#হে_সখা #অক্ষরময়ী উনবিংশ পর্ব

0
61

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
উনবিংশ পর্ব

হিমালয় পর্বতের কাছাকাছি হওয়ায় উত্তরবঙ্গে শীতের আগমন ঘটে ডিসেম্বরের শুরুতে। দূর পাল্লার বাসগুলো সারারাত যাত্রা করে গন্তব্যে পৌছায় ভোরবেলা৷ বাস থেকে নেমে যাত্রীদের থাকে ঘরে ফেরার তাড়া। যানবাহনের সংকটের কারনে এই সুযোগে যাত্রীদের কাছ থেকে একটু বেশি অংকের ভাড়া আদায় করে নেওয়া যায়। শীতের ভোরে লেপের নিচের আরামদায়ক ঘুম ছেড়ে বদিয়ার তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছে। গায়ে তার ফুটপাত থেকে কেনা মোটা সোয়েটার। খুব একটা শীত লাগছে না। তবুও বউটা ঘর ছাড়ার সময় চাদর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে৷ আজকে বাসে তেমন একটা যাত্রী নেই৷ যারা নেমেছিলো, তারা ইতোমধ্যে অটোতে করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। বদিয়ার হতাশ হয়ে ভ্যানগাড়ির প্যাটেলে পা দিয়ে চাপ দিতেই আবছা কুয়াশায় একটি নারী অবয়ব দেখতে পেলো। এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে বাহনের খোঁজ করছে। আঁধারে আশার আলো দেখতে পেয়ে ভ্যান রেখে বদিয়ার সেদিকে এগিয়ে গেলো। নারী অবয়বটি দৃষ্টিসীমায় আসতেই পরিষ্কার হলো নারীটির মুখের আদল। ওকে চিনতে পেরে বদিয়ার অবাক হয়ে শুধালো,
– তুই আকবার বাড়ির ছোট মাইয়া না?

গুলিস্তা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ধীরেসুস্থে উত্তর দিলো,
– হ্যাঁ৷
– শুনছিলাম তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকদিন পর বাপের বাড়ি আইলি। একা আসছিস? জামাই সাথে আসেনি?
– নাহ।
– বাড়ি যাবি তো? আয়, আয়। আমি পৌছায় দেই।

গুলিস্তার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে বৃদ্ধ বদিয়ার অতি উৎসাহে ভ্যানগাড়িতে রেখে দিলো। ভ্যানের একপাশে বসে গুলিস্তা শীতে কাঁপছিলো। এদিকে এতো ঠান্ডা পরেছে কে জানতো! মনে হচ্ছে অন্য দেশে চলে এসেছে। বদিয়ার তার ব্যাগ হতে নিজের চাদরটা বের করে পরম যত্নে গুলিস্তার গায়ে জড়িয়ে দিলো। মেয়েটাকে দেখলেই নিজের মেয়ের কথা মনে পরে যায়৷
– তুই এখনো চুপচাপ থাকিস! শ্বশুরবাড়ির লোক কিছু বলে না?

ফাঁকা রাস্তায় ভ্যানগাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করে না। কারনে অকারণে, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে আলাপ করতে বসে যায় বদিয়ার।
– মাগো, পরেরবাড়িতে টিকে থাকা অনেক কষ্ট৷ এতো সহজ সরল হইলে, লোকে তোরে পায়ের তলায় পিষ্যা চইলা যাবে৷ তোর মায়ে কেন যে এমনে হুট কইরা বিয়া দিয়া দিলো। শুনলাম, মেলা দূরেই নাকি শ্বশুরবাড়ি?

গুলিস্তা জবাব দিলো,
– সিলেটে।
– তোর মায়ে খোঁজ খবর নিতে যায়?
– নাহ।
– কী পাষাণ মায়ের মন! বাচ্চাকাল থাইকা মাইয়াটারে মারপিট আর ধমকের উপরে রাখছে৷ শ্বশুরবাড়ির লোক কেমন, আম্মা? মারপিট করে?
– নাহ। সবাই ভালো।
– মন দিয়া সংসার করবি আম্মা। মাইয়ার মানুষের আসল ঘর স্বামীর বাড়ি। তোর তো বাপের বাড়ি থাইকাও নাই।

গুলিস্তা যখন বাড়িতে পৌছালো, দিদার আড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে মাত্র। গুলিস্তাকে ভ্যান থেকে নামতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বদিয়ার ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো,
– বাসস্ট্যান্ডে আম্মারে দেইখা সাথে কইরা নিয়া আইলাম।

উত্তরে দিদার কিছু বললো না। বদিয়ারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গুলিস্তাকে বললো,
– ভিতরে যা।

গুলিস্তাকে দেখে পুরো বাড়িতে নিস্তব্ধতা নেমে এলো হুট করে৷ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত গুলিস্তাকে বৈঠকখানার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে সীমা বেগম রাখে ফুঁসছেন। তার একপাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে শর্মী। সীমা বেগম বললেন,
– ওরে জিগাও, এখানে কেন আসছে?

শর্মী অনেক সাহস সঞ্চার করে মিনমিনিয়ে বললো,
– সারারাত জার্নি করে আসছে। ওরে ঘরে নিয়ে যাই আম্মা৷ পরেও আলাপ করা যাবে।
– পরে কি আলাপ ওর সাথে! জামাই ছাড়া মেয়ে একলা বাপের বাড়ি আসছে৷ সারা গ্রামে হৈ হৈ পরে যাবে৷ কয়জনের মুখ বন্ধ করবা তুমি। আল্লাহ জানে কী অকাম ঘটায় আসছে৷

গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে জানতে চাইলো,
– ওই কথা কস না কেন?

গুলিস্তার পৃথিবীতে একমাত্র আতংকের নাম সীমা বেগম। মায়ের মুখটা কল্পনা করেই সে ভয়ে কেঁপে উঠে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের অকারণ রোষের স্বীকার হতে হয়েছে। সীমা বেগমের সামান্যতম মেজাজের হেরফের হলেই তার খেসারত দিতে হতো গুলিস্তাকে। গুলিস্তা সবসময় চেষ্টা করতো মায়ের দৃষ্টি হতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে৷ ঘরের এক কোণায় চুপটি করে বসে থাকতো যাতে ওর নিঃশ্বাসের শব্দও মায়ের কান অব্দি না পৌঁছায়। গুলিস্তার কথার আওয়াজে সীমা বেগমের মানসিক শান্তি নষ্ট করে দেয়। ছোট্ট মেয়েটা একসময় কলকল করে অনর্গল কথা বলতো। সীমা বেগম একদিন ভয়ংকরভাবে ওর গলা চিপে ধরে বলেছিলো,
– এতো আনন্দ আসে কই থেকে? আমার সুখের জীবনটা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে৷ রাক্ষসী একটা। তোর মুখ থেকে আর একটা আওয়াজ বের হইলে গলা টিপে একদম মেরে ফেলবো।

মায়ের অতর্কিত আক্রমণ থেকে সেদিন দিহান বাঁচিয়ে নিয়েছিলো বলে গুলিস্তা এখনো শ্বাস নিচ্ছে।
তবে উচ্ছ্বসিত সেই বাচ্চাটি ওখানেই কোথাও হারিয়ে গেছে। ছোট্ট গুলিস্তার প্রতিটা দিন কেটেছে আতংকে।

মায়ের সামনে কেন যাস তুই? নিজের ঘরে থাকবি খাওয়া-দাওয়া করবি। মায়ের সামনে যাবি না। অযথা কথা বলতে থাকলে মায়ের হাতে একদিন মারা পরবি নিশ্চিত৷
দিহানের সতর্কবার্তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে গুলিস্তা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিয়েছে নীরবতার পথে। অনেক বছর পর শর্মী যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে এলো, আদুরে মেয়েটাকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ততোদিনে একলা জীবনে ভীষণ ভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে গুলিস্তা। ওর মানসিক সমস্যার আভাস পেলেও কোনো সাহায্য করতে পারেনি শর্মী।

গুলিস্তা মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
– কিছু করি নাই আমি।
চকিতে সীমা বেগম সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলেন গুলিস্তার গালে।
– এখন মিথ্যা কথ বলাও শিখছিস! ওই জামাই কই তোর? সাথে আসে নাই কেন?

গুলিস্তা কান্নাভেজা কন্ঠে জবাব দিলো,
– বাসে তুলে দিয়ে গেলো তো।
যাত্রাকালে মা-বোনের অহেতুক বাক্যালাপে বিরক্ত হয়ে উঠেছে দিদার।
– আমার দেরী হইতেছে৷ আমি বের হইলাম আম্মা। ও যখন এসেই গেছে, এগুলা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে৷ এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে কন।

সকালের নাস্তার জন্য গুলিস্তাকে নিচে নামতে দেওয়া হলো না। নাস্তার প্লেট সাজিয়ে শর্মী আলিয়ার হাতে পাঠিয়ে দিলো গুলিস্তার ঘরে৷ নিজের ছোট ঘরটাতে বসে আপনমনে চারপাশ দেখছিলো গুলিস্তা৷ আলিয়া এলো নাস্তা নিয়ে। পরনে তার তাঁতের শাড়ি, নাকে নাকফুল, হাতে একজোড়া স্বর্ণের চিকন চুড়ি। গুলিস্তা অবাক হয়ে আলিয়ার নতুন বেশভূষা দেখছে। আলিয়া লাজুক হেসে ওর পাশে বসে বললো,
– অবাক হচ্ছিস দেখে! হবারই কথা। তোকে তো জানানোই হয়নি। তোর বিয়ের কয়েকদিন পরেই আব্বার মাথায় কী ভূত চাপলো কে জানে! একদিনের আলাপেই তোর দাউদ ভাইয়ের সাথে বিয়ের আয়োজন করে ফেললো। তেমন বড়সড় কোনো আয়োজন না। কাজী ডেকে বাড়ির সদস্যের সামনে কবুল বলা আর রেজিস্ট্রি পেপারে দুটো স্বাক্ষর। হয়ে গেলো বিয়ে। তখন থেকে এখানেই আছি।

গুলিস্তা গোলগাল চোখে তাকিয়ে আছে আলিয়ার দিকে। ওর নিজের ভাই ও চাচাতো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ ও জানতেও পারেনি।
– কী রে? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না জানিস! দানিশ ভাইয়ার বিয়ের আগে আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে, এটা কখনো কল্পনাও করিনি। আব্বার অহেতুক জেদের কারনে এই প্রথম একটা ভালো কাজ হলো।

নিজের কথায় নিজেই খিলখিলিয়ে হাসছে আলিয়া। সে হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গুলিস্তা নীরবে নাস্তার প্লেট টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

কানে কানে কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরেছে। পাড়ার মহিলারা পেয়ে গেলো আলোচনার নতুন টপিক৷ নাইয়রীকে দেখতে আসার নাম করে আকবর বাড়িতে পাড়ার মহিলাদের আনাগোনা ক্রমেই বাড়তে থাকলো। সীমা বেগমের মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট। বাড়িতে বাইরের মানুষের অহেতুক যাতায়াত উনার পছন্দ নয়। এ বাড়িতে দুটো ছেলের বউ রয়েছে। কখন কোন দুষ্ট মহিলা এসে বাড়ির বউয়ের মাথায় কূটনীতি ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে কে জানে!

– আমাদের গুলিস্তার এমন রাজ কপাল কে জানতো! চোখের সামনে লাথি ঝাটা খেয়ে বড় হলো মেয়েটা। বসতে বললে বসে, উঠতে বললে উঠে। ওরে নিয়ে আমাদের কী না চিন্তাটা হতো খালাম্মা! এমন আধপাগল মেয়েটাকে পরের বাড়িতে কেমনে পাঠাবেন! কতোবার ভেবেছি, এই মেয়ে নিয়ে আপনার বহুত কষ্টে দিন কাটবে। অথচ দেখেন, আল্লাহ ওরে রাজকপাল দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাইছে। শুনলাম বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। কেমন চুপেচাপে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন খালাম্মা। কেউ টেরই পাইলাম না। জামাই যে দেখবো সেই সুযোগটাও কেউ পাই নাই।

সীমা বেগম বুঝেন আলোচনা কোনোদিকে মোড় নিচ্ছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে পানের বাটি এগিয়ে দেন মহিলাদের দিকে। হাসি মুখে বলেন,
– ছেলের মা-ভাই বিদেশ যাবে। ওদের বড় তাড়া ছিলো। ভালো ঘর দেখে আমরাও আর আপত্তি করি নাই। মেয়ের বিয়ে তো একসময় দিতেই হতো। হাদিসেও ওতো আয়োজন করে বিয়ে দিতে না করা আছে। এই জন্য আরকি।
– তা অবশ্য ঠিক। গুলিস্তা দেখি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ভালোই সুন্দর হইছে। তো জামাইকে দেখছি না যে? সাথে আসে নাই?
– ব্যবসায়ী মানুষ। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। শ্বশুরবাড়ি এসে থাকার সময় আছে নাকি!
– সেকি কথা খালাম্মা! মেয়ে প্রথমবার নাইয়র আসছে। একলা পাঠায় দিছে ওরা? এ কেমন মানুষ! শ্বশুরবাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়নি তো আবার? আজকাল মানুষ একটু ঝামেলা মনোমালিন্য হতেই বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কয়েকদিন চুপচাপ থাকার পর একদিন হঠাৎ করে আসে তালাকনামা। কোনো ঝুট ঝামেলা নাই। সব হয় চুপিচাপে।
– আরেহ কী যে বলো তোমরা! অশুভ কথা কও কেন! দোয়া করো মেয়ে আমার সুখে শান্তিতে থাকুক। জামাই বড় ভালো মানুষ। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে পৌছায় দিয়ে গেছে। সে নিজে সময় বাইর করতে পারে নাই তো কী হইছে। মেয়ে আমার কয়েকটা দিন বাপের বাড়িতে হাসি আনন্দে কাটাচ্ছে। দুদিন পরে এসে আবার নিয়ে যাবে।

সীমা বেগমের উত্তরে মহিলারা সন্তুষ্ট হয় না। মায়ের পাশে চুপটি করে বসে থাকা গুলিস্তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। এটা ওটা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফিরে যায়। ওরা চলে গেলে সীমা বেগম মেয়ের মাথায় চাটি মেরে জানতে চান, আর কতো মিথ্যা কথা বলাবি?
খাটের উপর রাখা নারকেল পাতার ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেন গুলিস্তার পিঠে৷ চাপাস্বরে গালি দেন। জানতে চান মেয়ে হঠাৎ করে এভাবে চলে এলো কেনো? পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মান সম্মান খুইয়ে কী আনন্দ পাচ্ছে? গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চায়,
– আমি কি করেছি?

সুযোগ বুঝে শর্মী সীমা বেগমের আক্রোশ থেকে বাচিঁয়ে নেয় ওকে। নিজের ঘরে পৌছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– কেনো আবার এলে বলো তো! ফিরবে কবে তুমি?
– এইতো কয়েকদিন।
– জামাইকে আসতে বলছো না কেনো?
– এসে যাবে।
– কল দিয়ে আসতে বলো।
– ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ।
– চার্জার কোথায়?
– ও বাড়িতে রেখে এসেছি।

শর্মী হতাশ হয়ে কপালে হাত দিয়ে গুলিস্তার পাশে বসে। সপ্তাহ খানেক ধরে একই কাহিনী ঘটে যাচ্ছে। পাড়ার মহিলাদের আগ্রহের কমতি নেই। রোজ কেউ না কেউ এসে সীমা বেগমের মেজাজ বিগড়ে দিয়ে যায়। আর উনি চড়াও হয় গুলিস্তার উপর। সন্ধ্যা বেলার চায়ের আগে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় রোজ হজম করে যাচ্ছে মেয়েটা। হাতের কাছে যা পায়, তাই দিয়ে আঘাত করে নিজের গায়ের জ্বালা মিটায় সীমা বেগম।রোজ এমন নির্যাতনের চিত্র দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে শর্মী।
– আমার ফোন থেকে একটা কল করে আসতে বলো তাকে। সংসার জীবনে একটু আধটু ঝামেলা সবার হয়। এভাবে হাত পা ছেড়ে বসে থাকলে চলে?

গুলিস্তা অবাক চোখে তাকালো শর্মীর দিকে।
– কোনো ঝামেলা হয়নি তো। বিশ্বাস করো।

শর্মী হিসাব মিলাতে পারে না। বউকে একলা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মানে শর্মী জানে। কিন্তু এসেছে থেকেই গুলিস্তার একই কথা বলে যাচ্ছে। কোনো ঝামেলা হয়নি।
– আমাকে ফোন নাম্বারটা দাও। আমি আসতে বলি৷
– নাম্বার মুখস্ত নেই৷
শর্মী হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। যোগাযোগের সব রাস্তা আপাতত বন্ধ। কারো কাজ থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করা সম্ভব নয়৷ যতোক্ষণ না সীমা বেগম নিজে উদ্যোগ নিচ্ছেন।

– রাতের খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিবো। ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।
গুলিস্তার ঘর থেকে বের হতে হতে শর্মীর কপালের ভাঁজ আরও গভীর হয়। আর কতোদিন এভাবে চলবে।

সকালে নাস্তার টেবিলে তড়িঘড়ি করে নাস্তা পরিবেশন করছে শর্মী ও আলিয়া। আলিয়া খুব একটা ভালো রাধতে পারে না। শর্মীর সাথে থেকে ওর কাজে সাহায্য করে। টেবিলে বিরক্ত মুখে বসে আছে দিদার। গ্রাম থেকে বাঁধাকপি নিয়ে একটা ট্রাক আসার কথা ছিলো। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা আড়তে পৌঁছে গেছে। অথচ সে এখনো বাড়িতে বসে নাস্তার অপেক্ষা করছে।
– সামান্য নাস্তা তৈরি করতে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিন করো কি বাড়িতে বসে বসে?

স্বামীর কথায় শর্মী কোনো উত্তর দিলো না। আজ ঘুম থেকে উঠতে খানিকটা দেরী হয়ে গিয়েছে। নাস্তা পরিবেশন করা শেষে চেয়ারে ধপাস করে বসে আলিয়া বললো,
– ভাবী আর আমি মিলে দৌড়ে দৌড়েও কাজ করে কূল পাচ্ছি না। রান্নার কাজ দেখতে অল্প মনে হলেও এ অনেক ঝামেলার কাজ।

রুটি মুখে দিয়ে দিদার বললো,
– ঘরে তো আরেকজন আছে। ওরে ডাক দেও নাই কেন? সারাদিন শুয়ে বসে না থেকে কাজে একটু আধটু হাত লাগালেও তো পারে৷ এভাবে ঘরে বসে আর কতো অন্ন ধ্বংস না করবে?

ছেলের কথা শুনে সীমা বেগম মুহূর্তেই নিজের খাট থেকে উঠে ফুঁসতে ফুঁসতে গুলিস্তার ঘরের দিকে গেলেন। শর্মীর চোখে পরলেও সে স্বামীর কাছ থেকে সরে যেতে পারলো না৷ হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো গুলিস্তা। চিলের মতো আচানক সীমা বেগম হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো সেই চিরুনী। শক্তপোক্ত চিরুনী দিয়ে অনবরত বাহু ও পিঠে আঘাত করতে লাগলেন। গুলিস্তার ঘুমের ঘোর তখনো ঠিকমতো কাটেনি। অতর্কিত হামলায় চিৎকার করে উঠে। সীমা বেগম আরও রেগে গিয়ে বললেন,
– জন্মের পর থেকে একদন্ড শান্তিতে থাকতে দেস নাই আমারে। দেখেশুনে ভালো ঘরে বিয়ে দিলাম, দুদিন না যেতেই সেখান থেকে চলে এসে আবার আমার ঘাড়ে চেপে বসছিস। তোর জন্য এখন ছেলের সংসারেও অশান্তি। ছেলে আমারে বড় বড় কথা শোনায়। আমারে অন্ন দেখায়। ফিরে না এসে কোথাও ডুব দিয়ে মরতে পারলি না হতভাগী।

গুলিস্তার আর্তনাদে বাড়ির সকলে এসে ভীড় জমিয়েছে ওর ঘরের দরজায়। সীমা বেগমের শরীরে যেন অসুর ভর করেছে। একের পর এক আঘাত করতে দেখে শর্মীর গলা শুকিয়ে এলো। পাশে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিদারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– কখন যে কী বলো বসো তুমি! কথা বলার আগে একটু ভেবেও দেখো না।

দিদার বুঝতে পারছে না সে ভুল কী বলেছে! গুলিস্তা সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকে। এর থেকে রান্নাঘরে এসে ভাবীদের সাথে রান্নায় একটু সাহায্য করলে কী এমন সর্বনাশ হয়ে যাবে? সে অবাক হয় বললো,
– আশ্চর্য! আমি কী এমন বললাম!
– সে যাই বলো! সকালবেলা মাকে রাগিয়ে দিলে তুমি, আর ভুগতে হচ্ছে ওকে। যাও গিয়ে থামাও তোমার মাকে।
– এসব ঝামেলায় আমি নাই। আমার দেরী হচ্ছে।

দিদার তস্তপায়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। শর্মী, আলিয়া দুজনের কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পেলো না। উপায় না দেখে শর্মী হঠাৎ ছুটে গেলো দিহানের ঘরে। দিহান তখনো ঘুমাচ্ছিলো। জোরালো ডাকে চোখ মেলে তাকাতেই শর্মী হন্তদন্ত হয়ে বললো,
– মায়ের মাথাটা মনে হয় পুরো বিগড়ে গেছে। সকালবেলা মেয়েটাকে কীভাবে মারা শুরু করছে। তুমি একটু থামাও না ভাই। না হলে মেয়েটা আজকে মরেই যাবে।

দিহান বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে গুলিস্তার ঘরের দিকে গেলো। গুলিস্তা তখন ফ্লোরে লুটিয়ে পরে কাঁদছে। সীমা বেগম হাঁপিয়ে গেলেও দু পা দিয়ে একটু পর পর লাথি মেরে যাচ্ছেন গুলিস্তার ক্লান্ত দেহে। মাকে এক হাতে টেনে ধরে দিহান বললো,
– সকাল সকাল কী শুরু করছো তোমরা! শান্তিতে একটু ঘুমাইতেও দিবা না। তুমি যাও তো এখান থেকে।

সীমা বেগমের দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। মেয়েটাকে আজকে একটু বেশি মেরেছেন কিনা। সেগুলো হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেলে দিহানকে বললেন,
– এই জঞ্জালটাকে বিদায় করার ব্যবস্থা কর। এতোদিন পাড়া পড়শী জীবনটা অতিষ্ঠ করে ফেলছিলো। এখন তো ঘরের ছেলে অশান্তি করা শুরু করছে। ওর জামাইরে এসে বউ নিয়ে যাইতে ক।
– কেমনে আসতে বলবো! ফোন নাম্বার নাই আমার কাছে।
– ওর শ্বাশুড়িকে ফোন দে। যেমনে পারিস যোগাযোগ কর। এই মাইয়ারে আমি আর এক মুহুর্ত আমার ঘরে রাখবো না।
– আমি দেখতেছি।

দিহান ও সীমা বেগম বেরিয়ে যেতেই শর্মী ঘরে ঢুকে আগলে নিলো গুলিস্তাকে। মুখ ও হাতের অনেক জায়গায় কেটে গেছে। দ্রুত ক্ষত স্থান পরিষ্কার করতে হবে৷

আম্বিয়া খাতুনের ফোন নাম্বার ম্যানেজ করা না গেলেও রাহিলের ফোন নাম্বার ছিলো দিহানের কাছে৷ উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে দিহানকেই কল দিতে হলো। সীমা বেগম চতুর মানুষ। ফোন দিয়ে হাসি মুখে কুশলাদি বিনিময় করার পর বললেন,
– আসলে জামাইকে কল দিয়ে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমাকে ফোন দিলে খোঁজ পাওয়া যাবে। বিরক্ত করলাম না তো?

রাহিল অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। বিয়ের পর এই প্রথম গুলিস্তার বাবার বাড়ি থেকে কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো। রাহিল অবশ্য এসব ব্যাপারে তেমন আগ্রহ পায় না। সে বললো,
– ভাইয়ের সাথে আমার গত কয়েকদিন তেমন কথা হয়নি। মা হয়তো বলতে পারবে৷

আম্বিয়া খাতুন নিজেও অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
– রেহবারের সাথে কি দরকার বেয়াইন?
– তেমন জরুরি কিছু না। জামাইর সাথে কথা না হওয়ায় মেয়ে আমার অস্থির হয়ে আছে৷ মুখে কিছু না বললেও আমি তো মা, আমি বুঝি৷ তাই ভাবলাম এই সুযোগে জামাইকে আসতে বলি। এসে ঘুরেফিরে গুলিস্তাকেও নিয়ে গেলো৷

আম্বিয়া খাতুন মনে হয় কথা বলতে ভুলে গেলেন। গুলিস্তা বগুড়া গিয়েছে অথচ তিনি জানেন না৷ ব্যস্ততার কারনে বেশ কয়েকদিন ধরে গুলিস্তার সাথে কথা হয়নি। তবে দুদিন আগেও তো রেহবারের সাথে কথা হলো। সে কিছু জানালো না কেনো?
– গুলিস্তা বগুড়ায় নাকি! জানতাম না বেয়াইন।
– কি আর বলবো আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা! নিয়মকানুন কিছুই মানতে চায় না। বিয়ের পর প্রথমবার নাইয়র এসেছে, তাও আবার একা। জামাই ছাড়া কেউ প্রথমবার বাপের বাড়ি আসে! গ্রামের ব্যাপার তো বুঝেনই। চারদিকে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম কি বেয়াইন, রেহবার যদি একটু সময় করে নিজে এসে গুলিস্তাকে নিয়ে যেতো তাহলে গ্রামের মানুষজনের মুখ বন্ধ করতে পারতাম।

ফোনের ওপাশ থেকে আম্বিয়া খাতুন ধমকে জানতে চাইলেন,
– গুলিস্তাকে একলা বগুড়ায় পাঠিয়েছো কী মনে করে? গ্রামের রীতিনীতি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? না জানি মেয়েটাকে কতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে!

ক্লায়েন্টের সাথে একটানা মিটিং হতে খানিক ব্রেক মিলেছিলো রেহবারের। পাশের কফিশপে এসেছে কফি খেতে। গুলিস্তা বিহীন বাড়িটাতে একটা রাত ঘুমিয়ে কাটাতে পারেনি। পরের দিন সকালেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কাজের মধ্যে পুরোপুরি ডুবিয়ে ফেলেছে। প্রিয় শহর সিলেট ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে ব্যস্ত নগরী ঢাকাতে। পেন্ডিং মিটিংগুলোতে একের পর এক নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। আম্বিয়া খাতুনের প্রশ্নের জবাবে ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
– অফিসের কাজে ঢাকা আসতে হয়েছে। ও একা বাড়িতে কী করতো! তাই ভাবলাম বগুড়া থেকে ঘুরে আসুক। কাজ রেখে আমিও নিশ্চয়ই ওর পিছু পিছু বগুড়া ছুটে যাবো না।
– ওকে একা পাঠানো উচিত হয়নি। বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি গিয়েছে। এসব নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হয়। ওসব তুমি বুঝবে না। তোমার শ্বাশুড়ি মা ফোন করে ছিলেন। তোমার সাথে নাকি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না তাই আমাকে জানালেন। তোমাকে বগুড়া যেতে বলেছেন।
– টানা মিটিং চলছে। বেশিরভাগ সময় ফোন বন্ধ থাকে। আমি প্রচুর ব্যস্ত, মা। একটু ফ্রি হয়ে নেই, তারপর যাবো।
– ব্যস্ততার মাঝে নিজের জন্য সময় বের করে নিতে হয়। তুমি বগুড়া যাবে এবং সেটি আজকেই। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।

অগত্যা বাধ্য হয়ে ভর দুপুরেই রেহবারকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো।

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here