রাঙিয়ে_দাও #পর্ব(১৩) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
223

#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব(১৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ভার্সিটি টাইম শেষ করে প্রায় শেষ বিকালের দিকেই বাড়ি ফিরলো প্রহান।ভার্সিটি শেষে বাহিরে আরও কিছু কাজ ছিল তার।বিধায় সেগুলো সেরে বাড়িতে ফিরতে রোজকার থেকে আজকে একটু দেরি হয়েছে।বাড়িতে ঢুকতেই একটা নীরব পরিবেশ অনুভব করল।কিন্তু এই সময়টাতে তো বাড়ির পরিবেশ এতোটা চুপচাপ থাকার কথা নয়!তিন বিচ্ছুতো এই সময়ে বাড়িটা মাথায় তুলে রাখে।তাদের চিল্লাপাল্লাতে গৃহ ত্যাগ করার মতো অবস্থা না হলেও বাড়িতে টিকে থাকা প্রায় মুশকিল হয়ে যায়।তবে সে বাড়িতে থাকলে অন্যকথা।কিন্তু ছোট দুই বিচ্ছুর ক্ষেত্রে সে বাড়িতে থাকলে ভিন্ন কথা হলেও বড় বিচ্ছুরানীর ক্ষেত্রে সেটা একদমই নয়।তবে আজ তিনজনের একজনেরও কোনো সাড়াশব্দ নেই।নজরের মধ্যে-ও পড়ছে না।ব্যাপার কি?

ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই ভাবনাটা আরও প্রখর হলে-ও এক সেকেন্ডও কোথাও ব্যয় না করে নিজের রুমে দিকেই চলে গেলো প্রহান।রুমে ঢুকেই রোজকার মতো বাড়িতে এসে বাহিরের জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেলো। বাহিরে আজ প্রচন্ড গরম অনুভব করায় শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।বিধায় হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার বদৌলে আজ গোসল সেরে বের হলো সে।কালো ট্রাউজারে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে উন্মুক্ত শরীরে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিজের বেডের দিকে নজর যেতেই প্রিয় নারীটিকে দেখে নজর স্থির হয়ে গেলো তার।

প্রান্তি বেডে বসে অস্বাভাবিক ভাবে ঘন-ঘন পা দুলিয়ে যাচ্ছে।ফর্সা আকর্ষণীয় কোমল হাতজোড় তার বেডের দুপাশের বিছনায় চেপে রাখা।হারিণী নজরজোড়া নিজের অস্বাভাবিক ভাবে দুলতে থাকা পায়ের দিকে।স্থির নজরটা সেই রমণীরপানে স্থির থাকলে-ও কপাল কুঁচকে গেলো প্রহানের।ব্যাপারটা কি?আজ সূর্য কোন প্রান্তে উঠলো নাকি তার নজরের ভ্রম।মহারানী নিজের ইচ্ছেতে আজ এই-রুমে পদার্পিত।নজর কিছু সময় সেদিকে স্থির রেখে গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো প্রহান।ফের নিজের কাজে মনোবেশিত করে শান্ত কন্ঠে শুধালো।

—হঠাৎ আমার রুমে?ব্যাপার কি?

শান্ত স্বরটা কানে যেতেই মৃদু কেঁপে উঠলো প্রান্তি।তবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো সে।এই রুমে আসার আগে নিজেকে যতসম্ভব বুঝিয়ে,সাহস জুগিয়ে তারপর এরুমে পদার্পণ করেছে।এখনতো কোনোমতেও অস্বাভাবিক আচারন করলে চলবে-না।নিজের ভিতরটায় যা হয়ে যায় যাক।বাহিরেতো তাকে শক্তরূপে থাকতেই হবে নাহলে তো সে মানুষটাকে প্রশ্ন করতে পারবেনা।আর না তার মনের মধ্যে অতিষ্ঠ করে চলা প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে না।যা শান্তিতে তাকে বসতে খেতে শুতে এমনকি স্থির থাকতেও দিচ্ছে না।

—বড়আম্মা বলেছে এই রুমটা আমারও।তাই এই রুমে যখন তখন আসার অধিকার রয়েছে আমার।

কথাটা বলতে গিয়ে ভিতরে ভিতরে কুণ্ঠাবোধ করলে-ও বাহিরে নিজেকে যতোসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সহজ গলায় কথাগুলো বলে দিলো প্রান্তি।তবে প্রহান কথাটা সহজভাবে নিতে পারলো-না।স্থির নজরে প্রান্তির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলো।তবে এটা-ও বুঝতে পারলো মহারানী কোনো মতলবে এই রুমে পদার্পিত হয়েছে-নাহলে এতো শান্ততো তাকে থাকার কথা নয়।আর তার উপর রাগ হলে তো রুমের হালচাল-ও এতো পরিপাটি থাকার কথা নয়।

—তা অধিকার সচেতন মানবী কারন ছাড়া তো, তার এই সদ্য পাওয়া অধিকারপ্রাপ্ত ঘরে প্রবেশ করেনি।তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।তার এই অধিকার প্রাপ্ত ঘরে পদার্পণের কারনটা মূলত কি?

মানুষটা তারসাথে ফাজলামো করছে।এতো ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলো অথচ মুড দেখি তার রমরমা।থাকারই তো কথা পছন্দসই মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ঘটিয়ে এসেছে মুডতো তার শত ক্লান্তিতেও ফুরফুরে থাকাবেই। শুধু মুড তার সামনে আসলে বিগড়ে যায়! খারাপ হয়ে যায়!রাগে ক্ষোভে ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকলেও নিজেকে বাহিরে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো প্রান্তি।নাহলে এই মানুষটা সম্পর্কে তার খুব ভালো করে জানা।সে রেগে যতে যাই কিছু করুক না কেনো, শান্ত না থাকলে এই মানুষটার থেকে কখনোই সে তার একটা প্রশ্নের উত্তরও পাবে-না।

আবার প্রশ্নটা করবে কি-করে সেই বিষয়েও বেশ উশখুশ করলো প্রান্তির মন।কারন মানুষটার চারিত্রিক সম্পর্কে তার ভালো করেই জানা।কখনোই মানুষটা সম্পর্কে মেয়ে ঘটিতব্য কোনো কিছু শোনা যায়নি।সেও শোনেনি কখনো এমনকি নাবা আপু সম্পর্কে-ও না।সে ফারহান ভাইয়ারা যাই বলে থাকুক। ঘটলে তো কিছু হলেও জানা যায়,শোনা যায়।এমনকি বোঝা-ও যায়। কিন্তু সেরকম কখনোই সে কিছু দেখেনি শোনেও নি।

তবে আবিশার কথাগুলোও ফেলে দেওয়া যায় না।নাবা আপুর বিয়ের আগে পরে তার বন্ধুদের মধ্যে সব-থেকে প্রহান নামে মানুষটার সাথে তাকে কথা বলতে দেখা যেতো।আর বিয়ের পরেও।বিষয়টা নিয়ে বিয়ের আগে মাথা না ঘামালেও, এখন মাথা নিজ থেকে ঘামতে চাইছে প্রান্তির।আর মনতো তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।মন মস্তিষ্কের এই টানাপোড়েন যদি-ও মন বারবার সায় দিচ্ছে।যে আবিশা আর ফারহান ভাইয়ারা যেটা ইঙ্গিত দিতে চাইল এরকম কোনো বিষয় নাবা আপু বা ওই মানুষটার মধ্যে নেই।তবু-ও মেয়ে মানুষ সে। মনতো কিছুতেই স্বামী সম্পর্কিত মানুষটার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে মানিয়ে রাখা যায়না।যদিও সেই স্বামী যতোই সাফসুতরা চরিত্রের হোক না কেনো!আর-ও যদি সেই স্বামী নমাক মানুষটার উপরে দূর্বলতাটা হয় কঠিন আকারে।তবে তো মানুষটা যতোই সাধু ব্যক্তি হোকনা কেনো তার মুখ থেকে তো স্বীকারোক্তি শুনতেই হবে।না হলে তো নিজেকে ঠিক শান্ত রাখা যায় না আর যাচ্ছেও না।ভেবেচিন্তে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত হয়েই মুখটা উচু করলো প্রান্তি।এত-সময় কথা বললেও নজর সে তোলেনি।মুখটা উচু করতেই মানুষটাকে উন্মুক্ত শরীরে দেখে ফের নজর নামিয়ে নিয়ে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বললো।

—বিয়ের এতোদিন পরে-ও আপনার সাথে নাবা আপুর বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কটা এখনো এতোটা দৃঢ়?বিয়ের আগে তো এতোটাও ছিলোনা।

তোয়ালি রেখে কাভার্ড থেকে টিশার্টটা বের করে কেবল গায়ে জড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলো প্রহান।মূহুর্তেই হাতজোড়া থেমে গেলো তার।নিটোল কপালে ফের কয়েক গাছি ভাজ পড়লো।ঘাড় ঘুরিয়ে স্থির নজরটা বিছানায় বসা রমনীর পানে রাখলো।মেয়েটা তারসাথে কথা বললে-ও স্থির নজরটা এখনো নিজের দুলতেথাকা পায়ের দিকে।
তার অধিকার সচেতন বউটার এঘরে পদার্পণের বিশেষ কারন তবে এটাই।তবে কি আজ নাবাকে আর তাকে কফিশপে কথা বলতে দেখেছে মেয়েটা?আর একারনেই কি স্বামীর উপর অধিকার ফলানোর কথা মনে পড়েছে তার?নট ব্যাড!সময় যেতেই ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির সঞ্চারণ হলো প্রহানের।তবে মূহুর্তেই হাসিটা ঠোঁটের কোণ থেকে মিলিয়ে নিয়ে গায়ে টিশার্টটা জড়াতেই বেশ শান্তস্বরে বললো।

—ও আমার ফ্রেন্ড ছিলো।বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটা কি স্বাভাবিক নয় কি?

তড়িৎ গতিতে মুখ উঁচিয়ে প্রহানের দিকে তাকাল প্রান্তি।কথাটা অতি স্বাভাবিক হলেও তারকাছে মোটেও অতি স্বাভাবিক লাগলো না।উত্তর স্বাভাবিক হলেও সে ঠিক একই রকম উত্তর মানুষটার অন্যরকম কথার ভঙ্গিতে আশা করেছিলো।এবার আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না প্রান্তি।উঠে দাঁড়ালো।নিজের রাগগ ক্ষোভের নজরটা সোজাসুজি প্রহানের পানে তাক করে কিছুটা রুক্ষস্বরে বললো।

—ফ্রেন্ড নয় বলুন গার্লফ্রেন্ড।

ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলা কখনো প্রহানের স্বভাব নয়।তবে আজ কেনোজানি তারও বলতে খুব ইচ্ছে করলো।বউটা তো আর তাকে কম জ্বালায়নি,সেও নাহয় একটু জ্বালালো।ক্ষতি কোথায়?মেয়েটা নাহয় তারউপর একটু রেগে যাবে,কাঁদবে তা নাহলে তাকে বকবে।আর খুব বেশি হলে মেয়েটার আদুরে জায়গা-গুলোতে প্রহানের নামে নালিশ জানবে।এগুলো তো তার সব সয়ে গেছে তবে একটু জ্বালাতে ক্ষতি কোথায়?যদি অন্যত্রভাবে সে ক্ষতি দ্বিগুণ পুষিয়ে দেওয়া যায়।তাই সেও স্বাভাবিক স্বরে বললো।

—গার্লফ্রেন্ডই তো ছিলো।তো তাতে সমস্যা কোথায়?

কি অবলীলায় আবার স্বীকারও করছে।আশ্চর্য হয়ে প্রহানের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রান্তি। অথচ মানুষটাকে সহজ সরল চরিত্রবান সাধু সন্ন্যাসী কতো কিছুই না মনেমনে ভেবে বসে আছে সে।রাগ ক্ষোভ নিয়ে প্রহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো প্রান্তি।ফের দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

—সমস্যা আছে আমার।

মেয়েটাকে জ্বালাতে কি পরম শান্তি।আর তার রাগান্বিত মুখটা দেখতো আরও সুখময়।হাজার বছরের তৃষ্ণার্থ নজরের পরিতৃপ্তি।মনেমনে হাসলো প্রহান।তবে মুখের আদলে তা সামন্যতমও প্রকাশ্যে করলোনা।বুঝতে দিল না সামনের মেয়েটাকে।কারন মেয়েটার রাগতো এতো তাড়াতাড়ি ক্ষুন্ন হতে দেওয়া যাবেনা।রাগ তো বাড়াতে হবে তাকে।মেয়েটা তার কথায় জ্বলবে আর একটু একটু করে মনের কথাগুলো উগরে দেবে।আর সদর্পে সেটা উপভোগ করবে।এই রাগান্বিত মুখটা উপভোগ করা কি যে প্রশান্তি।প্রান্তির মতো নিজেও দুপা এগোল প্রহান।স্থির নজরটা প্রান্তির রাগে ক্ষোভে জ্বলতে থাকা হারিণটানা নজরে রেখে বেশ শীতলস্বরে বললো।

—কি সমস্যা তোর?যে মানুষটাকে তোর একটুও চাইনা তার-উপর এতো অধিকার সচেতন হওয়ার প্রয়োজন কি?তার গার্লফ্রেন্ড থাকুক বা অন্যত্র কিছু তাতে তোর সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়!তবে?

রাগে ক্ষোভে টানাটানা নজরে লোনাজল জমলো প্রান্তির।টলমল চোখজোড়া ফেটে নোনাজল গড়াতে চাইলেও সেটা হতে দিলোনা প্রান্তি।নিজেকে যতোসম্ভব স্বাভাবিক রেখে তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধালো।

–মানলাম আমার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়!তবে আমাকে কেনো বিয়ে করেছেন ?

একেই বুঝি বলে বাঙালি নারী।ভালোবাসুক আর নাইবা বাসুক স্বামী বলতে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ।সেখানে ভাগ বলতে অন্য নারীকে নজর দ্বারা-ও ছুঁতে দেবে-না।রাগে ক্রোধে জ্বলতে থাকা প্রান্তিকে আরও জ্বালাতে ইচ্ছে করলো প্রহানের।সোজা হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা প্রহান এবার মাথাটা নিচু করলো।প্রান্তিও নিজের জায়গায় অটল।সেটা দেখে প্রহান বেশ আদূরে ভঙ্গিমায় বললো।

—তুই যেকারণে আমাকে বিয়ে করেছিস।ধরে-নে ঠিক একই কারনে আমিও তোকে বিয়ে করেছি।

কথাটা সত্যি হলেও প্রান্তির মন কিছুতেই মানুষটার মুখ থেকে কথাটা মানতে চাইলো না।রাগে ক্ষোভে এবার সে কেঁদেই দিলো।হরিনটানা চোখজোড়া দিয়ে গড়ালো মুক্তোর ন্যায় বড়বড় ফোঁটার নোনাজল।ইচ্ছে করলো, সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে মেরে ফেলতে।যে মুখ দিয়ে অবলীলায় কথাগুলো বলছে সেই ঠোঁট দুটো আঁচড়ে দিতে।কিন্তু আর যাই করুক মানুষটার গায়ে হাত দিয়ে কখনো বেয়াদবি করা তাঁরদ্বারা হবেনা।সম্ভব নয় সেটা।
প্রহানও স্থির নজরে তাঁর প্রাননাশিনীর দিকে তাকিয়ে রইলো।তার প্রানটা কাঁদছে শক্তপোক্ত বুকের ভিতরে ব্যথা জাগার কথা কিন্তু ব্যথা জাগছে না।সেখানে বয়ে চলেছে অনাবিল শীতল জলস্রোত।মেয়েটা তারজন্য কাঁদছে।তার ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায়-না বলে এই অবিরাম নোনা জলস্রোত।

অবিরাম গড়িয়ে চলা অশ্রুপাত মুছতে নিলেই প্রান্তির হাতটা থামিয়ে দিলো প্রহান।পুরুষ স্পর্শ পেতেই প্রান্তির শরীর শিরশিরয়ে কেঁপে উঠলো তবুও নড়লোনা সে।কেনো জানে না ইদানীং এই স্পর্শটা,তার মন খুব করেই চাইছে।সেদিন মানুষটা তাঁকে শক্তহাতে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার পর থেকে চাওয়াটা আরও তিব্র হয়েছে।দাঁতে দাত চেপে কান্না আটকিয়ে প্রহানের মুখের দিকে চেয়ে রইল প্রান্তি।সেদিকে একপলক লক্ষ্য করলেও দু’হাতের আলতো স্পর্শে লোনাজলের মুক্তোদানা গুলো মুছে দিতে থাকলো প্রহান।ফের বেশ কোমল গলায় বললো।

—নাবার বিষয়ে ভুল তথ্যটা ফারহান দিয়েছে তোকে তাইনা?

প্রান্তি মুখে কিছু নাবললেও প্রহান তার চাহুনীর ভাষাতে বুঝে নিলো।আর দ্বিতীয়ত তখন কফিশপে ফারহান আর মাহিম ঢুকতেই।ফারহান তাকে উদ্দেশ্য বলেছিল।আগুন লাগিয়ে দিয়ে এসেছি, সামলে নিও বন্ধু।বিষয়টা কথার খেয়ালে তখন না বুঝলে-ও এখন ঠিকই বুঝেছে।অসভ্যটা তার কোথায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।ইডিয়ট একটা।মনেমনে ফারহানকে বকে চললেও সেটা মুখে প্রকাশ করলো-না প্রহান।বেশ আদূরে স্পর্শে প্রান্তির চোখের পানিটা মুছে দিয়ে তার টানাটানা নজরে নজর রেখে কৈফিয়তের স্বরে বললো।

—একটা কাজে ভার্সিটি থেকে বের হতেই রাস্তায় নাবার সাথে দেখাহলো।মেয়েটা এদিকে কিসের জন্য এসেছিল
জানা হয়নি।ভালোমন্দ কথা বলতে বলতে কফি অফার করলো।না বলতে পারিনি।তাই কফিশপে বসতে হলো।
আর মাহিম আর ফারহান এদিকেই ছিলো।আমাদেরকে দেখে তারপর ওরাও কফিশপে ঢুকেছিল।এছাড়া কিছু নয়।তবে নাবার আমার সাথে ইচ্ছাকৃত কথা বলার কারনও ছিলো।

ঠোঁটে দাঁত চেপে রাখা দাঁতটা এবার ছেড়ে দিলো প্রান্তি।মনেমনে হাজারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।তবে প্রহানের শেষের কথাটা শুনে ফের কপাল কুঁচকে গেলো তার।অভিমানি মন মুখে দিয়ে কিছু বের করতে দিলো-না। তবে প্রহানের দিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে৷ রইলো সে কারনটা শোনার জন্য।প্রান্তিকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো প্রহান।ফের বললো।

–নাবা,তোর সাধুসন্ন্যাসী ছোটো মামার এক্স গার্লফ্রেন্ড।যারজন্য বয়স পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তোর ছোটোমামা এখনো দেবদাস হয়ে সন্ন্যাসী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মূহুর্তেই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম হলো প্রান্তির।এটা কি শোনাচ্ছে এই মানুষটা এগুলো।ছোটো মামা কাওকে পছন্দ করতো এটা এবাড়ির মানুষ সবাই জানে।কিন্তু নাবা আপুকে পছন্দ করতো,ভালোবাসতো এটা কেউ জানেনা।এমনকি সে-ও না।

—এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেনো?নাবা শুধু আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিলো এছাড়া কিছু নয়।কিন্তু তোর ছোটো মামার গার্লফ্রেন্ড ছিলো,এটা তুই নাবা মাহিম সহ আমার অন্য ফ্রেন্ডদেরও জিজ্ঞেস করতে পারিস।এমনকি তোর ছোটো মামাকেও।অন্ততঃ চাচার দোষটা ভাতিজার ঘাড় থেকে নেমে যাবে।চাচার সংসার নাহলে-ও ভাতিজার সংসারটা আপতত বেঁচে যাবে।

প্রহানের অন্যত্র কথায় মন দিলোনা প্রান্তি।সে সব ভুলে একটাই কথা তার মাথা ঘুরপাক খেতে থাকলো।সত্যি ছোটো মামার গার্লফ্রেন্ড নাবা আপু ছিলো।আর তাকে ছোটো মামা ভালোও বাসতো।সে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো।

—এটা সত্যি,নাবা আপু ছোটোমামার গার্লফ্রেন্ড ছিলো।আর তারজন্য ছোটোমামা এখনো বিয়ের পিড়িতে বসতে নারাজ।

—তোর ছোটো মামাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।দেখবি দুঃখ গুলো সব কুড়িয়ে দেবে তোর কাছে।যদিও সেগুলো দুঃখ ছিলো-না।ছিলো তোর ছোটো মামার খেয়ালিপনা।

—সম্পর্ক যখন দুপক্ষের থেকে ছিল তবে বিচ্ছেদ হলো কেনো?

—ওরকম ছন্নছাড়া মানুষের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে।নাবার বাবারও দেননি।নিজের কথার মোহমায়ায় তো গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছিলেন তবে সেই নিজের খামখেয়ালি পনায় তা-ও আবার হারিয়েও ফেললেন।

—আপনি ছোটো মামাকে ইনসাল্ট করছেন কিন্তু?

—তো কি করবো?তোর ছোটো মামার আগের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে তোর জানাআছে?জানা থাকলে ছোটো মামার হয়ে শালিসি করতে আসতিস না।

কথার একপর্যায়ে প্রান্তি ফের বেডে গিয়ে বসলো।প্রহান সেটা দেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো।বইয়ের তাকের দিকে এগোলো।প্রান্তি ফের বললো।

—আপনি আর নানিআম্মা ছোটো মামাকে মোটেও সহ্য করতে পারেন না।কেনো বলুনতো?

—ব্যাপারটা সেরকম নয়।কিভাবে জীবন চলছে উনার দেখছিস?একটা ভুল আর ছন্নছাড়া জীবন যাপনের জন্য এই হাল তার।জীবনে কোনো কিছু নিয়ে তাকে আমি কখনো সিরিয়াস হতে দেখিনি।নাবার বিষয়টাও সেরকম ছিলো।বিধায় নিজের খেয়ালিপনায় হারাতে হলো তাকে।

একটু থেমে প্রহান ফের বললো—ছোটো চাচ্চু যে জীবনটা লিড করে মনেকর ওরকম জীবনটা যদি আমি লিড করতাম তোর বড়আম্মা তোকে কখনো আমার হাতে তুলে দিতেন।তোর মনেহয়?

হঠাৎ এমন কথায় জেনো প্রান্তি চমকে উঠলো। কেমন জেনো মায়া মায়া জন্মে গেছে মানুষটার উপর।এখন এমন কথা শুনলে বুকে কম্পন ধরে।কিছুটা আতঙ্কের স্বরে সে বললো–আপনি কি বলতে চাইছেন দিতো নাহ!

প্রহান নিঃশব্দে হাসলো।হাসিটা পৃথিবীতে সবচেয়ে সৌন্দর্যময় হাসি মনেহলো প্রান্তির।মুগ্ধ নয়নে হাসিমাখা মুখখানা দেখে গেলো সে।প্রহান বইয়ের তাক থেকে বই বাছতে ব্যস্ত। তবে মনোযোগ তার প্রান্তির কথায়।সে বললো।—কখনোই দিতো নাহ!সে যতোই আমি উনার ছেলে হইনা কেনো।এমনকি এবাড়ির কেউ রাজি হতোনা।

—ছোটো মামাকে যেভাবে দেখাতে চাইছেন ছোটোমামা এতোটাও ছন্নছাড়া না।হয়তো আপুকে না পেয়ে এমনটা হয়ে গেছেন।

—কিছুটা তেমনটা।আবার সেই তেমনটা দায়ী উনার আগের লাইফ স্টাইল।যে জীবনটাতে না তিনি পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন আর না নিজের জীবন ভবিষ্যত নিয়ে।পড়াশোনা যদিও শেষ করলেন চাকরী বাকরিতে কখনো ধ্যান দেননি।বাবা-চাচ্চু ব্যবসাতে মন দিতে বললেন।উনার ধারনা ব্যবসা তাঁর দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়।সেটাতেও মনোযোগ দিলেন না।এরকম ছন্নছাড়া হলে জীবন চলে? নাকি কোনো মেয়ের বাবা তারহাতে মেয়ে তুলে দিতে চায়।তবে তুলে দিতে চায়না বললে ভুল।বিয়ের কম প্রস্তাব তো আসলো না বিয়েটাও তিনি করলেন না।তার ভাষ্যমতে বিয়ে করে তিনি বউকে খাওয়াবেন কি?এবার ছোটো মামার পক্ষ না নিয়ে নিজের বুদ্ধি দিয়ে ভেবে বল।তার এই অযৌক্তিক কথার কারনগুলাের কি আদৌ-ও কোনো ভিত্তি আছে?আর দাদিআম্মার বকা গুলো কি জায়েজ নয়?নাবার ছেড়ে যাওয়াটা কি ভুল?যদিও সে ছোটো চাচ্চুকে ছেড়ে যায়নি।বারবার বাবার সাথে প্রেমিকের হয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেও যখন প্রেমিকের খামখেয়ালি পনা ছুটাতে পারিনি তখন অন্যত্র বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো।বয়সটাও মেয়েটার তখন নিতান্তই কম ছিল না।আর একটা মেয়ে কতক্ষণ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারে?

—খুব খারাপ হয়েছে?তবে আমি হলে কিছুতেই অন্যত্র বিয়ে করতে চাইতাম না।যাকে এতো ভালোবাসি তাঁকে ছেড়ে থাকতাম কিকরে?ভাবলেই তো আমার নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে।

হঠাৎ নজর থমকে গেলো প্রহানের।ঘাড় ঘুরিয়ে শীতল নজরে সোজাসুজি প্রান্তির মুখের দিকে তাকালো।ফের বললো।

—সেই নিঃশ্বাস আটকানো ভালোবাসাটা কাকে নিয়ে ভাবছিস?

প্রহানের প্রশ্নে থমকে গেলো প্রান্তি। কথার ছলে কথাটা বলে ফেলেছে সে।তবে কথার ছলে হলেও কথাটা অতি সত্য।এই মানুষটাকে ছাড়া অন্যত্র তার জীবনে কাউকে ভাবা সত্যিই কঠিন।হুটকরে এতো অপছন্দনীয় মানুষটা কোন ফাঁকফোকড় দিয়ে এতো আপন কি করে হয়ে গেলো কিছুতেই বুঝে পায়না প্রান্তি।তবে ওই হলুদ হলুদ ফর্সা শ্যামবর্ণের মানুষটা শুধু তার।কোনো মূল্যে সে কখনোই ওই মানুষটাকে ছাড়বে-না।আর তাকে ছেড়ে যেতে-ও দেবেনা।তাহলেই যে তার….কথাটা আর শেষ অব্দি ভাবা হলো প্রান্তির।নিজের অতি সন্নিকটে মানুষটাকে অনুভব করতেই নিঃশ্বাস এমনিতেই আঁটকে এল তার।আর সেই আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটাকে মানুষটা তার আদূরেস্বরের বার্তা দিয়ে একেবারে নিঃশেষ করে দিলো।

—-এই প্রান আমাকে কি সত্যিই চাইনা তোর?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here