কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা ১৬.

0
147

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৬.

নভেম্বরের বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাস। পুরোটা সকাল ঝুমঝুমিয়ে থেকে, কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশ এখনো মেঘলা। গুমোট ভাবটা পুরোপুরিভাবে কাটেনি। সবুজ ঘাসের ডগায় লেগে আছে পানিকণা। তাথৈ এপ্রোনের পকেটে হাত দিয়ে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। আজকে ল্যাবওয়ার্ক আছে ওদের। ক্লাসের বেশিরভাগ আড্ডায় ব্যস্ত। আলো একপাশে দাড়িয়ে ফাইলে কিছু লিখছে। তুল্য এককোনে হাইবেঞ্চে বসে। দাঁতে ম্যাচের কাঠি ধরে রেখে শার্লিকে দেখছে ও। শার্লি ল্যাবের একটা একটা জিনিস হাতে নিচ্ছে, বিজ্ঞের মতো পরখ করছে, আবার রেখে দিচ্ছে। তুল্য অপেক্ষায় আছে, কখন শার্লি একটা কিছু নষ্ট করবে, আর ও গিয়ে এ নিয়ে ঝামেলা করবে। ল্যাবের সহকারী খবরকাগজ থেকে চোখ তুললেন। চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে, পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন,

– মলিকিউলার ল্যাবে এসেছেন। একটু সতর্কতা মেনে চলুন কেমন?

ক্লাসের কেউ কিছু না বললেও কথাটা শার্লির গায়ে লাগলো। স্কেল হাতে ছিলো ওর। এগিয়ে এসে ওটা কাধে ঠেকালো ও। পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোকের সামনে বেশ ভাব নিয়ে বললো,

– কি মশাই? কথাটা কি আমাকে বললেন? টাকে নতুন চুল গজিয়েছে নাকি? হু?

শার্লির এ হেন আচরনে লোকটা থতমত খেয়ে যায়। আলো মাথা নেড়ে নিজের কাজে মন দিলো। তুল্য একপাশ থেকে উচু গলায় বললো,

– হোই তাথৈ? তোর বন্ধুরুপী বান্ধবীকে সামলাবি? নাকি আমি দায়িত্ব নেবো?

আলো তুল্যর দিকে চোখ তুলে তাকালো। শার্লি হচকিয়ে যায়। দুপা পিছিয়ে গুটিয়ে দাড়ায়। এই ছেলেটাকে দেখে শুরু থেকেই ভয় ওর। কিন্তু ইদানীং ওর ভয়ের ধরন বদলেছে। খালি মনে হয়, তুল্য কেমন একটা অদ্ভুতভাবে কথা বলে ওর সাথে। তাথৈ পকেট থেকে ফোন বের করলো। ক্লাস শুরু হবার কথা ছিলো আরো দশমিনিট আগে। অথচ এখনো টিচার ক্লাসে আসেননি। বিরক্তি নিয়ে ব্যাগের কাছে গেলো ও। বই বের করলো পড়বে বলে। তখনই ম্যাম ক্লাসে ঢুকলেন। তার সাথে আরো একজন ছিলো। ডেনিম রঙের শার্টের ওপর সাদা এ্যাপ্রোন, সিনথেটিক মাস্ক, আর হাতে গ্লাভস পরিহিত পুরুষালি অবয়বকে দেখে কপালে ভাজ পরে বেশিরভাগেরই। ম্যাম বোর্ডে নক করে বেশ দ্রুততার সাথে বললেন,

– এটেনশন গাইস! আমার একটু জরুরি কাজ পরে গেছে। আনফরচুনেটলি, তোমাদের এই প্রোজেক্টটা আমি নিতে পারছি না।

তাথৈ প্রচন্ড বিরক্ত হয়। বুকে হাত গুজে অন্যদিকে তাকালো ও। প্রোজেক্ট না নিলে একাডেমিক পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। যেটা ও মোটেও চাইছে না। ওর তো গ্রাজুয়েশন শেষ করা চাই। যতো দ্রুত সম্ভব! তুল্য টিচারকে ঢুকতে দেখে ম্যাচের কাঠি ফেলে না দিয়ে, পুরোটাই মুখে নিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু তার কথা আবারো গা ছাড়া হয়ে যায় ও। আলো ধীর আওয়াজে বললো,

– ম্যাম প্রোজেক্টটা তাহলে কবে নাগাদ কন্টিনিউ করবেন?

– ওকে৷ লেট মি এক্সপ্লেইন। আমি বলেছি প্রোজেক্ট আমি নিতে পারছি না। তারমানে এই না যে প্রোজেক্টটা পেন্ডিং থাকবে। তোমরা রিয়্যাকশন চেক করতে থাকো। শুধু অবসার্ভেশনে আমি থাকবো না। ও থাকবে।

সবাই তার পাশের ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা নিজের চেহারা দেখাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে সবার আগ্রহ বাড়ছে। টিচার বললেন,

– ও তোমাদের সিনিয়র ব্যাচের। তোমরা তো কোর্স কন্টেন্ট মেনে, মার্কসের জন্য ল্যাব করছো। ও এগুলো অবসার্ভ করবে৷ মোডিফিকেশন নিয়ে ওর…

ছেলেটা থামিয়ে দিলো তাকে৷ ম্যাম জানালেন, তার রিপোর্ট, আর ওদের প্রোজেক্টে নাকি মিল আছে। তাই প্রোজেক্ট অবসার্ভেশনে সে থাকছে। এমনটা প্রতিনিয়ত হয়। তবে ছেলেটা পরিচয় দিলো না। পরিপুর্ণ রিপোর্ট তৈরীর পর নাকি পরিচয় দেবে সে। ম্যাম সবটা গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। নতুন অবসার্ভেটরকে নিয়ে আশেপাশে গুনগুন শুনলেও, তাথৈ গুরুত্ব দিলোনা। ওর কাছে শুধুমাত্র নম্বর বিবেচ্য বিষয়। মোডিফিকেশন রিয়্যাকশন না। ছেলেটা আগে মাল্টিমিডিয়ায় কিছু বিষয় দেখালো। তারপর ক্লাসকে চারটে গ্রুপে ভাগ করে কাজ বলে দিলো। পুরোদমে কাজে লেগে যায় সবাই। আলো, তুল্য ওদের দল নিয়ে ছিলো। তাথৈ ওর নমুনা পরখ করতে করতে শার্লিকে বললো,

– অক্সিডিটি চেইক আমাদের সিলেবাসে নেই। তাহলে ল্যাবে এটা কেনো করানো হচ্ছে? বুঝলামনা।

– নমুনা প্রাণীতে সাইটোক্রোম অক্সিডেস এনজাইম আছে কি নেই, সেটা অক্সিডেস পজিটিভ প্রজাতি নাকি অক্সিডেস নেগেটিভ, এইটুক না জানলে প্রোজেক্ট এগোতে পারবেন না ম্যাডাম।

তাথৈয়ের একদম পাশ এসে বললো ছেলেটা। তাথৈ কিছুটা অবাকচোখে তাকায় তার দিকে। এই গলার স্বরটা ওর চেনা। চেহারা চিনতে ছেলেটার মাস্কের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ছেলেটা টেবিলের ওপরপ্রান্তে থাকা বিকার নিতে নিতে বললো,

– তোমার সমস্যা কোথায়? সবসময় নজরটা আমার ঠোঁটের দিকেই কেনো থাকে?

তাশদীদের কথা শুনে তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে চায়। ছেলেটা তাশদীদদ, টের পেয়ে হাতে থাকা কাচের ছোট্ট পিপেটটা শক্তমুঠো করে নেয় ও৷ এতটাই জোরে যে, ওটা ভেঙে ওর হাতে ঢুকে পরে। তাথৈ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না দিলো মা। কড়া গলায় বললো,

– তাশদীদ ওয়াসীর।

তাশদীদের হাত থামে। তাথৈয়ের দিকে ফেরে ও। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে শার্লি ব্যতিত সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ও একহাত বুকে গুজলো। আরেকহাত সেহাতে ঠেকিয়ে, থুতনির কাছে নিলো। তারপর তাথৈয়ের দিকে ঝুকে, ফিসফিসিয়ে বললো,

– তোমার সৌভাগ্যবশত, হ্যাঁ।

সের্ফ এটুক বলে তাশদীদ সরে দাড়ায়৷ অন্য গ্রুপের কাজকর্ম চেক দিতে চলে যায় ও। তাথৈ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে৷ পুরো ইউনিভার্সিটিতে আর কেউ ছিলো না? বেছেবেছে এর রিপোর্টটাই কেনো ওদের প্রোজেক্টের সাথে মিলতে হবে? প্রোজেক্টটা আট সপ্তাহ চলবে। আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে ল্যাবক্লাস। সে হিসেবে, মোট আটটা ক্লাস তাশদীদকে সহ্য করতে হবে ওকে! শার্লি শুনেছে সবটাই। শার্টের কলারের ভাজ ঠিক করতে করতে ও হেসে বললো,

– ছেলেদের দিক তাকিয়ে থুতু ফেললেও ওরা ভাবে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে। আর তুইতো মাস্কের নিচের ঠোঁটের দিকে তাকিয়েছিস!

তাথৈ অগ্নিচক্ষু করে তাকালো ওর দিকে। ওর দৃষ্টি দেখেই গলা ঝেরে, নিজের কাজে মন দিলো শার্লি। তাথৈ হাতের ভাঙা কাচ পাশের বিনে ফেলে টিস্যু মুঠো করে নেয়। সব রাগ এবার ওর নিজের ওপর এসে পরছে। বাকিদের মতো তাশদীদকে না চিনতে পারলেই ভালো হতো। আর যাই হোক, ক্লাস চলাকানীন, মেজাজটা তুঙ্গে থাকতো না ওর। একধ্যানে মাইক্রোস্কোপের দিকে তাকিয়ে রইলো তাথৈ। সত্যিই তাশদীদকে চেনে ও। খুব সহজে ল্যাবের নম্বর হাতে পাবে বলে ওর মনে হচ্ছে না।

ক্লাসে ঘন্টাখানেক দেরি আছে। তাথৈ বেরিয়েছে। এ ফাকে ল্যাবের পিপেট কিনতে যাবে ও। ল্যাবে যে ওটা ভেঙেছে, সেটা কারো চোখে পরেনি। শার্লি ক্যান্টিনে বসেছে দুপুরের খাওয়া খেতে। কার্জন পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই এক মহিলা তাথৈয়ের সামনে এসে দাড়ায়। বাধ্য হয়ে দাড়িয়ে চোখ তুলে তাকালো ও। কিন্তু সামনেরজনকে দেখে কিছুটা থমকে যায়। পাঁচফুট চার উচ্চতার ভদ্রমহিলার পরনে জলপাই রঙের সিল্কের শাড়ী। বড়গলার সরুহাতা ব্লাউজ, গলায় ডিজাইনার নেকলেস, হাতে এ্যান্টিকের চুড়ি, মাঝসিথি করে খোপা করা চুল। বাহাতে হ্যান্ডব্যাগ আর ডানহাতে খুব পরিপাটিভাবে অবাধ্য আঁচল ধরে রাখা মহিলাকে দেখে কেউ বলবে না, তার বয়স চল্লিশোর্ধ্ব। চেহারা, সাজগোজে নেই বয়সের রেশ। যা আছে, তাকে স্মার্টনেস-ই বলে। ভদ্রমহিলা তাথৈকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। কিছুটা বিস্ময়ে বললো,

– বাইশ বছর! সময় কতো দ্রুত চলে যায়!

তাথৈয়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। জীবনে প্রথমবারের মতো বুকফাটা কান্নারা ‘মা!’ আওয়াজ করে বেরিয়ে আসতে চায়। যে মাকে ছোঁয়ার কোনো স্মৃতি নেই ওর কাছে। ছবিতে যার চেহারা চিনেছে ও। যে মায়ের সঙ্গ বলতে পেয়েছে কেবল তার গর্ভজাত হওয়ার সময়টুকুন, সেই মা আজ ওর সামনে। ভদ্রমহিলা মৃদ্যু হেসে আরেকপা এগোলো তাথৈয়ের দিকে। ওর গালে হাত রেখে বললো,

– কেমন আছো বেইবি? মমিকে চিনতে পেরেছো? হুম?

তাথৈ কেবল বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়। যদিও কল্পনায় ওর বসবাস নেই। তবুও ওর মনের কোনে এক ক্ষীণ ধারনা ছিলো। কখনো ওর মা ফিরে আসলে, সবারআগে ওকে জাপটে জরিয়ে ধরবে, গালেমুখে পাগলের মতো চুমু দেবে, আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে ওকে। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো ঘটছে। ভদ্রমহিলা তাথৈয়ের গাল থেকে হাত নামালেন। আবারো আঁচলটা তেমন পরিপাটি করে দাড়িয়ে বললেন,

– লান্ডান থেকে গতকালই ফিরেছি। এসেই তোমার ছবি, ইনফো জোগাড় করেছি। সি! চলে এসেছি তোমার সাথে দেখা করতে! কত্তো বড় হয়ে গেছো তুমি! সো হ্যাপি টু সি ইউ!

– কিন্তু আপনাকে দেখে ও মোটেও খুশি না ম্যাডাম। বিনা দাওয়াতে চলে আসা আগুন্তকের আগমনে কেই বা সুখী হয় বলুন?

তাথৈ পাশে তাকায়। ওর ঠিক পাশ থেকে জবাব দেয় তুল্য। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে একদম স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে আছে ও। এতোগুলো বছর পর নিজের মাকে দেখার কোনো উত্তেজনা ওর মাঝে নেই। ভদ্রমহিলা একটু সময় নিয়ে তুল্যকেও চিনে ফেললেন। হাসিমুখে বললেন,

– তুল্য? ওহ বেটা! কেমন আছো মাই সন? মমি…

– এক্সকিউজ মি ম্যাডাম। বেটা, বেটি, বেইবি, নিজের এইসব লেইম ডাকগুলো নিজের কাছেই রাখুন। আমি কোনো বেটা নই আপনার। আ’ম তুল্য আলফেজ।

তুল্যর জবাব শুনে ভদ্রমহিলা দমে যায়। হাসি কমে আসলেও আবারো জোরালো হাসে সে। বলে,

– আই নো বেটা, মমির ওপর অনেক অভিমান তোমাদের। বাট হোয়াট আই ডিড, ওয়াজ এবসুলেটলি…

– আপনি কি করেছেন, কেনো করেছেন, তার কোনো কৈফিয়র আমাদের চাইনা ম্যাডাম। আর যেহেতু আপনার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, সেখানে আপনার অভিমানের তো প্রশ্নই ওঠেনা! ইউ মে লিভ!

– তুল্য, লুক! আমি তোমাদের…

মহিলা বলা শুরুর আগে একটা বিদেশী কুকুর এসে তাথৈয়ের পা শুকতে থাকে। তাথৈ নড়চড় না করে ওরদিক তাকিয়ে রইলো। তুল্য চড়া গলায় বললো,

– নিজের বাচ্চাকে ফেলে লন্ডন গিয়ে কুকুরের বাচ্চা পেলেছেন? তুলনা হয়না আপনার কোনো।

ভদ্রমহিলা বুঝলো, তুল্য তার বিপরীতেই বলবে। ওকে বোঝানো সহজ হবে না। তারচেয়ে নিরব থাকা তাথৈকে বোঝানো সহজ হবে হয়তো। উনি বেশ উদগ্রীব হয়ে বললেন,

– ত্ তাথৈ? দেখো বুজো তোমার আদর চাইছে! ও অনেক কিউট জানো! আমি…

– আমাদের না আপনার প্রতি ইন্টারেস্ট আছে, না এই বুজোর প্রতি। আপনার এই বিলেতী কুত্তারবাচ্চা কোলে তুলুন, আর দফা হন।

তুল্যর মুখে কুত্তারবাচা শব্দটা শুনে ভদ্রমহিলা আবারো দমে যান। দেশে ফিরে তৈয়ব আলফেজের নামডাক দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছেন তিনি। যে টাকার জন্য স্বামী সন্তান ছেড়েছিলেন, সে স্বামী সন্তান এখন আলাদা আলাদা করে তারচেয়েও কয়েকগুন বেশি টাকার মালিক। প্রাক্তন স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। শুধু চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদুটোর সাথে যোগাযোগ রাখতে। তাই ওদের খোজ নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তুল্যর ব্যবহারে তার প্রতি বিষাক্ততা স্পষ্ট। এদিকে তাথৈ নিরব। ওকে বুঝাতে পারবেন আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা ধৈর্য্য রাখলেন। বুজো লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাথৈয়ের পা ঘুরলো। তাথৈকে চুপ থাকতে দেখে তুল্য অবাক হয়। তাথৈ সহনশীলদের দলভুক্ত না। ক্ষমা করা, ক্ষমা চাওয়া, এসব ওর স্বভাব বহির্ভুত। তুল্যও চায় না, যে মা মাতৃত্বের চেয়ে টাকাকে বড় করে দেখেছে, সেই মা কে তাথৈ ক্ষমা করুক। তাথৈ অতি শান্তভাবে বললো,

– এটাকে সরাও। নয়তো আমিই ওকে সরানোর ব্যবস্থা করবো।

ওর জবাব শুনে ভদ্রমহিলা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। বিশ্বজয়ের হাসি দিলো তুল্য। সে হাসিতে গর্বও ছিলো। বোনকে চিনতে একবিন্দুও ভুল নেই ওর। এতোগুলো বছর যে মা ওদের কথা একবারো ভাবেনি, একটাবারো খোজ নেয়নি, একদিনে সামনে চলে আসলেই তাকে মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে তাথৈ না৷ বুজো তখনো তাথৈয়ের পায়ের আশপাশ ঘুরছে আর ওর পা শুকছে৷ তাথৈ মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। বললো,

– পরের দশসেকেন্ডে ও যদি আমার কাছ থেকে না সরে, আই সয়্যার আমি ওকে এমন জায়গায় সরাবো…বাইশবছর পর আমার খোজ তো পেয়ে গেলে। কিন্তু ওর খবর সারাজীবনেও পাবে না। ট্রাস্টমি!

ভদ্রমহিলা তাথৈয়ের এমন হিংস্র জবাব মোটেও আশা করেননি। ওমন আদুরে জীবটাকে নিয়ে কেউ এভাবে বলে, তার মন কতোটা পাথুরে হয়ে আছে, আন্দাজ হলো তার। দ্রুততার সাথে বুজোকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু বুজো ছুট লাগায়। মহিলা সেদিকে খেয়াল করার আগে তাথৈ একপা এগোলো। শক্ত গলায় বললো,

– নিজের সন্তানদের কথা তো ভাবোনি৷ এটলিস্ট এই কুকুরটাকে আগলে রাখো? যেভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, ওকে সেভাবে ছেড়ে দিও না। এন্ড ইয়েস, এটাও জেনে রাখো, আমার জীবনে তোমার কোনো দরকার নেই। কারোর দরকার নেই। তাথৈ আলফেজ ইজ এনাফ ফর হার! আ’ম, এনাফ ফর মি!

জোর গলায় বলে ভদ্রমহিলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তাথৈ। তিনি বিমুর্ত চোখে দেখলেন মেয়ের ঔদার্য। তুল্য তখনও ওখানে দাড়িয়ে। আয়েশের সাথে একটা সিগারেট ধরিয়েছে ও। ধোয়া ছেড়ে বললো,

– ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন ম্যাডাম। আপনার তাথৈ বেইবি একটু আলাদা। ওর লাইফে এইসব মমি-বেইবি নাটকের জায়গা নেই।

মহিলা আর একদন্ড দাড়ালেন না। এতোগুলো বছর পর নিজের সন্তানের মুখোমুখি হয়ে, তাকে এইভাবে অপমান হতে হবে, এমনটা ভাবেননি তিনি। বাঙালীরা বেশিই অনুভূতিপ্রবণ হয়। সে হিসেবে দুই ছেলেমেয়ে তাকে দেখে আবেগে পরবে, এমনটা আন্দাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টোটাই। তিনি ছুটলেন বুজোকে খুজতে৷ তুল্য সিগারেট টানতে টানতে মায়ের চলে যাওয়া দেখলো। তাচ্ছিল্যে হেসে নিজেনিজেই বললো, ‘শাহরুখ ডায়লগটা ভুলই দিয়েছিলো। কিসমাত কুত্তি চিজ নেহি হ্যায়। কিসমাত, কুত্তো কা হি চিজ হ্যায়।’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here