হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব২৭

0
319

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৭

চোখের নিমেষেই জীবন থেকে চলে গেছে আড়াইটা বছর! এই আড়াই বছরে বদলেছে অনেককিছুই। সেই ছোট্ট মেহু বড় হয়েছে এখন। চঞ্চলতা ছেড়ে এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে তবুও তার চঞ্চলতার আধিপত্যের দেখা মেলে। এদিকে অরনীরও বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় মাস খানিক হতে চলল! প্রণয়ের সম্পর্কের থেকেই তা রূপ লাভ করে বৈবাহিক সম্পর্কের। আরাভের সাথে প্রণয় থাকলেও পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হয়েছিল তাদের।

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ যাবত এসব ভাবছিলাম আমি। মনের কোণে নানান রকম চিন্তারা আঁতিপাঁতি করছে। আজ ইন্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে আমার! এসএসসির মতো ইন্টারেও জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলাম তবে গোল্ডেন হয়নি। বায়োলজিতে প্লাস মিস করেছিলাম। আর তাছাড়াও আমি বরাবরই ম্যাথে ভালো। তাই মেডিক্যাল বাদ দিয়ে ইন্জিনিয়ারিং এ পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাগ্য সহায় থাকলে চান্স হতেও পারে আবার না-ও পারে।

কাঁধে কারও শীতল স্পর্শে পেতেই একপলক চাইলাম সেদিক পানে। তপ্ত শ্বাস ফেলে পাশে থাকা ব্যক্তিটি বলে উঠল

-‘ টেনশন করছিস না মেহু। ইন্জিনিয়ারিং এ টিকে যাবি দেখিস।

আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম শুধু। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ব্যক্তিটি এবার আমায় নিজের দিকে ফিরিয়ে, আমার গালে দুহাত ঠেকিয়ে বলল

-‘ আমার উপরে এখনও রেগে আছিস বুঝি?

তার প্রশ্নের কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমার এমন ব্যবহারে মানুষটা ব্যথিত হয় ভীষণ। ভারী কন্ঠে তাই পুনরায় সে বলে উঠল

-‘ আমাদের ভালোর জন্যই তো এমন ডিসিশন নিতে হয়েছিল তখন। একবার ভেবে দেখ আমি এখানে থেকে গেলে তুই কি কোনোভাবে পড়াশোনায় কর্নসার্নট্রেট করতে পারতিস আর না আমি পারতাম। এতোকিছুর পরেও ভুল বুঝলি আমায়?

আমি তবুও নির্বিকার চিত্তে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আপাতত অনর্থক বাক্যচয়নে অনিচ্ছুক আমি।

এরই মাঝেই কোথ থেকে ছুটে এসে আলভি ভাইয়া বেশ উচ্ছ্বাসের সহিত বলে উঠল

-‘ তোমরা সবাই দেখো আমাদের মেহু চান্স পেয়ে গেছে!

এই একটা কথা শুনতেই অনেক বেশি উৎফুল্ল হয়ে পড়লাম আমি। ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলাম আলভি ভাইয়াকে। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাইয়া বলে উঠল

-‘ বলেছিলাম না মেহু, তুই চান্স পাবি। ভাই হিসেবে আমার আজ ঠিক কতটা গর্ব হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না তোকে! আমার বোনটার আজ থেকে নতুন পরিচয় যুক্ত হলো তবে!

হেসে ফেললাম আমি। আজ আমি ভীষণ খুশি। আজকের এই দিনটার জন্যই তো অপেক্ষার প্রহর গুণতাম। অবশেষে অবসান ঘটল তবে!

মা, বাবা, চাচ্চু, মামনি খুশি হলো ভীষণ। মা আমায় জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। কান্নার সুরে বললেন

-‘ এই দুই আড়াই বছর তুই যে পরিশ্রমটা করেছিলি, আমি সবসময় তোর জন্য দোয়া করতাম মা। যেন ভালোকিছুই হয় আমার মেয়েটার সাথে। আর আজ সেই আনন্দের দিনটা দেখতে হলো। আমার লক্ষ্মী মেয়েটা। জীবনে অনেক বড় হবি মা!

আর বাবা তো খুশিতে বলেই বসলেন, ‘আমার মেয়ে আমার গর্ব।’

মা বাবা দুজনকেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আজ আমার চোখেমুখে প্রাপ্তির আনন্দ! সবাই শুধু আমার এই সাফল্যটাই দেখবে কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা আমার কষ্টগুলো, কতটা ঝড় ঝঞ্জা বয়ে গেছে আমার উপর দিয়ে তা কখনো কেউ দেখবে না। চার দেয়ালের মাঝে আঁটকা পড়ে থাকা আমার চাঁপা আর্তনাদগুলো কেউ খতিয়ে দেখবে না। সবাই আমার বাইরের রূপটাই দেখবে ভেতরের ক্ষতগুলো নয়!

আদ্রিশ ভাইয়া এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল

-‘ কংগ্রাচুলেশনস মেহু! বেস্ট উইশেস ফর ইউ!

তার কথায় এক পলক তাকিয়ে আবারও চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। স্বার্থপরের মতো যে মানুষটা কিছু না বলেই চলে যেতে পেরেছিল, তার সাথে আর কি কথা থাকতে পারে আমার? হোক সে ভালোর জন্যই কিন্তু আমায় একটাবার বলে যেতে তার কিসে বিঁধেছিল।

পরবর্তীতে অবশ্য আদ্রিশ ভাইয়া বিসিএস দিয়েছিল পাশাপাশি এফসিপিএস ডিগ্রিও অর্জন করেছিল। এখন একটা সরকারি হাসপাতালে সে জয়েন করেছে।

যথারীতি বাবা, চাচ্চু আর আলভি ভাইয়া মিলে মিষ্টির দোকানে চলে যায়। মা আর মামনি যায় সংসারের হেঁশেল সামলাতে। আর ওদিকে রিশতা এখন ভার্সিটি কোচিং-এ ব্যস্ত। ড্রয়িং রুমে শুধু আমি আর আদ্রিশ ভাইয়াই পড়ে রইলাম।

নিরবতা ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে আদ্রিশ ভাইয়া ভারী গলায় বলে উঠল

-‘ সবই তো ঠিক ছিল তবে আজ কেন এতো দূরত্ব?

-‘ আপনি নিজেই এই দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন, আমি নই!

আমার সোজাসাপ্টা উত্তর। আদ্রিশ ভাইয়া হোঁচট খায় আমার এহেন জবাবে।

-‘ আচ্ছা দূরত্ব যখন আমিই তৈরি করেছি তখন আমিই নাহয় মিটিয়ে দিব। তবুও ভুল বুঝিস না আমায়।

অস্ফুটস্বরে উক্ত কথাগুলো আওড়ালেও শুনতে অসুবিধে হয়না আমার। তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বাঁকা হাসলাম শুধু। এবার আমি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম

-‘ চিন্তা নেই, আপনার জন্য এবার একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসব আমি। হাজার হোক আমাদের ডাক্তার ভাইয়া বলে কথা। তো এমন ডাক্তার ছেলের জন্য মেয়ের অভাব পড়বে না এটলিস্ট! দরকার পড়লে বিজ্ঞাপন রটিয়ে দিব। তবুও আপনার জন্যে আমি লাল টুকটুকে বউ এনেই তবে ছাড়ব!

হুট করে আমার এহেন কথায় আদ্রিশ ভাইয়া বোকা বনে যায়। তার মুখের এমন শ্রী দেখে আমার হাসি পায় ভীষণ। এ কয়দিনে উঠতে বসতে যে পরিমাণে ঠ্যাস মেরেছি, বেচারা ভুল স্বীকার করতে বাধ্য! তবুও চোখেমুখে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বসে রইলাম আদ্রিশ ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষায়। আদ্রিশ ভাইয়া এবার গলা ঝেড়ে থমথমে গলায় বলল

-‘ বাহ্ আমার ডায়লগ আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছিস! আচ্ছা সময়মতো আমিও দেখে নিব।

এতোটুকু বলেই বাইরে চলে যায় সে। আমি হেসে ফেললাম এবার। ফোনটা হাতে নিয়ে আহিরকে ফোন দিলাম। ফোনের অপর প্রান্ত হতে ভেসে এলো

-‘ আরে মেহুবুড়ি যে কি অবস্থা তোর?

-‘ ভাই কুয়েটে এ চান্স পেয়েছি আমি! ভালোই হয়েছে বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকতে পারব, দূরে কোথাও যেতে হবেনা আমার।

-‘ ওয়াট অ্যা গুড নিউজ! কংগ্রাচুলেশনস সিস! এবার আমার পালা। দোয়া কর যেন এক চান্সেই ঢাকা ভার্সিটিতে হয়ে যায়।

আরও কিছুক্ষণ ভাব বিনিময় করে ফোন রেখে দিলাম আমি। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার কথামতো আহির এসে হাজির হয় আমাদের বাসায়। এর মাঝে রিশতাও ফিরে আসে। দুজন দুজনকে দেখে বেজায় খুশি হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, ওদের মাঝে দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক চলছে! সবার জীবনেই তো প্রণয়ের বসন্ত নেমে এলো, আমার জীবনটাই কেন এমন অঁমানিশার আঁধারে ছেয়ে গেল তবে!

তিনজন মিলে বেশ অনেকক্ষণ যাবত আড্ডা দেওয়ার পর তাড়া দেখিয়ে আহির উঠে যায়। ওকে আরও কিছু সময় বসতে বললাম কিন্তু বসল না ও।

আহিরকে বিদায় দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলাম। যাওয়ার পূর্বে হাসতে হাসতে বলে বসল

-‘ আমি কিন্তু আবারও আসব তবে জামাই সেজে!

আমি, রিশতা হেসে ফেললাম দুজনেই তবে রিশতা হয়তো কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। আহিরও মাথা চুলকে হেসে ফেলে। এরই মাঝে আদ্রিশ ভাইয়া ফিরে আসে। আমাদের দিকে সে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল খানিক সময়।

আচমকা বলিষ্ট হাতের শক্ত বাঁধনে আমার কোমল হাত আঁকড়ে ধরে আদ্রিশ ভাইয়া। চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে থাকে আমার পানে। ওনার এহেন অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি রইল না আমার। আগুনে ঘি ঢালার উদ্দেশ্যে তাই বাঁকা হেসে বললাম

-‘ পছন্দ হয়নি আপনার জামাইবাবুকে?

-‘ রাখ তোর জামাইবাবু। ঘাট হয়েছে আমার! আর জীবনে কোনদিনও আমি মনের ভুলেও ওসব উল্টা পাল্টা বকবো না আর না ওসব ছাইপাঁশ অভিনয় করব। বহুত নাটক হয়েছে আর না।

চিবিয়ে চিবিয়ে এতোটুকু বলে থামল সে। আমি কুটিল হাসলাম শুধু। অনেক জ্বালিয়েছ, এখন বোঝ কেমন লাগে! তবে আমার এই হাসি বেশিক্ষণ স্থির হলো না, আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে সে বলল

-‘ তোকে নিয়ে আর কোন রিস্ক নিতে চাই না আমি। এবার একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ছাড়ব!

ওরা চলে যেতেই আহির আর রিশতা হাতে হাত মিলিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। রিশতা এবার বাঁকা হেসে বলল

-‘ মেহু তুই বোধহয় আজ শেষ!

#চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here