#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২৮ [মেহেন্দি স্পেশাল]
আমায় ঘিরে গোল হয়ে বসে রয়েছে সবাই। আর আমি দুহাত ভর্তি করে মেহেদি মেখে সঙ সেজে বসে আছি। আজ যে আমার মেহেন্দি অনুষ্ঠান! সেই সুবাদেই নামকরা মেহেদী আর্টিস্টদের মিলনমেলা বসেছে যেন আমাদের ‘খান মহলে’। বুঝতে আর বাকি নেই এসবই আদ্রিশের কারসাজি! ইতোমধ্যে আমার পুরো কাজিন মহল এসে হাজির হয়েছে। এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের সাথে বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা, তারা না এলে কি চলে! শুরু থেকেই আমায় আর আদ্রিশকে নিয়ে গুঞ্জন ছিল তবে আজ তা সত্যি সত্যিই বাস্তবে রূপান্তরিত হতে চলেছে! আর তাই আমার উপস্থিত কাজিনগণও নানাভাবে আমায় টিপ্পনী কেটে ঠাট্টা মশকরা করতে শুরু করে দিয়েছে, সেই সাথে উপরি পাওনা স্বরূপ যোগ দিয়েছে রিশতা আর অরনীও!
ওদের এমন টিটকারিতে লজ্জা পাওয়ার বদলে আমার রাগ হচ্ছে ভীষণ! আর এই রাগটা আরও একদফা চড়াও হয়ে বসল আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখতেই। হাসি হাসি বদনে এগিয়ে এলো সে আমার পানে। এদিকে আমার হাতে মেহেদী দেওয়ারত মেয়েটা বিনয়ের সহিত আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠল
-‘ ম্যাম, এখানে আপনার আর আপনার উডবি হাসবেন্ডের নাম দিবো?
আমি কিছু বলার পূর্বেই আদ্রিশ এসে অকপটে বলে দিল
-‘ হ্যাঁ সিওর! কেন নয়? তবে হ্যাঁ মেহরুন, আদ্রিশ আলাদা ভাবে না লিখে একটু ইউনিক, লাইক ❝মেহাদ্রিশ❞ এভাবে দিলে ভালো হবে।
আদ্রিশের কথামতো মেয়েটা তা-ই করল। আমি সরু চোখে ফিরে চাইলাম তার পানে। বিনিময়ে সে মুচকি হাসল শুধু। উনি চলে যেতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লাম আমি।
..
সেদিন,
আদ্রিশ ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মামনির কক্ষে। সেখানে মা আর মামনি দুজনে বসে পান চিবোচ্ছিলেন আর খোসগল্প জুড়েছিলেন। এই অসময়ে আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে তাদের আসরে ব্যাঘাত পড়ে। কপালে যৎকিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে তাই মামনি বলে উঠলেন
-‘ কিরে তোরা এখন এই সময়ে! কোনো সমস্যা হয়েছে?
আদ্রিশ চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
-‘ না কোনো সমস্যা হয়নি তবে হতে কতক্ষণ!
আদ্রিশের এমন হেয়ালিপনা দেখে তার কপালের ভাঁজ আরও খানিকটা প্রশস্ত হয়। গম্ভীর গলায় তাই তিনি সুধালেন
-‘ কি বলবে পরিষ্কার করে বল! এমন হেয়ালি আমার পছন্দ নয়।
আদ্রিশ এবার শান্ত গলায় সোজাসাপটা জবাব দেয়
-‘ আমার মেহুকে ভালো লাগে। তাই ওকে বিয়ে করতে চাই আমি।
আদ্রিশ ভাইয়ার আচমকা এহেন কথায় হতভম্ব হয়ে যাই আমি। জোড় গলায় বলে উঠলাম
-‘ ইম্পসিবল!
-‘ ওকে ফাইন, বিয়ে করতে মন না চাইলে করতে হবে না। তবে কোনো অঘটন ঘটে গেলে কিন্তু আমি দায়ী থাকব না। মাইন্ড ইট!
হুট করে আদ্রিশ ভাইয়ার হলোটা কি? উনি এভাবে কেন কথা বলছে! আগের আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে এই আদ্রিশ ভাইয়ার আকাশ পাতাল তফাত যেন! যে কিনা নিজের অনুভূতিগুলো সন্তর্পণে নিজের মাঝে চেপে রাখত, আর আজ সে-ই অকপটেই বলে দিচ্ছে এই কথাগুলো! আমি অবাক না হয়ে পারলাম না আর। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম তাই।
-‘ মা চাচির সামনে এসব কি অসভ্যের মতো কথা বলছো! ছোট থেকে এই শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছি তোমায়?
মামনির ঝাড়ি খেয়ে মাথা নিচু করে নেয় আদ্রিশ ভাইয়া। তবে দমে যায়না সে। এবার তাকে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, প্রয়োজন পড়লে বেহায়া হবে, তবুও তার মেহুকে তার নিজের করা চাই! নিচু গলায় পুনরায় সে বলে উঠল
-‘ আম্মু আমার অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। এতোদিন অনেক অপেক্ষা করেছি কিন্তু এখন আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। মেহুকে এখন আমার ইমিডিয়েটলি প্রয়োজন। তাই যত দ্রুত সম্ভব ওকে বিয়ে করে আমার বউ বানানো চাই!
মামনি এবার রেগে যান ভীষণ। মৃদু চেঁচিয়ে তাই বলে ফেললেন
-‘ দিনদিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছ! কার সামনে কি বলতে হয় সে বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে তোমার?
মা এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছিলেন। তবে তিনি এবার মুখ খুললেন। মামনির হাত চেপে বললেন
-‘ ভাবি, আমরা তো আগে থেকেই চাইতাম, আমাদের ছেলে মেয়ে দুটোর বিয়ে দিতে। আর এখন ওরাই যেহেতু দুজন দুজনকে পছন্দ করে সেহেতু আমি মনে করি বিয়েটা এবার দিয়েই দেওয়া উচিত।
মায়ের কথায় মামনি শান্ত হন। সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন।
আদ্রিশের কাছে এগিয়ে এসে হালকা হেসে মা বললেন
-‘ আগামী মাসেই না হয়..
-‘ না না ওতো দেরি করলে চলবে না। আজ সোমবার আর পাঁচদিন পরেই তো শুক্রবার! শুক্রবারেই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দাও, প্লীজ ছোট মা!
মায়ের কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ বলে উঠল উক্ত কথাটা। মামনি গর্জে উঠেন আদ্রিশের এমন আচরণে। আদ্রিশ পাত্তা দেয় না সেসব। সে চেয়ে আছে তার চাচির পানে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
-‘ আচ্ছা তবে তা-ই হবে বাবা।
তার চাচির এমন কথায় আদ্রিশের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। খুশিতে তার চাচির হাত ধরে বলে উঠল
-‘ তোমার মতো চাচি সবার ঘরে ঘরে হোক! তুমিই একমাত্র মানুষ যে বোঝে আমায়। আই লাভ ইউ ছোট মা, থ্যাংকুউ সো মাচ!
এতোটুকু বলেই চলে যায় আদ্রিশ। আমি অবাকের উপর অবাক হলাম। আচমকা আদ্রিশ ভাইয়ার এমন পরিবর্তনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ কোন আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখছি আমি!
আদ্রিশ ভাইয়ার পিছু পিছু আমিও বেরিয়ে পড়লাম। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। এতোদিন শুনতাম লোকটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের, তবে আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম। এর সাথে বিয়ে হলে আমার জীবনটা ত্যানাত্যানা হয়ে যাবে নির্ঘাত! সেই শোকে কপাল চাপড়ালাম আমি।
আদ্রিশ ভাইয়া আবারও ফিরে এলো। আমার একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল
-‘ কি রে কেমন দিলাম? বলেছিলাম না তোর জন্য সারপ্রাইজ রয়েছে, আরও আছে কিন্তু! আমায় আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে দেখে ঝটকা লেগেছে তাই না? সবে তো শুরু হলো, কাহানি আভি বাকি হ্যা ইয়ার!
এতোটুকু বলেই বাঁকা একটা হাসি দিয়ে চলে গেল মানুষটা। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি যেন। কিছুটা ঘোরের মাঝে থাকার পর, যখন হুশ ফেরে তখন ফুঁসে উঠি আমি। আমিও দেখে নেব তাকে!
..
-‘ কি এতো ভাবছ বউ? এতো না ভেবে একটু বরের দিকে নজর দিলে তো পারো!
শীতল পুরুষালি কণ্ঠস্বর কর্ণকুহুরে ঠেকতেই চকিত ফিরে তাকালাম সেদিক পানে। আমার পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে আদ্রিশ ভাইয়াকে হাসতে দেখে আবার রাগ চড়ে বসল আমার মাথায়। ভালো করে চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের গানবাজনা চলছে।ওদিকে আমাদের কাজিনরা যে যার কাজে ব্যস্ত, কেউ মেহেদি দিচ্ছে তো কেউ ডান্স প্রাকটিস করছে, তাছাড়াও বাড়ির বড়রাও এখানে নেই। এই সুযোগে দুম করে তার বুকে কিল, ঘুষি বসিয়ে দিলাম আমি। আকস্মিক আমার এহেন আচরণে সে অবাক হওয়ার পরিবর্তে হো হো হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ভ্রু নাচিয়ে সে বলল
-‘ আদ্রিশ খানের বউ এতো দূর্বল হলে চলে! তোর কিল ঘুষিতে আরও সুরসুরি লেগেছে আমার। বলি কি বেশি বেশি বাদাম, আখরোট খেয়ে শক্তি গেইন কর। নয়তো আমি যখন তোর উপরে উঠব তখন তো তোকে হারিকেন জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা!
ভ্রু কুচকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম তার পানে। পরে বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম আমি। বিয়ের আগেই এমন ঠোঁটকাটা, না জানি বিয়ের পর কি হয়!
ইতোমধ্যে আমাদের কাজিনরাও তাদের নৃত্য পরিবেশন শুরু করে দিলো। সোফায় বসে সেসব উপভোগ করছিলাম আমি। এরই মাঝে রিশতা, অরনী দুজনে ছুটে এসে আমায় টেনে নিয়ে গেল ওদের সাথে নাচার জন্য। আমি ইচ্ছে না থাকলেও ওদের জোড়াজুড়িতে তাল মেললাম শুধু।
ছেলেরা একদিকে নাচচ্ছে আর মেয়েরা আরেক দিকে। ছেলেদের মধ্যে রয়েছে আলভি, আরাভ, আদ্রিশ, আহির ছাড়াও আরও অনেকে। আর মেয়েদের মধ্যে মেহরুন, রিশতা, অরনী, আয়ুশীসহ আরও অনেকে। এবার পালা কাপল ডান্সের! ওদের এক করতে পেছন থেকে তাই আদ্রিশ আর মেহরুনকে ধাক্কা দেয় ওরা।
তাল সামলাতে না পেরে তাই আদ্রিশের বুকে আছড়ে পড়লাম আমি। আদ্রিশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমায়। সাউন্ড বক্সে চলছে সফট মিলডি সং। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আদ্রিশের পানে। কালো রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে মানিয়েছে বেশ! তাকে দেখলেই একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ফেলে আমায়। মন চায় শুধু চেয়ে থাকি তার পানে। এদিকে একইভাবে আদ্রিশও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল তার প্রেয়সীর পানে!
#চলবে~
মেহাদ্রিশ জুটিকে কেমন লাগে আপনাদের?