রাঙিয়ে_দাও #পর্ব_০৮ #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
266

#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব_০৮
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেছে।জীবনের পথচলাটা পূর্বের ন্যায় যেভাবে চলছিলো সেভাবেই চলছে প্রহান আর প্রান্তির।নূন্যতম-ও কোনো পরিবর্তন নেই।শুধু নামেই জেনো তারা স্বামী স্ত্রী।সম্পর্কের প্রভাবটা জেনো দু’জনের মধ্যে কার-ও নেই।সেই পূর্বের ন্যায় চলাফেরা ঘোরাঘুরি, কলেজ যাওয়া,দুষ্টামী ফাজলামো,সবকিছুর কোনো কিছুতেই যেমন আগে-ও বাঁধা ছিলোনা প্রান্তির। এখনোনেই।আর ওই কাঠখোট্টা মানুষটা যে তার স্বামী। সম্পর্কের প্রভাব আর দাবী না থাকায় সেটা জেনো এই একসপ্তাহতে ভুলতেই বসেছে সে।আগের ন্যায় মানুষটা কোনো কিছুতেই তাকে কিচ্ছু বলেনা।যদি-ও প্রান্তির মানুষটাকে নিয়ে ভবনা ছিলো অন্যরকম।যে বিয়ের পর তাকে মানুষটার স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে গা ভাসিয়ে আর নিজের মতো করে তাঁকে চলতেই দেবে-না।স্বামিত্ব ফলিয়ে এতোদিনে নিজের ইচ্ছেমতো চলার বিঘ্নতা ঘটাবে।ওই মানুষটার স্বভাবের কর্মকান্ডগুলো তারউপর প্রতিফলিত করবে।এতোদিনে মানুষটার বিপরীতে গা ভাসানোর শাস্তি সরূপ যখন তখন নিজের উপর স্বামীর অধিকার দেখাবে।কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমানিত করে মানুষটা আগের ন্যায় নিজে যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলছে।আর তাকে-ও চলতে দিচ্ছে।

বাড়িতে থাকলে আগের ন্যায় সামনাসামনি পড়ে গেলে বা হঠাৎ নজরে নজর মিলে গেলে যেমনটা দু’জনেই চোখ নামিয়ে নিতো।প্রয়োজন ছাড়া এক অপরের সাথে কথা না বলা।সেই পূর্বের সবকিছুর মতো নিয়মমাফিক চলছে।কোনো কিছুতেই কোনো পরিবর্তিত নেই।বিধায় দু’জনের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে এটা জেন বেমালুম ভুলতেই বসেছে প্রান্তি।আর ওই মানুষটার কি খবর তার জানা নেই।

—আপু,আমি একটা কথা আজ একসপ্তাহ ধরে খুব ভাবছি?

ডায়নিং টেবিলে বসে সকালের খাবার খাচ্ছে আদ্রনিদ্র আর প্রান্তি।তিনজনের আজ স্কুলে সাতই মার্চের ছুটি।টেবিলে ওরা তিনজন ছাড়া আপতত কেউ নেই।মামারা আগেই খেয়ে নিয়েছে।নিজেদের কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্য একটু পর বের হবে বিধায় মামিরাও তাদের সঙ্গ দিতে ব্যস্ত।আর নানিআম্মা নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আপতত উনারও সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ।ফুলবানু রান্নাঘরে নিজের কাজ করছে।আর ওরা তিনজন নিরিবিলি খাচ্ছে।বাড়ির অন্য সদস্যরা আর কোথায় কে কি করছে এটা প্রান্তির জানা নেই।জমজ দু’জনের মধ্যে আদ্র বরাবরই কম কথা বলে কিন্তু নিদ্র।দুনিয়ায় প্রশ্নের ঝুড়িটা জেনো তার মাথায় নিয়ে বসে আছে সে।নিজের ভাবনার মাঝে নিদ্রের কথাটা শুনে কপাল কুঁচকে গেল প্রান্তির।কিছুটা কৌতুকেরস্বরে সে বললো।

—তা কি এতো গবেষণা করে চলেছেন আমার ছোটো ভাইয়া জান?বলুন,দেখি আপনার ভাবনার কূল কিনারা মিলানো যায় কি-না।

—এই যে তুমি এখন দাদাভাইয়ের বউ হয়ে গেছো।আগে তো আমাদের আপু ছিলে এখন তো দাদাভাইয়ের বউ হয়ে ভাবি হয়ে গেছো।এখন তোমাকে আপু বলে ডাকা উচিত নাকি ভাবি?

কপাল আরও কুঁচকে গেলো প্রান্তির।কিছুসময় নিদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের খাবারে মনোযোগ দিলো।
প্রবাদে আছেনা,যার বিয়ে তার খোঁজ নেই পাড়াপড়শির ঘুমনেই।নিদ্রের হয়েছে তাই,যার বউ তার সেই সম্পর্কের অধিকার ফলানোর খোজ নেই।ভাইগুলোর সেই সম্পর্ক এর নাম দেওয়ার জন্য ঘুম নেই।

—তোকে এসব নিয়ে এতো ভাবতে বলেছে কে?আমি আগে তোর যেমন আপু ছিলাম এখনো সেই আপু।তোর দাদা-ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে,তোর সেই আপুর সম্পর্ক ধুয়েমুছেই যায়নি।সো আপু বলেই ডাকবি।ভাবি আবার কি?

—কিন্তু ভাইয়ের বউকে তো সবাই ভাবি বলেই ডাকে আপু। তবে আমরা কেনো ডাকবো না?

—সবাই ডাকলে-ও তোরা ডাকবি না,ওকে।

—নাহ!ইট’স নট ওকে।

খাবার বাদ দিয়ে চেয়ায়সুদ্ধ নিদ্রর দিকেই ঘুরে বসলো প্রান্তি।—ওই নট ওকে মানে কি?আমি যা বলছি তাই-ই হবে।

—ইট’স ওকে।

নিদ্র এতো সহজে মেনে নিলো,কিভাবে? এতো সহজে মানার ছেলে তো নিদ্র নয়,তাহলে?কপাল প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কুঁচকে ফেললো প্রান্তি।হঠাৎ নিদ্রকে ভদ্র বাচ্চার ন্যায় মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে দেখেই সন্দেহ আর-ও গাঢ় হলো প্রান্তির।আদ্র-নিদ্রতো তখনই শান্ত হয়ে যায় যখন…..ভাবনা সেখানেই ক্ষান্ত রেখেই সামনে তাকাল প্রান্তি।সিঁড়ির গোঁড়ায় ফর্মাল ড্রেসআপে মানুষটাকে শান্ত নজরে তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখে নিদ্রের চুপ হয়ে যাওয়ার কারনটা বুঝতে পারলো প্রান্তি।এবার নিজেও মাথা নিচুকরে নিলো সে।তবে নিদ্র যে কারনে মাথা নিচুকরে নিয়েছে সেই কারনে মাথা নিচু করে নেয়নি সে।যে মানুষটা খাওয়ার সময় এত বকবক একদম পছন্দ করেনা!বরং একারনে ইদানীং মানুষটাক যে-কোনো বেশে দেখলে তার বুকের মধ্যে অদ্ভুতভাবেই কিছুমিছু একটা হয়েযায়।ভালো কি মন্দ সেটার অনুভব সে করতে চায়না।শুধু জানে কিছু একটা হয়,যা কখনো আগে অনুভব হয়নি।

—আরেহ আমাদের নতুন মামনী কেমন আছে?

হঠাৎই ছেলে কন্ঠের এমন উচ্ছল সম্বোধনে আবারও মুখ উঁচু করে তাকালো প্রান্তি।তবে এবার আর সামনের দিকে নয় পিছনে ফিরলো সে।বুবুমনির পুরো ফ্যামিলি আজ হাজির।শাফিন দুলাভাইয়ের অফিসের ঝামেলায় তিনি এবাড়িতে খুবই কম আসেন।তবে বুবুমনি সপ্তাহে দুই-একবার আসেন।সাথে পুতুল কি নিয়ে আসেন অর্থাৎ বুবুমনির সাত বছরের মেয়েকে।বুবুমনির পড়ুকে ছেলেটাও কম আসে।ছেলেটাও আজ এসেছে।পড়ার জন্য ছেলেটাকে নানুবাড়িতে খুবই কম দেখা যায়।আর তারই উচ্ছল কন্ঠের পুরোনো সম্বোধন খালামনি বাদ দিয়ে প্রান্তিকে মামনি বলে ডাকা,সবার সামনে প্রান্তিকে লজ্জায় ফেললো।লজ্জা কাটাতে তাড়াতাড়ি প্রান্তি বললো।

—ওরেহ বাবাহ আমাদের পড়ুকে ছেলেটার তবে নানা বাড়িতে আসার সময় সুযোগ মিললো।খবর যে আজ ধামাকা,পূর্ণসাহেব পড়াশোনা ছেড়ে আজ নানুবাড়িতে?

ছেলেটা প্রান্তির প্রায় বছর খানেকের ছোট।বিধায় প্রায় সমবয়সী হওয়ায় দুষ্টমী ফাজলামো হয়।সেই হিসাবে পূর্নকে কথাটা বললেও সে উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে তার বাবা বললো।

—শালিকা এখন আমার শালা-বউ হয়ে গেছে।কি বলে তাকে সম্বোধন করা যায় বলতো প্রান্তিকা?

আজ হঠাৎ সবাই সম্বোধন নিয়ে পড়লো কেনো প্রান্তির বুঝে আসছেনা।কিন্তু বিষয়টাতে সে বেশ লজ্জা পাচ্ছে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এই সম্বোধন তারতো কোনো সাড়াশব্দ নেই।আঁড়চোখে পিছনে তাকানোর চেষ্টা করলো প্রান্তি।নাহ বান্দা সেখানে নেই।তবে গেলো কোথায়?এখনেই তো ছিলো।বাহিরেও তো যেতে দেখলো না তবে?

প্রান্তির মনেমনে ভাবনার মাঝেই তারদিকে এগিয়ে এল সবাই।ভালোমন্দ আলাপন হলো সবার সাথে।তারমধ্যে দাদিআম্মার রুম থেকে বের হলো প্রহান।ভার্সিটিতে আজ সাতই মার্চের ছুটি থাকলে-ও যেতে হবেই তাকে।
অনুষ্ঠান আছে।আর ইদানীং ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে দাদিআম্মার সাথে সাক্ষাৎ করে যায় সে।উনার শরীরের ভালো মন্দ খবরটা রোজ ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে যাওয়া,উনাকে দেখে যাওয়াটা জরুরি মনে করে প্রহান।আজও অন্যথা হলোনা।

প্রহান ড্রয়িংরুমে আসতেই সবাইকে দেখে ভালোমন্দ আলাপন সারলো।পূর্নও মামার সাথে কথা সেরে নানুর রুমের দিকে চলে গেলো।শাফিনও প্রহানের সাথে কিছু সময় কথা বলে প্রজ্ঞাকে আসতে বলে দাদিআম্মার রুমের দিকে আগ্রসর হলো।প্রজ্ঞা আগেই সোফায় বসে পড়েছিলো।সেটা দেখে তাকে সঙ্গ দিতে প্রহানও বসে পড়লো।বসার আগে হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে নজর বুলিয়ে নিতে ভুললো না।প্রহান বসতেই মিষ্টি হেসে প্রজ্ঞা বললো।

—তা আমার ভাইয়ের বিবাহিত সংসার জীবন কেমন চলছে আমি কি জানতে পারি?

প্রহান মৃদু হাসলো।ডায়নিং টেবিলের মধ্যে চেয়ারটায় বসা উচ্ছ্বসিত হয়ে কথাবলা মেয়েটাকে একপলক দেখে নিতে ভুললো না।তারপর শান্তকন্ঠে বললো।–যেমনটা আগে চলছিলো তেমনটাই।

—কিছুই পরিবর্তিত হয়নি।

—হওয়ার কথা ছিলো নাকি?তবে হয়েছে হয়তো, তোমাদের আদূরে বিড়ালটা আমাকে একটু জ্বালানো কম করেছে।

—আর কোনো পরিবর্তন নয়।

বুবুমনি সবসময় তার পিছে লাগে।আজ প্রহানও সুযোগ ছাড়লোনা কিছুটা কৌতুকের স্বরে বললো।–লাইফের নামের কিছুটা চেঞ্জিং এসেছে।আগে ব্যাচেলর লাইফ ছিলো।এখন বিবাহিত ব্যাচেলর।

কথাটা শান্ত ভঙ্গিমায় বললেও সেটা শুনে হেসে ফেলল প্রজ্ঞা।ফের বললো—এটা কোনো কথা হলো?বিবাহিত লাইফ থেকে আর কিছু চাইনা তোর।

উঠে দাঁড়ালো প্রহান।আবার-ও একপলক শান্ত নজরে ডাইনিং টেবিলে বসা রমণীকে পলকহীন নজরে দেখে নিয়ে বললো—চাইতো।তবে যেটা চাই সেটা আমি পেয়ে গেছি।আপতত এখন আর কিছু চাই না আমার।

প্রজ্ঞা-ও আর কিছু বললোনা।প্রহানও নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো।

.

পুতুলকে কোলে বসিয়ে নিজে খাচ্ছে আর পুতুলকেও খাওয়াচ্ছে প্রান্তি।খাওয়া শেষ হতেই হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তেই প্রান্তি বললো।

—আমার চকলেট কৈ পুতুল রানি?

প্রত্যেকবার এবাড়িতে আসার সময় মেয়েটা তারজন্য চকলেট নিয়ে আসে। আর আসার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো দিয়ে দেয়।এবার না দেওয়ায় প্রান্তি তাকে জিজ্ঞেস করলো।যদিও চকলেট তার খুব পছন্দনীয় নয় আবার অপছন্দনীয় নয়।কিন্তু মেয়েটার দেওয়ার অভ্যাসের খাতিরে কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেলল।প্রান্তির আদূরে প্রশ্নে মন খারাপ হলো পুতুলের।ফের গাল ফুলিয়ে বললো।

—মা চকলেট খেতে দেয়না মনিআম্মা।ডাক্তারে নিষেধ করেছে তাই।কিন্তু আসার সময় তোমার কথা মনে পড়তেই বাবার কাছে আমি চকলেট চেয়েছিলাম।কিন্তু মা বাবাকেসহ আমাকেও প্রচুর বকেছে।আর বাবাকে কিছুতেই চকলেট কিনতে দেয়নি।তাই আমিও তোমার জন্য চকলেট আনতে পারিনি।

পুতুলের গাল ফুলানো কথাতে হেসে ফেললো প্রান্তি।ফের হাসি মিলিয়ে মুখটা দুঃখীদুঃখী ভাব করে বললো।
—মা খুব অন্যায় করেছে আমার পুতুল রানির উপর।ইশ এটা মোটেও ঠিক হয়নি।

—তাই না বলো মনিআম্মা।

—তাই।তবে দাঁতের যন্ত্রণায় যদি আমার পুতুলরানিটা কষ্ট পায় তবে কিন্তু মা ঠিকই করেছে।

কথাটা মনোপুত না হলেও কিছু বললোনা পুতুল।প্রহান কে এদিকে আসতে প্রান্তির কোলেথেকে নেমে প্রহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফের আদূরেস্বরে বললো।–মামা চকলেট কিনবো।

পুতুলের দাঁতের বিষয়টা সম্পর্কে জানে প্রহান।তাই চকলেট কেনার পক্ষপাতিত্ব নয়।তবুও মেয়েটার আদূরে ভঙ্গিতে বলা কথাটা ফেলতে না পেরে বললো–আচ্ছা চলো।

পুতুলের হাত ধরে বাড়ির বাহিরের দিকে আগ্রসর হলো প্রহান।বিষয়টা প্রান্তির নজর এড়ালোনা।তবে খাওয়া শেষ হওয়ায় সে আর ডায়নিং টেবিলে বসে থাকলোনা।উঠে সোফায় বসা প্রজ্ঞার পাশে গিয়ে বসলো।দু’জনের মধ্যে টুকিটাকি কথা চললো।কিছুসময় যেতেই পুতুলও ফিরে এলো।পুতুলের দুহাত ভরা চকলেট।কিন্তু অনেক গুলো চকলেটের মধ্যে দুটো আলাদা ফ্লেভারের চকলেট দেখে কপাল কুঁচকে গেল প্রান্তির।অনেকগুলো ডেয়ারি মিল্ক চকলেটের মধ্যে দুটো কিটক্যাট।যা প্রান্তির খুবই পছন্দের নাহলেও পছন্দের।চকলেটের মধ্যে এই ফ্লেভারের চকলেট তার খেতে ভালো লাগে।

—এদুটো তোমার মনিআম্মা।

কিটক্যাট চকলেট দুটো হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুতুল চলে গেলো।কোমল কন্ঠে এটাও বলতে বলতে গেলো,আমি আদ্রনিদ্র মামাকেও কিছু চকলেট দিয়ে আসি।চকলেট দুটো হাাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল প্রান্তি।এমনটা নয় মানুষটার দেওয়া কিছু সে নেয় না।বরং খুবই সাচ্ছন্দ্য নেয় সে।ওই মানুষটা কোথাও ঘুরতে গেলে বা শপিংয়ে গেলে।বাড়ির কারও জন্য কিছু না নিয়ে আসলেও তার আর আদ্রনিদ্রের পছন্দ অনুযায়ী কিছু না কিছু নিয়ে আসে।আর সম্পর্ক তাদের যেননই থাক তারাও সেটা সদরে গ্রহন করে।কিন্তু আজ জেনো চকলেট দুটো নিয়ে অদ্ভুত কেমন কেমন অনুভব হলো প্রান্তির।সেই কেমন কেমন করা অনুভবের মধ্যে অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতিও অনুভব হলো তার।

—বাহ,আমার ভাইয়ের দেখি বউয়ের পছন্দ অপছন্দের দিকে বিশেষ খেয়াল আছে।মন্দ না।

ফ্যালফ্যাল করে প্রজ্ঞার দিকে তাকাল প্রান্তি।কি বলবে খুঁজে পেলোনা।এটা তো নতুন নয় তবে বুবুমনি এমনটা বলে তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে কেনো?প্রান্তির ব্যাপারটা বুঝে প্রজ্ঞা-ও হেসে দিলো।একপাশ দিয়েই আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো প্রান্তিকে।ফের বললো।

—বুবুমনিতো মজা করছিলো।এতে লজ্জা পেতে আছে।

কিছু বললো না প্রান্তি।প্রজ্ঞাও কিছুসময় নিশ্চুপ থাকল ফের গলায় স্বরটা কিছুটা গম্ভীর করেই বললো–আমি তোর-ও বুবুমনি আর প্রহানের-ও।তােদের ভালোর জন্য বলছি।স্বামী স্ত্রী সম্পর্কটা আল্লাহর নেয়ামতের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর বিশেষ একটা নিয়ামত।এই সম্পর্কটা তৈরী হয়ে গেলে বা যখন তৈরী হয়ে যায় এটা নিয়ে হেঁয়ালিপনা করতে নেই।আর না সেই সম্পর্কটা নিয়ে ছেলে খেলা করতে হয়।তাতে আল্লাহ খুবই অসন্তুষ্ট হন।
স্বামী আর স্ত্রী একে আপরের অর্ধাঙ্গী অর্ধাঙ্গ।মানে কি বুঝেছিস?নিজের জীবনের অর্ধেক অংশকে যাকে বলা হয়।যা প্রতিটি নর-নারীর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।আর সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে গুরুত্ব দিয়েই আগলে রাখতে হয়। হেলায় ফেলায় কাটাতে দিতে নেই।
তবে সেই সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে শয়তান প্রবেশ করে সম্পর্কটাকে নষ্ট করে দেয়।যদিও শয়তান আমাদের প্রতিনিয়ত তার ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছে।
সেই শয়তানকে সহজেই নিজেদের এই সম্পর্কের মধ্যে আসতে দিস না।

একটু চুপ হলো প্রজ্ঞা ফের বললো–আগে তোদের দুজনের মধ্যে ভালোমন্দ কি আর কেমন সম্পর্ক ছিলো সেটা ভুলে গিয়ে সম্পর্কটাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা কর।ভাই এক পা বাড়ালে তুই-ও আরেক পা বাড়িয়ে দে।সম্পর্কটাকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বামীস্ত্রী দুজনের ই সমান পদক্ষেপের প্রয়োজন।নাহলে দূরে দূরে থাকলে সেই সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যায়।বুঝে শুনে দু’জনেই যখন একি বাঁধনে বাঁধা পড়েছিস।তবে সম্পর্কটাকে সুন্দরভাবেই এগিয়ে নিয়ে যা।এভাবে দূরে দূরে থাকিস না দু’জন আর থাকার চেষ্টাও করিস না।একে অপরের ভালোমন্দের প্রয়োজনীতা অনুভব কর।দেখবি দু’জনের প্রতি দু’জনের ভালোবাসা এমনিতেই তৈরী হয়ে যাবে।আর ভাইকে তো চিনিস আর জানিসও খুব ভালো করে।তুই না নিজ ইচ্ছেতে তারদিকে এগিয়ে গেলে সেও এই সম্পর্কটাতে কখনোই এগোবেনা।আর তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো কখনোই নয়।তাই তোকেই কথাগুলো বললাম।বুবুমনির কথাগুলো ভেবে দেখিস।

হাতে থাকা চকলেট দুটোর দিকে একমনে নজর রেখে চুপচাপ কথাগুলো শুনে গেলো প্রান্তি।কিচ্ছুটি বললো না।প্রজ্ঞাও বুঝলোনা একপক্ষীক কথাগুলো বলে সে ঠিক করলো কি-না। তবে প্রান্তি বয়সে অপরিপক্ক তাই কথাগুলো তাকে বোঝানোর জন্য বলেছে সে।ভাইটা তো আর বয়সে অপরিপক্ক নেই।নিশ্চয় তার কথাগুলো বুঝে যদি প্রান্তি এগোই তবে তার ভাইটা পিছে মুড়বে না এটা তার বিশ্বাস।

.

সময়টা বেলা এগোরাটা।বাড়িতে জামাই এসেছে বলে রান্নার তোড়জোড় চলছে।মাহবুবা বেগম আর উনার জা রান্নাঘরে রান্না করছেন।বাড়ির সব ছেলেমেয়ে গুলা ড্রয়িংরুমে খেলা করছে।প্রজ্ঞা আর প্রান্তি রাবেয়া খাতুনের সাথে গল্প করছে।এমন সময় গলা উচিয়ে মাহবুবা বেগম প্রান্তিকে ডাক দিলেন।এক ডাক পেতেই প্রান্তিও চলে এলো।

—বড়আম্মা ডাকছো আমায়?

—ওহ এসেছিস।আমার একটা কাজ করে দেন মা।এখন কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে ইচ্ছে করছেনা।তুই প্রহানের রুমে গিয়ে ওর আধোয়া কাপড়ের ঝুড়িটা এনে ফুলবানুর কাছে দে না মা।

রান্নাঘরে বড়আম্মাকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করতে দেখে আর কিছু বলতে পারল না প্রান্তি।সহজেই ওই রুমটাতে যাওয়া হয়না তার।তব রুমটার মালিকের উপর রাগ হলে সেই শোধ তার উপর না উঠাতে পারলে ঠিকই রুমের মধ্যে থাকা জিনিসের উপর রাগ ঝাড়তে ভোলে না প্রান্তি।তখন সাচ্ছন্দ্য রুমের মধ্যে ঢুকে রুমের বারো চৌদ্দ যেটা বাজানোর হয়,বাজিয়ে চলে আসে।বড়আম্মার কথা মেনে সেই কাঙ্ক্ষিত রুমের দিকে পা বাড়ালো প্রান্তি।রুমের কাছটাতে এসে ভিড়ানো দরজা আলগা করতেই অদ্ভুত একটা পরিচিত সুগন্ধ ভেসে আসলো নাকে।সুগন্ধটা তার অতি পরিচিত। মানুষটা আশপাশ থাকলে সুগন্ধটা সে পায়।

রুপালি কারুকার্যের ভারী পর্দটা ঠেলে রুমের মধ্যে প্রবেশ করতেই সুগন্ধটা আরও তিব্রভাবে নাকে ঠেকল প্রান্তির।অজানা কারনে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো তার।অতি শান্ত পরিবেশের পরিপাটি করে রাখা ঘরটার চারপাশটা ধীর নজরে একবার নজর বুলিয়ে নিলো সে।ঝুড়িটা কোথাও নজরে মিললো না।পিছনে ফিরতেই দেখতে পেলো,দরজার কর্নারে রাখা ঝুড়িটা।পারফেক্ট জায়গা।মনেমনে ক্ষীন হাসলো প্রান্তি।পুরুষ মানুষও এমন নিখুঁত গোছগাছ টাইপের হয়।হয় তো।এই যে এই ঘরের মালিকের ঘরটা দেখলেই তো বোঝা যায়।সে কতোটা পরিপাটি আর নিখুঁত স্বভাবের।

ঝুড়িটা হাতে নিয়ে কলপাড়ে চলে এলো প্রান্তি।ঝুড়িটা ফুলবানুর দিকে এগিয়ে দিতেই লক্ষ্য করলো ফালবানু মিটিমিটি হাসছে।আশেপাশে তাকালো প্রান্তি,নাহ এমন কিছু তো নজরে পড়ছেনা।যে তা দেখে ফুলবানু হাসছে।তবে?

—এই তুমি হাসছো কেনো ফুলবানু।

—আপনারে দেইখা।

আশ্চর্য হলো প্রান্তি।আশ্চর্য নজর নিয়েই নিজের সমস্ত শরীরটা একবার নজরে বুলিয়ে নিলো।কৈ তাকে অদ্ভুত দেখতে তো লাগছে এমনটাও তো-না।তবে ফুলবানু কেনো এমনটা বলছো?সেটা দেখে ফুলবানুর হাসিটা প্রসারিত হলো।বললো– আপনারে অদ্ভুত দেখাচ্ছে না।

—তবে?

—এইযে সেদিন কলেজ থাইকা আইসা বড়আম্মারে কি কইলেন,তোমার পোলা পৃথিবীর সব চাইতে খারাপ পোলা।বাড়িতে আইলে আপনে খুন কইরা ফালাইবেন তারে।অথচ আপনে ভাইজানের তরে নিজেই খুন হইয়া গেলেন।এখন আবার তারই কাম করা লাগছে।দেখছেন গরীবের কথা বাসি হইলে ফইলা যায়।আমার বদদোয়া আপনের গায় লাগছে তাই মুই হাসতেছে।

নাক ফুলিয়ে কথাগুলো শুধু হজম করে গেলো প্রান্তি।তার মনেহলো ফুলবানুর মুখটা সুচসুতো দিয়ে সেলাই করে দিতে।কিন্তু সেটাতো হওয়ার নয়।বলে হাতি কাঁদায় পড়লে বাঙেও লাথি মারে।তার অবস্থা এখন হয়েছে তাই।তবে এই রাগ সে কার উপরে দেখাবে।নিজের উপর নাকি বাড়ির অন্যদের উপর নাকি ওই লোকটার উপর।যাকে নিয়ে ফুলবানুও তাকে উপহাস করছে।

—তুমি আমাকে উপহাস করে কথা বলছো ফুলবানু?

—তওবা তওবা।আমি আপনের নিয়ে উপহাস কইরা কথা কমু ক্যান।আপনি ভাইজানের বউ আপনেরে নিয়ে আমি উপহাস কইরা কথা কইতে পারি।ভাইজানের বউ নাহয়ে আগের প্রান্তি আপা হইলে সে নাহয় এখখান কথা ছিলো।

আগের থেকে শেষের কথাগুলো শুনে আরও রাগ হলো প্রান্তির।এই রাগের কারনটা শুধু ওই মানুষটা নাহলে ফুলবানু তাঁকে এতো কথা কখনো শোনাতে পারতোনা।রাগ-ক্ষোভে ফুলবানুকে বললো—তুমি আর তোমার ভাইজান একটু-ও ভালো না।যার জন্য আমাকে কথা শোনালে,তোমার কথার দরুন তাকে ভুগতে হবে।বলে দিলাম তোমাকে!

কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলো প্রান্তি। সেদিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়ালো ফুলবানু।সে তো প্রান্তি আফামনিরে একটু ক্ষেপানোর জন্য কথাগুলো বলেছে কিন্তু আফামনি যে এতো ক্ষেপে যাবে সে ভাবতেই পারিনি।তারজন্য এবার ভাইজানের কপালে কি দূঃখ লেখা আছে কে জানে।

.

আছরের আজানের বেশ আগেই বাড়িতে এলো প্রহান।দোতলা বাড়িটা একদম শান্ত।হয়তো সবাই দুপুরের খাওয়ার পর রেস্ট নিচ্ছে।নয়তো ঘুমিয়েছে।আর বিচ্ছু গুলো-ও নিশ্চয় ঘুমে।না-হলে বাড়িটা এতোটা-ও শান্ত থাকার কথা নয়।দরজা খুলে দিলো ফুলবানু।খুলেই প্রহানকে দেখে অসহায় নজরে তাকালো সে।সেদিকে বিশেষ খেয়াল করলোনা প্রহান।নিজের রুমে চলে গেলো।গোসল সেরে পোশাক পরে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিচ্ছিলো।কিন্তু আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার আগে প্রিয় নারীর প্রতিবিম্বটা নজরে পড়লো।খুশি হওয়ার বদৌলে কপাল কুঁচকে গেলো প্রহানের।মেয়েটার চেহেরার ভাবসাব দেখেতো সুবিধার মনে হচ্ছেনা।আবার কি হলো?কে কি বললো?কার রাগটা আবার তারউপর মেটাতে এসেছে কে জানে?নজরটা শান্ত রেখেই পিছনে ফিরলো সে।তারআগেই সূর্যের ন্যায় প্রখর রূপ নিয়ে মেয়েটা তার সামনে এসেই হাজির।

—আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেনো?আমি নাহয় সবার চাওয়াটকে উপেক্ষা করতে পারিনি বলে সম্মতি দিয়েছি।আপনি না করলে তো কেউ আপনাকে জোর করতে পারতোনা। তবে কেনো সম্মতি দিলেন,অসম্মতি প্রকাশ করলেন না? অপছন্দ হওয়া সত্ত্বে-ও আমাকেই কেনো বিয়ে করলেন?

এই অবুঝ বউটাকে সে কি-করেই বা বোঝায়।ভেঙেচুরে বোঝানোর ক্ষমতাটা কি সত্যিই তার আছে।থাকলে তো মেয়েটা এতোদিন তাকে বুঝে যেত।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহান।মেয়েটা যে কার-ও উপর রেগে গিয়েই তাকে প্রশ্ন করছে এটা বেশ বুঝলো সে।শান্ত পদক্ষেপ প্রান্তির দিকে আরও দুকদম বাড়িয়ে দু’জনের মাঝের দুরত্বটা অনেকটাই ঘুচিয়ে ফেললো প্রহান।মুখটা নিচু করলো। প্রান্তির রাগান্বিত নজরে নিজের শান্ত নজরটা রাখলো।ফের কোমল কন্ঠে বললো।

—কিছুকিছু চাওয়া আর ইচ্ছেগুলো না চাইতেও নিজের নিয়ন্ত্রাধীন রাখতে হয়।যেমনটা তুই আমার বউ হওয়া সত্ত্বে তোরসাথে এখন খুব বর বর আচারন করতে ইচ্ছে করছে।আর তার থেকে-ও খুব বাজে ভাবে ইচ্ছে করছে তোর ওই কোমল গোলাপি রঙা ঠোঁটে নিজেকে ডুবিয়ে নিতে।কিন্তু ওই যে কিছু কিছু চাওয়া না চাইতে-ও দমন করে রাখতে হয় নিজ নিয়ন্ত্রণে। তাতেই সবার শুভ হয়।ভালো হয়।

একটু থেমে মুখটা আর-ও এগিয়ে নিলো প্রহান।সাহসী মেয়েটা তবুও একচুল নড়লোনা।দু’জনের শ্বাস-প্রশ্বাস মিশে একাকার হতে থাকলো। তবু-ও দু’জনেই দু’দিকে থেকেই অবিচল।ফের প্রহান বললো

—মনেকর তোকে বিয়ে করার আমার কারনটাও ঠিক এমনটাই।যারজন্য সম্মতি জানাতেই হলো।

চলবে…

লেখার পর রি চেইক করতে ভিষণ আলসেমি হয়।যার কারনে প্রচুর টাইপিং মিস্টিক থাকে।তাই ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here