিছু বলার পূর্বেই রিশতা মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল
-‘ এদিকে এসো না আহির। ফ্লোরে তেল পড়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে।
এতোটুকু ঠিক ছিল তবে বিপত্তিটা ঘটল আহিরের দিকে চেয়ে চেয়ে ওকে সতর্ক করতে গিয়ে নিজেই চিত পটাং হয়ে পড়ে গেল। রিশতাকে পড়ে যেতে দেখে আগের বারের মতো আর আহির হাসলও না আবার চিংড়ি মাছ চিংড়ি মাছ বলে চেঁচালও না। ওর দিকে এগিয়ে এসে টেনে তুলল ওকে। আমিও সাহায্য করলাম। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বিচলিত হয়ে রিশতার উদ্দেশ্যে আহির বলল
-‘ তুমি ঠিক আছ রিশতা? কোথাও ব্যথা পেয়েছো কি?
‘না’ সূচক মাথা নাড়িয়ে, পূর্বের ন্যায় মাথা নত করে নেয় ও। আহিরের সামনে আবারও পড়ে গিয়েছে ভাবতেই লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে ও। আহির কিয়ৎক্ষণ বসে রয় ওর পাশে। টুকটাক ভাব বিনিময় করে চলে যায় ও। যাওয়ার পূর্বে আবারও রিশতার উদ্দেশ্যে বলে যায়
-‘ নিজের খেয়াল রেখো রিশতা। কোথাও ব্যথা পেয়ে থাকলে মেহরুনকে বলো কেমন! আজ আসি তাহলে। আর মেহুবাড়ি চলি তবে, আবারও দেখা হবে।
মেঝেতে পড়ে থাকা তেলটুকু পরিষ্কার করে নিয়ে, আহিরকে বিদায় জানিয়ে পুনরায় নিজের কক্ষে চলে এলাম। পায়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে রিশতা। তাই তেল গরম করে ওর পায়ে মালিশ করে দিলাম খানিক সময়। অরনীও চলে এলো কক্ষে। ওর মন খারাপ ভীষণ। আমি আর তাই ঘাটালাম না ওকে। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমের আর সহজে ঠাঁই মিলল না আমার নেত্রপল্লবের কোণে।
একটা নির্ঘুম রাত্রি যাপনের পর অবশেষে সূয্যি মামার দেখার মিলল! বেলকণিতে বসে ভোরের আলো ফুটতে দেখছিলাম এতোক্ষণ যাবত। কয়েলও ফুরিয়ে এলো এতোক্ষণে। কয়েল না জ্বালালে হয়তো মশায় খেয়ে ফেলত আমায়!
দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম আমি। ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলাম ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিশ ভাইয়া। সাথে আলভি ভাইয়া, মা, বাবা, চাচ্চু আর মামনি। মামনির চোখে অশ্রু টলমল করছে। হয়তো আবারও ছেলেকে ছেড়ে থাকতে হবে, এ কথা ভেবেই তার এ দশা!
আমায় দেখে মা অবাক হয়ে বলে উঠলেন
-‘ এই সাত সকালে উঠে পড়েছিস! কানের ধারে ড্রাম বাজালেও তো ঘুম ভাঙে না তোর! আজ সূর্য কোন দিয়ে উঠল! আমি তো নিজের চোখও বিশ্বাস করতে পারছি না!
এতোটুকু বলে চোখ ডলে আবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন মা। সকাল সকাল মায়ের এমন কান্ড কারখানায় উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে ফেলে। বাদ যায়নি আদ্রিশ ভাইয়াও। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে সে আমার উদ্দেশ্যে বলে বসল
-‘ মেহুপাখি চলে যাচ্ছি আমি। আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। তুই কিন্তু ভালোভাবে পড়াশোনা করবি, একদম ফাঁকিবাজি করবিনা। এসএসসিতে গোল্ডেন পেয়েছিস বলে ইন্টারে গা ভাসিয়ে দিস না যেন! ইন্টারে কিন্তু হিউজ পড়া, সময় কম। এসএসসির মতো এতো সময় পাবিনা, মাত্র আঠারো মাস সময়! আর যেহেতু সাইন্স নিয়ে পড়বি, তাই বি কেয়ারফুল। আর হ্যাঁ মুখস্থ নয়, মন দিয়ে বুঝে বুঝে পড়বি কেমন! আসি তাহলে।
আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে চেয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। তারপর ভারী গলায় বললাম
-‘ কথা দিলাম, ভালোভাবেই পড়াশোনা করব। তবে একটা কথা। আমায় না সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিল, এটাই কি তবে আমার সারপ্রাইজ?
আমার কথায় মলিন হেসে সে বলল
-‘ তবে তুই যা ভাবছিস তাই।
তার কথায় হাসলাম শুধু। কন্ঠে কিছুটা বিষাদ ঢেলে বললাম
-‘ আপনার সারপ্রাইজে আমি সত্যিই সারপ্রাইজড। এমন সারপ্রাইজ আমি সারাজীবন মনে রাখব ভাইয়া।
আমার কথার পিঠে আর কোনো কথা বাড়ায় না সে। শুধু এক চিলতে হাসি উপহার দিয়ে নিজের গন্তব্যের পথে পা বাড়ায় সে। পেছনে আর ফিরেও তাকায় না সে।
আদ্রিশ ভাইয়া চলে যেতেই মামনি কেঁদে ওঠেন। সামলে নিলাম মামনিকে। নিজেকেও ধাতস্থ করে নিলাম। মনে মনে পণ করলাম পড়াশোনাটা ভালোভাবেই করব আমি। পরিশ্রমীরা কখনো হেরে যায় না। আমি হবো সেই পরিশ্রমী ব্যক্তি। নিজের লক্ষ্যকে স্থির রেখে সে পথেই পদার্পণ করব। যত বাধা বিপত্তিই আসুক না কেন আমি পারব, আমায় পারতেই হবে! সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে মাঝে মাঝে দূরত্বেরও প্রয়োজন পড়ে। আমাদেরও দূরত্বের সত্যিই প্রয়োজন ছিল। নইলে কেউ-ই হয়তো আশানুরূপ ফলাফল পেতাম না। আবারও দেখা হবে। ভাগ্য সহায় থাকলে ভালোকিছুই হবে ইনশাআল্লাহ।
#চলবে~
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/