হে_সখা #অক্ষরময়ী চতুর্বিংশ পর্ব

0
121

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
চতুর্বিংশ পর্ব

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেহবার চুল চিরুনী করছে। সেই সাথে দেখছে দরজা থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া গুলিস্তাকে। মেয়েটা কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলছে না। এই নিয়ে কয়েকবার দরজার সামনে এসে আবার ফিরে গেছে। রেহবারের এতোটা অনুপ্রেরণামূলক আচরণের পরেও কিছু বলতে দ্বিধা করছে ভেবে খানিকটা মন খারাপ হলো। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেও খাবারের নাড়াচাড়া করতে দেখে রেহবার নিজেই জানতে চাইলো,
– কি বলতে চাইছো বলে ফেলো। এতো ভাবনা চিন্তা করার দরকার নেই৷ কখনো কখনো আমাদের হুট করে কিছু কাজ করে ফেলতে হয়। এতো ভেবে চিন্তে জীবন চলে নাকি!

কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। তারপর মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো,
– অফিস না যাই?
– আচ্ছা, যেতে হবে না।

রেহবারের স্বাভাবিক উত্তর শুনে গুলিস্তা অবাক হলেও ভাবলেশহীন কন্ঠে জানতে চাইলো,
– সত্যি?
– হ্যাঁ যেতে ইচ্ছে না করলে যাবে না। তবে এখন আমরা অফিসে নয়, অন্য কাজে বাইরে যাবো। তৈরী হয়ে নেও।

পাসপোর্ট অফিসের সামনে এসে গুলিস্তা আরেকুদফা অবাক হলো। কিন্তু রেহবারের পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশের পর ওকে যা যা করতে বলা হলো বিনাবাক্যে সেগুলো মেনে নিলো। ফটোসেশন, আই স্ক্যানিং, ফিংগারপ্রিন্ট এর প্রক্রিয়া শেষ হলো দ্রুত। কাগজপত্র যা কিছু প্রয়োজন ছিলো সেগুলো রেহবার জমা দিয়ে দিয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রেহবার ভেবেছিলো গুলিস্তা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে, পাসপোর্টের ব্যাপারে জানতে চাইবে। সেসবের কিছু হলো না। পথের ধারে ফুচকার দোকান চোখে পরায় রেহবার গাড়ি থামালো।
গাছের নিচে চেয়ার টেবিল পাতানো। সেখানে বসে এক প্লেট দই ফুচকা অর্ডার করলো। পুরোটা সময় গুলিস্তা খুব আগ্রহ নিয়ে রেহবার ও ওয়েটারের কথোপকথন শুনলো।

– তোমাকে খুব সহজে বোকা বানিয়ে বিপদে ফেলা যাবে, এটা জানো?
গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে না জানালো। তা দেখে রেহবার হেসে বললো,
– তোমাকে একটি অপরিচিত জায়গায় নিয়ে গেলাম, তুমি বিনাবাক্যে চলে গেলে। জানতেও চাইলে না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি! ওখানে তোমাকে যা যা করতে বলা হলো, তা চুপচাপ মেনে নিলে। কেনো ছবি তুললো, আই স্ক্যান করলো কিছুই জানো না। তোমার মধ্যে কোনো কৌতূহল নেই, সতর্কতাও নেই। এসব কালেক্ট করে তোমাকে যেকোনো বিপদেও ফেলতে পারে।
– আপনি সাথে ছিলেন তো।
– কাউকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। পরিচিত অপরিচিত কারো উপরেই এতোটা নির্ভরশীল হবে না। পাসপোর্ট অফিসে কেনো যাচ্ছি এটা আমাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। এখনো কিন্তু কিছু জানতে চাচ্ছো না। অথচ মনে ঠিকই প্রশ্ন জেগেছে৷

ধরা পরে যাওয়ায় গুলিস্তা মাথা নিচু করে ফেললো।

– আমরা ফ্লোরিডা যাচ্ছি। মায়ের সাথে দেখা করতে। সামনের মাসের মধ্যেই যেতে পারবো মনে হচ্ছে।

গুলিস্তা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এতোদিন তো দেশের মানুষদের কোনোরকম সহ্য করে নেওয়া গেছে। এখন ফটরফটর করে ইংরেজি বলা মানুষদের কীভাবে ফেস করবে! গুলিস্তার মনে হলো সে ধুলোর সাথে মিশে যাচ্ছে।

এরমধ্যে ওয়েটার ফুচকার প্লেট নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো। রেহবার নিজে বাইরের খাবার তেমন একটা খায় না। যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তার জানা মতে মেয়েদের ফুচকার প্রতি প্রচন্ড দূর্বলতা রয়েছে। তাই গুলিস্তাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে এসেছে। এই মেয়ে তো নিজে কখনো কিছু আবদার করবে না।
– নেও, খাওয়া শুরু করো।

ফুচকার প্লেট নিজের দিকে টেনে নিয়ে গুলিস্তা ভেবে পাচ্ছে না, আগে কোনটা খাবে। চামচ হাতে বাটির মধ্যে থাকা তরল নাড়াচাড়া করে পাশে রাখা পুরের দিকে তাকালো। কেমন অদ্ভুত সব জিনিসপত্রে প্লেট ভরিয়ে ফেলেছে। ওকে উদাসভাবে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেহবার জানতে চাইলো,
– খাচ্ছো না কেনো?
– কীভাবে খাবো?

গুলিস্তা মিনমিনে কি বললো রেহবার শুনতে পেলো না। শুধু দেখতে পেলো গুলিস্তা মাথা ঝুঁকিয়ে চিবুক একদম বুকের সাথে মিলিয়ে ফেলেছে। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– কী সমস্যা?

ক্ষণিকেই মস্তিষ্কে নতুন সন্দেহ উদিত হলে সন্দিহান গলায় বললো,
– এক মিনিট, তুমি কি আগে কখনো ফুচকা খাওনি? আমার জানামতে ফুচকা দেখলেই মেয়েরা হামলে পরে। রাহিল পর্যন্ত ফুচকা বলতে পাগল।

লজ্জায়, অপমানে গুলিস্তার কান্না পেলো। সে মাথা নিচু করে রেখেই মাথা দুদিকে দোলালো। রেহবার হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে ফুচকার প্লেট নিজের দিকে টেনে নিলো। শার্টের স্লিভল গুটিয়ে হাত ধুয়ে পুর দিলো ফুচকার ভেতর। টকে চুবিয়ে গুলিস্তার মুখের সামনে ধরে বললো,
– দেখি মুখ খোলো। বড় করে হা করবে৷ এটা পুরোটা একসাথে খেতে হয়৷

রেহবারের দুষ্টু, মিষ্টি, বিরক্তিকর আদেশ পালন করতে করতে পুরো একটা মাস কেটে গেছে।
দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করতে হবে তাই অফিসের জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নিতে এই কয়েকটা দিন অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে। তবুও কাজের ফাঁকে গুলিস্তার খবর নিতে কখনো ভুলেনি।প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েকবার ফোন দিয়ে গুলিস্তার খবর নিতো। সময় মতো খাবার খেয়েছে কিনা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কখনো অযথা ফোন দিয়ে জানতে চাইতো গুলিস্তা এখন কি করছে। রেহবারের উত্তাল ঝড়ের বিপরীতে গুলিস্তা বরাবরই ধীর, শান্ত।
এখন যেমন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে চুপটি করে। বিছানার উপর বড় দুটো লাগেজ খুলে সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখার কাজটি রেহবার নিজেই করছে। বগুড়া যাওয়ার সময় গুলিস্তাকে প্যাকিং এর কাজ দেওয়ায় ভালোই খেসারত দিতে হয়েছিলো। ফোন প্রায় ফেলে রেখে যাচ্ছিলো৷ চার্জার তো রেখেই গিয়েছিলো। তাই এবার আর কোনো রিস্ক নেয়নি। গুলিস্তার কী কী প্রয়োজন সেগুলো ওকে দিয়ে আনিয়েছে। তারপর সেগুলো নিজেই রিচেক করে লাগেজে ভরছে৷
– আর কিছু নিতে চাইলে এখনি বলো।
– কিছু নেই।
– প্রয়োজনীয় কিছু ফেলে যাচ্ছো কিনা আরেকবার ভেবে দেখো।
গুলিস্তার মনে হলো, সে নিজের প্রশান্তি এখানে ফেলে যাচ্ছে। চাইলেও সে কথা রেহবারকে বলা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঢাকা থেকে দুবাই এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। রেহবার ও গুলিস্তা সেই বিমানেই যাত্রা করেছে। গুলিস্তার মনে হচ্ছে কেউ তার দেহ থেকে প্রাণটা কেড়ে নিয়ে যেতে চলেছে। রেহবার ওর অনুভূতি বুঝতে পারলেও তেমন একটা পাত্তা দিলো না। না চাইতেও এইটুকু অস্বস্তিতে ওকে ফেলতেই হচ্ছে। কিন্তু জার্নির পুরোটা সময় নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করে ওর খারাপ লাগাটুকু ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।
ফ্লাইটে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে কয়েকবার হয়েছে, তাই এবার তেমন একটা অসুবিধা হলো না। শুধু গায়ের অদ্ভুত পোষাকটা সামান্য প্যারা দিচ্ছ। এমনিতেই সালোয়ার কামিজ ও শাড়ি পরে অভ্যস্ত গুলিস্তা। বিয়ের পর বরাবর শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। মা, ভাবীদের থেকে এমনটাই শিখেছে সে৷ আজকেও বিকালে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যাচ্ছিলো তখন একটি নতুন শাড়ি আলমারি থেকে বের করেছে মাত্র। কোথা থেকে রেহবার এসে সেটি আবার আলমারিতে তুলে রেখে দিলো। হাতে একটি শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সেটি পরতে বললো। সেই পোষাক পরে গুলিস্তার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছে। চেঞ্জিং রুমের পা সমান লম্বা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া বাকি ছিলো মাত্র। এদিকে রেহবার একটু পর পর দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে।
– কই? হলো তোমার? আরেহ আর কতোক্ষণ লাগবে! তাড়াতাড়ি বের হও। আমাকেও তো রেডি হতে হবে নাকি!

বাধ্য হয়ে চেঞ্জিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে রেহবারের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু করছিলো। কিন্তু রেহবার ওর দিকে তাকালো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে।

– গায়ে ঠিকঠাক হয়েছে দেখছি! আমি তো ভাবছিলাম বড় সাইজ নিয়ে ফেললাম কিনা! ওমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও।

ঢিলেঢালা একটা প্যান্ট এর সাথে লম্বা শার্ট পরে গুলিস্তার প্রাণ যায় যায় দশা। আর সে কিনা সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তবুও রেহবারের আদেশে একটুখানি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকালো। সেখানে বরাবরের মতোই মুগ্ধতা। হালকা হাসি বিনিময় করে চেঞ্জিং রুমে চলে গেলো। গুলিস্তাকে দিয়ে গেলো আত্মবিশ্বাসী হওয়ার একটুখানি মন্ত্রণা।

জানালার পাশের সীটে বসে নিজের গায়ের অদ্ভুত পোষাকটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে গুলিস্তা। ফুল স্লিভস শার্ট পুরো শরীর ঢেকে রেখেছে। ঢিলেঢালা আরামদায়ক কাপড় হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তবুও গড়পড়তা বাঙালি মন। বসে থাকার কারনে শার্টটি হাঁটুর নিচে উঠে এসেছে। সেটি বারবার টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেটি খেয়াল করে রেহবার ওর হাত দুটো নিজের দিকে টেনে নিলো।
– এমন উসখুস না করে শান্ত হয়ে বসো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে৷ প্রচুর এনার্জি দরকার হবে। যেকোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে। একদম মনের মধ্যে চেপে রাখবে না।

দুবাই এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছালো তখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট। ঘুমে গুলিস্তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। ওদের পরবর্তী ফ্লাইটের তখনো তিন ঘন্টা সময় বাকি। গুলিস্তাকে চেয়ারে বসিয়ে রেহবার ছুটে গেলো খাবার আনতে। এদিকে ব্যস্ত এয়ারপোর্টে এতো রাতেও মানুষজন গিজগিজ করছে। হঠাৎ গুলিস্তার পাশের চেয়ারে একজন পুরুষ এসে বসলো। কেতারদুস্ত ভদ্র লোক। পাশে বসেই মুখে হাসি টেনে অভ্যর্থনা জানালো,
– হাই।

এ কেমন ভদ্রলোক হলো! বসার আগে অনুমতি পর্যন্ত নিলো না। অপরিচিত পুরুষ মানুষের সান্নিধ্যে গুলিস্তার আত্মা কেঁপে উঠলো। আঁতকে উঠে নিজের আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে রেহবারকে খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। এদিকে সেই ভদ্রলোক পরে গেলেন দ্বিধায়। মেয়েটি কোনো সমস্যায় পরলো না তো আবার? তিনি নিজেও দাঁড়িয়ে পরে গুলিস্তার কাছে জানতে চাইলেন,
– কোনো সমস্যা? সমস্যা হলে বলতে পারো? তুমি একা এসেছো? কাউকে খুঁজছো?

একেরপর এক প্রশ্ন করেও ভদ্রলোক কোনো উত্তর পেলেন না। এদিকে নিজের সামনে ফটফট করে ইংরেজি বলা লোকটিকে গুলিস্তার সুবিধা মনে হচ্ছে না। দু হাত নাড়িয়ে কি যে বলছে সেই জানে! কথা বলতে বলতে একদম গুলিস্তার কাছে চলে এসেছে। ভয়ে গুলিস্তা দু পা পিছিয়ে গেলো। এখন কি সে উল্টোদিকে ফিরে একটা ভোঁ দৌড় দিবে? আগে এমন গায়ে পরা লোক দেখলে সে দৌড়ে বাড়ি চলে যেতো কিন্তু এখান তো দৌড়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র গন্তব্য রেহবার। যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের লাগেজ, ব্যাগপ্যাক ওখানে রেখেই গুলিস্তা সেখান থেকে দ্রুত পায়ে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু সে এক পা এগুলো সেই ভদ্রলোকও ওর পিছনে এক পা এগিয়ে যাচ্ছেন। অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছেন,
– আর ইউ ওকে? হোয়াটস রং উইথ ইউ? হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং? ইউ নিড এনি হেল্প?

গুলিস্তা জানে না সে কখন কান্না করতে শুরু করছে। শুধু জানে এই মুহুর্তে এই মানুষটির থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে হবে। সে পেছন না ফিরে আরও দ্রুত পা চালালো।

( চলবে..)

[এই বোকা মেয়ে এয়ারপোর্টে হারিয়ে গেলেও আমি অবাক হবো না। শুধু বেচারা রেহবারের জন্য খারাপ লাগবে। 🫣]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here