রাঙিয়ে_দাও #পর্ব-(১৪) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
230

#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব-(১৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

মাহবুবা বেগমের তীব্র গলার আওয়াজে প্রান্তির থেকে প্রশ্নের উত্তরটা আর নেওয়া হলো-না প্রহানের। দু’জনেই চমকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাহবুবা বেগমের গলার আওয়াজে বাহিরের উদ্দেশ্য চলে এলো।দু’জনেই বেশ আশ্চর্য হলো।প্রান্তির আগেই প্রহানই পা বাড়ালো রুমের বাহিরে।এবাড়িতে সবার উচ্চস্বরের কথা শোনা গেলেও মায়ের গলার আওয়াজ কখনোই এতো উচ্চতর হয়না।কখনোই না!সর্বকাজে তিনি অতিমাত্রায় ধৈয্য নিয়ে গলার আওয়াজ নিন্ম রেখেই কথা বলেন।বলতে পছন্দ করেন।আর সবাইকে সর্বদা সেভাবেই কথা বলতে উপদেশ দেন।

তবে আজ কি হলো উনার যে তিনি গলা এতোটা চড়াও করে কথা বলছেন।আর বকে চলেছেনও বটে যা উনার স্বভাবজাত নয়।তবে এবাড়ির কাউকে যে বকছেন না সেটা উনার বকে চলা কথার ধরন শুনেই বোঝা যাচ্ছে। তবে কাকে এতো কথা শোনাচ্ছেন?দো-তালার সিঁড়ির মাথায় আসতেই আপনাআপনি নজর নিচে চলে গেলো প্রহানের।

পাশের বাসার হিমানী মেয়েটাকে সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে কিছুটা হলে-ও বিষয়টা বুঝতে পারলো প্রহান।মাথানিচু অবস্থায় অনবরত মেয়েটা চোখের পানি মুছে চলেছে।আজও হয়তো মেয়েটাকে অকথ্য ভাষায় বকেছে নাহলে গায়ে হাত তুলেছে।প্রহান ভোবে পায়না।মাস্টার্স পড়া এতো বড়ো একটা মেয়ের গায়ে কি-করে তার বাবা মা হাত তুলতে পারে?অবশ্যই আপন মা হলে মনেহয় এতোটা নিষ্ঠুর আচরণের হতে পারতো না।সৎমা বিধায় এই অমানবিকতা!মেয়েটা- ও ভারী কোমলস্বভাবের আর শান্ততো বটেই।নিজের প্রতি শত জুলুমে-ও মুখ খোলে না।কখনোই প্রতিবাদ করেনা।

—কি হয়েছে বড়আম্মা এতো বকছে কাকে?

হড়বড়িয়ে প্রশ্ন করে প্রহানের পাশে দাঁড়িয়ে গেল প্রান্তি।দাঁড়াতেই প্রহানের মতো তার-ও নজর আপনা-আপনি নিচে চলে গেল।হিমানীকে মাথানিচু করে কাঁদতে দেখে আর তারইপাশে নানিআম্মাকে মাথায় হাতদিয়ে সান্ত্বনা দিতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো প্রান্তি।ফের বললো।

—হিমানী আপু এবাড়িতে কি করছে?ওই জল্লাদ মহিলা আবারও কি তাঁকে মেরেছে নাকি?

প্রহান শুধু একপলক তাকালো প্রান্তির দিকে।প্রান্তিও সেই তাকানোতে বুঝলো।তুই যা বলছিস আমি-ও তাই ভাবছি।আর মনেহচ্ছে হয়েছেও তাই।প্রহান নিচে না নামলেও প্রহানকে পাশ কাটিয়ে প্রান্তি দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো।বড়আম্মা বকে চলেছে।আর মেজো আম্মা উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।।

—ভাবী এবার থামুন নাহলে আপনার প্রেশারটা বেড়ে যাবে।আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো।

—তুমি আমাকে থামতে বলছো, আশা।কিন্তু আজ ওই মহিলা যা করলো তাতে উনার নোংরা মন মানসিকতার সীমা পার করে দিয়েছে।কি করে নিজেকে স্থির রাখি? উনার নিজের দুটো মেয়ে আছে তবুও এই মেয়েটার উপরে কি-করে এতোটা অমানবিকতার পরিচয় দিতে পারে?

মাহবুবা বেগমের কথার একপর্যায়ে সোফার একপাশে বসা হিমানীর দাদি বলে উঠলেন–দোষ আমার বউমা। অল্প বয়সে মেয়েটার যখন বিয়ের প্রস্তাব আসত।তখন মানা না করে বিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।তবে আমি কি ভাবতাম বলোতো?মেয়েটার মা চলে যাওয়াতে খম লাঞ্চনা গঞ্জনা তাকে তো সহ্য করতে হয়নি।এখনো সহ্য করতে হচ্ছে মেয়েটাকে।বিয়ের পরে যে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সেই একই লাঞ্চনা গঞ্জনা দ্বিগুণ সহ্য করতে হবে না কে জানে।আরও মেয়েটার গায়ের রং ময়লা।তাই চেয়েছিলাম মেয়েটা লেখাপড়া শিখে নিজে সমর্থবান হোক।তবে অন্তত কোনো কূল না থাকলেও নিজে জেন কিছু করে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম এই সমাজে মেয়েদের আঠারোর উর্ধ্বে বয়সে চলে গেলে তাঁকে নিচুস্তর দৃষ্টিতে দেখা হয়।তারা হয়ে যায় বুড়ি।সমাজের মানুষের চোখের কাটা।আরও যদি হয় গায়ের রং ময়লা।তবেতো সর্বহারা পোড়াকপালি।আর আমি সেই পোড়াকপালি কে সঙ্গ দিয়েছি।ওর দুর্ভাগ্যকে আর দূর্ভাগ্যে পরিনত করেছি।

—দাদু এভাবে বলছো কেনো?তুমি তো সবসময় আমার ভালো চেয়েছো।

হিমানির নিচুস্বরের কথাটা শুনে বৃদ্ধা মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা স্বভাবে ব্যবহারে ভিষণ গুনি।শ্যামলা রঙের একটা মায়াবি চেহারাও আছে।তবে সমাজে এসব মেয়েদের কদর কোথায়।

—ভালো চাইতে গিয়ে তো খারাপটা চেয়ে ফেলেছি।না হলে কি আর আজ এই দিনটা দেখতে হতো।ধরে বেঁধে এক বুড়োকে কি তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারতো।আর সেটাও কি আমাকে দেখতে হতো?যদি ছেলেটা আমার বিদেশ না থাকতো তবে তোমার কি আর এই হাল হতো।সংসারে আমারও কিছুটা জোর থাকতো।

হিমানী আর একটাও কথা বললো না।সত্যি বলতে তার মতো অভাগা মনেহয় আর কেউ নেই।নাহলে ছোটো বেলায় মা কি আর তাকে ফেলে চলে যেতে পারলো?তার ভবিষ্যতের কথা একবারও না ভেবে কিকরে তাকে একা ফেলে চলে গেলো।সেই ছোটো থেকে মায়ের চলপ যাওয়া নিয়ে,নিজের গায়ের রং নিয়ে কথা শুনতেশুনতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার।

—-খালাম্মা আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই।

মাহবুবা বেগমের কথায় তার মুখের দিকে চাইলেন বৃদ্ধা সাথে রাবেয়া খাতুনও।তিনি হয়তো ছেলের বউ কি বলতে চাইছে কিছুটা হলেও আচ করতে পারলেন।

—কি বলতে চাইছো বউমা।

—আমি হিমানীকে আমাদের বাড়িতে রাখতে চাই।শুধু আমাদের বাড়িতে বলে নয়,তার যোগ্য সম্মান দিয়ে আমি হাবিবের বউ করে তাকে এবাড়িতে রেখে দিতে চাই।

চমকে উঠলো সবাই।তবে কেউ কোনো কথা বললো না।যে যার নীরব ভাবনায় ডুবে থাকলো।হিমানী মেয়েটা ও নিশ্চুপ রইলো।মনে হলো জীবনের প্রতি তার কোনো ইচ্ছে আকাঙ্খা নেই।রাবেয়া খাতুন বলে উঠলেন।

—মেয়েটাকে এমনিতেই এবাড়িতে রেখে দাও বউমা।
তাকে হাবিবের সাথে জড়ানোর কি দরকার?এমনিতেই মেয়েটা পোড়াকপালি তারউপর আরেক ছন্নছাড়াকে তুমি তার জীবনে জড়িয়ে মেয়েটার আরও দূর্ভাগ্য ডেকে আনতে চাইছো।

—মা,আপনি রাজি কি-না তাই বলুন।হাবিবের বিষয়টা আমি বুঝে নেবো।ও যতোই ছন্নছাড়া হোক মেয়েটাকে ও কখনোই অযত্নে রাখবেনা সেই বিশ্বাস আমার আছে।আর মেয়েটাকে এভাবে বাড়িতে রাখতে বলছেন।আশেপাশে কথা শোনানোর মানুষের কি অভাব আছে।জীবনটা আরও দূর্বিষহ হয়ে উঠবে মেয়েটার।

রাবেয়া খাতুন ভেবে দেখলেন বউমা উনার ভুল বলছে না।তাই তিনিও বেশ নমনীয় গলায় বললেন।

—আমার ছন্নছাড়া ছেলেটার উপর আমার থেকে তোমার হক বেশি বউমা।তুমি ওর দুধমাতা।যতোটা অধিকার আমার ওর উপরে ঠিক ততোটাই অধিকার তোমার ওর উপরে।তুমি ওর জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত যখনতখন নিতে পারো।আমি কখনো দ্বিমত করেনি আর করবোওনা।আমি তো শুধু মেয়েটার কথা ভেবে বলছিলাম।

শাশুড়ি মায়ের অনুমতি পেতেই মাহবুবা বেগম হিমানীর দাদির অনুমতির অপেক্ষা করলেন।তিনিও ভেবে দেখলেন মেয়েটা এবাড়িতে থাকলে বেশ সুখেই থাকবেন।হয়তো তার এতোবছের দুঃখ এবার ঘুচাবে।যদিও ছেলেমেয়ের বয়সের বেশ একটা তফাৎ আছে।তবুও আধা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে হওয়ার থেকে হাবিবের সাথে বিয়ে হওয়া ঢেড় গুন ভালো।আর তিনি যদি হঠাৎ মারা যান মেয়েটার কপালে যে কি দূর্গতি আছে তিনি এখনই অনুভব করতে পারছেন।অনেক ভেবেচিন্তে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।বৃদ্ধা অনুমতি দিতেই মাহবুবা বেগম এবার হিমানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।স্নেহময় হাত রাখলেন তার মাথায়।

স্নেহময় হাতটা মাথায় পড়তেই মুখ উঁচু করে তাকালো হিমানী।শ্যামলা রঙের মায়াবী গড়নের দেখতে মেয়েটার মায়াভরা চোখ দুটো দেখলেই যে কারও হৃদয় শান্ত হয়ে যায়।সেই নজরে নজর রেখে মাহবুবা বেগম বেশ সৌহার্দপূর্ণ গলায় বললেন।

–আমি তোমার মতামতের উপর এই সম্পর্কটা এগোবো যদিও তোমার আগে আমি আমার দুই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের অনুমতি নিয়েছি্।তবুও তুমি রাজি থাকলেই তবেই সম্পর্কটা হবে।তুমি ওবাড়িতে ফিরে গেলে উনি হয়তো তোমাকে আবারও কোনো বয়স্ক লোকের সাথে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিয়ে দেবেন।তাই এছাড়া যে আমারও কোনো উপায় নেই।

হিমানী মুখে কিছু বললোনা।মোটামোটা চোখ করে শুধু মাহবুবা বেগমের দিকে চেয়ে থাকলো।কিছুটা সময় পার হতেই মাথা উপর নিচ দুলিয়ে সম্মতি জানালো।
সেটা দেখে মাহবুবা বেগম মৃদু হেসে হিমানীর পাশে বসা প্রান্তিকে বললেন।

—তোর ছোটো মামাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বল।বল বড়আম্মা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে বাড়িতে ডেকেছে।

এতোসময় নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছিলো প্রান্তি।নির্দেশ পেতেই নিজের ঘরে ছুটলো ফোন করতে।মাহবুবা খাতুন প্রহানকে সিঁড়ির মাথায় দাড়িয়ে থাকতে আগেই দেখেছেন। তাকে উদ্দেশ্য বললো।

—-তোর বাবা আর চাচ্চুকে জুরুরি ভিত্তি লতে বাড়িতে আসতে বল।কারন জিজ্ঞেস করলে বল মা আসতে বলেছে।

.
ঘন্টাখানেকের মধ্য সবাই বাড়িতে হাজির হলো।মাহবুবা বেগম সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বললেন।হিমানীর সম্পর্কে কিছুটা হলেও সবার জানা।তাই আর দ্বিরুক্তি করলোনা কেউ তবে বিয়ের বিষয়ে কথা উঠতেই প্রহানের বাবা চাচা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।মাহবুবা বেগমও তাদের কে বুঝিয়ে শুনিয়ে মানিয়ে নিলেন।

হাবিব বাড়িতে আসতেই নিজের বিয়ের কথা শুনে আঁতকে উঠলো।আরও হিমানীর সাথে নিজের বিয়েটা ঠিক মানতে পারলোনা।এক পুচকি মেয়ে,সে নাকি হবে তার বউ।এটা কেনো কথা হলো।কেউ তার সাথে যুক্তি তর্কে গেলোনা।মাহবুবা খাতুন এতোদিন হাবিবের ছন্নছড়া জীবন নিয়ে কিছু না বললেও এবার মুখ খুললেন।অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে তাকেও মানিয়ে নিলেন।
সেখান থেকে আরও ঘন্টাখানেকের মাথায় ছোটখাটো পরিসরে হিমানি আর হাবিবের বিয়েটা হয়ে গেলো।

.

সময়ের চক্রে আর-ও কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো।দেখতে দেখতে পবিত্র রমজান মাসও চলে এলো।আজ রোজা নির্ণয় দশের উর্ধ্বে চলে গেছে।সময়টা বিকাল বেলা।বছরের অন্য দিনগুলোতে রান্নার তোড়জোড় দুপুরের সময়টাতে হয়ে থাকলে-ও রোজার মাসটাতে রান্নার তোড়জোড় চলে বিকালের সময়টাতে।রান্নাঘরে রান্না আর ইফতারির তোড়জোড় চললেও সেখানে সময় দিতে পারছেন না মাহবুবা বেগম।যদি-ও সেদিকে খেয়াল না দিলেও চলছে।বাড়ির অন্যদুই গুনী বউ সেটা সুন্দর হাতে সামলে নিচ্ছে।তবুও বাড়ির বড় বউ হিসাবে যে দায়িত্বটা তিনি এতবছর যাবত পালন করে আসছেন সেটা জেনো অভ্যাসে গেঁথে গেছে।বিধায় বাড়ির সব জায়গা থেকে রান্নাঘরটা উনাকে টানে বেশি।কাজ না থাকলেও জেনো একঝলক হলে-ও সেখান থেকে ঘুরে আসা চাই।কিন্তু মেয়েটাকে ফেলে যেতেও পারছেন না।

ড্রয়িংরুমের চার আসনের মোটা সোফাটায় মাহবুবা বেগম বসে আছেন।আর উনার কোলে মাথা রেখে গুটি -শুটি মেরে শুয়ে আছি প্রান্তি।পরপর কয়েকটা রোজা হয়ে গেছে তবু্-ও আজকের দিনের মতো এতোকষ্ট তার অন্যকোনো দিনও হয়নি,যা আজ হচ্ছে।শরীর দূর্বলতার সাথে সাথে অদ্ভুত ক্লান্তও লাগছে।চোখমুখ জেনো সর্বক্ষণের জন্য ডুবে আছে।কিছুতেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা।তেমন পানির তৃষ্ণাও লাগছে।নিজের ঘরেও শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছে করছে-না।বিধায় ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে নিরিবিলি শুয়ে পড়েছে।আর বাড়িতে পুরুষ বলতে আপতত কেউই নেই। ইফতারির সময়ের আগে ছাড়া কেউ আসবেও না।আদ্রনিদ্র ও বাড়িতে নেই।দুই বিচ্ছু গেছে আজ প্রজ্ঞা আপুর বাড়িতে।বিধায় ড্রয়িংরুমের নিরিবিলি পরিবেশে এসে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়েছে প্রান্তি।

আর প্রান্তিকে ওরকম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মাহবুব বেগম রান্নাঘর ছেড়ে নিজে এসেই প্রান্তির মাথার নিচে নিজের কোলটাকে আরামদায়ক বালিশের স্থান করে দিয়ে বসলেন।বছরের অন্যসময়টাতে মেয়েটা কখনো একবেলা না খেয়ে থাকতে পারে না।তবে রোজা মাসটাতে তার চিত্র হয়ে যায় ভিন্ন।কষ্ট হলেও রোজা ভঙ্গ করেনা।সে যতোই দূর্বল হোক বা কষ্ট হোক না কেনো।আজ মেয়েটার গোলগাল মায়াবী মুখটা একদম শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে।যেটা উনি একদমই দেখতে পারেন না।তবে কি আর করার,ফরজ ইবাদতে যতোযাই হোক কোনো ছাড় নেই।তবুও প্রান্তির কাছে শারীরিক বিষয়ে ভালোমন্দ এটাওটা শুধাতে থাকলেন।
মাথার চুলের ভাজে অনবরত হাত-ও বুলিয়ে দিতে থাকলেন।কিছু সময় পার হতেই প্রান্তির মাথাটা ফের সোফার উপরে কোমল স্পর্শে রেখে তিনি বললেন।

—আমি একটু ওদিকটায় দেখে আবার আসছি।চুপচাপ শুয়ে থাক সোনামা,উঠবিনা কিন্তু।আমি একটু ওদিকটা দেখে তাড়াতাড়ি চলে আসছি।

প্রান্তি কোনো কথাই বললো-না।মূলত দূর্বলতায় আর ক্লান্তিতে গলা দিয়ে তার জেনো কোনো কথা বের হতেই চাইছে-না।তাই নীরব থেকে-ও বুঝিয়ে দিলো।তুমি যাও বড়আম্মা,আমি আজ তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মনবো।তাছাড়া যে আজ তোমার প্রানোরানির কোনো উপায়ও নেই।তোমার দস্যি প্রনোরানিটা যে আজ ভিষন দূর্বল।

আসরের নামাজ আদায় করে,আরও কিছুসময় বাহিরে থেকে বাড়িতে ফিরলো প্রহান।ড্রয়িংরুমের দরজার কাছে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে।মাহবুবা বেগমের কোলে প্রান্তিকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলো,দস্যিপনা মেয়ের দস্যিপনা ছুটে গেছে রোজার ক্লান্তিতে।মেয়েটা এরকমই রোজার সময়টাতে বিকাল বেলাটা আসলেই মেয়েটার দিকে আর তাকানো যায়না।মায়াবী গোলগাল মুখখানা আরও মায়াময় হয়ে উঠে।ক্লান্তশ্রান্ত টানাটানা দূর্বল চোখজোড়া নিয়ে তখন এমন ভাবে তাকায় মনেহয় পৃথিবীর সবসূখ জেনো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ওই মায়াময় ক্লান্ত নজরজোড়ায়।ক্লান্ত নজর জোড়া জেনো তখন আরও মায়াময় দেখায়

মাহবুবা বেগমকে চলে যেতেদেখে,ড্রয়িংরুমের দরজাটা নিঃশব্দে লাগিয়ে ধীরপায়ে ভিতরের দিকে এগোলা প্রহান।নিঃশব্দে প্রান্তির মাথার কাছে গিয়ে বসলো।মৃদু শব্দ পেয়ে প্রান্তিও, কে এসেছে না দেখেই তার কোলে মাথাটা তুলে দিয়ে কোমরটা দুহাতে শক্তকরে চেপে ধরে ক্লান্তস্বরে বললো।

—তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছো বড়আম…

কথা শেষ করতে পারলোনা প্রান্তি।পুরুষালী শক্তশরীর আর সেই শরীরের পারফিউমের তীব্র সুগন্ধে তার ক্লান্ত গলার স্বর পুরোটাই থেমে গেলো।বুঝতে পারলো,যাকে মনে করে সে কোলে মাথা রেখে ঝাপটে ধরেছে মানুষটা তিনি নন।তবে মানুষটা কে এটাও তার বুঝতে একটু-ও অসুবিধা হলোনা।ক্লান্ত শরীর অনুভূতির শিরশিরানিতে আর-ও নুইয়ে আসলো।তবে সরে গেলোনা সে।ঝাপটে ধরা শক্তপোক্ত কোমরটা আরও শক্তকরে ঝাপটে ধরে মুখ গুঁজে দিলো সেই মেদহীন পেটানো পেটে।

প্রহানও এতোসময় চুপচাপ প্রান্তির দেখে যাচ্ছিলো।বুঝতে চাচ্ছিলো তার মনোভাব।মায়ের জায়গায় সে বসেছে এটা প্রান্তি বুঝতে পেরেও নিশ্চুপ রয়েছে দেখে সেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের হাতখানা আদুরে স্পর্শে প্রান্তির মাথায় রাখলো।কোমর সমান ঘনকালো চুলের ভাঁজে নিজের শক্তপোক্ত আঙুলগুলো গলিয়ে দিয়ে বেশ কোমলকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

—নামাজ পড়েছিস?

ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত শিহরন বয়ে গেলেও বাহিরে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইলো প্রান্তি।প্রহান প্রশ্ন করতেই গলা কাঁপলেও মৃদুস্বরে কোনোমতে উত্তর দিলো–হুমম।

কিছু সময় নীরবতায় পার হয়ে যাওয়ার পর প্রহান ফের জিজ্ঞেস করলো—শরীর বেশী খারাপ লাগছে?

আদূরে স্বরের কথাগুলো ক্লান্ত প্রান্তিকে একদম পানির মতো গলিয়ে দিলো।পেটে গুঁজে থাকা মুখখানা একটু আলগা করে প্রহানক একপলক দেখে নিলো।ফের বেশ আহ্লাদী হয়ে বললো।—খারাপ লাগছে-না তবে পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে খুব।

নিজের পেটে গুঁজে থাকা মায়াবিনী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এতসময় কথা বলছিল প্রহান।যদিও মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।প্রান্তি মুখ উঁচু করে আহ্লাদীস্বরে কথাটা বলতেই মুখে মৃদু হাসি ফুটলো প্রহানের।কিছুসময় সেই ক্লান্ত মায়াময় মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ নিচুকরে জীবনের প্রথম ভালোবাসাময় সুদীর্ঘ স্পর্শ আকলো প্রান্তির কপালে।প্রান্তির দূর্বল শরীর মূহুর্তেই কেঁপে উঠল,মায়াময় ক্লান্ত চোখজোড়া পরম আবেশে আপনমনে বন্ধ হয়ে এলো।হঠাৎ মনেহলো ক্লান্তিতে ডুব দেওয়া শরীর-মন জেনো তৃষ্ণামুক্ত হলো।মানুষটা জেনো প্রান্তির শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ক্লেশ মূহুর্তেই তার পুরুষালী পুরো ঠোঁটদ্বারা ম্যাজিকের মতোন চুষে নিয়েছে।নিজের মনের সমস্ত ভালোবাসা মিশিয়ে প্রগাঢ় চম্বুন একে সরে আসলো প্রহান।ফের ছোটো বাচ্চাদেরকে বোঝানোর মতো করে প্রান্তিকে বললো।

—আর একটুখানি সময়,এইতো ইফতারি সময়টা প্রায় হয়ে এসেছে।তারপর আর এতো ক্লান্ত লাগবে না। ঠিক হয়ে যাবে।

ইফতারির পরে আর কি ঠিক হয়ে যাবে,প্রান্তিরতো মনে হলো এই মূহুর্তেই সব ঠিক হয়ে গেছে।কি ছিলো ওই পুরুষালি ঠোঁটের নমনীয় স্পর্শে যা মূহুর্তেই তাকে মুগ্ধতার প্রশান্তিতে ছেয়ে দিলো।সমস্ত শরীরজুড়ে এনে দিলো সুখের জলসূখা।মূহুর্তেই দূরকরে দিলো শরীরের ক্লান্তি ক্লেশ।মানুষটার কথা কাজ দিনকে দিন তারদিকে টানছে তাকে।যা বিবাহিত সম্পর্কের আগে কখনো তার অনুভব হয়নি।অথচ বিয়ের সম্পর্কটা তৈরী হতে না হতেই মানুষটার প্রতি এতো দূর্বলতা এতো টান এতো মায়া জড়িয়ে গেলো।আগে মানুষটার ছায়া থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করতো তার।অথচ এখন মানুষটার ছায়ায় ডুবে থাকতে মন চায়।এ কেমন মধুর সম্পর্কের আবেশে ডুবে গেলো তার মন।

—আমি চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিচ্ছি চুপচাপ শুয়ে থাক।তবে ঘুমিয়ে পড়িস’না জেনো আরও ক্লান্ত লাগবে।

প্রহানের কথার বিনিময়ে প্রান্তি কিচ্ছুটি বললো না।বরং ঝাপটিয়ে ধরা কোমরটা আরও শক্তপোক্ত ভাবে দুহাতে চেপে ধরে নিশ্চুর রইলো।তার যে এখন আর আপতত কিচ্ছু চাই না।যে সুখের আবেশে সে ডুবে আছে সেটা সহজে কেটে যাক এটা আপতত সে চাইছে না।প্রান্তিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে প্রহানও আর কথা বাড়ালোনা।ডানহাতটা প্রান্তির মাথার চুলের ভাঁজে চললেও অন্যত্র হাত দিয়ে টিভির রিমোটটা তুলে নিয়ে টিভি ছাড়লো।এন টিভিতে শুরু হওয়া পিএইচপি কুরআনের আলো অনুষ্ঠানে এনে রেখে দিলো।বাচ্চাদের কুরআন তেলওয়াতের স্বরগুলো এতো সুমধুর।শুনলেই শরীর মন জুড়িয়ে যায়।অবশ্যই তারও কুরআন তেলওয়াতের গলাও বেশ।

ড্রয়িংরুমে এতো সময়ের সুন্দর চিত্রটা নজর এড়ালো না মাহবুবাা বেগমের।মা হওয়া সত্ত্বেও অপলক আর মুগ্ধ নজরে অবলোকন করে গেলেন ছেলেমেয়ে দুটোর মন ছুয়ে যাওয়া ভালােবাসাময় চিত্রটা।যে দৃশ্যবলী দেখে মা হয়ে নজর ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিলো,কিন্তু তিনি যেতে পারলেননা।কেনো জানি দৃশ্যটা উনাকে আঁটকে দিলো।তবে দৃশ্যটা নজরে পড়তেই মন থেকে বারংবার দোয়া করতে থাকলেন,এরকম মধুময় দৃশ্যবলী জেনো ছেলেমেয়ে দুটোর জীবনে অগণিত অসংখ্যবার সহস্রবার আসে।মৃদু হেসে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন মাহবুবা বেগম।ছেলেমেয়ে দুটো এতো দ্রুত সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে যাবে ভাবতে পারেন নি তিনি।বিশেষ করে প্রান্তির ক্ষেত্রে তো নয়।তিনি মনেমনে অসংখ্যবার আওড়াতে থাকলেন।

—এভাবেই উনার ছেলেমেয়ে দুটো একে-অপরের নিবিড়বন্ধনে সুখে আর শান্তিতে থাকুক।ভালোবেসে এভাবেই সুখে-দুঃখে দুজনের ছায়া হয়ে থাকুক।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here