রাঙিয়ে_দাও #পর্ব(১১) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
231

#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব(১১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা ঋতুতে প্রেমময় ঋতুরাজ বসন্তকাল।সময়ের মতোই প্রান্তির মনের ঋতুটা-ও একদম প্রেমময় রমরমা বসন্তকাল চলছে।সেখানে-ও কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল ফুলের ন্যায় লাল,সাদা,হলুদ বিভিন্নরঙা পুষ্পে রঞ্জিত হয়ে আছে তার মন।তবে বসন্তের প্রেমিকের ন্যায় তার মনের মধ্যে রাঙিয়ে উঠা রঞ্জিত সেই ফুলগুলো সদরে গ্রহন করার প্রেমিক পুরুষটার দারুণ অভাব।অভাব বলে অভাব!একেবারে ধুধু মরুভূমির মধ্যে একফোঁটা জল পাওয়ার মতোই সংকটময় অভাব!কেনো যে তার একান্ত পুরুষটা বসন্তের প্রেমিক পুরুষের মতো হলো না?কেনো একটু প্রেমিক স্বভাব না হয়ে অপ্রেমিকের মতো কাঠখোট্টা স্বভাব হলো তার?বুঝে পায় না প্রান্তি।মানুষটা এরকম কাটখোট্টা স্বভাবের নাহয়ে একটু প্রেমিক পুরুষের মতোই তার মনের খবরটা রাখলে কি এমন ক্ষতির বোঝা বইতে হতো তাকে?এইযে সেই পুরুষটার প্রেমে মরমর অবস্থা এখন তার।এতো এতো অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও তারপ্রতি মন বশিভূত হয়ে পড়ল প্রান্তির।সেই খোঁজ আছে কি ওই কাঠখোট্টা নিষ্ঠুর হৃদয়হীন মানুষটার।

সেদিন ওই ঘটনার পর কলেজে বসে তাঁকে কত বকলো অথচ বাড়িতে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো মানুষটা।প্রান্তি মনে করেছিলো বাড়িতে গিয়ে তাকে মানুষটা না জানি কতশত বকবে।যেভাবে কলেজে বসে ধমকালো বকলো
অথচ মানুষটা বাড়িতে গিয়ে একটুও টুঁ-শব্দ-ও করেনি।বিষয়টাতে খুব ভালো লাগার কথা থাকলে-ও,প্রান্তির মোটেও ভালো লাগিনি।কেনো জানি ইদানীং মন উল্টো গাইছে।যা আগে চাইতো,এখন মনমাঝি উল্টো চাইছে। এই উল্টো চাওয়াতেই জেনো সে ইদানীং ভিষণ ভিষণ খুশি।তবে তাঁকে খুশি করতে যে বরাবর ওই অপ্রেমিক মানুষটা খুবই নারাজ।বান্দা আগে-ও নারাজ ছিলো আর এখনো নারাজ।নাহলে কি আর সেই দিনটার পর কতোগুলো দিন পার হয়ে গেলো অথচ মানুষটা তার খবরটা একটু-ও রাখেনা।প্রেমিক না-হয়ে না-হয় খোঁজ নাই রাখলো।স্বামী হয়ে তো একটু খোঁজ রাখতেই পারে তাঁকে। অথচ মানুষটার এমন একটা ভাব,প্রান্তি বলে যে তার জীবনে কেউ আছে এটা জেনো মানুষটার খেয়ালই নেই।সে জানেই না প্রান্তি কে?

দেখা হচ্ছে, নজরে নজর পড়ছে।আবার পূর্বের ন্যায় নজর মিলিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু ওই মানুষটার নজর মিলিয়ে গেলেও তার বেহায়া নজরটা মানুষটার থেকে কিছুতেই মিলিয়ে নিতে পারছেনা প্রান্তি।হঠাৎই কেনো এমন বেহায়া হয়ে গেলো মন, বুঝে আসেলো না তার।শুধু কি একটুআধটু বেহায়া হয়েছে মন?নাহ,একটুতো নয় বেশ নির্লজ্জতার পরিচয় দিচ্ছে সে।এই যে মানুষটার সাথে দেখা হলে-ও কথা হচ্ছে না।আর এই কথা না হওয়াতে মন আরও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে।ইদানীং মানুষটার ওই গম্ভীর স্বরের কথাগুলো শুনতে যে ভিষণ ইচ্ছে করে তার।আর তাঁকে একটু দেখার তৃষ্ণাতো তার সকল অনুভূতি পার করে দিয়েছে।যে মানুষটাকে আগে ভালো লাগতোনা,হঠাৎই সেই অপছন্দনীয় মানুষটাকে কেমন ভালো লাগতে শুরু করল।হুটকরে কি হয়ে গেলো? কেমন মরমর কঠিন প্রেমরোগে মরলো তার বেহায়া মন?মরলো তো মরলো,ওই কাঠখোট্টা মানুষটার প্রেমে কেনো মরলো?যে মানুষটার তার খবরে পুরোই বেমালুম বেখবর!

—কি হয়েছে তোর?এতো কি ভেবে চলেছিস বল-তো?দুটো সিএনজি ফাঁকা চলে গেল সেদিকে খেয়াল আছে তোর?আজ কি বাড়িতে ফিরবি না না-কি?

মন আরও খারাপ হয়ে গেল প্রান্তির।কেউ তাকে বোঝে না।এই মেয়েটা আগে তাকে কত বুঝতো।এখন একটুও বোঝেনা।এই যে তার মন ভিষণ ভিষণ খারাপ।একটু-ও কি তার আভাস চোখমুখে পড়ছেনা।সেটা কি ওই নিষ্ঠুর মানুষটার মতো এই মেয়েটাও খেয়াল করছে-না।মনটা এবার আরও বিষন্নতায় ডুবলো প্রান্তির।তার বিষয়ে সবাই কতো বেখেয়ালি।

—তুই-ও এখন আর বুঝিস-না আমাকে।তুইও মানুষটার মতোই ভিষণ খারাপ!

—কি হয়েছে তোর?এরকম কেনো বলছিস?

প্রশ্নটা করলেও হঠাৎ প্রান্তির অভিমানী অভিযোগে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকা বনে গেলো আবিশা।কলেজ ছুটি হয়েছে সেই কখন।খালি সিএনজির উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আছে তারা।অথচ পরপর দুটো খালি সিএনজি চলে গেলো।প্রান্তির এদিকে কোনো ধ্যান নেই।বিধায় কথাটা বলেছে সে।তারজন্য এরকম কথা বলছে কেনো মেয়েটা?আর সে বাদে ওই মানুষটা আবার কে?কোনো ভাবে কি সে প্রহান ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করছে?দুষ্ট হাসি প্রশ্রয় নিলো আবিশার ঠোঁটের কোণে।ফের প্রান্তির শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো।

—কিরে জানু,বরের সাথে মান অভিমানের গীত চলছে নাকি?সামথিং সামথিং…

—আগে কাছ থেকে সর।আর কোনো সামথিং সামথিং নয়।সব নাথিং।

নাক ফুলিয়ে প্রান্তির বলা কথাগুলো শুনে মুখের দুষ্ট হাসিটা আরও প্রগাঢ় হলো আবিশার।ফের বললো।তাহলে তো অবশ্যই সামথিং সামথিং।আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের প্রানোরানি প্রহান মাহমুদের প্রেমে পড়ে ডুবে যাচ্ছে।যদি-ও প্রহান মাহমুদ বলে কথা,প্রেমেতো ডুবে নয় ডুবে মরে যাওয়ার কথা।

অসহায় পানে আবিশার দিকে তাকালো প্রান্তি। একটু কথায় মেয়েটা কেমন তার মনের লুকানো অনুরক্তিটা বুঝে গেলো।অথচ সারাদিন ওই মানুষটার সামনে ঘুরছে ফিরছে সে কিন্তু মানুষটা তাকে বুঝছেনা।তারসাথে কোমন অবুঝ বালকের চেয়েও অবুঝ ব্যবহার করছে।

—অপছন্দনীয় মানুষটা এতো তাড়াতাড়ি পছন্দনীয় হয়ে উঠলো ব্যাপার স্যাপার কি বান্ধবী?যদি-ও প্রহন…

আবিশার কথার আর উত্তর দেওয়া হয়ে উঠলো না প্রান্তির।তারআগে দুজনের সামনে বাইক সমেত হাজির হয়ে গেলো প্রহান মাহমুদ।আবিশা ভড়কে গেলে-ও কপাল কুঁচকে গেলো প্রান্তির।বান্দাকে স্মরণ করতে না করতেই বান্দা হাজির।এতো সুসম্পন্ন তার ভাগ্য নয় তবে?আর এখনো ভার্সিটি টাইম শেষহতে অনেক দেরী।তবে বান্দা এখানে কি করছে?তারতো পৃথিবীর সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ভার্সিটি আর গভীর মনোযোগে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা।এসব ছাড়াতো বান্দা চোখে কিছুই দেখতে পায়না।নজরে পড়েনা তার।তবে বান্দার এখানে কি চাই?

—দাদিআম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।তোকে নিয়ে যেতে বলেছেন।গাড়িতে উঠ।

মানেটা কি?কলেজ আসার সময় সে তো নানিআম্মাকে সুস্থ দেখে আসলো প্রান্তি।এমনকি বাসার পাশে হিমানী আপুর দাদি অসুস্থ সেখানে-ও উনাকে যেতে দেখলোো।তবে হঠাৎ আবার কখন কি করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন?।প্রান্তিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রহান হয়তো ব্যাপারটা বুঝলো।

—তোর দাদিআম্মা অসুস্থ৷ হয়ে পড়েছেন।ফুপা ফোন দিয়ে আমাকে তোকে একটু নিয়ে যেতে বললেন।দাদিআম্মা নাকি বারবার তোর কথা বলছেন। দেখতে চাইছেন তোকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রান্তি।দাদিআম্মা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন।প্রান্তির মা মারা যাওয়ার পরে কিছুতেই তিনি প্রান্তিকে তার মামা মামির কাছে তাকে রাখতে রাজি হন নি।বলেছিলেন,মা মারা গেছে তো কি হয়েছে নাতনীকে তিনি কোলেপিঠে করে মানুষ করবেন।যদিও প্রান্তিকে নিয়ে মায়ের কথা দেওয়ার বিষয়টা দাদিআম্মা তখনও জানতেন না।পরে বিষয়টা জানার পর মানতে রাজি হয়েছিলেন।তবুও অনেক বুঝানোর পরে।কিন্তু প্রান্তি বুঝতে শেখার পর তিনি আবারও প্রান্তিকে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন।তবে ততোদিনে প্রান্তি-ও বড়আম্মা বলতে আর কাউকে বুঝত না বিধায় তাকে ছেড়ে অন্যত্র থাকার কথা ভাবা মানেই নিজের মায়ের মমতাকে ছাড়া।যা কখনোই প্রান্তির জন্য সম্ভব্য ছিলোনা।আর এই বিষয়ে প্রান্তির দাদিআম্মাকে তার বাবাও অনেক বুঝিয়ে ছিলেন।

দাদিআম্মা বুঝলেও উনার কথা ছিলো।উনার বংশের একমাত্র ছেলের প্রথম বংশধর প্রান্তি।তাই সে ছেলে হোক বা মেয়ে।সেই বংশধরকে তিনি অন্যত্র মানুষ হতে দেবেন না।উনাদের কি কম আছেন নাকি,যে মা নেই উনার একমাত্র ছেলের সন্তান অন্যত্র পেলেবেড়ে মানুষ হবে। মা নেই তো কি হয়েছে তিনি আদর যত্ন দিয়ে নানতিকে মানুষ করবেন।কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে কি দেড় বছরের বাচ্চাকে সবদিকে সামলিয়ে রাখা উনার দ্বারা সহজ কথা ছিলো।যাই হোক তবুও প্রান্তির বাবা উনাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মানিয়ে নিয়েছিলেন।

তবে প্রান্তির এই হঠাৎ বিয়েটা তিনি মানতে পারছেননা।এটা প্রান্তি ফোন আলাপে উনার কথায় বুঝেছেন।ওই বাড়িতে যাতায়াত কম থাকলেও যোগাযোগ প্রতিনিয়ত চলে প্রান্তির।সত্যি বলতে ওই বাড়ির সবাই তাকে খুবই ভালোবাসে।এমনকি নতুন আম্মাও।যদি-ও তিনি কম কথা বলেন।তবুও সে গেলে যত্নে ক্রুটি করেন না।যাই হোক দাদিআম্মা তার এই হঠাৎ বিয়েটা মানতে এজন্য নারাজ,কারন তিনি নাকি চাইছিলেন প্রান্তির মেজো ফুফুর একমাত্র ছেলের সাথে প্রান্তির বিয়ে হোক।যে ছেলে আপতত দেশের বাহিরে পড়াশোনা করছে।ফুফুর সাথে কথা বলে রেখেছেন সে আসলেই নাকি দাদিআম্মার ইচ্ছে অনুযায়ীন তারসাথে প্রান্তির বিয়ে দেবেন তিনি।এমনই ইচ্ছে পোষন ছিলো উনার।বিধায় তিনি তার এই হঠাৎ বিয়ের একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন।

—কি হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?উঠে বস।

ভাবনা ছেড়ে আবিশার দিকে তাকালো প্রান্তি।একবার জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা তাদের সাথে যাবে কিনা।আবিশা সঙ্গেসঙ্গে মানা করে দিল।হয়তো প্রহান মাহমুদ না থাকলে মেয়েটা তাঁকে সঙ্গ দিতে ভুলতো না বা প্রহান মাহমুদ জায়গায় অন্য কেউ হলেও মানা করতো না।

ধীরেসুস্থে প্রান্তি একটু দূরত্ব বজায় রেখে বাইকে উঠে বসলো।যদিও মানুষটাকে নিয়ে মনের অনুভূতি ভালো লাগার হলেও মানুষটা সামনে আসলে তা অদ্ভুতভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়।বরং সে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়।সেভাবেই চলার চেষ্টা করে।প্রান্তি উঠে বসতেই স্বাভাবিক গতিবেগ রেখে বাইক ছাড়লো প্রহান।কিছুদূর যেতেই বললো।

—আমাকে ধরে বস।না-হলে পড়ে যাবি।সামনে রাস্তা ভালো না।

বাইক চলায় মানুষটা স্টুডেন্ট লাইফ থেকে অথচ এই প্রথম প্রান্তি তার বাইকে উঠলো।প্রহান কথাটা বলতেই নিশ্চুপ মেনে নিলো সে।এমনিতেই মন দ্বিরুক্তি করতে চাইলোনা।নিজের কোলের মধ্যে গুঁজে রাখা হাতটা বাড়িয়ে পুরুষালী কোমর ভেদ করে প্রহানের পেটের উপর হাতটা রেখে আলতো হাতে শার্টটা চেপে ধরলো প্রান্তি।সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো তার।অথচ আঁকড়ে ধরা মানুষটা কেমন নিশ্চল।

.

সেখান থেকে ঘন্টাখানিক বাদে কাঙ্ক্ষিত বাড়িটা তারা পৌঁছে গেলো।সাদা রঙচটা তিনতলা বাড়িটায় প্রবেশ করতেই ভালো-মন্দ আলাপের ঝড় বয়ে গেলো।প্রান্তি এবাড়িতে মাঝেমধ্য আসলেও প্রহানের কোনো অনুষ্ঠান ব্যতিত এবাড়িতে আসা হয়না।তবু-ও খুবই কম।আর আসলে-ও প্রান্তির মামাতো ভাই হিসাবে।আজ জামাই হিসাবে এই বাড়িতে পদার্পণ তার।খাতির যত্নটা-ও তদ্রূপ করলো বাড়ির সবাই।এখানে এসেই প্রথমেই প্রান্তির দাদিমার সাথেও ফর্মালিটি কথাবার্তা সেরে নিয়েছিলো প্রহান।বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন কারনে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি।এখন মোটামুটি সুস্থ তিনি।

দুপুরে জামাইয়ের খাবার আয়োজন চলছে।আপতত নাস্তাপানির আপ্যায়ন পর্ব ছেড়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে প্রহান।শ্বশুর আর জামাইতে টুকিটাকি গল্প করে চলেছে।ড্রয়িংরুমের পাশ ঘেঁষে রুমটা প্রান্তির দাদিআম্মার।সেখানে বেডে শুয়ে আছেন তিনি আর তার পাশে বসে আছে প্রান্তি।রুমের মধ্যে কি কথা হচ্ছে মোটামুটি সবই কানে আসছে শ্বশুর জামাইয়ের।তবে দুজনের ভাব এমন একটা সেদিকে জেনো তাদের কান নেই।

—আমি চেয়েছিলাম আহান নানুভাইয়ের সাথে তোমার বিয়েটা হোক দাদুমনি।শুধু ছেলেটা পড়াশোনা করে দেশে আসার অপেক্ষা করছিলাম।কিন্তু তোমার বাবা করলোটা কি?আমাকে না জানিয়ে তোমার বিয়েতে মত দিয়ে দিলো।এমনকি বিয়েও দিয়ে দিলো।কাজটা ঠিক আমার মনপুত হলোনা।

এতো সময় দাদিআম্মার স্বাভাবিক কথাগুলো নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো প্রান্তি।হঠাৎকরে এই প্রসঙ্গে কথা বলায় চমকে ড্রয়িংরুমের দিকে তাকাল সে।মানুষটা একমনে তার বাবার কথা বলে চলেছে।মনে হচ্ছে এদিকে খেয়াল নেই।

—তোমার মেজো ফুফুর একমাত্র ছেলে ছিলো ,সংসারে কোনো ঝামেলা ছিলোনা।আর সবদিক থেকে নানুভাই ও তোমার যোগ্য ছিল।দেখতে শুনতে লেখাপড়ায় অথচ আমি যেটা চাইলাম ভাগ্য মানলোনা।বিয়েটা হলে তোমার ফুফুও নিজের মেয়ে মতো করে রাখত তোমায়।কতো ভালো হতো।তুমিও কতো ভালো থাকতে।

দাদিআম্মার কথার প্রেক্ষিতে কি বলবে খুজে পেলো না প্রান্তি।শুধু নিশ্চুপ দাদিআম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে গেলো।সে দস্যিপনা দূরন্ত সবকিছু ওবাড়িতে।এ বাড়িতে সে বরাবর নিশ্চুপ।কেমন জেনো নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনা এবাড়িতে।বিধায় কারও মুখেমুখে কথা বলা।আদর ভলোবেসে ওবাড়ির সবার মতো সবাইকে নিজের ভেবে আবদার করা,সহজ হয়ে কথা বলা,দূরন্তপনা করা এগুলো ঠিক হয়ে উঠে না প্রান্তির।

—তোমার মেজোফুফুও মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন তোমার বাবার উপর।সে-ও কতো আশা করেছিলো,তোমাকে ছেলের বউ করবে বলে।কিন্তু তা আর হলো কৈ।

বৃদ্ধা মহিলা ঘনোঘনো দু’বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ফের ধীর গলায় বললেন–তবে যা হয়ে গেছে তা তো গেছেই। এখন তুমি সুখে শান্তিতে থাকলেই ভালো।আমি দোয়া করি তুমি সবসময় ভালো থাকো।সুখে থাকো।

—-আমি খুবই ভালো আছি দাদিআম্মা।আমার কখনো মনে হয়না,আমি ওই বাড়ির মেয়ে নই। বড়আম্মা এটা আমাকে কখনোই মনে করতে দেন না,শুধু বড় আম্মা নয় ওবাড়ির সবাই কেউই সেটা বুঝে দেন না।আর দেন নি -ও কখনো।আর সম্পর্ক আরও একটা যখন তৈরী হয়েছে ইনশাআল্লাহ সামনে আমি আরও ভালো থাকবো।

ওবাড়ির কারও সম্পর্কে কাউকে কখনো ভালোমন্দের জাস্টিফাই দিতে চায়না প্রান্তি।মানুষগুলো একান্ত তার।তাদের ভালোমন্দও সব নিজের মনে করে সে।বিধায় তাদের সম্পর্কে অন্যকে জাস্টিফাই দেওয়া নিজের ভিষন অপছন্দনীয়।সেখানে মানুষগুলোর তো তুলনায় হয়না।তাই তাদের সম্পর্কে জাস্টিফাই করাতো অহেতুক বিষয়।তবে দাদিআম্মা অসুস্থ বিধায় তাকে না চাইতেও কথাগুলো বলতে হচ্ছে প্রান্তিকে।তাই অসুস্থ মানুষটাকে স্বান্তনাসরূপ কথা গুলো বললো সে।প্রান্তির কথা শুন বৃদ্ধা মলিন হাসলেন।তিনি জানেন তার নানতি ওবাড়িতে ভালো আছে আর ভালো থাকবে-ও।তবু-ও তিনি প্রান্তিকে এবাড়ির সবার সাথে একটা মজবুত সম্পর্ক তৈরী করার জন্য।নিজের নাতীর সাথে বিয়ের কথাটা মনেমনে ঠিক করে রেখেছিলেন।মেয়েটা মোটেও এই বাড়িতে আসতে চায়না।রক্তের সম্পর্ক থাকলেও,আপনজনদের সাথে যে আত্মার সম্পর্কটা মানুষের থাকে।সেই আত্মার সম্পর্কটা জেনো মেয়েটার সাথে উনাদের নেই।তাই সেই আত্মার সম্পর্কটা তৈরী করতে,মেয়েটাকে সাথে এবাড়ির সবার সুসম্পর্ক দৃঢ় করতে তিনি মেয়ের কাছে এই ইচ্ছেটা পোষন করেছিলেন।মেয়েটা-ও উনার রাজি ছিলো।ভাইয়ের মা মরা মেয়েটাকে ছেলের বউ করতেকিন্তু মেয়েটার ভাগ্যে যা ছিলো তা আর ঠেকাতে পারলেন কৈ।

—হুমম।আমিওতো চাই তুমি ভালো থাকো।তবে কখনো যদি তোমার কোনোরূপ কষ্ট হয়,আর এই দাদিমস যদি জীবিত থাকেন তবে তাকে তোমার বাবার আগে স্মরণ করো।

—এমন কিছু মানুষ আমাকে আগলে রেখেছে সেরকম কোনোরূপ কষ্ট আল্লাহর রহমতে আমাকে ছুঁতে পারবে না দাদিআম্মা।আল্লাহর রহমতে তারা এরূপ কষ্ট আমাকে কখনো স্পর্শ করতে দেবেন না।তাই আপনি নিশ্চিতে থাকুন।এসব ভেবে নিজের অসুস্থতা বাড়াবেন না।আমি আল্লাহর রহমতে খুবই ভালো আছি এবং ভালো থাকবো।

—এটাই দোয়া করি আমি সবসময়।তুমি খুব ভালো থাকো দাদুমনি।

আরও বিভিন্ন কথার একপর্যায়ে দুপুরের খাবার জন্য তাড়া পড়লো।খেয়েদেয়ে আরও একটু সময় রেস্ট করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো প্রান্তিদের।দাদিআম্মাতো আজ কিছুতেই ছাড়বে না প্রান্তিকে।প্রান্তির থাকা,না থাকার বিষয় নিয়ে প্রহান কিছুই বললোনা।মূলত পড়াশোনার বিভিন্ন ছুতো দিয়ে প্রান্তিই চলে এলো।কেননা তার এবাড়িতে এতটা ভালো লাগেনা যতোটা ওবাড়িতে সে অনুভব করে।তবুও আজ না থাকার কারনটা ওটা ছিলো-না।আজ কারনটা অন্যত্র ছিলো।মুলত সে তার স্বামী নামক মানুষটার সঙ্গ ছাড়তে চাইছিলো না।এই অপছন্দনীয় মানুষটার সঙ্গ হঠাৎই তার ঠিক কতখানি ভালো লাগায় পরিনত হয়েছে এটা যদি সে কাউকে বোঝাতে পারতো।

.

গোধূলি লগ্নে ওবাড়িতে থেকে বের হয়েছে প্রান্তিরা।এখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে।চলতি পথে মসজিদ দেখে গাড়ি থামিয়ে প্রান্তিকে একটা নিরাপদ স্থলে রেখে নামাজ পড়ে নিলো প্রহান।নামাজ শেষে আবারও গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে প্রান্তিকে কিছু খাবারও কিনে দিলো।তবে তাকে জিজ্ঞেস করলোনা সে কি খেতে চায় বা না চায়।নিশ্চুপ খাবার কিনে এনে তার হাতে ধরিয়ে দিলো।প্রান্তিও শুধু চেয়েচেয়ে দেখলো।প্রয়োজন ছাড়া কথা কম বললেও মানুষটা পছন্দ অপছন্দ জিজ্ঞেস করে।কিন্তু আজ কি হলো?যদিও তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে মানুষটার জানা।শান্ত মানুষটা হঠাৎ আরও শান্ত হয়ে গেলো?কি হয়েছে ভেবে পেলোনা প্রান্তি।

সন্ধ্যার কলহমুক্ত পিচঢালা রাস্তা। সেই রাস্তার দু’ধারের ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো রঙিন করে তুলেছে যাত্রাপথ।বসন্তের মনোরম বাতাস ওই মানুষটাকে ছুঁয়ে তাকে স্পর্শ করে হুহু করে তার গন্তব্যে চলে গেলো।পাশের মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের সুগন্ধে মন নেতিয়ে আসছে প্রান্তির।খাবার হাতে থাকা সত্ত্বেও, না খেয়ে চুপচাপ বসে আছে প্রান্তি।অনেকটা পথ নিরবতায় পার হওয়ার পরে হঠাৎই অতি শীতল আর শান্ত কন্ঠে প্রান্তিকে ডেকে উঠলো প্রহান।

—প্রান।

বরাবরের মতোই পরান চমকিয়ে শিরশির করে উঠলো প্রান্তির শরীর -মন।এতোসময় ফেলে আসা রাস্তার ধারে নিজের নজর অটল থাকলেও এবার ঘাড় ফিরিয়ে পাশে থাকা মানুষটার দিকে নজর দিল প্রান্তি।পিছনের পিঠের অংশ ছাড়া গম্ভীর মুখটা নজর পড়লোনা তার।তবে উত্তর দিতে ভুললো না।ছোটো করে শুধু বললো।

—হুমম।

—হঠাৎই যে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিলি,এমনকি বিয়েটা-ও সবার মন রক্ষার্থে করে ফেললি।সারাজীবন থাকতে পারবি-তো এই অপছন্দের মানুষটার সাথে।

একটু নীরব থেমে ফের প্রহান বললো।–অবশ্যই তোর কাছে তো অপশন আছে।চাইলেই এই অপছন্দের মানুষটাকে নিজের জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে পছন্দের কাউকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিতে পারিস।এই অপছন্দের মানুষ তোকে কখনো দোষারোপ করবে না এমনকি তোর চেনাজানা আপনজনেরাও না।সবার মতো আমিও চাই তুই…

কথা শেষ করতে পারলো না প্রহান।পেটে জোরেশোরে খামচানোর তীব্র ব্যথায় গাড়ির গতিপথ থামিয়ে না দিলেও স্লো করে ফেললো সে।শরীরে ব্যথা পেলেও মনে বয়ে গেলো প্রশান্তি।গম্ভীর মুখের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো নিটোল মৃদু হাসি।আর একটা কথাও বাড়ালো না সে।বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাতেই প্রান্তি ধপাৎ করে নেমে পড়লো আগেপিছে না তাকিয়ে গটগট করে বাড়ির মধ্যে হাঁটা দিলো।বাড়ির সদর দরজায় এসে রাগ-ক্ষোভ নিয়ে পিছনে মুড়লো দেখলো সেই অসভ্য পুরুষটা নিশ্চল নজরে তারদিকে তাকিয়ে আছে।তখন কথাগুলো শুনে বুকের মধ্যে যে ক্রন্দনের ঢেউ উথলে ছিলো সেটা মূহুর্তেই চোখের কোণে এসে ভীড় জমালো।সেদিকে খেয়াল না করে, সারাপথ যে রাগ ক্ষোভটা নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলো সেটা মূহুর্তেই উগরে দিয়ে বললো।

—আমি ইদানীং একটু একটু করে একপা একপা করে আপনার দিকেই এগোচ্ছিলাম।অথচ আজকে আপনি আমাকে আবার সেই আগের স্থানে এনেই দাড় করিয়ে দিলেন।আমার এগোনো দশ পা আবারও পিছিয়ে দিলেন।আপনি একটু-ও ভালো মানুষ নন।আমার আগের ধারণাই ঠিক ছিলো।আপনি খুব খুব খুব খারাপ মানুষ!

একটুখানির মধ্যে নাকের জল চোখের জল একসাথে করে ফেললো প্রান্তি।সেটা হাতের উল্টো পিঠে ডলে ফের বললো।

—আমার আপনাকে কখনো চাইনা।চাইনা মানে চাইনা।একটুও চাইনা।

চলবে….

ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here