প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১২

0
288

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২

গটগট পায়ে তারাতাড়ি করে রুমে ঢুকতে গিয়ে তৌসিফের বুকের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো পৌষ। একদম নাক বরাবর গিয়ে লেগেছে তৌসিফে’র বুকে। ধাক্কাটাও কম জোরে লাগে নি। একদম যাহাকে বলে “জোরকা ঝাটকা হ্যা জোরোসে লাগা”। পৌষ পরতে পরতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। তৌসিফ অবশ্য ধরা বা ছুঁয়া’র সুযোগ পায় নি। সটান হয়ে একদম সিনা টান টান করে দাঁড়ালো পৌষ। গলায় একবার খক করে শব্দ করে পরিষ্কার করলো। ঘুম ভাঙা মুখ আর অসংলগ্ন পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে নাস্তানাবুদ পৌষ অথচ রাগীনির রাগ নাকের ডগায়। নাকের পাটা ফুলিয়ে অগ্রসর হলো তৌসিফে’র দিকে। সকাল সকাল উড়নচন্ডী বউয়ের এহেন হাবভাব দেখে তৌসিফ কিছুটা বিব্রত। ভাবা যায় তৌসিফ তালুকদার বিব্রত? পৌষ দাঁত খিটমিট করলো ঠিক টক খাওয়া দাঁত যেমন লাগে তেমন ভাবে। তৌসিফের একদম দুই ইঞ্জি দূরে থেকে ঘাড়টা উঁচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে,

— কিহ? কই যাওয়া হচ্ছে সক্কাল সক্কাল?

তৌসিফ যেন এই প্রথম অধিকার বোধ দেখতে পেলো তবে ও জানে পৌষ রাগে এসব জিজ্ঞেস করছে। সকালে মিনু’র ব্যাপার টা নিয়ে এখনও খচমচ করছে ও। তৌসিফ বেশ শান্ত স্বরে বললো,

— সোহা এসেছে….

বাকিটা বলার আগেই পেছনে সোহা হাজির হলো। হাসি মুখে “কেমন আছেন” জিজ্ঞেস করে রুমে ঢুকতে নিতেই পৌষ দরজা অর্ধেক ভিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মেকি হেসে বললো,

— সরি, আসলে আমাদের রুমে প্রাইভেসির ব্যাপার স্যাপার আছে। আপনি যেতে পারেন এখন। সকাল সকাল আমি রোম্যান্টিক মুডে আছে। বাই।

বলেই ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকাল দুজন। সোহা’র মনে হলো ওর মুখটাতে কেউ বুঝি ঝামা ঘঁষে দিলো। এদিকে তৌসিফ হতভম্ব ভাব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পৌষ’র মতো একটা দূরন্দার মেয়ে ঠিক কতটা রাগ থেকে এসব কথা বলে? অবশ্য বলাটাও স্বাভাবিক। হঠাৎ ই তৌসিফে’র মাথায় দুষ্টামি চাপলো। পায়ে থাকা সেন্ডেলে চপ চপ আওয়াজ তুলে সামনে যেতে নিলেই তৌসিফ ওর হাতটা টেনে ধরলো। ছোঁ মে’রে হাত ছাড়িয়ে নিলো পৌষ। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,

— চুহ! চুহ! কষ্ট হচ্ছে সোহা ডার্লিং’কে আসতে দিলাম না দেখে?

— হোয়াট রাবিশ পৌষরাত?

— এএই খবরদার আমাকে রাবিশ বলবেন না। ঐ ছেড়ী রাবিশ! ওর বোন রাবিশ!

— পৌষরাত আস্তে কথা বলো। আমার সাথে একদম উঁচু গলা চলবে না। না জেনে না বুঝে কি শুরু করলে সকাল সকাল?

বেশ ঠান্ডা গলায় ই বললো তৌসিফ। একটু দমে গেলেও নিভলো না পৌষ। ঠিক রবি সিমের মতো জ্বলে উঠলো আপন শক্তিতে। পৌষ’র হঠাৎ মনে হলো গত মাসে তার ফোন থেকে গ্রামীন সিম তেইশ টাকা কেটে নিয়েছে। কারণ নেই কোন। মানেই হুদাই। কল সেন্টারে কল দিয়ে উড়াধুড়া ঝেরেছে পৌষরাত। যদিও এতে করে কোন লাভ হয় নি তবে কথা হলো মনের শান্তি বড় শান্তি।
নিজের গভীর চিন্তায় ভাটা পরলো ওর যখন তৌসিফ বললো,

— ফ্রেশ হয়ে এসো। নাস্তা করবে। বেরুতে হবে একটু পর।

পৌষ আড় চোখে তাকিয়ে গটগট পায়ে চলে গেল। বাথরুমে ঢুকেই কিছুটা জোরেই বললো,

— আমি বুঝি না বড় লোক হয়েও মানুষের নজর কেন ছোট হয়। হলুদ বাত্তি কেন লাগাতে হবে? সাদা লাইটের কি আকাল পরলো?

তৌসিফ শুনেও কিছু বললো না। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বের হলো দরজা খুলে। না জানি কি অপেক্ষা করছে সামনে যদিও ততটা পরোয়া তৌসিফ করে না। ফোন হাতে নিয়ে রুম ছাড়তেই দেখলো সোফায় সোহা মাথা নিচু করে বসে আছে তার পাশে বসেই এটা ওটা বলছে মিনু।

— আপা মন খারাপ করো না। তাকাও না আপা। কথা বলো। আচ্ছা রুমে চলো। কিছু খাবে? নিয়ে আসি?

সোহা উত্তর করলো না। তৌসিফ টেবিল থেকে আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসালো। ওখানে থেকে একটু সামনে এসেই জিজ্ঞেস করলো,

— কেমন কাটলো ছুটি?

ব্যাস। তৌসিফে’র গলা শুনেই মাথা তুললো সোহা। টলমলে চোখে তাকালো ওর দিকে। তৌসিফের হাবভাব একদম স্বাভাবিক। পৌষ একটু আগে যে সোহা’কে সাবান ছাড়া ধুঁয়ে দিলো তা যেন তৌসিফ দেখতেই পায় নি। সোহা কান্না আটকে কোনমতে বললো,

— ভালো।

বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। মিনু আপাকে জড়িয়ে ধরলো। তৌসিফ উঠে যেতে যেতে বললো,

— ও ছোট মানুষ। এতসব বুঝে না। ভুলে যাও।

ফোনে কল আসতেই তৌসিফ ড্রয়িং রুম সংলগ্ন বড় বারান্দায় গেলো। সকাল সকাল আজ মিষ্টি রোদ উঠেছে।
.
মুখটা নরম তুলতুলে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বের হলো পৌষ। একই টাওয়াল দিয়ে হাত মুছে এক পা সোফায় তুলে মুছে একই ভাবে আরেক পা মুছলো। মুছামুছি শেষ হতেই ঢিল মে’রে ছুঁড়ে মা’রলো সোফায়। যেই না ঘুরে দাঁড়ালো ওমনিই তিনশত ষাট ডিগ্রী এঙ্গেলে ওর মাথা ঘুরে গেলো। পৌষ’র মনে হলো হিন্দি সিনেমার মিউজিক বাজছে ওর কানে, “ধুমতানা না না না”।
সোহা ওদের বেড গোছাচ্ছ। এই মেয়ে এতটা বেহায়া কিভাবে হলো? পরক্ষণেই ভাবলো যেই মেয়ে টাকার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে সেই মেয়ে বেহায়া নাহলে আর কে হবে? তৌসিফে’র মতো চরিত্র ঠিক না থাকা পুরুষের জন্য একদম উত্তম হলো এই কাজের মেয়ে।
পৌষ শুনেছে তৌসিফ যেখানেই যায় এই মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যায়। সেবার নাকি এই কাজের মেয়ে নিয়ে ও ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছে। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো পৌষ’র। কোন নরকে এসে পরলো ও?

নিজের সাথে হেরে যাওয়া মানুষ গুলো বিভিন্ন প্রকৃতির হয়। এরমধ্যে পৌষ হলো চঞ্চল প্রকৃতির। অতিরিক্ত কথা, চঞ্চলতায় নিজে ব্যাস্ত রাখে সবটা ভুলে থাকতে অথচ প্রতিটা জিনিস ওকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
সোফায় ফেলা টাওয়ালটা হাতে তুলে বিছানায় একদম সোহা’র হাতে ছুঁড়ে মা’রে ও। সোহা চমকে তাকাতেই পৌষ দাঁত বের করে হেসে বলে,

— আমাদের বেড গোছানোর প্রয়োজন নেই আপনার। অন্য কাজগুলো করবেন তাহলেই হলো। টাওয়ালটা ধুঁতে দিন। আর হ্যাঁ, বাথরুম রোজ ক্লিন করা হয় এটা। আজ নাহয় আপনি করে ফেলুন কাজ যেহেতু করবেনই।

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো সোহা’র। শ্যামলা চেহারায় সেটা স্পষ্ট। পৌষ পরখ করলো। নাহ্। কোন দিক দিয়ে যায় না৷ এই মেয়ের ফিনফিনে এক শরীর, একদম কাট কাট একটা মুখ। কোথায় রুপ? কোথায় লাবণ্য? পৌষ’র বুঝে আসলো না তৌসিফ নষ্টামি তো চাইলেই রুপবর্তী কারো সাথে করতে পারতো কিন্তু না ও করলো এত অতি সাধারণ চাসা মেয়ের সাথে। এর কারণ কি?
অতশত আর ভাবলো না পৌষ। সোহা তখনও ঠাই দাঁড়িয়ে। পৌষ এবার জোরেই বললো,

— কি হলো? যান এখন।

এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এলো সোহা। তৌসিফ ফোনে কথা বলছিলো কিন্তু সোহা গিয়ে দাঁড়ালো ঠিক ওর সামনে। টলমলে চোখ করে তাকিয়ে বললো মাত্র ওকে করা অপমানের কথা। আশ্চর্যের বিষয় তৌসিফ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু বললো,

— ওকে ওর মতো থাকতে দাও।

বলেই চলে গেলো। সোহা হা করে তাকিয়ে রইলো। ও কি কিছু করেছে ঐ মেয়ে’কে? উল্টো কথা কেন বললো তৌসিফ? রাগে গা রি রি করে উঠলো ওর। চোখ দিয়েই যেন ভস্ম করে দিবে পৌষ’কে।
.
তৌসিফ রুমে ঢুকেই দেখলো এলোমেলো রুম। পৌষ মাথা আঁচড়ে হিজাব বাঁধছে। তৌসিফ ফোনটা ড্রেসিং টেবিলে রেখেই বললো,

— অন্য কাউকে ডাকতে রুম গোছাতে।

— আপনার হাত নেই?

— মানে?

— বিছানায় দেখুন।

তৌসিফ দেখলো তবে বুঝলো না। পৌষ হিজাবের শেষ পিনটা লাগাতে লাগাতে বললো,

— আমার সাইড আমি গুছিয়ে রেখেছি। আপনারটা আপনি গোছান।

তৌসিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

— কিহ্?

— কি না বলুন জ্বি।

— এত টাকা দিয়ে কাজের লোক রেখেছি কেন?

— আমি কি জানি? হয়তো খায়েশ মিটাতে।

তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। পৌষ একটু জোরেই বললো,

— এই রুমে যাতে কোন কাজের মেয়ে না আসে আমার শোয়া বোড গোছাতে। বেশি প্রয়োজন হলে নিজের রুমে ডেকে নিক….

তৌসিফ আচমকা হাতের তালু দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,

— চুপ থাকো একটু। আমি গুছাচ্ছি বেড।

নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিলো পৌষ। শয়তানি হাসি দিতে দিতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তৌসিফ বদলের মতো কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলো। এত এত টাকা মাস শেষে দেয়া হয় কাজের লোকদের এখন কি না নিজের কাজ নিজের করতে হবে?

রুমের বাইরে আসতেই তৌসিফ দেখলো পৌষ সোহেল নামের মধ্য বয়স্ক লোকটাকে বলছে,

— চাচা শুনুন, বেড রুমে যত ফকিন্নি ফকিন্নি লাইট আছে সব পাল্টে এনার্জি লাইট আনবেন। টাকার চিন্তা নেই। এত বড়লোক মানুষ এদের টাকা পয়াসা রাখার জায়গার শুধু অভাব। আপনিই বলুন এত টাকা দিয়ে কি হবে? কবরে নিবে? আরে বাবা কিপ্টামির লিমিট থাকা উচিত। এত টাকা থাকতে কেন চারশত চল্লিশ বোল্ডের হলুদ বাত্তি লাগাব?

পৌষ’র কথা শুনে তৌসিফের এবার মাথা ঘুরে উঠলো। ওর এই লাইটিং করাতে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে সেখানে পৌষ দেড়শত টাকার এনার্জি লাইটের সাথে এসবের তুলনা দেয়? তুলনা বললেও তো ভুল। এগুলো পাল্টে কি না সাদা লাইট লাগাবে? কাকে কি বুঝাবে ও? এই মেয়েকে তো সোজা বললে উল্টো বুঝে। সাদা বললে কালো বুঝে। শুধু বিয়ে বললে বাসর বুঝে না।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ বললো,

— খেতে বসো পৌষরাত। তোমাকে ভার্সিটি ড্রপ করে অফিসে যাব। নতুন সিপ মেন্ট এসেছে।

— যেই না ছাতা মাথা নাস্তা এসব আপনিই খান। ফালতু যত্তসব ফকিন্নিদের খাবার। বলি যে আটার দম কি এতই বেশি যে সকালে সাদা রুটি বানানো হয় না এখানে?

রাগে গজরাতে গজরাতে চলে গেল পৌষ। তৌসিফ ও উঠে দাঁড়ালো। সকাল দশটা বাজে। আজ নাহয় নাস্তাটা বউয়ের সাথে বাইরে হবে। তৌসিফ’কে উঠতে দেখেই ব্যস্ত হলো সোহা। তৌসিফ থামিয়ে দিয়ে বললো,

— এরপর থেকে নাস্তায় ঝামেলা হলে সবগুলোর চাকরি বাতিল করে দিব৷ টাকা দিয়ে কাজ করাই চারা দিয়ে না।

সোহা মাথা নামিয়ে রাখলো। ও ই রুটি বানাতে নিষেধ করেছিলো।

#চলবে…..

[ আচ্ছা পিহা তো অনেক ছোট। এটা কেন ভাবলেন ওর সাথে হেমন্তের জুটি দিব? ভাই-বোনের কি সুন্দর খুনশুটির সম্পর্ক হতে পারে না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here