হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব৩১

0
224

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩১ [বিবাহ স্পেশাল (১)]

বধু বেশে প্রফুল্ল চিত্তে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পড়া নিজের প্রতিবিম্বের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ! পড়নে আমার বিয়ের মেহরুন রঙের বেনারসি আর ভারী স্বর্ণের অলংকার! যা আমার সাধারণ সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে! ছোট থেকেই প্রতিটা নারীর এমন বধুরূপে সাঁজবার শখ থাকে আর সেটা যদি হয় নিজের শখের পুরুষটির জন্যে তাহলে তো আর কোনো কথা-ই রইল না। আমিও অবশ্য তার ব্যতিক্রম নই। আজ যে আমার সকল স্বপ্নগুলি একে একে বাস্তবে রূপান্তরিত হতে চলেছে! আর এই সবকিছু হয়েছে আমার প্রাণপ্রিয় মানুষটির বদৌলতে!

পার্লারের মেয়েগুলো সেই তখন থেকে আমার মুখশ্রীতে নানান ধরনের ভারী মেকআপের প্রলেপন লেপেই চলেছে। এতে করে আমায় বেশি সুন্দরী দেখা গেলেও আমার আসল রূপের বিলুপ্তি ঘটেছে যে! এ কারণে আমার মাঝে প্রতিবাদী মনোভাব ফুটে উঠলেও, নিজেকে দমিয়ে রাখলাম কেননা আমি বউ মানুষ, সামান্য বিষয়ে এমন করাটা শোভা পায় না যে আমার! অগত্যা তাই উপায়ন্তর না পেয়ে চুপটি করে ভদ্র মেয়ের মতো বসে রইলাম।

মেয়েগুলোর কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবার পর, পাশ থেকে একটা মেয়ে বেশ উচ্ছ্বাসের সহিত বলে উঠল

-‘ ম্যাম দেখুন, আপনাকে কিন্তু দারুণ লাগছে!

মেয়েটার কথা শুনে আয়নায় পড়া প্রতিবিম্বের পানে আরও একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি। সত্যিই চমৎকার লাগছে আমায়! মনের কোণে কেমন এক অন্যরকম অনুভূতিরা উঁকি দিয়ে যায়! এছাড়াও মস্তিষ্কের নিউরন সেলের মাঝেও নানান রকম শঙ্কা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আমায় এমন রূপে দেখে না জানি এই আদ্রিশটা আবার কি করে বসে, ভাবতেই অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলাম আমি!

এরই মাঝে কক্ষের দরজা ঠেলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রিশতা, অরনী, আর আয়ুশী ভাবি। আয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওরা এগিয়ে আসে আমার পানে। এর মধ্যে রিশতা কিছুটা চেঁচিয়ে বেশ উচ্ছ্বাসের সহিত বলে উঠল

-‘ মাশাআল্লাহ! তোকে তো বউ সেঁজে সেই লাগছে মেহু! বলা যায় তো না, আবার দেখা গেল, আমাদের মেহুকে এমন রূপে দেখে আমাদের আদ্রিশ ভাইয়া ফিট খেয়ে বসল!

রিশতার কথায় উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে ফেলে। আর এদিকে ওর এহেন বাক্যচয়নে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হলো আমায়! তবে ভারী মেকআপের আস্তরণে আমার গাল ঢাকা পড়ায় ঐ লজ্জার লাল আভা নজরে পড়েনি আর!

আমায় নিজেদের দিকে ফিরিয়ে থুতনিতে আলতো হাত ছুঁইয়ে আদুরে ভঙ্গিতে অরনী বলল

-‘ ইশশ, কতোদিনের শখ ছিল তোর আর আদ্রিশ ভাইয়ের বিয়েটা খাওয়ার! আজ সত্যিই তা পূরণ হতে চলেছে। সত্যি বলতে কি আমার না এখনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা এসব!

অরনীর কথার পিঠে আমি কিছু বলার পূর্বেই, পাশ থেকে রিশতা ফোঁড়ন কেটে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠল

-‘ তোর যখন বিশ্বাসই হচ্ছে না, তখন আয় একটা চিমটি কেটে দেই?

রিশতার কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় অরনী। ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে, দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল

-‘ তুই আর মানুষ হলি না রে রিশু!

সরু চোখে অরনীর দিকে চেয়ে জবাব দেয় রিশতা

-‘ বাহ রে, আমি তো মানুষ-ই আর কি মানুষ হবো!

রিশতা হতে এমন উত্তর পেয়ে মাথায় হাত চলে যায় অরনীর। আর এদিকে এতোক্ষণ যাবত আমি নির্বিকার চিত্তে চেয়ে চেয়ে ওদের তাল তামাশা দেখছিলাম। ওদিকে পার্লারের মেয়েগুলোও চলে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।

এবার আয়ুশী ভাবি এগিয়ে এসে আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল

-‘ তোমায় সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে মেহরুন! দোয়া করি বোন, জীবনে অনেক অনেক সুখি হও। দেখো আমাদের আদ্রিশ ভাই তোমাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসবেন!

আয়ুশীর কথায় মুচকি হাসলাম আমি। উঠে দাঁড়িয়ে আলতো হাতে জড়িয়ে নিলাম তাকে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে, মুচকি হেসে বললাম

-‘ আমার পরেই এবার কিন্তু তোমার সিরিয়াল! আর কতোদিন মিছে মিছে ভাবি ডাকব, বলতো?

আকস্মিক আমার এহেন কথায় থতমত খেয়ে যায় আয়ুশী। সেইসাথে লজ্জায় তার গাল রাঙা হয়ে ওঠে। এই বাড়ির সকলে জানে আয়ুশী আমার স্কুলের সিনিয়র আপু। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় আমার বিয়ের সুবাদে তার আগমন! তাই ও এ বাড়িতে আসায় বাড়ির লোকজন বিষয়টা আমলে নেয়নি তেমন। আর তাছাড়াও এতো ব্যস্ততার মাঝে এসব সূক্ষ্ম জিনিস খেয়াল করার সময়ও থাকেনা। তবে আসল সত্যিটা তো আমি, রিশতা, অরনী আর আদ্রিশ ছাড়া কেউ জানেনা।

আমার তালে তাল মিলিয়ে রিশতা, অরনী দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল

-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও তাই চাই। আর কতদিন এমন মিছে মিছে ভাবি ডাকব? এবার আমরাও পারমানেন্টলি ভাবি ডাকতে চাই! মেহু আর আদ্রিশ ভাইয়ের বিয়ের পর তোমার আর আলভি ভাইয়ের বিয়েতেও এনজয় করতে চাই আমরা!

আমাদের এহেন কথায় এবার সত্যি সত্যিই ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায় আয়ুশী ভাবি। তাই তো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে চলে যায় সে। ওর চলে যাওয়ার পানে চেয়ে আমরা তিনজনেই হাতে হাত মিলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম।

আমার ঘরে মা ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন

-‘ কি রে, কি নিয়ে তিনটা মিলে এতো হাসাহাসি করছিস, বল তো?

-‘ ও কিছু না মামিমা। আসলে আজ মেহুর বিয়ে তো তাই কিভাবে কি করতে হয়, একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছিলাম আরকি!

মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দেয় রিশতা। রিশতার বলার ভঙ্গি দেখে কেশে উঠলাম আমি। ইশ এই মেয়ের বুদ্ধি এখনও হাঁটুতেই গেঁথে আছে বোধহয় নইলে মায়ের সামনে কেউ এমন অসভ্যের মতো কথা বলে! এমনিতেই যতবারই মা অথবা মামনির সামনে পড়েছি, তারা কেমন করে যেন আমায় দেখেছে, যার দরুন প্রতিবারই লজ্জায় পড়তে হয়েছে আমায়। আর এখন আরও একদফা লজ্জায় পড়তে হচ্ছে!

মা ওদের কথায় পাত্তা দিলেন না। এগিয়ে এসে আমার চিবুক উঁচু করে ধরে আলতো আমার গালে হাত ছুঁইয়ে বললেন

-‘ মাশাআল্লাহ, আমার মেয়েটাকে দেখতে আজ পরীর চাইতে কোনো অংশে কম লাগছে না! দেখতে দেখতে আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কতো বড় হয়ে গেল! আজ নাকি তার বিয়ে, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না রে মা! তুই এতো বড় হলি কবে! সেইদিনই না আমার কোল আলো করে তুই এলি! আমার ছোট্ট মেহুকে সারারাত কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম! খাওয়া নিয়ে আমার মেয়ের বাহানার শেষ ছিল না, ধরে বেঁধে খাইয়ে দিতাম! মাঝেমধ্যে তো পেছন পেছন দৌড়াতে হতো তোকে খাওয়ানোর জন্য। তারপর এলো তোকে স্কুলে ভর্তি করানোর পালা! আমি আর তোর বাবা তোকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম এইতো কিছুদিন আগের কথা, এখনো চোখের সামনে ভাসে! কখনো বাবার কোলে চড়ে, কখনো-বা আমার হাতের একটা আঙ্গুল তোর ছোট্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে, ছোট ছোট পা ফেলে স্কুলে যেতিস! যদিও তখন আমাদের গাড়ি ছিল না আর স্কুল খুব বেশি একটা দূরে না হওয়ায় হেঁটেই যেতাম! এসব কিন্তু খুব বেশিদিন আগের কথা নয়! অথচ দেখো, নিমেষেই সময়গুলো কত দ্রুত চলে গেল! আমার সেই ছোট্ট মেহুর আজ নাকি বিয়ে!

আবেগে উপরোক্ত কথাগুলো বলতে বলতেই মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। সাথে আমারও। শক্ত করে তাই জড়িয়ে ধরলাম মাকে। মা আমার পিঠে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন। এভাবে খানিক সময় কেটে যাওয়ার পর মামনি এসে অভিমানি সুরে বলে উঠলেন

-‘ মাকে পেয়ে তো আমার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিস! আমরা শাশুড়িরা সত্যিই বড় অবহেলিত!

মামনির এমন অভিমানি কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। এবার মাকে ছেড়ে, মামনির দিকে এগিয়ে এলাম। আলতো করে মামনির গালটা টেনে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললাম

-‘ তোমার মতো এমন একটা সুইট কিউট শাশুড়ি আম্মু থাকলে, তাকে কি এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায়!

আমার এমন কথায় মামনি আমার কপালে চু’মু দিয়ে বললেন

-‘ এইজন্যই তো তোকে এতো ভালোবাসি রে মা। তোকে ছাড়া থাকতে পারব না বলেই তো আমার দশটা না পাঁচটা একটামাত্র ছেলের বউ করে এ বাড়িতেই সারাজীবনের মতো রেখে দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম!

মামনির কথায় মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সত্যিই আমি ভীষণ ভাগ্যবতী মামনির মতো এমন একটা শাশুড়ি আম্মু পেয়ে। আমার বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে তবে!

আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে মায়ের উদ্দেশ্যে মামনি বললেন

-‘ খুব তো মেয়ের শাশুড়ি, শশুরবাড়ি নিয়ে চিন্তায় ছিলি, তো শাশুড়ি হিসেবে পছন্দ হয়েছে তো আমায়? আর যাইহোক আমাদের শাশুড়ির মতো দজ্জাল শাশুড়ি হবো না আমি!

মামনির কথায় মা ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন

-‘ তোমার কোনো তুলনা হয়না ভাবি! তুমি যেভাবে আমাকে শাশুড়ির ধমক থেকে বাঁচাতে আর বিশেষ করে আমার মেয়েটাকে আগলে রাখতে, সত্যি বলতে কি এমন জা বা এমন চাচি ক’জনের ভাগ্যে জোটে! আর আজ থেকে তো তুমি আমার মেয়ের শুধু চাচিই নও, আমার মেয়ের শাশুড়ি হতে যাচ্ছো! তোমার মতোন শাশুড়ি যার কপালে জুটবে তার মতো ভাগ্যবতী আর দুটো নেই!

রিশতা, অরনীও বাদ যায় না। মায়ের সাথে সহমত পোষণ করে তারাও বলে উঠল

-‘ হ্যাঁ ছোট মামিমা ঠিকই বলেছ! আমাদের বড় মামিমার সাথে দজ্জাল শাশুড়ির স্বভাবটা ঠিক যায়না!

ওদের কথার পিঠে শুধু বিগলিত হাসলেন মামনি। এবার মামনি আমায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাড়া দেখিয়ে বললেন

-‘ জড়িয়ে ধরার পরেও অনেক সময় পাবি। এখন তো নিচে চল। ছেলেটা আমার তোর অপেক্ষায় কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে রে!

মামনি হতে এহেন কথায় বিপাকে পড়ে যাই আমি। হুট করে আমার গতরাতের কথা মনে পড়ে যায়। গতরাতে আদ্রিশই আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল, শীতল কন্ঠে একপ্রকার হুমকি দিয়ে চলে যায় সে। তার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, আমিও নিজের কক্ষে চলে গিয়েছিলাম তবে সেরাতে আর এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারিনি আমি।

মামনির ডাকে ধ্যান ভাঙে আমার। কেউ আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমায় নিয়ে নিচে নেমে এলো। রিশতা আর অরনীর মাঝে আজ পুলক জেগেছে! তারা তো এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল! আজ জম্পেশভাবে হৈ হুল্লোড় করবে সেইসাথে কব্জি ডুবিয়ে তাদের প্রিয় দুটি ভাইবোনের বিয়েতে খাবে!

আমি স্টেজের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি ততই আমার হৃদ স্পন্দন বেড়েই চলেছে যেন! মনের কোণে আবারও সূক্ষ্ম অনুভূতিরা হানা দিতে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে! স্টেজের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে আসতেই নজর পড়ে আমার শখের পুরুষটির পানে! উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এই সুঠামদেহীর পুরুষটিকে শুভ্র শেরওয়ানিতে মানিয়েছে ভীষণ! তাহার এমন রূপ দেখিয়া থমকে যায় আমার চরণ দুখানি! পুনরায় হৃদয় উপকূলে উত্তাল ঢেউ তোলে। আমার যে সেই পূর্বের ন্যায় আবারও তাহাকে দেখিয়া #হৃদয়ে_লাগিল_দোলা!

তাকে দেখে মোহগ্রস্ত চিত্তে চেয়েছিলাম এতক্ষণ যাবত! কিন্তু ভাবনার সুঁতো ছিড়ল তার করা এক আজব কাণ্ডে…

#চলবে ~

কেমন হলো আজকের পর্বটা? আপনারা তো ঠিকমতো রেসপন্স করেন না বলেই একদিন পর পর গল্প দেই। যদি আবার আগের মতো রেসপন্স করতেন তাহলে আবার আগের মতোই নিয়মিতই গল্প দিতাম!🫤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here